“আমার মা সেলিনা পারভীন। শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। তাঁর হারিয়ে যাওয়ার কাহিনীটি আমার কাছ থেকে কোনোদিন হারিয়ে যাবে না। আমার মায়ের হারিয়ে যাওয়ার দিনটি আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ ও দুর্ভাগ্যজনক দিন।
সেদিন ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। দেশ স্বাধীন হতে আর মাত্র তিন দিন বাকি। কোনো কোনো অঞ্চল ইতিমধ্যে মুক্ত হয়ে গেছে। আমরা তখন ছিলাম সিদ্ধেশ্বরীতে, তত্কালীন ১১৫নং নিউ সার্কুলার রোডে। আমাদের বাসায় আমরা তিনজন মানুষ- আমি, মা আর আমাদের উজির মামা। সেদিন শীতের সকালে আমরা ছাদে ছিলাম। মা আমার গায়ে তেল মাখিয়ে দিয়েছেন। একটু পর তিনি আমাকে গোসল করতে নিয়ে যাবেন। আমি ছাদে খেলাধুলা করছি আর মা একটা চেয়ার টেনে কী যেন লিখছেন। শহরে তখন কারফিউ। রাস্তায় মিলিটারি। পাকিস্তানী বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য বিমান থেকে চিঠি ফেলা হচ্ছে।
হঠাত্ দূরে একটা গাড়ির আওয়াজ হলো। আমাদের বাসার উল্টো দিকে খান আতার বাসার সামনে E.P.R.TC-এর ফিয়াট মাইক্রোবাস ও লরি থামে। সেই বাসার প্রধান গেইট ভেঙে ভিতরে ঢুকে গেল কিছু লোক। আমরা তিনজন ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে দেয়ালের ফাঁক দিয়ে এই দৃশ্যটা দেখলাম।
কিছুক্ষণ পর মা আমাকে গোসল করানোর জন্য নিচে নিয়ে আসেন। গোসলের পর আমি আবার ছাদে চলে যাই। আর মা যান রান্না করতে। ছাদে আমার সঙ্গে উজির মামাও ছিলেন।
এরপর আবার গাড়ির শব্দ। এবার একটি গাড়ি এসে থামে আমাদের বাসার সামনে। ছাদে দাঁড়িয়ে দেয়ালের ফাঁক দিয়ে আমরা দেখি কয়েকজন লোক আমাদের বাসায় ঢুকছে। তাদের সবাই একই রঙের পোশাক পরা ও মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা। এরা বাসার প্রধান লোহার কলাপসিবল দরজার কড়া নাড়ছে। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের এক ভদ্রলোক বের হয়ে কলাপসিবল গেইট খুলে দেয়। গাড়িতে করে আসা লোকগুলো ভদ্রলোকের কাছে সেলিনা পারভীনের পরিচয় জানতে চায়। ভদ্রলোক আমাদের ফ্ল্যাটটি দেখিয়ে দেন। ভদ্রলোককে ঘরে চলে যেতে বলে লোকগুলো আমাদের ফ্ল্যাটে এসে কড়া নাড়ে। মা দরজা খুলে দেন। লোকগুলো মার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় এবং বাসায় কে কে থাকে তাও জেনে নেয়। এ সময় মার সাথে লোকগুলোর বেশ কিছু কথা হয়। আমি আর উজির মামা ততক্ষণে সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়েছি। আমরা উঁকি দিলে ওরা দেখে ফেলে। আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে। আমি ও উজির মামা ভয় পাই। মা আমাদের ডেকে নিয়ে লোকগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি মার কাছে চলে আসি। এরপর মাকে তাদের সাথে যেতে বলে লোকগুলো।
