অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র ঘোষ এদেশের আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের এক কিংবদন্তি তুল্য নাম। তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘সাধনা ঔষধালয়’-এর মাধ্যমে এ সুনাম অর্জন করেন। পৃথিবীতে যতদিন আয়ুর্বেদ শাস্ত্র থাকবে ততদিন এই চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্রের নাম। একজন মহান দেশপ্রেমিক, শিক্ষাব্রতী ও সমাজ সেবক হিসাবেও তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ। একাত্তর সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তবে দুঃখের বিষয় এই প্রজন্ম তো বটেই, এদেশের শিক্ষিতজনদের অনেকেই তাঁর সম্পর্কে কোনো কিছুই জানে না। তারচেয়েও দুর্ভাগ্য তাঁর রক্ত ও ঘামে গড়া প্রতিষ্ঠান সাধনা ঔষধালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারিরাও কিছু জানে না।
অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র ঘোষের জন্ম ১৮৮৭ সালে শরিয়তপুর জেলার গোসাইরহাট উপজেলার জলছত্র গ্রামে। তাঁর বাবার নাম পূর্ণচন্দ্র ঘোষ। শিশুকাল থোকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। গ্রামের বাড়িতেই তাঁর ছেলেবেলা কাটে। গ্রামের এক স্কুলেই তিনি তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করেন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি শিক্ষকদের নানা প্রশ্ন করতেন যার মূল কথা ছিল ‘এটা কেন হয়’। এই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিভঙ্গীই তাঁকে জীবনে সব সমস্যার উত্তর দিতে সহায়তা করেছে। ছেলের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ ও মেধা দেখে পূর্ণচন্দ্র ঘোষ তাঁকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। তখন পুরান ঢাকাই ছিল মূল শহর। সেখানে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা জুবিলি স্কুলে তিনি ভর্তি হন। ১৯০২ সালে মাত্র পনের বছর বয়সে যোগেশ চন্দ্র ঘোষ প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। তারপর ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। স্কুল ও কলেজ জীবনে তিনি স্বদেশিকতা ও জাতীয়তাবাদের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন। বিভিন্ন বিপ্লবী কর্মকান্ডের খোঁজ-খবর রাখতেন। তাঁর বন্ধুদের অনেকেই তখন বিপ্লবী দলের সাথে যুক্ত ছিল। কিন্তু তিনি সরাসরি এসবের সাথে জড়িত ছিলেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে স্বদেশ চিন্তা যে তাঁর ভিতরে গভীর প্রভাব ফেলেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যার প্রমাণ বিদেশি ঔষধের চেয়ে তিনি দেশীয় গাছ-গাছড়ার মাধ্যমে চিকিৎসাকে গুরুত্ব দিতেন।
যোগেশ চন্দ্র ঘোষ ১৯০৪ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে এফ.এ. পাশ করেন। তারপর চলে যান পশ্চিমবঙ্গে। সেখানে গিয়ে কুচবিহার কলেজে ভর্তি হন। ১৯০৬ সালে কুচবিহার কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন। এম.এ. ডিগ্রী অর্জনের জন্য ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে। সেখানে শিক্ষক হিসেবে পান প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে। ধীরে ধীরে তাঁর সাথে রায়ের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ই তাঁকে দেশজ সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে নিজের জ্ঞানকে কাজে লাগানোর জন্য ব্যাপক উৎসাহিত করেন। বলা যায়, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ই তাঁকে স্বদেশ প্রেমের বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়া হাতে-নাতে শিখিয়ে দেন। ১৯০৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পাশ করার পর তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য ইংল্যান্ড চলে যান। সেখান থেকে এফ. সি. এস. ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর তিনি আমেরিকায় যান এবং সেখান থেকে এম.সি.