১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ বাঙালীর উপর। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল গণহত্যার অন্যতম প্রধান টার্গেট। রাশীদুল হাসান সেই সময় থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (সাবেক ইকবাল হল) পাশে শিক্ষকদের আবাসিক ভবনে। চারতলা ভবনটির চার তলায় থাকতেন রাশীদুল হাসান। পাশেই ছিল একটি বিশাল বস্তি। পাকবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণের সময় সেই বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। হতদরিদ্র বস্তিবাসীরা তখন জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিভিন্ন আবাসিক ভবনের ছাদে। রাশীদুল হাসান যে ভবনে থাকতেন সেই ছাদেও আসে অনেক মানুষ। পাকহানাদাররা এক পর্যায়ে সেটি টের পেয়ে যায়। তারা তখন সেখানে হানা দেয়। এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী ৩২ জন নিরীহ বস্তিবাসীকে নির্মমভাবে সেই ছাদে হত্যা করে। যাবার সময় তারা ভবনে বসবাসরত শিক্ষকদের ঘরেও হামলা চালায়। রাশীদুল হাসানের পরিবার তখন একটি রুমে ঢুকে খাটের নিচে লুকিয়ে ছিল। তিন বেড রুমের দু’টি রুমেই ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর করে হানাদাররা। কিন্তু কী ভেবে যেন তারা ওই একটি কামরাতেই হামলা করেনি। যদি হামলা করত তাহলে বলার অপেক্ষা রাখে না রাশীদুল হাসানের পরিবারের অবস্থাও হতো সেই বস্তিবাসীদের মতোই।
ভাগ্যক্রমে সেদিন রাতে বেঁচে গেলেও পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে তিনি শেষ রক্ষা পাননি। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর জল্লাদের দল এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় তাঁকে ধরে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে হত্যা করে।
রাশীদুল হাসানের জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বড়শিজা গ্রামে ১৯৩২ সালের ১ নভেম্বর। পিতা মৌলবি মোহাম্মদ আবু সাঈদ। তিনি ছিলেন শিক্ষক, মাদ্রাসায় পড়াতেন। মাতা খাদিজা বেগম ছিলেন গৃহিণী। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে রাশীদুল হাসান ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ।
বৃটিশ আমলে পশ্চিমবঙ্গে বিশেষত মুসলমান সমাজ ছিল শিক্ষা-দীক্ষায় অনেকটা পিছিয়ে। কিন্তু রাশীদুল হাসানের বাবা মৌলবি মোহাম্মদ আবু সাঈদ সেই গণ্ডি পেরিয়ে পরিবারটিকে শিক্ষার আলোয় নিয়ে আসেন। গ্রামে বসবাস করেও তিনি বাড়িতে এক বিশাল লাইব্রেরি গড়ে তোলেন। কলকাতা থেকে বিভিন্ন সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রিকা আনাতেন। পারিবারিক এই লাইব্রেরিতেই পরিবারের ছেলে-মেয়েদের অনেকটা সময় কাটত। সেখানে আসতেন এলাকার শিক্ষিত মানুষেরাও। এই লাইব্রেরিকে কেন্দ্র করেই রাশীদুল হাসানের ছেলেবেলার পাঠ-আগ্রহ গড়ে ওঠে। তাঁদের পরিবারটি ছিল সাংস্কৃতিক দিক থেকে খুবই অগ্রসর। মুসলিম পরিবারে সেসময় গান-বাজনা বা নাটকের ব্যাপারে যে ধরনের গোঁড়ামি ছিল মৌলবি মোহাম্মদ আবু সাঈদের পরিবার ছিল এ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। প্রসঙ্গত বড়শিজা গ্রাম ও শান্তি নিকেতন ছিল খুবই কাছাকাছি। মাঝখানে মাত্র একটি রেল স্টেশন। পরিবারের অনেক সদস্যই শান্তি নিকেতনে যাতায়াত করতেন। ফলে শান্তি নিকেতনের সাংস্কৃতিক আবহাওয়ার প্রভাব পরিবারটিতে ছিল বেশ ভালোভাবেই।