মা লোকগুলোকে বলেন, ‘বাইরে তো কারফিউ। এখন যাব কীভাবে?’ লোকগুলো বলে, ‘আমাদের সাথে গাড়ি আছে। তাছাড়া আমাদের সাথে কারফিউ পাশও আছে। কোনো সমস্যা হবে না।’ ওরা নাছোড়বান্দা, আম্মাকে নিয়ে যাবেই। মা তখন বলেন, ‘ঠিক আছে। আপনারা অপেক্ষা করুন। আমি শাড়ি বদল করে আসি।’ ওরা বাধা দেয়। বলে, ‘দরকার নেই। গাড়িতে করে যাবেন আবার গাড়িতে করেই ফিরে আসবেন।’ আমিও তখন মার সাথে যেতে চাই। কিন্তু লোকগুলো আমাকে ধমক দিয়ে বলে, ‘বাচ্চা লোক নেহি জায়েগা।’ উজির মামা কিছু বলতে চাইলে তাঁকেও বলে, ‘বাড়াবাড়ি করবেন না।’
আমি তখন মার খুব কাছে। তাঁর হাত ধরে আছি। মা আমার মাথায় হাত বুলান। তিনি আমাকে বলেন, ‘সুমন তুমি মামার সাথে খেয়ে নিও। আমি যাব আর চলে আসব।’ এই ছিল আমার জীবনে মার কাছ থেকে শোনা শেষ কথা।
ওরা আমাকে ও মামাকে ঘরের ভিতর চলে যেতে বলে। উজির মামার সাথে মা কথা বলার সুযোগ পেলেন না। মামা আমাকে ঘরের ভিতর নিয়ে এলেন। উজির মামা দরজায় দাঁড়িয়ে সব দেখছেন। আমি মাকে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে থাকি, অনেকটা ঝাপসাভাবে। মা রান্নার সময় কোমরে একটা গামছা ঝুলিয়ে রাখতেন ময়লা হাত মোছার জন্য। ওরা মার কোমর থেকে সেই গামছাটা নিয়ে নিল। তারপর চোখ বাঁধল। হাত পিছমোড়া করে বাঁধল। ওরা মাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। একটু পরে মামাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওরা বন্দুক নিয়ে কেন আসলো? মার কাছে কেউ তো এভাবে আসে না।’
১৩ ডিসেম্বর মাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর বাসায় ছিলাম আমি আর উজির মামা। মা আমাকে ছেড়ে কখনো কখনো কাজের তাগিদেই বাড়ির বাইরে ফেনী বা অন্য কোথাও যেতেন। ফলে আট বছর বয়সী আমার কাছে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি। মার এক-দু’দিনের অনুপস্থিতিতে আমি আগে থেকেই অভ্যস্ত ছিলাম। আমার শিশুমন ধরেই নিয়েছিল বরাবর মা যেমন আমার কাছে ফিরে আসেন এবারও তাই হবে। মা কেন আসেন না বা আমি মার কাছে যাব- এসব বায়না যখন ধরতাম তখন উজির মামা আমাকে নানা প্রবোধ দিতেন। আমি তাতেই সন্তুষ্ট থাকতাম।
১৪ তারিখ কেটে গেল। ১৫ তারিখ সারাদিন কেটে গেল। ১৫ তারিখ বিকালেই আমি আর উজির মামা সিদ্ধেশ্বরী থেকে উজির মামার বাংলামটরের (সাবেক পাকমটর) বাসায় চলে আসি। সেখানে গিয়ে আমি স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সাথে খেলাধুলায় মেতে যাই। পরদিন দেখি হাজার হাজার পাকিস্তানী আর্মি দুহাত ঊর্ধ্বে তুলে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ১৬ তারিখ সেখানেই থাকি। ১৭ ডিসেম্বর রাতে যাই সেজ মামার বাসায়। পরে আমি অন্যদের কাছ থেকে শুনেছি ১৮ ডিসেম্বর আমার মায়ের মৃতদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। ১৪ ডিসেম্বর আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো পাকিস্তানের দালাল আলবদর বাহিনীর ঘৃণিত নরপশুরা সেখানেই মাকে হত্যা করে। ১৮ ডিসেম্বরেই তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে সমাহিত করা হয়।