এস. ডিগ্রি লাভ করেন। পড়াশুনা শেষ করে ভাল চাকরি-বাকরি নিয়ে আমেরিকাতে বেশ স্বচ্ছন্দেই জীবন অতিবাহিত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে দেশে ফিরে আসেন। ১৯০৮ সালে দেশে ফিরেই যোগেশ চন্দ্র ঘোষ যোগ দেন ভাগলপুর কলেজে। সেখানে একটানা চার বছর রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে গৌরবের সাথে কাজ করেন। পরে চলে আসেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। ১৯১২ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত প্রায় চল্লিশ বছর তিনি জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতা করেন। সেখানে তিনি দীর্ঘদিন অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি তাঁর চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাজকেও একই গতিতে এগিয়ে নিয়ে যান। অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র ঘোষ কিশোর বয়স থেকেই দ্রব্যগুণ সম্পর্কে যে উৎসাহ লাভ করেছিলেন যৌবনে শিক্ষাগুরু বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অনুপ্রেরণায় তিনি এ বিষয়ের উপরই গবেষণা শুরু করেন। স্বদেশের মানুষকে রোগ থেকে স্বল্প মূল্যে মুক্তি দিতে তিনি দেশিয় গাছপালা থেকে ঔষধ তৈরির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে তিনি ১৯১৪ সালে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী গেন্ডারিয়ায় ৭১ দীননাথ সেন রোডে বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তোলেন ‘সাধনা ঔষধালয়’। অনেকের ধারণা তিনি নিজের স্ত্রীর নামে এই প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করেছিলেন। কিন্তু তা নয়। তিনি নিজের স্বপ্ন-সাধনা থেকে প্রতিষ্ঠানের এরূপ নামকরণ করেছিলেন। প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে এটি দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও সুনাম অর্জন করে। দেশ-বিদেশে বিভিন্ন স্থানে এর শাখা ছড়িয়ে পরে। তাঁর গবেষণা, অদম্য সাধনা ও কর্মোদ্যমের ফলে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা ও আয়ুর্বেদীয় ঔষধ প্রস্তুত প্রণালী আধুনিক মানে উন্নীত হয়। ডা. অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র ঘোষ নিজের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেশজ মানুষের সংযোগের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘ব্যক্তিগত কল্যাণের উর্ধ্বে উঠিয়া দেশের বৃহত্তম কল্যাণ কামনায় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করিলে সেই প্রতিষ্ঠান দেশেরও প্রিয় হয়। সিংহ যখন জাগে, তখন তাহার স্বপ্ন, তন্দ্রা এবং নিদ্রা যায় না, তাহার সিংহত্ব জাগে। জাতি যখন জাগে, তখন সকল দিক দিয়াই জাগে। একার চেষ্টাতে জাগে না, সকলের চেষ্টাতেই জাগে। সর্বপ্রকার পরিপুষ্টি লইয়া দেশ উন্নতির পথে অগ্রসর হউক, এই কামনা প্রতিদিনের কামনা। সুতরাং জনসাধারণ সাধনা ঔষধালয়কে তাঁহাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান বলিয়া গণ্য করিবেন না কেন?’
যতদূর শোনা যায়, অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র ঘোষ জগন্নাথ কলেজ থেকে অবসর গ্রহণের পর আয়ুর্বেদ ঔষধের উৎকর্ষ সাধন ও আয়ুর্বেদ ঔষধকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তুলতে নিজস্ব গবেষণাগারেই তিনি নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। শুধুমাত্র রোগী দেখা ছাড়া খুব একটা জনসমক্ষে আসতেন না। এই সময়ে তিনি রোগ ব্যাধির কারণ ও লক্ষণ, আয়ুর্বেদ চিকিৎসার অন্তর্নিহিত তত্ত্ব, আয়ুর্বেদ ঔষধের ব্যবহার পদ্ধতি ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-‘অগ্নিমন্দা ও কোষ্ঠবদ্ধতা’, ‘আরোগ্যের পথ’, ‘গৃহ চিকিৎসা, চর্ম ও সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি’, ‘চক্ষু কর্ণ নাসিকা ও মুখ রোগ চিকিৎসা’, ‘আয়ুর্বেদ ইতিহাস’, ‘টেক্সট বুক অব এনঅরগানিক কেমিস্ট্রি’, ‘সিম্পল জিওগ্রাফ’, ‘সিম্পল এরিথমেটিক’ ইত্যাদি।