রাশীদুল হাসানের শিক্ষা জীবন শুরু হয় মুর্শিদাবাদ জেলার ঐতিহাসিক ভাবতা আজিজিয়া মাদ্রাসায়। সেখানেই তিনি প্রথম শ্রেণী থেকে হাই মাদ্রাসা পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি হাই মাদ্রাসা পাশ করেন। রাশীদুল হাসানের বড় ভাই তৈয়ব আলী ছিলেন পূর্ববঙ্গের ঢাকায় অবস্থিত বৃটিশ হাই কমিশনের ফাস্ট সেক্রেটারি। ফলে হাই মাদ্রাসা পাশ করার পর রাশীদুল বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে লেখাপড়ার জন্য ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি হন ঢাকার ইসলামিয়া ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। সেখান থেকেই ১৯৪৯ সালে আই.এ. পাশ করেন। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। ১৯৫২ সালে ইংরেজিতে বি.এ. (অনার্স) ডিগ্রি এবং ১৯৫৪ সালে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন।
রাশীদুল হাসান যখন ঢাকায় আসেন তখন পাকিস্তান জামানার সবে শুরু। কিন্তু সময়টা বাঙালী মুসলমানের আত্ম-প্রতিষ্ঠার যুগ-সন্ধিক্ষণও বটে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর খুব বেশি সময় লাগেনি যখন বাঙালী মুসলমানরা বুঝতে পারে যে, বৃটিশের গোলামির জিঞ্জির ছিন্ন করে তারা স্বাধীন পাকিস্তানের নাগরিক হয়েছে বটে। কিন্তু তারা নতুন করে শোষণের শিকারে পরিণত হয়েছে। আর সেই শোষণ চালাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় উর্দু-প্রেমিক সামরিক-বেসামরিক কর্তাব্যক্তিরা। ১৯৪৮-‘৫২ সাল ছিল ভাষা আন্দোলনের কাল। ভাষা আন্দোলনের সবকিছুই রাশীদুল হাসান প্রত্যক্ষ করেছেন নিজের চোখের সামনে। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময়ই ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় সমর্থকে পরিণত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরে যখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকেন তখন ভাষা আন্দোলনের কাজে বেশ ভালোভাবেই জড়িয়ে পড়েন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকাকালীন হল সংসদে সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
দেশ বিভাগের পর রাশীদুলের বড় ভাই চাকরি ছেড়ে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। পূর্ব পাকিস্তানে একা রয়ে গেলেন রাশীদুল। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক। অন্য অনেকের মতো দেশ বিভাগের সময় রাশীদুলের পরিবার দেশ ত্যাগ করেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করার পর পরই রাশীদুল হাসান শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি নরসিংদী কলেজে যোগদান করেন, সেখানে প্রায় এক বছর ছিলেন। পরে চলে যান পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। সেখানেও বছর তিনেকের মতো শিক্ষকতা করেন।
রাশীদুল হাসান ছাত্রাবস্থাতেই বিয়ে করেন বীরভূমের মেয়ে বেগম রোকাইয়া রশীদকে। রোকাইয়া ছিলেন পিতামাতার একমাত্র কন্যা। তিনি ভারতের নাগরিক। তিনি কিছুতেই ঢাকায় আসতে চাচ্ছিলেন না। ফলে ১৯৫৮ সালে রাশীদুল হাসান সিদ্ধান্ত নেন পশ্চিমবঙ্গে নিজের পরিবারের কাছে ফিরে যাবেন। এডওয়ার্ড কলেজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি চলে যান পশ্চিমবঙ্গে। সেখানে গিয়েও তিনি কৃষ্ণচন্দ্র কলেজে ইংরেজী বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি পাকিস্তানের পাসপোর্ট সারেন্ডার করে জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিকত্ব ফিরে পেতে আবেদন করেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত প্রায় আট বছর তিনি সেখানে চাকরি করেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার নানা অজুহাত দেখিয়ে শেষতক আর রাশীদুল হাসানকে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করেনি। অবশেষে রাশীদুল হাসান বাধ্য হয়েই ১৯৬৭ সালে ঢাকায় ফিরে আসার পরিকল্পনা করেন।