মা ছিল একটু শীত-কাতুরে। সবসময় পায়ে মোজা আর স্কার্ফ ব্যবহার করতেন। ১৩ ডিসেম্বর যেদিন বাড়ি থেকে মাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় সেদিনও তাঁর পরনে ছিল সাদা শাড়ি-ব্লাউজ, সাদা স্কার্ফ, পায়ে সাদা জুতা ও মোজা। ফলে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে তাঁকে অনেক শহীদের মধ্যেও আমার আত্মীয়রা সনাক্ত করতে পারলেন সহজেই।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে জানতে পারি, আমার মা আর বেঁচে নেই। আমি জানতে পারি, মা আর কখনোই আমার গায়ে তেল মেখে দেবেন না। আমার জন্য আর তিনি কোনোদিন চকলেট নিয়ে আসবেন না। আত্মীয়রা আমাকে বললেন, ‘আমার মা আল্লাহর কাছে চলে গেছেন’।”
সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের একমাত্র ছেলে সুমন জাহিদ এভাবেই তাঁর মায়ের অপহরণের করুণ কাহিনী শুনিয়ে আসছেন। কাঁপানো গলায় অসংখ্যবার তিনি এই নিষ্ঠুর কাহিনীটি স্বজন-বন্ধু-সভা-সমাবেশে বলেছেন। বছরের পর বছর ধরে একই শব্দমালা বলে চলেছেন তিনি। কাউকেই ফিরিয়ে দিতে পারেন না, যদি কেউ শুনতে চায় তাঁর মায়ের সেই অপহরণের করুণ কাহিনীটা। যেমন আজও শুনালেন তিনি।
সেলিনা পারভীনের জন্ম বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার ছোট কল্যাণনগর গ্রামে, ১৯৩১ সালের ৩১ মার্চ। এক বর্ধিষ্ণু পরিবারে। সেলিনা পারভীনের দাদা আর নানারা উভয়ই ছিলেন ছোটখাটো সামন্ত প্রভু। বাবা মৌলবি আবিদুর রহমান। মাতা মোছাম্মদ সাজেদা খাতুন। নয় ভাই-বোনের মধ্যে সেলিনা পারভীন ছিলেন তৃতীয়। সেলিনা পারভীনের পিতৃদত্ত নাম ছিল মনোয়ারা বেগম মনি। পরিবারের অনেকে তাঁকে ছুটু বলেও ডাকতেন। বাবার চাকরি সূত্রে ফেনী শহরেই শুরু হয় তাঁর ছেলেবেলা। বাবা মৌলবি আবিদুর রহমান ছিলেন ফেনীর গুরু (টিচার্স) ট্রেনিং স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ছাত্র জীবনে সেলিনা পারভীনের বাবা ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। সকলেরই শ্রদ্ধেয় ছিলেন তিনি। বিশেষ কৃতি ও ব্যক্তিত্বশালী শিক্ষাবিদের কন্যা হিসেবে সেলিনা পারভীন নিজের মতো বড় হবার জন্য অনুকূল প্রতিবেশ পেয়েছিলেন। তাঁর মা সাজেদা খাতুনও প্রথম জীবনে প্রায় ১২ বছর শিক্ষকতা করেছেন। তত্কালীন বাঙালী মুসলমান পরিবারের রক্ষণশীলতার যুগেও সেলিনা পারভীনের পরিবার ছিল অনেক দিক থেকেই উদার ও স্বাধীনচেতা। নিয়মিত সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় পরিবারের ছেয়েমেয়েদের প্রগতির প্রতি দুর্বার আকর্ষণ গড়ে ওঠে। সুযোগ পেলেই বাড়িতে বসত গানের আসর, ছেলেমেয়েরা মিলে মঞ্চস্থ করত পারিবারিক নাটক। পরিবারের বড়রা হতেন সেইসব আসরের শ্রোতা। আর এসবের মধ্যমনি ছিলেন সেলিনা পারভীন। যে কোনো গান একবার শুনলেই হুবহু গেয়ে ফেলতে পারতেন, দারুণ শখ ছিল ছবি আঁকার। উল দিয়ে বাঁশের চালুনির উপর কারুকাজ বা রং দিয়ে মাটির সরার উপর কারুকাজের হাতও ছিল দেখার মতো।