১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলে এদেশের বহু হিন্দু পরিবার ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পদ ফেলে দেশ ত্যাগ করে ভারত চলে যায়। কিন্তু যোগেশ চন্দ্র ঘোষ তা করেননি। তিনি দেশের মায়ায় বাধা পড়ে এখানেই থেকে যান। বার বার তাঁর জীবনে নানা দুঃসময় এসেছে তবু কেউ তাঁকে নিজ দেশ ত্যাগে বাধ্য করতে পারেনি। তিনি ভালবাসতেন এদেশকে আর এদেশের মানুষকে। ১৯৬৪ সালে যখন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার শহর হিসেবে ঢাকার কুখ্যাতি ছড়িয়েছে তখনো নির্দ্বিধায় সব সঙ্কটকে মোকাবেলা করেছেন তিনি। সেই সময়ের একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আসিফ সিরাজ বলেন, ‘সেই দুর্যোগকালে আমরা তাঁর কাছে ছুটে যাই তাঁর সাহায্যের আশায়, তিনি আমাদের বিমুখ করেননি। তাঁর সাধনা ঔষধালয়ের বিরাট লৌহকপাট খুলে দেন। গেন্ডারিয়া, ধনিয়া ও শনির আখড়ার ভীতসন্ত্রস্ত হিন্দু পরিবার তাঁর কারখানায় নিশ্চিন্তে আশ্রয় পায়, বেঁচে যায়। দারোয়ানরা বন্দুক হাতে পাহাড়া দিত, আর আমরা ছেলেরা রাস্তায় লাঠি-হকিস্টিক নিয়ে এবং কারখানার ভেতরে হামলা হলে তিনি দারোয়ানদের গুলি চালানোর হুকুম দেওয়াতে রায়টকারিরা হামলা করার সাহস পায়নি। এখন ভাবি কারখানার নিরাপত্তা, লুটপাটের কথা ভেবে তিনি তো আমাদের ফিরিয়েও দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি, আর এখানেই তাঁর মহানুভবতা, মানবতাবোধ। তিনি মানুষকে ভালবাসতেন। এমন মানুষকেও মরে যেতে হয় হায়েনাদের হাতে।… গেন্ডারিয়ার এমন কোনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, ক্রীড়া সংগঠন নেই যারা তাঁর কাছ থেকে কমবেশি আর্থিক সহযোগিতা পায়নি।’
অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র ঘোষ ছিলেন সহজ সরল জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। তিনি ছিলেন সদালাপী। মানুষের সাথে অত্যন্ত সহজেই মিশতে পারতেন। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে নিজ পরিবারের সদস্যদের মতোই আপন করে নিতেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতেও তিনি মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। শেষে খুব বেশি একটা বাইরে বেরুতেন না। শুধু নিজের পড়াশুনা আর গবেষণা করতেন। সকাল-বিকেলে ঘরের সামনের খোলা ছাদে পায়চারি করতেন। প্রতিদিন ঘন্টাখানেকের জন্য নীচে নেমে আসতেন। রোগী দেখতেন। ব্যবস্থাপত্র দিতেন। অফিস ও কারখানার কাজকর্ম তদারকি করতেন। এবং ‘সাধনার বাঁদর’ বলে খ্যাত কুঠুরী মৃগয়াদের খাদ্য খাওয়াতেন। এই ছিল তাঁর দৈনিক রুটিন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী এদেশের নিরীহ বাঙালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু করে গণহত্যা। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে চলে এই গণহত্যা। সেসময় ঢাকা শহর ছেড়ে যেতে থাকে লোকজন। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে পাকবাহিনী ‘ভারতীয় দালাল’ বলে হত্যা করতে কসুর করত না। পাকবাহিনীর সহোদর রাজাকার-আলবদর-আলশামস-শান্তি কমিটির লোকজন হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িগুলোতে পরিকল্পনা করে হামলা চালাতে থাকে। এই অবস্থায় ঢাকা শহর ছেড়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ভারতে আশ্রয় নিতে থাকে। সাধনা ঔষধালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারিরাও একই পথ বেছে নেয়। অনেকে যোগেশ চন্দ্র ঘোষকে সে সময় ভারতে চলে যাওয়ার কথা বললেও তিনি তা শোনেননি। তিন রয়ে গেলেন। সাথে নির্জন বাড়িতে থাকল তাঁরই বিশ্বস্ত দুই দারোয়ান রামপাল ও সুরুজ। এরা দীর্ঘ ১৭ বছর অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র ঘোষের সাথে কাটিয়েছেন। সাথে থাকল বাড়ি আর কারখানা ভর্তি বানর।
প্রতিদিনের মতোই ৩ এপ্রিল রাতে কারখানার গেইট পাহাড়া দিচ্ছিল রামপাল, ইউসুফ মিস্ত্রি আর ডোমি সিং। রাত শেষে ৪ এপ্রিল ভোরের দিকে এক গাড়ি পাকিস্তানী হানাদার সাধনা ঔষধালয়ের গেইটের সামনে এসে দাঁড়ায়। ভিতরের দারোয়ানদের তারা গেইট খুলতে বলে। কিন্তু দারোয়ান গেইট না খুলে ভয়ে আত্মগোপন করে। পাকিস্তানী হানাদাররা প্রথমে কিছুক্ষণ গালাগালি ও চিৎকার করে। পরে বন্দুকের গুলিতে কারখানার গেইটের তালা ও শিকল ভেঙ্গে ফেলে। কিন্তু তখনই পাশ্ববর্তী মসজিদে ফজরের আযান শুরু হলে বর্বরের দল ভিতরে না ঢুকে এবারের মতো চলে যায়।
