১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল বেলা। ঘড়িতে ৯টা কি সাড়ে ৯টা বাজে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ৩১ নম্বর ঈশা খাঁ রোডস্থ বাড়িতে চরম দুরবস্থার মধ্যেও সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য পরম নিশ্চিন্তে শান্তির সাধনায় মগ্ন অর্চনার মাঝে। পরনে সাদা ধবধবে ধুতি। সন্ধ্যা, চণ্ডীপাঠ শেষ করেছেন কেবল। টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে। কিন্তু পূজামণ্ডপ ছেড়ে এখনও খেতে আসেননি তিনি। এমন সময় হঠাত্ ক্রিং ক্রিং শব্দে সদর দরজার বেলটা সজোরে বেজে উঠল। বেল বাজছে অবিরাম, পর পর গেটের দরজায় কড়া বুটের আঘাত। উপরের তলার দরজায়ও পড়ল এমনি কষাঘাত। ঘরের সবাই শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। দ্বিধাগ্রস্ত শঙ্কিতচিত্তে সন্তোষচন্দ্রের স্ত্রী রুদ্ধ দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন, বুটের সজোর আঘাতে ততক্ষণে উপরের তলার দরজাটা ভেঙে গেল। সন্তোষচন্দ্রের স্ত্রী আরও শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। দরজা খোলার জন্য হাত বাড়াতেই স্মরণ হলো স্বামীর কথা। ছুটে গেলেন পূজামণ্ডপে। দেখলেন সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য তখনও ধ্যানমগ্ন। কন্যা ও স্ত্রীর ডাকাডাকিতে একসময় তিনি উঠে দাঁড়ালেন। দরজা খুলতে উদ্যত হলেন। কিন্তু কন্যার কথায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কাপড় বদলাতে ঢুকলেন ঘরে।
এদিকে দরজার কড়া নড়েই চলেছে। তাঁর স্ত্রী দরজা খুললেন। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল ওরা ক’জন। আরও কয়েকজন দ্বারে রইল পাহারায়। ওদের হাতে উদ্যত রাইফেল। ওরা আলবদরের সদস্য। ঘরে ঢুকেই ওরা গৃহস্বামীর সন্ধান চাইল। অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য দৃঢ়তার সঙ্গে ওদের সামনে এলেন। তিনি আসতেই ওরা বলল- ‘স্যার, আমাদের সঙ্গে একটু যেতে হবে।’ পরিস্থিতি অনুমান করতে পারলেও ‘স্যার’ সম্বোধনে অধ্যাপক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বোধ করলেন। বললেন- ‘টেবিলে খাবার দিয়েছে, খেয়ে আসি। তোমরা একটু বসো।’ ওদের পক্ষ থেকে ত্বরিত্ উত্তর এল- ‘না, স্যার, বসতে পারব না। আপনাদের জন্য ভালো নাশতার ব্যবস্থা করা হয়েছে, এক্ষুনি চলুন।’ অবশেষে ঘর থেকে বের হলেন সরল নির্ভীক এই জ্ঞানতাপস, অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য। ঘরের দরজা পেরুতেই দেখলেন দুদিক থেকে কয়েকজন উদ্যত রাইফেল উঁচিয়ে তাঁকে ঘিরে ফেলেছে। এবার আর কিছু বুঝতে বাকি থাকল না তাঁর। তিনি জিজ্ঞেস করলেন- ‘কিন্তু আমার অপরাধ কী; বলেন আপনারা?’ এ প্রশ্নের কোনো উত্তর তিনি পাননি সেদিন। বেশ ক’বার জিজ্ঞেস করার পর, ওরা শুধু বলল, ‘বেশি কথা বলবেন না। চুপ করে থাকেন। আমরা যখন যাকে খুশি নিয়ে যেতে পারি।’
নিচে অপেক্ষমাণ গাড়িতে উঠানোর আগেই কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে ফেলা হলো তাঁর। তখন তিনি হয়ত ভয়ে আঁৎকে উঠেছিলেন, নিশ্চিত বুঝে ফেলেছিলেন তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে কী ভয়ানক পরিণাম! গাড়ি চলতে লাগল। এরপর মিরপুরের শহীদ স্মৃতিসৌধের কাছে নিয়ে গিয়ে আরো অনেকের সঙ্গে তাঁকেও এই পৃথিবীর আলো-বাতাসের সীমানা থেকে পাঠিয়ে দেয়া হয় অন্য আরেক পৃথিবীর দিকে। কিন্তু প্রায় ২০/২১ দিন তাঁর মৃতদেহের কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। পরে ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি তাঁর দেহাবশেষের খোঁজ পাওয়া গেল রায়পুরার ঝিলে। ততদিনে তাঁর পবিত্র দেহ গলে গেছে প্রায়। সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যকে সনাক্ত করা গেল পরিধানের কাপড়, ধূসর চুল ও দাঁত দেখে। এরপর তাঁর ক্ষত-বিক্ষত পচনশীল দেহাবশেষ রমনার তত্কালীন পুলিশ ইন্সপেক্টর মি. মজুমদারের ট্রাকে বাক্সবন্দি হয়ে ফিরে এল এবং পোস্তোগোলা শ্মশানে আগুনে পুড়িয়ে শেষকৃত্য হলো তাঁর দেহের।
অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ১৯১৫ সালের ৩ আগস্ট ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। যদিও পৈতৃক বাড়ি ছিল ঢাকা জেলার নওয়াবগঞ্জ উপজেলাধীন যন্ত্রাইল গ্রামে। তাঁর পরিবার ছিল রক্ষণশীল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এক ব্রাহ্মণ পরিবার। তথাপি তত্কালীন বাস্তবতায় আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত পারিবারিক আবহ পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর পিতামহ ছিলেন তারিণীচরণ শিরোমনি মহামহোপাধ্যায়, যিনি ‘দ্বিতীয় রঘুনন্দন’ নামে অভিহিত এবং পুরাণ, ন্যায় ও স্মৃতিশাস্ত্রে সুপণ্ডিত বিধায় ‘মায়ারাম বিদ্যাসাগর’ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যের পিতা ক্ষিতিশচন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন ঢাকার একজন আইনজীবী। তাঁর মায়ের নাম সরযুবালা দেবী। তাঁর দুই কাকা সচ্চীদানন্দ ভট্টাচার্য ও সুকুমার ভট্টাচার্য ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। সচ্চীদানন্দ ভট্টাচার্য কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন। আর সুকুমার ভট্টাচার্য শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করে গেছেন সারাজীবন। আইনজীবী পিতার সন্তান সন্তোষ ভট্টাচার্য জীবন যাপনের মধ্যে যে নিয়ম ও আধুনিকতার শিক্ষা পেয়েছিলেন, তার সাথে সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক শিক্ষার। ফলে ব্যক্তি সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যের চরিত্রে বহুবিধ গুণাবলির সমাবেশ ঘটে। একদিকে তিনি আধুনিকতাকে গ্রহণ করেছেন এবং তা ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করেছেন। অন্যদিকে ঐতিহাসিক বিষয়াবলিকে মূল্যহীন মনে করেননি। সমাজ বিবর্তনকে তিনি সহজভাবে মেনে নিয়েছেন এবং একই সঙ্গে শ্রদ্ধাশীল থেকেছেন তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের প্রতি। তাঁর মধ্যে সমন্বয় ঘটেছিল সনাতন ও আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্যসমূহের। ফলে তিনি হয়ে ওঠেন ব্যক্তি জীবনে সাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জীবনে আধুনিক। সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যের শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বের প্রায় পুরো সময়গুলোই কেটেছে ঢাকাতে।
সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য বিয়ে করেছিলেন রেলওয়ে কর্মচারী ভূপেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কন্যা বীণাপাণিকে। বীণাপাণি চক্রবর্তীর জন্মস্থান চট্টগ্রাম হলেও বিবাহকালীন অবস্থান ছিল ময়মনসিংহে। সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ও বীণাপানি চক্রবর্তী দাম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে প্রদীপ ভট্টাচার্য ও মেয়ে স্বপ্না ভট্টাচার্য (গঙ্গোপাধ্যায়)। বীণাপাণি চক্রবর্তী ছোটবেলা থেকেই ভালো গান গাইতেন। ১৯৮৫ সালের আগস্ট মাসে তিনি পরলোকগমন করেছেন।