ফেনী সরলা বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াশুনা শুরু করেন সেলিনা পারভীন। কিন্তু ১৯৩৯ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ‘৪১-‘৪২-এর দিকে সে ধাক্কা এসে লাগে ফেনীতেও। ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে জাপানি আগ্রাসন শুরু হয়ে যায়। তখন ফেনীতে বিমান ক্ষেত্র তৈরি ও দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার কাজে ব্যাপকভাবে জমির রিকুইজিশন শুরু হয়। সেলিনা পারভীনদের পুকুরওয়ালা বিশাল বাড়িটিও দু’দফায় রিকুইজিশন হয়ে যায়। শহরে তখন থমথমে পরিস্থিতি। ফলে সেলিনা পারভীনদের পরিবার ফেনী শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়। আশ্রয় নেয় নোয়াখালীর গ্রামাঞ্চলে। সেখানেই দাদা-নানাদের আদি বাস। যুদ্ধের সময় পারিবারিক বিপর্যয় ঘটায় সেলিনা পারভীন এবং তাঁর ভাই-বোনদের লেখাপড়ায় ছেদ পড়ে।
এই যুদ্ধাবস্থার মধ্যে সেলিনা পারভীন কিন্তু নিজের মতোই ঘুরে বেড়াতেন সারা পাড়াময়। ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে গাছে চড়েন। দাদা আর নানা বাড়ির নারিকেল, আম, জাম, ঢেউয়া, বরই গাছে চড়া তাঁর জন্য ডাল-ভাত। কিন্তু সমাজ চোখ রাঙায়। পাড়ার মরুবি্বরা মুখ খোলেন। বদনাম রটে যায় গেছো মেয়ে বলে। তখন সেলিনা পারভীনের বয়স ১১-১২ বছর। সমাজের চোখে তাই তিনি বিবাহযোগ্যা। ফলে পরিবারের মুরুব্বি আর আত্মীয়-স্বজনেরা সেলিনার সহজ-সরল বাবার উপর চাপ সৃষ্টি করে মেয়েকে বিয়ে দেবার জন্য। সেলিনা জেদ ধরেন, কিছুতেই বিয়ে করবেন না। সামাজিক চাপ আরও প্রকট হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ আর যুদ্ধাবস্থার মধ্যেই সেলিনা পারভীনকে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিবাদ আর চিত্কার করেও তা ঠেকাতে পারেননি তিনি।
বিয়ের দু’বছর পর ১৯৪৫ সালে কলকাতা নিবাসী শিক্ষয়িত্রী উমাদির সংস্পর্শে আসেন সেলিনা পারভীন। উমাদির উত্সাহ সেলিনা পারভীনকে সাহিত্য সাধনায় আরো উত্সাহিত করে তোলে। সত্যিকার অর্থেই সেলিনার মধ্যে কবি ও সাহিত্যিক চেতনার উন্মেষ ঘটে এই সময়। তাঁর নিজের একটা জাবদা খাতা ছিল, সেটা লেখায় ভরে উঠতে শুরু করল দিন দিন। নিজেদের বাড়িতে মাওলানা নুর মোহাম্মদ আযমী নামে সেলিনার বাবার এক সাহিত্যিক বন্ধু আসতেন। তিনি ছিলেন কবি গোলাম মোস্তফারও বন্ধু। আযমী সাহেবই সেলিনার কবিতার খাতা নিয়ে যেতেন কবি গোলাম মোস্তফার কাছে। গোলাম মোস্তফা তাঁর কবিতার পাশে মন্তব্য লিখে দিতেন। পরে যখন ঢাকায় জোনাকী সিনেমা হলের গলিতে সেলিনা পারভীনরা থাকা শুরু করলেন তখন পড়শী হিসাবে পেয়ে যান কবি গোলাম মোস্তফাসহ শিল্পী জয়নুল আবেদীন, প্রফেসর মনসুর উদ্দীন প্রমুখদের মতো গুণী ব্যক্তিদেরকে। তাঁদের সাথে ঘনিষ্ঠতাও তৈরি হয়।
ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। সেলিনা পারভীন তাঁর বড় বোনের শ্বশুরবাড়ি কুমিল্লা থেকে একরকম প্রস্তুতিবিহীন অবস্থাতেই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলেন। কিন্তু উত্তীর্ণ হতে পারেননি। পাঠ্যবই অপেক্ষা অপাঠ্য বইয়ের প্রতিই সেলিনা পারভীন ছিলেন অধিক অনুরক্ত। অঙ্ক করে সময় নষ্ট করার চেয়ে চাঁদের আলো উপভোগ নয়ত কবিতা লেখাকেই গুরুত্ব দিতেন বেশি। মাধ্যমিক পাশ করতে না পারলেও দমে গেলেন না। সেলিনা পারভীন পড়বেন ও সাহিত্য সাধনা করবেন বলেই স্থির করলেন।
সামাজিক চাপে বিয়ের পিড়িতে বসলেও স্বাধীনচেতা সেলিনা পারভীন সে সংসার করেননি। ১৯৪৮ সালে বিবাহবিচ্ছেদ করেন তিনি। এজন্য সম্পর্ক-দূর সম্পর্ক থেকে অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু ভেঙে পড়েননি তিনি। এ অবস্থার মধ্যেই ফেনী শহরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুরু করেন ছাত্র পড়ানোর কাজ। কিন্তু তাঁর বাবা-মাকে প্রতিনিয়ত পাড়া-পড়শীদের বিভিন্ন সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। পাড়া-পড়শীদের বিভিন্ন সমালোচনা হতে বাবা-মাকে মুক্তি দিতে এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৯৫৬ সালে সেলিনা ঢাকায় চলে আসেন। ইতিমধ্যে তাঁর দুই ভাই চাকরি শুরু করেছেন এবং তাঁরা ঢাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। সেলিনা পারভীন তাঁর বাবা-মাকে নিয়ে সেখানেই উঠেন। ১৯৫৭ সালে মিডফোর্ডে (বর্তমান সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) নার্সিং পেশায় ভর্তি হন তিনি। কিন্তু কিছুদিন পর তা ছেড়ে দেন। তারপর ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে মেট্রনের চাকরি করেন। কিন্তু কোথাও স্থির হতে পারছিলেন না। ফলে চাকরি ছেড়ে আবার ফিরে যান ফেনীতে।
বাবা আবিদুর রহমান তখন মেয়ের সম্মতি নিয়েই পুনরায় তাঁকে বিয়ে দেয়ার কথা ভাবেন। মেয়েও সম্মতি দেন। ফেনীর ছাগলনাইয়ার এক সম্ভ্রান্ত বনেদি পরিবারের রাজনীতিক কর্মী মো. জাহাঙ্গীরের সাথে ১৯৬২ সালে সেলিনা পারভীনের বিয়ে হয়। সংসার করার বাসনা নিয়ে চলে যান চট্টগ্রামে। কিন্তু সেলিনার স্বামী ছিলেন এক অদ্ভুত মানুষ। সেলিনাকে একলা ফেলে হঠাত্ করেই উধাও হয়ে যেতেন তিনি। সেলিনার গর্ভে যখন সন্তান তখন তাঁকে সেই অবস্থায় একলা ফেলে উধাও হলেন তাঁর স্বামী। ১৯৬৩ সালের ৩১মে উপকূল জুড়ে যে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায় সেই রাত্রেই সেলিনা একা অসুস্থ অবস্থায় গিয়ে হাজির হন চট্টগ্রামের সরকারি হাসপাতালে। সেখানেই নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই সিজারিয়ানের মাধ্যমে প্রথম ছেলে সন্তানের মা হলেন তিনি। প্রসূতি হয়েও নিজেকেই সবকিছু সামলে নিতে হলো। বুঝলেন আসলে স্বামী-পুত্র নিয়ে সংসার করা তাঁর ভাগ্যে নেই। চট্টগ্রামের পাঠ চুকিয়ে আবার ফিরে এলেন ফেনীতে। মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সাথে বিবাহবিচ্ছেদ চূড়ান্ত হলো ১৯৬৬ সালে।