সকাল বেলা অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র ঘোষ নীচে এসে দারোয়ানদের কাছ থেকে সব শোনেন। ঠিক এসময়ই গেন্ডারিয়ার শান্তি কমিটির একজন ব্যক্তি আরো জনা চারেক পাকিস্তানী সেনাকে সাথে নিয়ে ভিতরে ঢোকে। প্রথমে যোগেশ চন্দ্র ঘোষ পাকিস্তানী একজন সেনার সাথে ইংরেজিতে কথা বলেন। পরে তাদের সাথে দু’তলার ঘরের দিকে চলে যান। দারোয়ানরা সবাই নীচে থাকে। কিছুক্ষণ পরেই গুলির আওয়াজ হয়। সেখান থেকে যোগেশ চন্দ্র ছাড়া আর সবাই বের হয়ে আসে। আসার সময় প্রত্যেকের হাতে ছিল দু’টি করে কাঠের পেটি। এগুলোতে ছিল মূল্যবান জাফরান, এলাচি, লবঙ্গ ইত্যাদি। মিনিট দশেকের মধ্যেই হায়েনার দল তাদের কাজ শেষ করে চলে যায়। হায়েনারা চলে যাবার পর নীচ থেকে দারোয়ানরা উপরে ওঠে দেখতে পায় পিঠের বাঁ দিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র ঘোষের নিথর দেহ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। পাঁজড়ে বেয়নেটের খোঁচা। তাজা রক্তে ভেসে গেছে ঘরের সিঁড়ি। দারোয়ানরা প্রাণভয়ে কারখানা ছেড়ে চলে গেল। সারা জীবনের শ্রম আর মেধা দিয়ে গড়ে তোলা অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র ঘোষের প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান মাত্র ৫/৬ ঘন্টার মধ্যে লুট হয়ে শ্মশাণে পরিণত হয়।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বধীন হবার পর তাঁর ছেলে ডা. নরেশ চন্দ্র ঘোষ আবার সাধনা ঔষধালয়কে দাঁড় করান। যোগেশ চন্দ্র ঘোষের স্ত্রীর নাম ছিল কিরণবালা ঘোষ। তাঁদের এক ছেলে ও দুই মেয়ে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র ঘোষের জন্ম ১৮৮৭ সালে শরিয়তপুর জেলার গোসাইরহাট উপজেলার জলছত্র গ্রামে।
পড়াশুনা: গ্রামের এক স্কুলেই তিনি তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করেন। ঐতিহ্যবাহী ঢাকা জুবিলি স্কুল থেকে ১৯০২ সালে মাত্র পনের বছর বয়সে যোগেশ চন্দ্র ঘোষ প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। তারপর ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে।
যোগেশ চন্দ্র ঘোষ ১৯০৪ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে এফ.এ. পাশ করেন। তারপর চলে যান পশ্চিমবঙ্গে। সেখানে গিয়ে কুচবিহার কলেজে ভর্তি হন। ১৯০৬ সালে কুচবিহার কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন। এম.এ. ডিগ্রী অর্জনের জন্য ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে। ১৯০৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পাশ করার পর তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য ইংল্যান্ড চলে যান। সেখান থেকে এফ. সি. এস. ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর তিনি আমেরিকায় যান এবং সেখান থেকে এম.সি.এস. ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবন: ১৯০৮ সালে দেশে ফিরেই যোগেশ চন্দ্র ঘোষ যোগ দেন ভাগলপুর কলেজে। সেখানে একটানা চার বছর রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে গৌরবের সাথে কাজ করেন। পরে চলে আসেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। ১৯১২ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত প্রায় চল্লিশ বছর তিনি জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতা করেন। সেখানে তিনি দীর্ঘদিন অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি তাঁর চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাজকেও একই গতিতে এগিয়ে নিয়ে যান এবং ১৯১৪ সালে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী গেন্ডারিয়ায় ৭১ দীননাথ সেন রোডে বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তোলেন ‘সাধনা ঔষধালয়’।
মৃত্যু: ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে নিহত হন।
তথ্যসূত্র: এই লেখাটি তৈরি করার জন্য সাধনা ঔষধালয়ের একজন পুরানো ভৃত্য, গেন্ডারিয়ার একজন প্রবীণ প্রতিবেশী এবং বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘স্মৃতি ১৯৭১’-এর দ্বাদশ খণ্ড, বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান, মমতাজ বেগম ও তপন কুমার দে সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের কথা’ বই ব্যবহার করা হয়েছে।
লেখক: চন্দন সাহা রায়