সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর বার্তা ও কার্যনির্বাহী সম্পাদক। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর আল বদররা তাঁকে তাঁর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। এ দেশের সংবাদপত্র জগতের অন্যতম পুরোধা ছিলেন তিনি। পাকিস্তান আমলে যে কয়জন সাংবাদিকের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
কলকাতায় ‘আজাদ’ পত্রিকায় তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। সে সময় তিনি বি.এ.’র ছাত্র। পড়তেন ইসলামিয়া কলেজে। থাকতেন বেকার হোস্টেলে। এই কলেজে পড়ার সময়ই শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুদ্দীন মোল্লা, আসফউদদৌলা রেজা, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় তাঁর। পিতৃহীন সিরাজুদ্দীন হোসেন বেঁচে থাকার তাড়নায়ই এ সময় সংবাদপত্রে কাজ নিতে বাধ্য হন। তখন ‘আজাদ’ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ছিলেন মোহাম্মদ মোদাব্বের। ‘আজাদ’ তখন কলকাতার মুসলমানদের একমাত্র প্রভাবশালী দৈনিক। খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস কাজ করতেন ‘আজাদ’-এ। তিনিই সিরাজুদ্দীন হোসেনকে নিয়ে হাজির করলেন মোহাম্মদ মোদাব্বেরের কাছে। সিরাজুদ্দীন হোসেনের তখন সাংবাদিকতা বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসকে মোহাম্মদ মোদাব্বের বললেন, ‘ওকে একটু-আধটু দেখিয়ে দিও।’
শিক্ষানবিশ হিসেবে সেখানেই কাজ শুরু করলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। দিন সাতেক পর খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস জানালেন, যে খবরগুলো ছাপা হচ্ছে, তার কয়েকটি সিরাজের লেখা। সে সময় ‘আজাদ’-এর বার্তা বিভাগে নিয়ম ছিল প্রত্যেকদিন সকালে শিফট ইনচার্জদের নিয়ে বসে সব সংবাদ পরীক্ষা করা। এই নিয়ম ছিল বলে ভুল অনুবাদ পত্রিকায় প্রকাশ করা হতো না। এই পদ্ধতির মাধ্যমে প্রমাণ হলো, সিরাজের অনুবাদে ভুল থাকত না।
মোহাম্মদ মোদাব্বের নিজের পাশে বসিয়ে সিরাজুদ্দীন হোসেনকে কাজ শিখিয়েছেন। কীভাবে সংক্ষিপ্ত করে অনুবাদ না করে নিজের ভাষায় খবর লিখতে হয়, সেটা বুঝিয়ে দিতেন তিনি। মাত্র পনের দিনের শিক্ষানবিশের পরই সিরাজের বেতন সিনিয়র সাব-এডিটরের পর্যায়ে ধার্য করা হলো। অনেকেই তাতে আপত্তি করেছিল, কিন্তু মোহাম্মদ মোদাব্বের নিজের সিদ্ধান্তে ছিলেন অনড়। মোহাম্মদ মোদাব্বের এ ব্যাপারে লিখেছেন, ‘কারো আপত্তি গ্রাহ্য করিনি। যোগ্যতার মূল্য দিয়েছি, মুখ দেখে বেতন ধার্য করিনি।’ দেশবিভাগের পর ‘আজাদ’ পত্রিকা ঢাকায় চলে এলো।
কীভাবে ‘আজাদ’ থেকে সিরাজুদ্দীন হোসেনের চাকরি গেল, তা নিয়ে লিখেছেন ফয়েজ আহমেদ। ‘চুয়ান্ন সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট অংশ নিয়েছিল। প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও মওলানা ভাসানীর মতে অমিল দেখা গেল। জানুয়ারির শুরুতেই খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাচ্ছে। একটি ব্যাপারে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শেরে বাংলা। রটে গেল, শেরে বাংলা যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দিয়েছেন। মুসলিম