ফেনীর পারিবারিক পরিবেশে তখন সেলিনা পারভীন অনাহুত। ছেলে সুমন একটু বড় হলে তাঁকে নিয়ে আবার চলে এলেন ঢাকায়। শুধুমাত্র অসীম মনোবলকে সম্বল করে ক্ষীণ স্রোতস্বিনী ছুটে চললেন সমুদ্রাভিমুখে। এবার শুরু হলো তাঁর আসল জীবন সংগ্রাম। কঠোর পরিশ্রম করা শুরু করলেন নিজের ও সন্তানের জীবনকে সুন্দরভাবে সাজানোর জন্য।
১৯৬৫ সালে চাকরি নিলেন সলিমুল্লাহ এতিমখানায়। এরপর ১৯৬৬ সালে চাকরি নেন আজিমপুর বেবিহোমে। এসময় লালবাগে একটি এক রুমের বাসা নিয়ে থাকেন। ছেলেকে নিয়েই কর্মস্থলে যান। কিন্তু কর্মস্থলের পরিবেশ ও বাসস্থানের পরিবেশ কোনোটিই তাঁর পছন্দ নয়। পরে বেবিহোমের চাকরি ছেড়ে দেন। জীবনের এই চরমতম দুঃসময়েও কবিতা আর সাহিত্য তাঁকে গভীরভাবে টানতে লাগল। সাহিত্য পত্রিকাতে কাজ করবেন এটিই ছিল তখন তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। ১৯৬৬ সালেই সেলিনা পারভীন চাকরি নিলেন সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকায়, সম্পাদিকার সেক্রেটারী হিসাব। এখানে এসে ধীরে ধীরে সাংবাদিকতায় দক্ষ হতে শুরু করলেন তিনি। পরে ১৯৬৭ সালে চাকরি নিলেন মহিলাদের সাপ্তাহিক ‘ললনা’য়। এই সময়েই তাঁর লেখা কবিতা, নিবন্ধ ও প্রতিবেদন ‘পূর্বদেশ’, ‘আজাদ’, ‘দৈনিক পাকিস্তান’, ‘সংবাদ’, ‘বেগম’ ও ‘ইত্তেফাক’-এ প্রকাশিত হয়। কিন্তু কোনো লেখাই সংরক্ষণ করা হয়নি।
দেশে মহিলাদের পত্রিকা বলতে ‘বেগম’ তখন খুবই জনপ্রিয়। ‘বেগম’-এর একটি নিজস্ব ধারা তৈরি হয়ে গেছে। ‘ললনা’ তৈরি হলো আরো একটু আধুনিকতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। শুরু থেকেই এই পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শিল্পী রফিকুন নবী, শিল্পী হাশেম খান, বেবি মওদুদ, সাংবাদিক শাহাদাত চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির, মোহাম্মদ আখতার প্রমুখ। সেগুনবাগিচা থেকে বের হতো ‘ললনা’। ‘ললনা’-র সম্পাদিকা ছিলেন সোফাবেজা খানম।
সেলিনা পারভীন ‘ললনা’য় কাজ পান বিজ্ঞাপন বিভাগে। একাই সব সামলান। বিজ্ঞাপন সংগ্রহ, টাকা তোলা সব। পত্রিকা অফিস থেকে বেতন হিসাবে অনেক সময় তেমন কিছুই পেতেন না। ‘ললনা’য় কাজ করতে করতে ১৯৬৯ সালে বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ১৯৬৯ সালে বের করেন ‘শিলালিপি’ নামে একটি পত্রিকা। নিজেই এটি সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন। ‘শিলালিপি’ সেলিনার নিজের সন্তানের মতোই। দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত ‘শিলালিপি’ সকলেরই নজর কাড়ল। স্বাধীনতার পক্ষের পত্রিকা ‘শিলালিপি’। এই সুবাদে ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলে অনেকের সাথেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন তিনি।