ঢাকা শহরের প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ পগোজ স্কুলে সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য শিক্ষাজীবনের শুরু করেন। শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। ১৯৩২ সালে এই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন, প্রথম বিভাগে। উল্লেখ্য যে, এই পরীক্ষায় তিনি অবিভক্ত বাংলায় চতুর্দশ স্থান অধিকার করেছিলেন। এরপর আই.এ. ভর্তি হন ঢাকা ইন্টারমেডিয়েট কলেজে। এই কলেজ থেকেই ১৯৩৪ সালে আই.এ. পাস করেন, প্রথম বিভাগে। এই পরীক্ষায় তিনি অবিভক্ত বাংলায় দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী হবার গৌরব অর্জন করেন। এবার স্নাতক (সম্মান) ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ইতিহাস বিভাগে। ১৯৩৭ সালে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন, দ্বিতীয় শ্রেণীতে। এবছর স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় কোনো ছাত্রই প্রথম শ্রেণী পায়নি এবং তিনি হয়েছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম। এজন্য তিনি স্যার যদুনাথ সরকার বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন তিনি। এই কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ সমকালীন নিয়মানুসারে বিভাগীয় সুপারিশক্রমে তাঁকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল।
ছোট থেকেই গবেষণামূলক কর্মকাণ্ড ও শিক্ষকতা পেশার প্রতি আলাদা একটা টান ছিল সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যের। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়েই ১৯৩৮ সালে ইতিহাস বিভাগে গবেষণার কাজ শুরু করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল মৌর্য শাসন পদ্ধতি। নব-আবিষ্কৃত শিলালিপি, সমকালীন রচনা ও বিদেশি পর্যটকদের বিবরণীর মাধ্যমে তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন মৌর্য শাসন পদ্ধতি সম্পর্কে নতুনভাবে আলোকপাত করার জন্য। কিন্তু ১৯৩৯ সালে তদানীন্তন জগন্নাথ কলেজে ইতিহাসের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করলে এই গবেষণাকর্ম সাময়িককালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। তরুণ এই শিক্ষক অতি সহজেই নিজের পাণ্ডিত্য, সাধনা ও সহানুভূতিসম্পন্ন অন্তর দিয়ে ছাত্রদের মন যেমন কেড়েছিলেন, তেমনি অন্য শিক্ষকদেরও সুদৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ফলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। তখনকার জগন্নাথ কলেজের সুখ্যাতি ছিল সুদূরপ্রসারী। বহু খ্যাতনামা পণ্ডিত শিক্ষাবিদ তখন ওই জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনা করতেন। দীর্ঘ দশ বছরের মতো সময় অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য জগন্নাথ কলেজেই কাটিয়েছেন। তিনি ওখানে ছিলেন যেন আত্মতৃপ্ত কর্মযোগী। কখনো কোনো অনিয়ম বা অবহেলা করেননি দায়িত্ব পালনে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর প্রথম যৌবনের উদ্যম ও উত্সাহ তিনি জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদের জন্যই ব্যয় করেছিলেন।