লীগ শিবিরে তখন দারুণ আনন্দ। ‘আজাদ’-এর সম্পাদক মাওলানা আকরম খাঁ বিরোধী শক্তির নাজুক পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নিলেন। তিনি সেখানকার অন্যতম রিপোর্টার সন্তোষ বসাককে ডেকে যুক্তফ্রন্ট ভাঙনের সংবাদ মুসলিম লীগের দৃষ্টিকোণ থেকে করার নির্দেশ দিলেন। সারাদিন ঘুরে এমন এক রিপোর্ট করলেন যা দিয়ে প্রমাণ করা যায় যে, যুক্তফ্রন্ট ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে। মওলানা সায়েব রিপোর্টটি অনুমোদন করে ওপরে লিখে দিলেন ‘যাবে’। রাতের শিফটে যিনি প্রধান, তাঁর উপর দায়িত্ব বর্তালো রিপোর্টটির উপযুক্ত ব্যবহার করার।
‘আজাদ’-এ সেদিন রাতের শিফটের দায়িত্বে ছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। তখন তিনি আজাদের যুগ্ম-বার্তা সম্পাদক। তাঁর নির্দেশ ও পরিচালনায় রাতের খবর নিয়ন্ত্রিত হয়। রাত দশটার দিকে রাতের শিফট পরিচালনা করতে যেতেন তিনি, ফিরতেন ভোর রাতে। সেদিনও ফাইল দেখতে দেখতে লক্ষ্য করলেন, একটা স্পাইকে ছোট্ট একটা খবর। শেরে বাংলা বলেছেন, যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাবার প্রচারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তিনি যুক্তফ্রন্ট থেকে পদত্যাগ করেননি।
সিরাজুদ্দীন হোসেন সত্ সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে শেরে বাংলার বিবৃতিটাই ছেপে দিলেন। সন্তোষ বসাকের রিপোর্টটি ছাপলেন না। পরদিন অফিসে এসে তিনি ছোট্ট একটি খাম পেলেন। সেখানে লেখা আছে, ‘আপনার চাকরির আর প্রয়োজন নাই’।
১৯৫৪ সালে ১৫ দিনের ব্যবধানে সিরাজুদ্দীন হোসেন ও আসফউদদৌলা রেজা ‘আজাদ’ ছেড়ে ‘ইত্তেফাক’-এ যোগ দেন। সিরাজুদ্দীন হোসেন কাজের ব্যাপারে খুব কঠোর ছিলেন, কিন্তু তাঁর কাছে মানবিকতা ছিল সবকিছুর ঊর্ধ্বে। একবার বার্তা বিভাগের এক সহকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আসফউদ্দৌলাকে নির্দেশ দিলেন। ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছেন জেনে বিচলিত হয়ে পড়লেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। নিজ বাড়িতে তাঁকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘ওর চাকরি গেলে বউ ছেলেপেলে নিয়ে দাঁড়াবে কোথায়?’ অন্যায়কারীকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত এবং কারও কাছ থেকে পাওয়া আঘাত মন থেকে মুছে না ফেলা পর্যন্ত তিনি শান্তি পেতেন না।
সিরাজুদ্দীন হোসেন জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে। তত্কালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার শালিখা থানার শরুশুনা গ্রামে তাঁর জন্ম (বর্তমানে তা মাগুরা জেলা)। মাত্র সাড়ে ৩ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। এ সময় তাঁর চাচা মৌলবী মোহাম্মদ ইসহাক পিতৃহারা ভাইপো-ভাইজিদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। চাচার কাছে থাকাকালে সিরাজুদ্দীন হোসেন মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর স্কুল, যশোর জেলা স্কুলে পড়াশোনা করেন। পারিবারিক ভুল বোঝাবুঝির কারণে তিনি চাচার কাছ থেকে সরে আসেন। শেষে যশোরের ঝিকরগাছার