জীবন বোঝার আগেই আমি যুদ্ধ বুঝি, হৃদয় বোঝার আগেই আমি মৃত্যু বুঝি। আমি কেবল বাবা বুঝিনা। বাবা নামক একটি অন্তর্গত অস্তিত্ব শুধুই আমাকে ডাকে ‘আয়’ – কিন্তু আমি তাঁকে ছুঁতে পারিনা! আমি তাঁর কাছে দৌড়ে যেতে পারিনা!
আমার সমস্ত চেতনার রঙ, আমার সমস্ত অনুভূতির আবিলতা, আমার নিঃশব্দ স্বপ্নালু আবেগ আমাকে কেবলি বুঝিয়ে দিয়ে যায় – ঐ যে তারার বাগান ভরা আকাশ – সেই আকাশের সবচে’ জ্যোতির্ময় তাঁরাটিই তোমার বাবা। আর আমি তাই খুব ছোট বয়স থেকে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে বাবাকে ডাকি। খুব মন খারাপ হলে বেদনার্ত আমি তারা নামক বাবাটির সাথে মনে মনে কথা বলি। ফাঁকা মাঠের ভেতর, খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে কেবলি ইচ্ছে হয় বাবা-বাবা বলে চিৎকার করে কাঁদি। সেই চিৎকারে যেন আমার বুকের ভেতরের নিরেট অন্ধকারে জমে থাকা চাপ-চাপ যন্ত্রণারা উঠে আসে।
আমাদের বাসার পাশেই সরকারী কলোনী। ছোটবেলায় বিকেলে কলোনীর মাঠে বন্ধুদের সাথে খেলতাম। তাদের বাবারা প্রায়ই বিকেলে বেড়াতে বেরুবার সময় ছেলেমেয়েদের হাত ধরে সঙ্গে নিতেন আবার কখনো বা তারাই দৌড়ে গিয়ে আব্দার জুড়ত সঙ্গে যাবে বলে; আর আমি তখন পিছনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকতাম তাদের চলে যাবার দিকে। হঠাৎ কখনোবা কোনো সহৃদয় বাবা অন্য হাতে আমাকেও ধরতে চাইতেন। আমি বলতাম, ‘আপনারা যান, আমি বাসায় যাব।’
বাবার প্রতি প্রচন্ড অভিমানে বাসায় না ফিরে আমি একা একা সেই ছোট্ট মফস্বল শহরের অলিগলি ঘুরে বেড়াতাম। ফেরার পথে আমার সমস্ত অভিমানের ঝড় আমার অশ্রুসিক্ত কচি দুই গালে বেদনার লাল পাতা ফেলে দিয়ে বলে যেত – তোমার বাবা নাই! ওদের যে বাবা আছে তুমি ওদের নও। তুমি কখনোই ওদের মতো নও।
খুব ঝড় হলে, বৃষ্টি হলে দরজা জানালা বন্ধ করে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না আমার। মনে হয় – যদি বাবা এসে আমাদের ডেকে ডেকে ফিরে যান। ভেজা পাঞ্জাবী থেকে তাঁর টিপটিপ বৃষ্টির ফোটা ঝরছে আর দরজায় দাঁড়িয়ে কড়া নাড়তে নাড়তে ক্লান্ত বাবা যদি ফিরে যান!
ছেলেবেলায় স্কুল থেকে ফেরার পথে হঠাৎ কখনো মনে হতো – এখন বাসায় গিয়ে দেখবো, বাসা ভর্তি মানুষের ভীড়, তাদের হাজারো কৌতুহল এড়িয়ে অস্থির বাবা কেবলি বলছেন, ‘কোথায় – আমার ছেলেমেয়েরা কোথায়? কতদিন দেখিনা ওদের।’ বাবার হাতে লাল টুকটুকে পুতুল!