তারপর ১৯৪৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে যোগদান করেন, অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে। ওই সময়ের কিছু আগে দেশ বিভাগের কারণে অনেক শিক্ষক ভারতে চলে যান। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক জায়গায়ই শূন্যতার সৃষ্টি হয়। অবশ্য পদ পূরণে বিলম্ব হয়নি। সন্তোষ ভট্টাচার্যও জগন্নাথ কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বৃহত্তর কর্মক্ষেত্র এবং অধিকতর দায়িত্বশীলতার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। ১৯৫০ সালে তিনি স্থায়ী প্রভাষকের পদ পান। ষাটের দশকে তিনি সিনিয়রপ্রভাষক তথা সহকারী অধ্যাপকের পদ লাভ করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ঐ পদেই ছিলেন। শিক্ষকতার সঙ্গে সঙ্গে তিনি জড়িত হয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে। তিনি খুবই ধীরসম্পন্ন পণ্ডিত অধ্যাপক ছিলেন, কিন্তু আত্মভোলা ছিলেন না কখনো। ঘন্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসে ঢোকা, নিয়মিত টিউটোরিয়াল ক্লাস নেয়া শুধু নয়, মন্তব্যসহ খাতা ফেরত দেয়া ছিল তাঁর নৈমিত্তিক ব্যাপার। এ কারণে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা শঙ্কাকুল থাকলেও ছিল শ্রদ্ধাশীল।
ইতিহাসের অধ্যাপক হওয়া সত্ত্বেও সংস্কৃত এবং বিশেষত ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি তাঁর যেমন দক্ষতা ছিল, তার চেয়ে বাংলা ভাষার প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছিল অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যের। তাঁরই এক সময়কার সহকর্মী বাংলা বিভাগের অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিমের ‘আমার সহকর্মী’ শিরোনামে স্মৃতিচারণমূলক এক লেখা থেকে জানা যায়, ‘আমার জ্যেষ্ঠ কন্যা ইতিহাসে এম.এ. পড়তে গেল- তার বিশেষ বিষয় ছিল ‘অতীত ভারতবর্ষের ইতিহাস’- পড়াতেন অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য। একদিন মেয়ে খুব ক্ষুব্ধ চোখ মুখ নিয়ে বাড়ি এসে বলল- মা, স্যার (সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য) আমাকে টিউটোরিয়ালে কম নম্বর দিয়েছেন এবং বলেছেন ইংরেজিতে লিখলে তিনি নম্বর কাটবেন। কন্যাটি ইংরেজিতে সদ্য এম.এ. পাস করে গেছে। স্বভাষা সম্পর্কে অশ্রদ্ধা না থাকলেও কিছুটা উন্নাসিকতা তখনকার ইংরাজি বিভাগের আভিজাত্যের লক্ষণ ছিল। সুতরাং কন্যা বাংলাতে লিখতে রাজী নয়। শেষ পর্যন্ত আপত্য স্নেহে অন্ধ আমি অধ্যাপকের দ্বারস্থ হলাম। ব্যথিত কন্ঠে অধ্যাপক ভট্টাচার্য বললেন- ‘আপনার মেয়ের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকবে না, স্বভাষা চর্চা করবে না, এ আপনি সমর্থন করেন কী করে!’ অধ্যাপকের এ কথায় লজ্জায় আমার মাথা নত হয়ে গেল। এক নতুন মানুষকে আমি সেদিন আবিষ্কার করলাম। তিনি শুধু নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণই ছিলেন না, ছিলেন একনিষ্ঠ দেশপ্রেমিক। সেখানে কোনও লোভ বা কোনোও মোহের কাছে তিনি মাথা নত করেননি, পরাজয় স্বীকার করেননি।’
দেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অতি সচেতন হয়ে ওঠে এবং সঙ্গত কারণেই রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ যায় বেড়ে। ৫৮ সালের পর আন্দোলন বিপ্লবী রূপ নিতে শুরু করে। এ সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রায়ই আলাপ আলোচনায় বসতেন, সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যও এসব আলোচনায় অংশ নিতেন, বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর বিশ্লেষণী মত প্রকাশ করতেন, কিন্তু কখনও উচ্চকন্ঠ বা উত্তেজনা প্রকাশ করতেন না। ওই সময় পড়াশুনা ফেলে ছাত্রছাত্রীরা যখন বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির কুশপুত্তলিকা দাহ করত, মিছিল মিটিং করত, তা অনেক শিক্ষককে আনন্দ দিত। কিন্তু সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ইতিহাসের অধ্যাপক হলেও ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ’ আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল ‘পড়াশোনাকে বাদ দিয়ে আন্দোলন নয়। পড়াশুনাকে ঠিক রেখে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে পারো।’ কট্টর ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেও তিনি ছিলেন সংস্কারমুক্ত, আধুনিক চেতনাসম্পন্ন একজন মানুষ। পড়া এবং পড়ানো এই দুই নেশায় তিনি ছিলেন বিভোর। সময় পেলেই তাঁর ছাত্রজীবন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্রকালীন সময়ের কথা বলতে বলতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময় ১৯৫৭-৫৮ সালে সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য জগন্নাথ হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ১৯৫৬-৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোর্টের (সিনেটের) সরকার মনোনীত সদস্য হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন। পরে জগন্নাথ হলের ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৬৬ সালের ১ জুলাই হতে ১৯৬৭ সালের ১ এপ্রিল পর্যন্ত। কেননা এ সময় অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র দেব ছিলেন শিক্ষা ছুটিতে। উল্লেখ্য যে, ১৯৩৪-৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি জগন্নাথ হলেরই সংযুক্ত ছাত্র ছিলেন। ফলে জগন্নাথ হলের সাথে তাঁর যে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল- তা তাঁকে বাধ্য করেছিল বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হলের প্রাধ্যক্ষ হিসেবে কঠিন দায়িত্ব পালন করতে। অপূর্ব দক্ষতায় নিজেই সমস্যার সমাধান করেছেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী শক্তিমানদের আহ্বান জানাতে হয়নি কখনো। অথচ ওই সময়টাই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কঠিন সময়। সরকার ও ছাত্ররা ছিল বিপরীতমুখী। সামনের কাতারের রাজনৈতিক জীবন চর্চায় সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য কখনো না এলেও খুবই রাজনীতি সচেতন ছিলেন। সহকর্মী বন্ধুবান্ধব বা ছাত্রদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি যেমন আলাপ আলোচনা করতেন, তেমনি অনেক বিষয়ে পথ নির্দেশনাও দিতেন।
১৯৫৩ সালে সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ঢাকা যাদুঘরের কিউরেটর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন ড. আহমেদ হাসান দানীর অনুপস্থিতিতে। ১৯৬৭-৬৮ সালে গঠিত ইতিহাস পরিষদ ও ‘East Pakistan History Association’-এর সাথে তিনি জড়িত হন। তিনি ইতিহাস পরিষদের কোষাধ্যক্ষ এবং যুগ্ম সম্পাদক ইত্যাদি দায়িত্বপূর্ণ পদ গ্রহণ করেছিলেন। অন্যদিকে তিনি ছিলেন East Pakistan History Association (যা পরে বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি নামে পরিচিত)-এর কার্যকরী কমিটির সদস্য। পাকিস্তান এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা হলে তিনি ১৯৫২ সালেই এর সদস্য হন এবং বেশ কয়েকবার এশিয়াটিক সোসাইটির কাউন্সিলে তথা কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। এসব গবেষণা সংগঠন সমূহের প্রকাশনার ক্ষেত্রে তাঁর অতুলনীয় অবদান রয়েছে। ১৯৫৭-৬০ সাল পর্যন্ত তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ইতিহাস কমিটির সদস্য ও প্রধান পরীক্ষক ছিলেন।
সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য উত্তরাধিকার পরিমণ্ডল হতে লব্ধ সংস্কৃত জ্ঞানের সদ্ব্যবহার করেছিলেন তাঁর ইতিহাস চর্চায়। তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন প্রাচীন ভারতের ইতিহাস সাধনায়। তিনি যখন ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ছিলেন, সে যুগে ভারতের প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস চর্চাই ছিল গবেষণার প্রধান বিষয় এবং তাঁর শিক্ষকদের অধিকাংশই নিয়োজিত ছিলেন প্রাচীন ভারতের ইতিহাস চর্চায়। এই সমকালীন গবেষণার ধারা সমানভাবে প্রভাব সৃষ্টি করেছিল তাঁর ইতিহাস চেতনার বলয়ে। পূর্বতন ধারা অনুসরণ করে তিনি নিয়োজিত হয়েছিলেন প্রাচীন ভারতের ইতিহাস চর্চায়। বিশেষভাবে প্রাচীন ভারতের মৌর্য ও গুপ্ত যুগই ছিল তাঁর পদচারণার ক্ষেত্র। অবশ্য সন্তোষচন্দ্রের প্রাচীন ভারতের ইতিহাস সাধনার আর একটি অনুপ্রেরণা ছিল সংস্কৃত ভাষার উপর দক্ষতা। সমকালীন ইতিহাস গবেষকদের তুলনায় তাঁর প্রকাশনা ছিল খুবই কম। মেধাবী ছাত্র হিসেবে ভালো রেজাল্ট করলেও বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ তিনি পাননি। অন্যদিকে তিনি ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে রচনার সংখ্যা বৃদ্ধির চেয়ে মান বৃদ্ধির উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি লিখেছেন কম সত্য, কিন্তু যেটুকু লিখেছেন সেখানে বিষয়ের উপর তাঁর দক্ষতা, আলোচনার গভীরতা, তথ্য উপস্থাপনের কৌশল নিঃসন্দেহে প্রাজ্ঞজনের প্রশংসার দাবিদার।
সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যের গবেষণা প্রকাশনা, গ্রন্থ সমালোচনা, অনুবাদ ও অন্যান্য প্রকাশনার মধ্যে: ইংরেজি প্রবন্ধ-`The Original Home of the Guptas’ (1962), Journal of the Asiatic Society of Pakistan, Vol. VII, No. 1; `The Buddha in the Puranas’ (1966), Nalinikanta Bhattasali Commemoration Volume, Dhaka Museum; `Emperor Asoka : A Re-Study’ (1970), Journal of the Asiatic Society of Pakistan, Vol. XV, No. 3; `The Ramgupta Problem in the Light of the Recently Discovered Inscriptions’ (1972), Asiatic Society of Bangladesh, Dhaka. বাংলা প্রবন্ধ- ‘অশোকের ধর্ম’ (১৯৬৯), বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ পত্রিকা; ‘ব্যাড়ী ভক্তি তরঙ্গিণী’ (১৯৬৮) ইতিহাস, ২য় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা; ‘কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র’ (১৯৭২) পঞ্চম বর্ষ, প্রথম-তৃতীয় সংখ্যা। গ্রন্থ ও প্রবন্ধ পত্রিকা সমালোচনা- `The Yellow Scarf : An Account of Thaggee and Its Suppression by Sir Francis Tuker (London, 1961), (1962), বাংলা একাডেমী পত্রিকা, পঞ্চম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা। `Journal of the Ancient India History (Review), (1968), Journal of the Asiatic Society of Pakistan, Vol. XIII, No. 3. `Peshwar-Historic City of the Frontier, Ahmed Hasan Dani, (1968) ইতিহাস, তৃতীয় বর্ষ, প্রথম সংখ্যা। অন্যান্য রচনা- Philip Van Ness Myers, A Short History of Modern Times, Volume One : Modern Europe from 1453 Upto the Present Day, Dhaka : Mallick Brothers (সম্পাদনা) (১৯৬২); ‘শুধু ভালবাসা’ (১৩৯৬), শীর্ষক একটি অনুবাদকৃত গল্প, বাসন্তিকা, জগন্নাথ হল বার্ষিকী, চতুর্দশ বর্ষে ছাপা হয়।