কাছে মিছরিদিয়াড়া গ্রামের এক বিধবার বাড়িতে জায়গির থেকে ঝিকরগাছা স্কুলে পড়াশুনা করতে থাকেন। বিধবা নারী সিরাজুদ্দীন হোসেনকে নিজের ছেলের মতো স্নেহ করতেন। বৃদ্ধার ছেলেরা চাষাবাদের কাজ করত। তারাও জনাব হোসেনকে আপন করে নিয়েছিল। পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি বৃদ্ধার ছেলেদের চাষাবাদের কাজেও সাহায্য করতেন। তাদের জন্য মাঠে ভাত নিয়ে যেতেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষা নিকটবর্তী হলে দেখা গেল পরীক্ষার ফি যোগাড় করতে পারছেন না সিরাজুদ্দীন হোসেন। তখন সেই উদারপ্রাণ বৃদ্ধা তাঁর বাড়ির একটি বড় মোরগ বিক্রি করে ফি-এর ঘাটতির টাকার সংস্থান করে দেন। জায়গির থাকা অবস্থায় তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং যশোর মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলেজে আই.এ.-তে ভর্তি হন। আই.এ. পাশ করার পর সিরাজুদ্দীন হোসেন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে বি.এ. পড়া শুরু করেন। কলেজ জীবনে বই কেনার মতো আর্থিক স্বচ্ছলতা তাঁর ছিল না। অন্যের বই আর শিক্ষকদের লেকচারের উপর ভিত্তি করে নোট তৈরি করেই তিনি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতেন। ১৯৪৭ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি ‘দৈনিক আজাদ’-এ সাংবাদিকতা শুরু করেন। কালক্রমে তিনি ‘আজাদ’-এর বার্তা সম্পাদক হন। সমসাময়িককালে এত অল্প বয়সে বার্তা-সম্পাদকের পদে কাজ করার সৌভাগ্য আর কারো হয়নি।
১৯৫৪ সালে ‘আজাদ’-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর তিনি ঢাকার ইউএসআইএস অফিসে জুনিয়র এডিটর হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। এক বছর পর তিনি ‘ইত্তেফাক’-এর বার্তা সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। মানিক মিয়ার অসাধারণ দূরদৃষ্টি আর সিরাজুদ্দীন হোসেনের টিমওয়ার্ক ‘ইত্তেফাক’কে অল্পদিনের মধ্যেই একটি প্রথম শ্রেণীর সংবাদপত্রে পরিণত করে।
ষাটের দশকে সিরাজুদ্দীন হোসেন এক অসাধারণ কাজ করেন। ছেলেধরা বিষয়ে তিনি পুলিশের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন। সে সময় পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থানে আশঙ্কাজনকভাবে শিশু অপহৃত হচ্ছিল। ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এ সম্পর্কিত খবরও ছাপা হচ্ছে। পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সতর্কবাণী ছাপা হচ্ছে। সংঘবদ্ধ শিশু অপহরণকারী দলের কারসাজির ফলেই যে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে, সে বিষয়ে কারো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু পুলিশের আইজি এক সংবাদ সম্মেলন করে মন্তব্য করলেন, শিশু অপহরণের এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা, এর পিছনে কোনো সংঘবদ্ধ সংগঠিত দল নেই। আইজির সংবাদ সম্মেলনের কথাও ছাপা হলো ‘ইত্তেফাক’-এ।