তখন ১৯৬৯-এর রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ। জাতির ক্রান্তিকাল। নিজেও শরিক হন গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলন কর্মকাণ্ডে। ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই বেরিয়ে পড়তেন ‘৬৯-এর ২১ ফেব্রুয়ারি পল্টনের জনসভায় বা শহীদ মিনার থেকে বের হওয়া নারীদের মিছিলে যোগ দিতে। শরিক হতেন বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদে আর সভায়ও। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার প্রমুখদের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সমাজতন্ত্রের প্রতিও আস্থাশীল হয়ে পড়েন তিনি। এরই মধ্যে শুরু হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সেলিনা পারভীন ঢাকায় ছিলেন। তাঁর বাসায় মাঝে মাঝে রাত হলে কয়েকজন তরুণ আসতেন। খাওয়া-দাওয়া করে চলে যাওয়ার আগে এরা সেলিনা পারভীনের কাছ থেকে সংগৃহীত ঔষধ, কাপড় আর অর্থ নিয়ে যেতেন। ‘শিলালিপি’র বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়েই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের এই সহযোগিতা করতেন। এই তরুণদের সকলেই ছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা।
চারিদিকে তখন চলছে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ, প্রতিরোধ। চারপাশে শুধু বুলেটের শব্দ আর বারুদের গন্ধ, চিত্কার, গোঙানি, রক্তস্রোত আর মৃত্যু। এরই মাঝে ‘ললনা’ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ‘শিলালিপি’র উপরও নেমে আসে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর খড়গ। হাশেম খানের প্রচ্ছদ করা একটি ‘শিলালিপি’র প্রকাশিতব্য সংখ্যা নিষিদ্ধ করে দেয় পাকিস্তান সরকার। ‘শিলালিপি’ প্রকাশের অনুমতি মিলল তবে শর্ত হলো নতুনভাবে সাজাতে হবে। সেলিনা পারভীন বরাবরের মতো প্রচ্ছদ না নিয়ে তাঁর ভাইয়ের ছেলের ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ করে আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে ‘শিলালিপি’র সর্বশেষ সংখ্যা বের করেন। কিন্তু এর আগের সংখ্যার জন্যই সেলিনা পারভীন পাকিস্তানী ও তাদের দালালদের নজরে পড়ে যান। যেটাতে ছিল দেশ বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের লেখা এবং স্বাধীনতার পক্ষের লেখা। তাই কাল হলো। ‘শিলালিপি’র আরেকটি সংখ্যা বের করার আগে নিজেই হারিয়ে গেলেন।
দুঃখ, কষ্ট আর দারিদ্র্যের সংসারে নিভে যাওয়া প্রদীপকে ঘিরে যিনি জীবনে আশা আর স্বপ্নের আলো জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। অপমান, অত্যাচার আর জীবন যন্ত্রণা সইতে সইতে যিনি উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, জীবনযুদ্ধে একজন লড়াই করে যাওয়া একনিষ্ঠ সৈনিক হিসাবে-তিনিই সেলিনা পারভীন, শহীদ সাংবাদিক।
“-কিন্তু বড় ভালবাসি মানুষকে
আমাকে রেখে যেওনা চোরাবালিতে
-হে মানুষ
আমি তো মূর্খ”
(আবেদন, সেলিনা পারভীন)
সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি
জন্ম : সেলিনা পারভীনের জন্ম বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার ছোট কল্যাণনগর গ্রামে ১৯৩১ সালের ৩১ মার্চ। বাবা মৌলবি আবিদুর রহমান, মাতা মোসাম্মৎ সাজেদা খাতুন। শৈশবে পিতৃদত্ত নাম ছিল মনোয়ারা বেগম মনি। ১৯৫৪ সালে এফিডিয়েন্ট করে সেলিনা পারভীন নাম নেন।
শিক্ষাজীবন : ফেনী সরলা বালিকা বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ সালে ছাত্রজীবন বিঘ্নিত হয়। ফিরে যান গ্রামের বাড়ি ছোট কল্যাণনগরে। ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় (প্রাইভেট) অংশগ্রহণ। উত্তীর্ণ হতে পারেননি।
পরিবার : সম্ভবত ১৯৪৩ সালে তত্কালীন সামাজিক অবস্থার চাপে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে। স্বাধীনচেতা সেলিনা পারভীন সে সংসার করেননি। ১৯৪৮-এ বিবাহবিচ্ছেদ। পরে ১৯৬২ সালে বিবাহ হয় ফেনীর ছাগলনাইয়া নিবাসী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর-এর সঙ্গে। একমাত্র পুত্র সুমন জাহিদের জন্ম ১৯৬৩ সালের ৩১ মে। বিবাহবিচ্ছেদ ১৯৬৬ সালে।
কর্মজীবন : ফেনীতে ছাত্র পড়িয়ে কর্মজীবন শুরু। ১৯৫৬ সালে ঢাকায় আসেন। ১৯৫৭ সালে মিডফোর্ড (বর্তমানে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) হাসপাতালে নার্সিং ট্রেনিং গ্রহণ। ১৯৫৯ সালে রোকেয়া হলে মেট্রনের চাকরি। ১৯৬৬ সালে আজিমপুর বেবিহোমে শিক্ষকতা। ১৯৬৬ সালে ‘সাপ্তাহিক বেগম’ পত্রিকায় সম্পাদিকার সহকারী হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৭ সাল থেকে আমৃত্যু ‘সাপ্তাহিক ললনা’য় কাজ করেন।
পত্রিকা সম্পাদনা : ‘শিলালিপি’ ১৯৬৯ সাল। পত্রিকাটির প্রকাশনা ও সম্পাদনার দায়িত্ব একাই পালন করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পত্রিকাটির প্রচ্ছদ ও অন্যান্য রচনা পাকসেনা প্রধানের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
শখ : ছবি আঁকা, সংগীত চর্চা, ব্লক তৈয়ারি এবং ডিজাইনের কাজেও পারদর্শী ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় গেরিলা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয় সহায়তা দান। মৃত্যুর সাথে সাথে তাঁর জীবনের কর্মকান্ডের প্রায় সমস্ত তথ্যই হারিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যা শত্রুর জন্য ক্ষতিকর হয়েছিল।
মৃত্যু : একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনীর লোকেরা তাঁর সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বর অন্যান্য দেশ বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের সাথে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৮ ডিসেম্বর শহীদ সেলিনা পারভীনের দাফন হয় আজিমপুর নতুন গোরস্থানে।
তথ্যসূত্র: ১. শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীন স্মারকগ্রন্থ (দ্বিতীয় সংস্করণ)।
২. সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদের সাক্ষাত্কার।
লেখক : চন্দন সাহা রায়