একাত্তর সালে যুদ্ধের উত্তপ্ত দিনগুলোতে ঢাকা শহর ছেড়ে দলে দলে লোকজন নিরাপত্তার সন্ধানে পাড়ি দেয় দূর-দূরান্তের গ্রাম-গঞ্জে। অনেকেই ভারতে চলে যায়। বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ লোকই চলে যায় ভারতে। সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যকেও অনেকেই অনুরোধ করল ভারত চলে যেতে। অথচ তিনি দেশ ছাড়লেন না। অবশ্য কিছুদিনের জন্য তিনি পরিবার-পরিজনসহ ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি যন্ত্রাইলে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরই ফিরে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিজের ঘরে অর্থাত্ ৩১ নম্বর ঈশা খাঁ রোডস্থ বাড়িতেই। কেউ তাঁকে ভারতে চলে যাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি বলতেন- ‘আমি আমার মাতৃভূমি ছেড়ে কোথাও যাব না। কেন যাব? আমি তো কোনো অন্যায় করিনি।’ না কোনো ছাত্র, না কোনো সহকর্মী, না কোনো আত্মীয়-পরিজন, কেউ তাঁকে তাঁর এই সংকল্পচ্যুত করতে পারেনি। যে ছাত্র বারবার তাঁকে এদেশের সীমানার বাইরে রেখে আসতে চেয়েছিলেন, সেই প্রিয় ছাত্র, ইতিহাসের অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনও চিরকালের জন্য রয়ে গেলেন এই সীমানার ভেতরই, তার প্রিয় শিক্ষকের বুকে।
প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তাধারার অধিকারী, সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ। সত্য ও ন্যায়ের সাধনায় ব্রতচারী এই পণ্ডিত চিরকাল দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবেসে জ্ঞানের আলো বিলিয়ে গেছেন। এদেশীয় রাজাকার-আলবদরদের সহায়তায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীরা তাঁর জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিলেও তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকেও জ্ঞানের আলো দিয়ে যাচ্ছেন।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
জন্ম:
অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ১৯১৫ সালের ৩ আগস্ট ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। যদিও পৈতৃক বাড়ি ছিল ঢাকা জেলার নওয়াবগঞ্জ উপজেলাধীন যন্ত্রাইল গ্রামে।
পরিবার-পরিজন:
পিতামহ : তারিণীচরণ শিরোমনি মহামহোপাধ্যায়। পিতা ক্ষিতিশচন্দ্র ভট্টাচার্য, পেশায় ছিলেন আইনজীবী। মা সরযুবালা দেবী। দুই কাকা সচ্চীদানন্দ ভট্টাচার্য ও সুকুমার ভট্টাচার্য ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য বিয়ে করেছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কন্যা বীণাপানিকে। তাঁদের ছেলে প্রদীপ ভট্টাচার্য ও মেয়ে স্বপ্না ভট্টাচার্য (গঙ্গোপাধ্যায়)। ১৯৮৫ সালের আগস্ট মাসে বীণাপানি ভট্টাচার্য পরলোকগমন করেছেন।
পড়াশুনা:
ঢাকার পগোজ স্কুলে শিক্ষাজীবনের শুরু করেন। শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। ১৯৩২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন, প্রথম বিভাগে। এরপর আই.এ. ভর্তি হন ঢাকা ইন্টারমেডিয়েট কলেজে। ১৯৩৪ সালে আই.এ. পাস করেন, প্রথম বিভাগে। স্নাতক (সম্মান) ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ইতিহাস বিভাগে। ১৯৩৭ সালে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন, দ্বিতীয় শ্রেণীতে। ১৯৩৮ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন তিনি।
কর্মক্ষেত্র:
১৯৩৯ সালে জগন্নাথ কলেজে ইতিহাসের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তারপর ১৯৪৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে যোগদান করেন, অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে। ১৯৫০ সালে তিনি স্থায়ী প্রভাষকের পদ পান। ষাটের দশকে তিনি সিনিয়র প্রভাষক তথা সহকারী অধ্যাপকের পাদ পান এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ঐ পদেই ছিলেন। ১৯৫৭-৫৮ সালে জগন্নাথ হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৫৬-৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোর্টের (সিনেটের) সরকার মনোনীত সদস্য হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন। পরে জগন্নাথ হলের ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৬৬ সালের ১ জুলাই হতে ১৯৬৭ সালের ১ এপ্রিল পর্যন্ত। ১৯৫৩ সালে ঢাকা জাদুঘরের কিউরেটর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন ড. আহমেদ হাসান দানীর অনুপস্থিতিতে। ১৯৬৭-৬৮ সালে গঠিত ইতিহাস পরিষদ ও East Pakistan History Association-এর সাথে তিনি জড়িত হন। তিনি ইতিহাস পরিষদের কোষাধ্যক্ষ এবং যুগ্ম সম্পাদক ইত্যাদি দায়িত্বপূর্ণ পদ গ্রহণ করেছিলেন। অন্যদিকে তিনি ছিলেন East Pakistan History Association (যা পরে বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি নামে পরিচিত)-এর কার্যকরী কমিটির সদস্য। পাকিস্তান এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা হলে তিনি ১৯৫২ সালেই এর সদস্য হন এবং বেশ কয়েকবার এশিয়াটিক সোসাইটির কাউন্সিলে তথা কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। এসব গবেষণা সংগঠন সমূহের প্রকাশনার ক্ষেত্রে তাঁর অতুলনীয় অবদান রয়েছে। ১৯৫৭-৬০ সাল পর্যন্ত তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ইতিহাস কমিটির সদস্য ও প্রধান পরীক্ষক ছিলেন।
গবেষণাকর্ম ও লেখালেখি:
সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যের প্রকাশিত রচনার সংখ্যা যদিও সংখ্যায় খুবই কম, তথাপি মানবিচারের উচ্চাঙ্গের। তাঁর গবেষণা প্রকাশনা, গ্রন্থ সমালোচনা, অনুবাদ ও অন্যান্য প্রকাশনার মধ্যে: ইংরেজি প্রবন্ধ- `The Original Home of the Guptas’ (1962), `The Buddha in the Puranas’ (1966), `Emperor Asoka : A Re-Study’ (1970), `The Ramgupta Problem in the Light of the Recently Discovered Inscriptions’ (1972). বাংলা প্রবন্ধ- ‘অশোকের ধর্ম’ (১৯৬৯), ‘ব্যাড়ী ভক্তি তরঙ্গিণী’ (১৯৬৮), ‘কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র’ (১৯৭২)। গ্রন্থ ও প্রবন্ধ পত্রিকা সমালোচনা- ‘The Yellow Scarf : An Account of Thaggee and Its Suppression by Sir Francis Tuker (London, 1961), (1962); `Journal of the Ancient India History (Review), (1968), `Peshwar-Historic City of the Frontier, Ahmed Hasan Dani, (1968). অন্যান্য রচনা- Philip Van Ness Myers, A Short History of Modern Times, Volume One : Modern Europe from 1453 Upto the Present Day (1962); ‘শুধু ভালবাসা’ (১৩৯৬), শীর্ষক একটি অনুবাদকৃত গল্প।
মৃত্যু:
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর আল বদর বাহিনীর কতিপয় দুর্বৃত্তের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান তিনি।
তথ্যসহযোগিতা নেয়া হয়েছে রতন লাল চক্রবর্তী লিখিত ‘শহীদ সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য’ (বাংলা একাডেমী : ১৯৯৭), ড. নীলিমা ইব্রাহিম লিখিত স্মৃতিচারণমূলক লেখা ‘আমার সহকর্মী’, (স্মৃতি ১৯৭১ : বাংলা একাডেমী), সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যের কন্যা স্বপ্না গঙ্গোপাধ্যায় লিখিত স্মৃতিচারণমূলক লেখা ‘আমার বাবা’; এছাড়া বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ ও শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ থেকে।
লেখক : সফেদ ফরাজী