সিরাজুদ্দীন হোসেন পুলিশের এই মন্তব্য মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। তাঁর এ প্রচেষ্টার ফলে শিশু অপহরণের এক বিরাট কাহিনী উদ্ঘাটিত হয়। তত্কালীন ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও, ত্রিশাল ও ভালুকা- এই তিন থানার বিরাট সীমান্ত অঞ্চল ছিল গোচারণ ভূমি। লম্বা লম্বা ঘাস মানুষের মাথা ছাড়িয়ে যেত। ফলে বাইরে থেকে বোঝা যেত না, সেখানে কারা আছে। গোচারণ ভূমির মাঝে মাঝে ছিল চালাঘর। সংঘবদ্ধ শিশু অপহরণকারীরা ছোট ছোট ছেলেদের চুরি করে এই গোচারণভূমিতে নিয়ে আসত। লোক-চক্ষুর অন্তরালে শিশুদের দেয়া হতো অসামাজিক কাজের প্রশিক্ষণ। কোনো কোনো শিশুর হাত-পা কেটে বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষার কাজে লাগানো হতো। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই অপকর্ম করে যেত তারা। শিশু অপহরণকারীদের এই স্বর্গরাজ্য আবিষ্কৃত হলো সিরাজুদ্দীন হোসেনের উদ্যোগে। সত্তরেরও বেশি শিশুকে উদ্ধার করা হলো। আইপিআই (ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট)-এর ক্রোড়পত্রে সিরাজুদ্দীন হোসেন ও উদ্ধারকৃত শিশুদের নিয়ে ছাপা হলো প্রতিবেদন। এ জন্য তিনি ম্যাগসেসে মনোনয়ন পেয়েছিলেন।
১৯৭১ সালে অবরুদ্ধ বাংলায় বসেও সিরাজুদ্দীন হোসেন সাহসিকতার সঙ্গে সাংবাদিকতা করে গেছেন।
একাত্তরের সাতই মার্চের ভাষণটি বেতারে প্রচারের দাবি কী করে উঠল, তা সাংবাদিক আমির হোসেনের বয়ানে শোনা যাক : ‘২রা মার্চের কথা। রাতের মতো কাজ শেষ করে বাসায় ফিরবার আগে সিরাজ ভাইয়ের কাছে গিয়ে বললাম, চলে যাচ্ছি, সব কাজ শেষ। সিরাজ ভাই একটা নিউজের কপি দেখছিলেন। মুখ না তুলেই বললেন, সাংবাদিকদের কাজ আবার শেষ হয় কী করে? লেখা শেষ হয়ে থাকলে বসে পত্রিকা পড়। ঘরে ফেরার তাড়া কিসের?
আমি বললাম, তাড়া নেই কিছুই। আজকের মতো যা লেখার ছিল শেষ করেছি। তাই যেতে চাইছিলাম।
সিরাজ ভাই চায়ের অর্ডার দিয়ে বললেন, চা খা। ক্লান্তি আর ঘুম দুটোই পালাবে।
চেয়ার টেনে বসে পড়লাম।
হাতের কপিটা দেখা শেষ করে সিরাজ ভাই বললেন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে যে ভাষণ দেবেন, সেটা রেডিওতে প্রচারিত হলে সারাদেশের মানুষ শুনতে পেত। মিটিং-এ তো লোক আসবে বড়জোর ৮-১০ লাখ। পত্রিকা পড়বে ধর তার কয়েকগুণ। কিন্তু বাকিরা? সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ৭ কোটিই শুনতে পাবে না, জানতেও পারবে না তিনি কী বললেন। অথচ ভাষণটা রেডিওতে প্রচারের ব্যবস্থা হলে মুহূর্তের মধ্যে তা ঘরে ঘরে পেঁৗছে যাবে।
আমি বললাম, কিন্তু সেটা হবে কী করে?
সিরাজ ভাই বললেন, হতে পারে। দেখ না চেষ্টা করে। চা খেয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের ধর। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা রেডিওতে প্রচারের দাবি জানিয়ে একটি বিবৃতি ছেপে দিই। দেখা যাক কিছু হয় কি না। বিবৃতিটা তুই-ই লিখে ফেল, শুধু কনসেপ্ট নিয়ে নে।
তখন রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে। চা খেতে খেতেই টেলিফোন করতে শুরু করলাম। তাজউদ্দিন সাহেব থেকে শুরু করে যাকেই ডায়াল করি, হয় ঘুমে না হয় বাইরে। আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট কোনো নেতাকেই পেলাম না। বললাম, কাউকেই তো পাচ্ছি না, কাল চেষ্টা করে দেখব?
সিরাজ ভাই বললেন, সময় চলে যাচ্ছে। দেরি করা ঠিক হবে না। কি করা যায়, বলত?