রাশীদুল হাসান যখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকতেন তখন হল প্রভোস্ট ছিলেন প্রফেসর এম এ গণি। ১৯৬৭ সালে প্রফেসর এম এ গণি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যাঞ্চেলর হন। তাঁর সঙ্গে প্রফেসর গণির সম্পর্ক ছিল খুবই আন্তরিক। ভারতে অবস্থানকালীন সময়ে নাগরিকত্ব বিষয়ক যে জটিলতা সৃষ্টি হয় তিনি তা প্রফেসর গণিকে অবহিত করেন। পরে প্রফেসর গণির সহযোগিতাতেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন ১৯৬৭ সালের ৪ অক্টোবর।
প্রথমে পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাশীদুল হাসান একা ঢাকায় আসেন। তার কিছুদিন পরই বড় ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে স্ত্রীও চলে আসেন। ১৯৭০ সালে রাশীদুল হাসান ইংরেজি বিভাগের সিনিয়র প্রভাষক পদে উন্নীত হন। এই সময়েই জন্মগ্রহণ করে তাঁর ছোট মেয়ে সুরাইয়া আমীনা স্মৃতি।
রাশীদুল হাসান বরাবরই ছিলেন রাজনীতি সচেতন মানুষ। গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সমর্থক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করার পরপরই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন সক্রিয়ভাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেই তিনি ছিলেন অপরিহার্য ব্যক্তি। ছাত্রছাত্রীদেরকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে উত্সাহিত করতেন নিয়মিতভাবে। ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তিনি ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে তিনি বন্ধুত্বের মতো বিবেচনা করতেন।
রাশীদুল হাসান যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন তখন সারাদেশেই পাকিস্তান বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন তুঙ্গে। স্বাধীনতার প্রশ্নে বাঙালী জাতি তখন একাট্টা। পাকিস্তানের রাজনীতিতে নানা পালাবদল ঘটে। কিন্তু কেউই বাঙালী জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের বিষয়ে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেননি। সব শাসকের চোখ থাকে শোষণের দিকে, বাঙালীকে অবহেলা-বঞ্চনা আর নির্যাতনের মাধ্যমে দাবিয়ে রাখতে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ব্যাপক বিজয় লাভের পর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে নানা টালবাহানা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালীকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেন। আর ওদিকে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরের বদলে গোপনে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিতে থাকে। ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সামরিক বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য ও অস্ত্র এনে এদেশের সেনানিবাসগুলো ভরে তোলেন। বাঙালীর অস্ত্র তখনো পর্যন্ত মনোবল। বড়জোড় ডামি রাইফেল আর বাঁশের তৈরি দেশীয় অস্ত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ, বুয়েট খেলার মাঠ প্রভৃতি স্থানে ছাত্ররা অস্ত্র চালানোর মহড়া দেয়। রাজপথে ডামি রাইফেল কাঁধে মিছিল হয়। ভুট্টো আর মুজিবের আলোচনাও দীর্ঘায়িত হতে থাকে কোনোরকম সাফল্য ছাড়াই। এরপর আসে সেই বীভত্স ২৫ মার্চের কালরাত্রি।
২৫ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের পরদিন রাশীদুল হাসানের পরিবার ক্যাম্পাস ছেড়ে রায়েরবাজারে এক আত্মীয়ের বাসায় চলে যায়। সেখানে আনোয়ার পাশার পরিবারও থাকত। আনোয়ার পাশা ও রাশীদুল হাসান ছিলেন বাল্যবন্ধু। দু’জনে ছিলেন হরিহর আত্মা।
প্রায় একমাস রায়ের বাজারে অবস্থান করার পর তিনি আবার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরে আসেন। এবার বাসা পরিবর্তন করেন। যথারীতি অন্য অনেকের মতো ক্লাসেও যেতেন। কিন্তু এই সময়েই তাঁর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগ গড়ে ওঠে। তিনি নানাভাবে ছাত্রদেরকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উদ্ধুদ্ধ করতেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন। তিনি যে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গোপনে কাজ করছেন সেটি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে গোপন থাকল না। স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনীর নজরেও এসে যায় তা। অবশেষে তাঁর এই কাজকর্মের জন্য ১৯৭১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তাঁকে পাক হানাদার বাহিনী ইংরেজি ডিপার্টমেন্ট থেকে গ্রেফতার করে এবং তাঁকে কারারুদ্ধ করে রাখে। তাঁর স্ত্রী রোকাইয়া রশীদ তখন দিশেহারার মতো স্বামীর বন্ধুদের কাছে সহায়তার জন্য ছুটে বেড়ান। বারবার উপাচার্যের বাসায় যান। তখন উপাচার্য ছিলেন সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন। একদিন তিনি ধমকের সুরেই রোকাইয়া রশীদকে বললেন, ‘তুমি এত অস্থির হয়ে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছ কেন? ওরা কয়েক সপ্তাহ রেখেই ছেড়ে দেবে। রশীদের একটু শিক্ষা হওয়া দরকার। ক্লাশে ছাত্রদের দেশ ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নানা কথা বলে উত্তেজিত করে। এ খবর আমার কানে এসেছে। তুমি ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি যাও।’
সে সময় প্রায় ১২ দিন পাকবাহিনী রাশীদুল হাসানকে বন্দি করে রাখে। বন্দি দশা থেকে বেরিয়ে আসার পর রাশীদুল হাসান একবারেই নিশ্চুপ হয়ে যান। সবসময় কী যেন চিন্তা করতেন। খুব বেশি একটা ঘরের বাইরেও যেতেন না। তবে পরিবারের সদস্যদের সাথে তিনি দৃঢ়ভাবেই বলতেন যে, এদেশ স্বাধীন হবেই।
ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই যুদ্ধের মোড় ঘুরতে শুরু করে। একদিকে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গেরিলা বাহিনী উপর্যুপরি হামলা চালিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর মনোবল ভেঙে দিচ্ছিল, অন্যদিকে মিত্রবাহিনীও বিভিন্ন স্থানে জয়লাভ করছিল। এমন পরিস্থিতিতে ক্রমাগতই পিছন হটতে থাকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। কিন্তু যুদ্ধের শেষ দিকে এসে তারা মরণ কামড় বসায় এদেশের বুদ্ধিজীবীদের উপর।
জগন্নাথ হলের পাশে রাশীদুল হাসান আর আনোয়ার পাশা সে সময় থাকতেন পাশাপাশি ভবনে। তিনি থাকতেন চারতলা ভবনের তিন তলায়। এই এলাকাটিতেই তখন পাকিস্তানের দালাল শিক্ষকরা থাকতেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের হত্যার ক্ষেত্রে এদের বড় ভূমিকা ছিল বলে অনেকে মনে করেন। সারাদিন রাশীদুল হাসানের পরিবার নিজের বাসাতে থাকলেও রাত্রে চলে আসত আনোয়ার পাশার বাসায়। সেখানেই সবাই একসাথে থাকতেন।
১৩ ডিসেম্বর রাত্রেও তাই হলো। ১৪ ডিসেম্বরে সকাল বেলায় আনোয়ার পাশার স্ত্রী সবার জন্য খিচুরি রান্না করলেন। নাস্তা খেতে বসবেন এমন সময়ই ওই ভবনের নিচেই একটি কাদামাখা বাস এসে দাঁড়ায়। বাসটির কোনো নাম্বার প্লেট ছিল না। রাশীদুল হাসানের স্ত্রী রান্নাঘর থেকে বাসটি দেখতে পান। তিনি আনোয়ার পাশার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘বুবু এত সকালে এখানে বাস এল কী করে?’ আনোয়ার পাশার স্ত্রী বললেন, ‘এটা দালালদের পাড়া। আর্মিরাই হয়তো এসেছে তাদের লোকদের সঙ্গে কথা বলতে।’
কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই আনোয়ার পাশার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। আঁৎকে উঠলেন সবাই। রাশীদুল হাসান পায়জামা-পাঞ্জাবি ও শাল পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। আর আনোয়ার পাশার পরনে ছিল লুঙ্গি ও গায়ে ছিল জামা। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনেই আনোয়ার পাশা দরজা খুলে দিলেন। ছয়-সাতজন খাকি পোশাক পড়া ছাত্র ঘরে ঢুকে পড়ল। এরা প্রথমেই জিজ্ঞেস করে,’আনোয়ার পাশা স্যার কে?’ আনোয়ার পাশা বললেন, ‘আমিই আনোয়ার পাশা।’ পাশেই ছিলেন রাশীদুল হাসান, তাঁর পাশে ১২ বছরের বড় মেয়ে নীলি। রাশীদুল হাসান খাকি পোশাকে ছাত্রদের দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা কারা? কী জন্য এসেছ।’ এরা বলল, ‘তিনি আমাদের স্যার, আমরা তাঁকে একটি জরুরি কাজে নিতে এসেছি। আধ ঘন্টার মধ্যেই দিয়ে যাব।’ এদের মধ্যে একজনের হাতে ছিল একটি কাগজ। তার মধ্যে বিভিন্ন জনের নাম লেখা। তাদের একজন রাশীদুল হাসানকে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, আপনার নাম কী?’ রাশীদুল হাসান তাঁর নিজের নাম বললেন। সঙ্গে সঙ্গেই ওই লোকটি বলল, ‘স্যার, আপনিও আমাদের সঙ্গে চলেন।’
ওই কাগজটিতেই ছিল আসলে সমস্ত বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। আনোয়ার পাশার নামের পাশে তাঁর ঠিকানাও লেখা ছিল। কিন্তু রাশীদুল হাসানের নামের পাশে কোনো ঠিকানা লেখা ছিল না। কারণ যুদ্ধের নয় মাসে রাশীদুল হাসান তিনবার বাসা বদল করেন। ফলে ঘাতকরা সঠিকভাবে তাঁর ঠিকানাটি জানত না।
খুব বেশিক্ষণ দেরি না করেই ঘাতকরা রাশীদুল হাসান ও আনোয়ার পাশাকে নিচে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় রাশীদুল হাসানকে তাঁর গায়ের শাল দিয়ে এবং আনোয়ার পাশাকে তাঁর গায়ের জামা দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে। এই দৃশ্য দেখেই দুই পরিবারের সদস্যরা ডুকরে কাঁদতে শুরু করে। পরিবারের সদস্যরা কাদামাটি মাখা বাসটিতে আরো অনেককে চোখ বাঁধা অবস্থায় বসে থাকতে দেখেন।
১৪ ডিসেম্বরের পর রাশীদুল হাসান ও আনোয়ার পাশার পরিবার তাঁদেরকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা বের করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনো হদিসই করতে পারেননি তাঁরা। অবশেষে ২২ দিন পর গায়ের জামা-কাপড় দেখে রায়ের বাজার বুদ্ধিজীবীদের হত্যাস্থল থেকে তাঁদের চিহ্নিত করা হয়। মৃতদেহ দুটি এতই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে, পরিবারের সদস্যরাও তা দেখতে পারেননি। পরে এই দুই বুদ্ধিজীবীকে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে দাফন করা হয়।
রাশীদুল হাসানের মৃত্যুর পর পরিবারটি একেবারেই অসহায় হয়ে পড়ে। তিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁর অনুপস্থিতিতে পরিবারটিকে মোকাবেলা করতে হয় নানাবিধ সমস্যা। রাশীদুল হাসানের নিকট-আত্মীয় কেউই এদেশে ছিল না। স্বাধীনতার পর ভারত থেকে তাঁর ভাইয়েরা আসেন পরিবারের সবাইকে সেখানে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু রাশীদুল হাসানের স্ত্রী ভারতে যেতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী এদেশের জন্য জীবন দিয়েছে। এটিই তাঁর দেশ। তাঁর সন্তানেরা এই দেশেই বসবাস করবে।’ নিজে খুব বেশি পড়াশুনা করেননি তবে তিনি ছিলেন খুবই রুচিশীল ও সহিষ্ণু মহিলা। স্বামীকে হারিয়েও পরিবারের তিন সন্তানকে তাঁদের বাবার আদর্শেই বড় করে তুলেছেন। সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে একজন সার্থক মা হিসাবে সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষায় মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য উত্সাহ যুগিয়েছেন। তাঁর এই বিপদসঙ্কুল যাত্রাপথে সে সময় পাশে দাঁড়িয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তারা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসাবে রাশীদুল হাসানের পরিবারকে একটি বাসস্থান ও সামান্য মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করে দেয়। এটুকুকে সম্বল করেই রাশীদুল হাসানের সন্তানেরা সমাজে আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
রাশিদুল হাসানের এক ছেলে ও দুই মেয়ে। সবার বড় ছেলে মাহমুদ হাসান। তিনি বুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছেন। দ্বিতীয় মেয়ে রোকাইয়া হাসিনা নীলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি করেছেন। ছোটবেলা থেকেই বাবার উত্সাহে গান শিখতেন ছায়ানটে। এখন রবীন্দ্রনাথের গানই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। রেডিও টিভির একজন প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী। দেশের বাইরেও গান করেছেন প্রচুর। সবার ছোট মেয়ে সুরাইয়া আমীনা স্মৃতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে পাশ করেছেন।
রাশীদুল হাসান দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন এদেশ একদিন স্বাধীন হবেই। এদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু তিনি স্বাধীন দেশের বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র দুদিন আগে তাঁকে এদেশ থেকে চলে যেতে হয়েছে চিরদিনের জন্য। দেশীয় রাজাকার-আলবদরদের কূট-কৌশলের কারণে তিনি সেদিন এদেশ থেকে চিরবিদায় নিলেও তিনি বেঁচে আছেন এদেশের কোটি মানুষের মাঝে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
জন্ম: রাশীদুল হাসানের জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বড়শিজা গ্রামে ১৯৩২ সালের ১ নভেম্বর। পিতা মৌলবি মোহাম্মদ আবু সাঈদ। মাতা খাদিজা বেগম। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে রাশীদুল হাসান ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ।
শিক্ষা: রাশীদুল হাসানের শিক্ষা জীবন শুরু হয় মুর্শিদাবাদ জেলার ঐতিহাসিক ভাবতা আজিজিয়া মাদ্রাসায়। ১৯৪৭ সালে তিনি হাই মাদ্রাসা পাশ করেন। ঢাকার ইসলামিয়া ইন্টারমিডিয়েট কলেজে থেকে ১৯৪৯ সালে আইএ পাশ করেন। উচ্চশিক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগ থেকে ১৯৫২ সালে ইংরেজীতে বি.এ. (অনার্স) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন।
শিক্ষকতা: ১৯৫৪ সালে তিনি নরসিংদী কলেজে যোগদান করেন, সেখানে প্রায় এক বছর ছিলেন। পরে চলে যান পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। সেখানেও বছর তিনেকের মতো শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণচন্দ্র কলেজের ইংরেজী বিভাগে যোগ দেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৭০ সালে সিনিয়র লেকচারার পদে উন্নীত হন।
পরিবার: স্ত্রী বেগম রোকাইয়া রশীদ। এক ছেলে মাহমুদ হাসান, দুই মেয়ে রোকাইয়া হাসিনা নীলি ও সুরাইয়া আমীনা।
মৃত্যু: ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকহানাদার বাহিনীর সহযোগী এদেশীয় দালালরা আনোয়ার পাশার বাসা থেকে রাশীদুল হাসানকে তুলে নিয়ে যায়। ২২ দিন পর তাঁর মৃতদেহ রায়ের বাজার অন্য বুদ্বিজীবীদের সাথে পাওয়া যায়।
তথ্যসূত্র: লেখাটি তৈরি করার জন্য শহীদ অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের বড় মেয়ে রোকাইয়া হাসিনা নীলির সাক্ষাত্কার নেয়া হয়েছে।
লেখক : চন্দন সাহা রায়