বাবাহীন আমার এই ২৫ বছরের প্রতিটি দিনই কোনো না কোনোভাবে আমাকে মনে করিয়ে দেয় বাবার উপস্থিতির মতোই বিশাল তাঁর অনুপস্থিতির শূন্যতা।
শুনেছি নিজের কবর নিজেকে দিয়ে তৈরী করিয়ে, হৃদয় আর শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করে পাকিস্তানী পশুরা আমার বাবাকে হত্যা করেছিল। হাতের আঙুল নিশপিশ করে আমার। মনে হয় বাবার মৃত্যুর সময় যদি তাঁর পাশে থাকতাম তবে ঐ রাজাকার আলবদর-নরপিশাচদের চামড়া ছিঁড়ে হাড়মাংসগুলো আলাদা করতাম বাবার রক্ত-বওয়া এই শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে। কিন্তু আজ এতো বছর পরেও যখন দেখি আমার হাত বাঁধা, আমার মুখ বাঁধা- আমার বাবার আত্মত্যাগের পলিতে গড়া এই দেশে একাত্তরের উল্লসিত নরপিশাচরা লাফিয়ে বেড়াচ্ছে, যাচ্ছেতাই বলছে- করছে, অনুষ্ঠানে ফিতে কাটছে তখন আমার অস্থির আঙুল আরো বেশি অস্থির হয়ে ওঠে।
মৃত্যুর পূর্বে পাকিস্তানী হায়নার দল মুক্তিযুদ্ধ এবং আওয়ামী লীগ থেকে বিচ্ছিন্নতার শর্তে যশোর ক্যান্টনমেন্টের বন্দীদশায় আমাদের বাবাকে বারবার মুক্তির লোভ দেখিয়েছিলো, প্রিয়তম স্ত্রী আর সন্তানদের সান্নিধ্য, নিরাপদ জীবনযাপনের স্বপ্নে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু দুঃখিনী দেশ আর মানবতার মুক্তিকামী বাবা আমাদের জীবন জীবন বলে কেঁদেও সেদিন মৃত্যুকেই গ্রহণ করেছিলেন।
যে রাজাকারদের কাছে মাথা নত না করার অপরাধে ওরা আমার বাবাকে হায়নাদের হাতে তুলে দিয়েছিল, সেই তারাই পরাজয়ের প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ে পুড়ে দীর্ঘ পাঁচ বছর পরেও তাদের পুনরুত্থানের চিহ্ন এঁকে দিতে চাইল আমাদের অগ্নিদগ্ধ শরীরে!
আমার বাবা শেখ আবদুস সালাম ১৯৪০ সালে যশোর জেলার কালিয়া থানার (বর্তমানে নড়াইল জেলার অধীন) বিলবাওচ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
খুব ছোট বয়স থেকেই মানুষের দুঃখ কষ্ট তাঁকে প্রবলভাবে অলোড়িত করত, যার ফলে স্কুল জীবন থেকেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কথিত আছে খুব ছোট বয়স এবং শরীরের কারণে তাকে টেবিলের উপর উঠিয়ে দেয়া হত বক্তৃতা দেবার সুবিধার জন্য। তাঁর মেধাবী গঠনমূলক আবেগী বক্তব্যে সবসময়েই মানুষ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েছে।
মানুষকে বড় ভালোবাসতেন তিনি। মানবিক মূল্যবোধ তাঁকে সবসময় আচ্ছন্ন করে রাখত। তাই নিপিড়ীত মানুষের পাশে তাঁকে সবসময়ই দেখা যেত। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাঁকে কয়েকবার জেল খাটতে হয়েছে।
তাঁর অনুন্নত জন্মস্থানের ভগ্নদশার কথা বিবেচনা করে তিনি ১৯৬০ সালে কৃতিত্বের সাথে বি.এ. পাশ করা সত্বেও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ সাময়িক স্থগিত রাখেন।
এই সময় তিনি বেশ কয়েকটি অসম্পূর্ণ স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে স্কুলগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাছাড়া অনুন্নত পরিবেশ ও রাস্তাঘাটের সংস্কার সাধন ছাড়াও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে তিনি প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্সে ভর্তি হন। এর মাঝে তিনি ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে বি.এড. সার্টিফিকেটসহ শিক্ষা ব্যবস্থা, বিজ্ঞান এবং ইংরেজি ভাষা, শিক্ষা ও সাহিত্যের উপর কয়েকটি ডিপ্লোমা করে প্রত্যেকটিতেই কৃতিত্বের সাথে সার্টিফিকেট অর্জন করেন।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানসহ বিভিন্ন গণআন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭০ সালে তিনি এম.এ. প্রথম পর্ব পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
১৯৭১ সালে তিনি এম.এ. শেষ পর্ব পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন কিন্তু দেশের তীব্র গণআন্দোলনের কারণে পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। এই সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কালিয়া থানায় ফিরে গিয়ে আপামর জনসাধারণকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন।
তিনি প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে ফেলে ঐ এলাকার জনগণের উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দেন সেই ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাধারণ মুক্তিকামী জনগণ দলে দলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়।
তিনি ‘মুক্তিবাহিনী সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি কমিটি গঠন করেন। তিনি সেই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। সেই সময় তিনি কালিয়া থানা আওয়ামী লীগেরও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
তিনি কালিয়া মহাবিদ্যালয় (বর্তমানে শহীদ আবদুস সালাম মহাবিদ্যালয়) নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। যার অধ্যক্ষ হিসাবেও তিনি কর্মরত ছিলেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। মে মাসের প্রথম দিকে তিনি রাজাকার বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাকিস্তানি মিলিটারীদের হাতে ধরা পড়ে যশোর ক্যান্টনমেন্টে বন্দী হন। সেখানে বহু নির্যাতনের পর পাকিস্তানী মিলিটারীরা ১৩ মে আনুমানিক বেলা ১০টার দিকে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
সংগ্রহ : আমার বাবা – শেখ সালমা নার্গিস; স্মৃতি ১৯৭১, সপ্তম খন্ড; সম্পাদনা – রশীদ হায়দার, প্রকাশক : বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
লেখক : শেখ সালমা নার্গিস