আমি বললাম, বিবৃতিটা তোফায়েল আহমদের নামে হলে যদি চলে, ছেপে দিই। কাল তাঁকে সব খুলে বললেই হবে।
সিরাজ ভাই রাজি হলেন। আমি তখনকার যুবনেতা তোফায়েল আহমদের নামে বিবৃতি তৈরি করে দিলাম। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিওতে সরাসরি প্রচারের দাবি সম্বলিত সেই বিবৃতি পরদিন ‘ইত্তেফাক’-এ ছাপা হলো।
সেদিনই বিকেলে তোফায়েল আহমদের সঙ্গে দেখা করি আওয়ামী লীগ অফিসে। আমাকে দেখেই তিনি বললেন, আমি বুঝতে পারছি বিবৃতিটা আপনিই ছেপে দিয়েছেন। সারাদিন বিভিন্ন পত্রিকার লোকজন অনুযোগ করছে, বিবৃতিটা শুধু ইত্তেফাকে পাঠালেন কেন? শেষে বাধ্য হয়ে বলতে হয়েছে, অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল, তাই তার পক্ষে সব পত্রিকায় পাঠানো সম্ভব হয়নি।
বঙ্গবন্ধু অফিসেই ছিলেন। তোফায়েল আহমদের সঙ্গে তাঁর রুমে ঢুকতেই বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে বললেন, আমির, তোর বিরুদ্ধে তোফায়েলের নালিশ আছে। তার অনুমতি ছাড়া তুই নাকি তার নাম জাল করে বিবৃতি ছেপেছিস ‘ইত্তেফাক’-এ।
আমি বললাম, যা করেছি গুড ফেইথে করেছি এবং সিরাজ ভাইয়ের নির্দেশে করেছি। সুতরাং এই নালিশে আমি ঘাবড়াইনি।
বঙ্গবন্ধু বললেন, খুব ভালো করেছিস। এটা আরো আগেই করা উচিত ছিল। ওরা হয়তো খেয়াল করেনি। সিরাজ এসব ব্যাপারে খুব সজাগ। এজন্যই তো আমি ওর ওপর এত ভরসা করি। তোফায়েলের বিবৃতিটা তোরা ভালোই ছেপেছিস। আজ এ ব্যাপারে তাজউদ্দিনের বিবৃতি যাচ্ছে পত্রিকায়।
পরদিন পত্রিকায় তাজউদ্দিন আহমদের বিবৃতি প্রকাশিত হয়। ৭ মার্চের ভাষণ রেডিওতে সরাসরি প্রচারের দাবি ক্রমশ এমনই জোরালো হয়ে ওঠে যে, কর্তৃপক্ষ এ দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন। ৭ মার্চ রেসকোর্স থেকে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারের সম্পূর্ণ প্রস্তুতিও গ্রহণ করা হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সরকারি উচ্চ মহলের নির্দেশে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দিতে শুরু করলে দেখা যায় রেডিওতে তা প্রচার হচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন এই আশংকা করেই বেতারে তাঁর ভাষণ সরাসরি প্রচারের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। কর্তৃপক্ষ ৮ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়। রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারিত হওয়ার ঘটনাটি ছিল অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ ও তাত্পর্যপূর্ণ। কিন্তু সেই রাতে সিরাজুদ্দীন হোসেন ঐভাবে দৃশ্যত সাংবাদিকতার প্রচলিত রীতি লঙ্ঘন করে ইত্তেফাকে তোফায়েল আহমদের নামে উল্লিখিত বিবৃতিটি প্রকাশের ব্যবস্থা না করলে বঙ্গবন্ধৃর ৭ মার্চের ভাষণটি আদৌ রেডিওতে প্রচারিত হতো কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ আছে।’ (আমির হোসেন, ইত্তেফাকের সিরাজ ভাই/স্মৃতিপটে সিরাজুদ্দীন হোসেন, ২৯৭-২৯৯ পৃষ্ঠা)
একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সিরাজুদ্দীন হোসেন ‘ইত্তেফাক’-এ কাজ করেছেন। ২৫ মার্চেই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ‘ইত্তেফাক’ অফিস। পরে তা আবার চালু হয়। পাকিস্তানী বাহিনীর পৈশাচিক অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত হলো বাংলা। বড় পরিবার নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করার কথা ভাবতে পারলেন না সিরাজুদ্দীন হোসেন। এখানে থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন তিনি। একাত্তরের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় ‘ইত্তেফাক’- এর সাংবাদিক শফিকুল কবির যখন সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার অনুমতি চাইলেন, তখন সিরাজুদ্দীন হোসেন কোনো আপত্তি জানাননি। তবে বললেন, এখানে থেকেও কিছু কাজ করার আছে। তিনি বুঝালেন, ‘আজ হোক, কাল হোক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসবেই। আর এ স্বাধীনতার ইতিহাস রচিত হবে দুই ধারায়। যাঁরা ভারতে চলে যাচ্ছে, তাঁরা দেখবে একটি দিক, আর এখানে যাঁরা শেষপর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে, পাক বাহিনীর প্রতিটি দুষ্কর্ম লক্ষ্য করে তাঁরা বিচার করবে অন্যদিক।’
কোনো জরুরি তথ্য ওপারে পাঠাতে হলে শফিকুল কবিরকেই খবর দিতেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। আগরতলার কংগ্রেস ভবন পর্যন্ত তা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তাঁর। কাজ সম্পর্কে সিরাজুদ্দীন হোসেন কতটা সচেতন ছিলেন, তার একটি উদাহরণ দিয়েছেন শফিকুল কবির তাঁর ‘সিরাজ ভাইয়ের শেষ কথা’ নামের স্মৃতিচারণে। তিনি বলছেন, “আগস্টের (১৯৭১) মাঝামাঝি ঢাকা বেতারের দুজন কর্মকর্তাকে সিরাজ ভাইয়ের কাছে নিয়ে এলাম। তাঁরা মুজিবনগর যেতে চায়। সিরাজ ভাই তাঁদের সম্মতি দিলেও (অবশ্য ব্যক্তিগত কারণে শেষপর্যন্ত তাঁরা এখানেই থেকে গেছেন) আমাকে পরে ধমকালেন। কোন যুক্তিতে তাদের বিশ্বাস করে সিরাজ ভাইয়ের কাছে নিয়ে এসেছিলাম, তাঁর ব্যাখ্যা চাইলেন। তাঁরা আমার বন্ধুপর্যায়ভুক্ত, এর বেশি কোনো যুক্তি আমার কাছে ছিল না। তিনি বললেন, ‘না, এক্ষেত্রে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়- স্বজন কাউকেই সহজ দৃষ্টিতে বিশ্বাস করা যাবে না। ভাই হয়ে ভাইকে ধরিয়ে দিচ্ছে, খুন করছে এমন ঘটনা এ পরিস্থিতিতে বিরল নয়।'” তিনি আরো লিখেছেন, “সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ৩০ নভেম্বর, মঙ্গলবার। ‘ইত্তেফাক’-এ তাঁর জন্য বসে অপেক্ষা করছি। বাইরের কি কাজ সেরে তিনি অফিস এলেন সাড়ে বারোটার দিকে। অফিস কক্ষে প্রথমেই রাইটিং প্যাড টেনে নিয়ে খুব দ্রুত কিছু লিখতে লাগলেন। মাত্র একটি স্লিপ লেখার পরই অফিস কক্ষে অন্যান্য লোকজন ঢুকে গেল। তিনি লেখা বন্ধ করলেন। লেখা স্লিপটি সতর্কভাবে গুঁজে দিলেন আমার হাতে। কিছুক্ষণ পর লোকজনের ভিড় কমলে তিনি বললেন, ‘অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে এই তথ্যগুলো আমি পেয়েছি। তোকে আরও কিছু জোগাড় করে দেব। এগুলো ওপারে পাচার করার ব্যবস্থা করতে হবে।’ সিরাজ ভাইয়ের লেখা সেই স্লিপটি এখনো সঙ্গে করে বয়ে বেড়াচ্ছি। তার হুবহু অনুলিপি তুলে ধরছি।
ঈমানের বরকতে
১. মন্ত্রী আবুল কাশেম-ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়ের মালিক, বর্তমান নাম কাশেম টেক্সটাইল মিলস।
২. মওলানা আমিনুল ইসলাম-সদরঘাটের বিখ্যাত ব্রাহ্মসমাজ লাইব্রেরী ও যাবতীয় সম্পত্তির মালিক। এপ্রিলের প্রথমভাগে লাইব্রেরী লুট করিয়ে ১০ টাকা মণ দরে বই বিক্রি করেন। এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকাও ওই একই দরে বিক্রি হয়। সম্প্রতি নিজ নামে অ্যালট করিয়ে দখলীদার।
৩. মওলানা আবদুল মান্নান-মদন মোহন মন্দির ভবনের বর্তমান মালিক।
সংক্ষেপে সিরাজ ভাই লিখলেও এখানে অস্পষ্ট কিছু নেই। পাক সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ফন্দি-ফিকির করে দালাল কোম্পানি কীভাবে মানুষের ধন-সম্পদ লুন্ঠন ও আত্মসাত্ করত, এইটি তার একটি নমুনা মাত্র।”
মুক্তিযুদ্ধের সময় সিরাজুদ্দীন হোসেন ‘ইত্তেফাক’-এর পাতায় সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় লিখেছেন এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করেছেন। সে সময় এ রকম সাহস দেখানো ছিল রীতিমত ভয়ঙ্কর। যুদ্ধের সময় সিরাজুদ্দীন হোসেন ‘ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়’ নামে একটি উপ-সম্পাদকীয় লেখেন। সেখানে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘যে দোষে শেখ মুজিবকে দোষী বলা হচ্ছে, পশ্চিমা রাজনীতিকরা সেই একই দোষে দুষ্ট।’ এ সময় জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র ‘দৈনিক সংগ্রাম’-এ ‘অতএব ঠগ বাছিও না’ নামে একটি উপ সম্পাদকীয় লিখে জনাব হোসেনকে পরোক্ষভাবে মৃত্যুর হুমকি দেয়। কিন্তু এসব হুমকি তাঁর কলমকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। সকল বাধা উপেক্ষা করে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি সংবাদ পরিবেশন করেছেন বস্তুনিষ্ঠভাবে।
১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর তাঁকে তাঁর শান্তিনগর, চামেলীবাগের ভাড়া বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানী বাহিনী ও আলবদর বাহিনীর লোকেরা। এর পর তিনি আর ফিরে আসেননি।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
নাম : সিরাজুদ্দীন হোসেন
জন্ম : ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে তত্কালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার শালিখা থানার শরুশুনা গ্রামে তাঁর জন্ম (বর্তমানে তা মাগুরা জেলা)।
পড়াশোনা : ঝিকরগাছা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর যশোর মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলেজ থেকে আই.এ. পাশ করেন। আই.এ. পাশ করার পর সিরাজুদ্দীন হোসেন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে বি.এ. পড়া শুরু করেন। কলেজ জীবনে বই কেনার মতো আর্থিক স্বচ্ছলতা তাঁর ছিল না। অন্যের বই আর শিক্ষকদের লেকচারের উপর ভিত্তি করে নোট তৈরি করেই তিনি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতেন। ১৯৪৭ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি ‘দৈনিক আজাদ’-এ সাংবাদিকতা শুরু করেন।
কর্মজীবন : ১৯৪৭ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি ‘দৈনিক আজাদ’-এ সাংবাদিকতা শুরু করেন। কালক্রমে তিনি ‘আজাদ’-এর বার্তা সম্পাদক হন। সমসাময়িককালে এত অল্প বয়সে বার্তা-সম্পাদকের পদে কাজ করার সৌভাগ্য আর কারো হয়নি।
১৯৫৪ সালে ‘আজাদ’-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর তিনি ঢাকার ইউএসআইএস অফিসে জুনিয়র এডিটর হিসবে কিছুদিন কাজ করেন। এক বছর পর তিনি ‘ইত্তেফাক’-এর বার্তা সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি ‘ইত্তেফাক’-এই কর্মরত ছিলেন।
মৃত্যু : ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর তাঁকে তাঁর শান্তিনগর, চামেলীবাগের ভাড়া বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানী বাহিনী ও আলবদর বাহিনীর লোকেরা। এর পর তিনি আর ফিরে আসেননি।
লেখক : জাহীদ রেজা নূর (সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে)