আশির দশকে নারী ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইনি সহায়তা দেয়ার জন্য হামিদা হোসেনসহ আরও কয়েকজন মিলে প্রথমে একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের কথা ভাবেন এবং সেটির নাম দেন ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’। তাঁরা নয়জন মিলে এটি প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে তাঁরা সহ জুনিয়র আইনজীবী এবং শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করতেন। প্রথমে তাঁদের এক বন্ধু ধানমন্ডিতে একটি গ্যারেজ দেন ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’র অফিস করার জন্য। পরে এই অফিসটি পুরানা পল্টনে স্থানান্তরিত হয়। প্রথম অফিসটিতে তাঁরা সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে দিয়ে সারা দিন বসে থাকেন। কিন্তু কেউ আসে না সহায়তা নেয়ার জন্য। কারণ এসব দরিদ্র মানুষরা তাঁদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। তাছাড়া প্রথমে তাঁরা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না টাকা-পয়সা ছাড়া কেউ এরকম সহায়তা দিতে পারে। এরকম অবস্থায় হামিদা হোসেন সহ অন্যান্যরা হতাশ হয়ে পড়েন।
কিন্তু পরে তারা এসব মানুষের বাড়িতে বাড়িতে যেয়ে তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেন এবং তাঁদেরকে ফ্রী সহায়তা দেয়ার কথা জানান। হামিদা হোসেনরা যখন সুবিধা বঞ্চিত এসব নারীদেরকে তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেন তখন তাঁরা খুব অবাক হয়ে বলেন, ‘সত্যিই কী এটি আমাদের অধিকার?’ দরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিত এসব মানুষরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জানার পর সহায়তা নেয়ার জন্য ধীরে ধীরে আইন ও সালিশ কেন্দ্রে আসতে শুরু করেন।
এভাবে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে গড়ে তোলেন আজকের সবার কাছে সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান আইন ও সালিশ কেন্দ্র। সাধারণ মানুষের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই যে প্রতিষ্ঠানটির মুখ্য উদ্দেশ্য। ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্যমুলক কার্যক্রম বন্ধের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানটি মানবাধিকার রক্ষার্থে আইন সহিংসতা বন্ধ, বস্তি উচ্ছেদ কার্যক্রম বন্ধ, সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংঘটিত সহিংসতা বন্ধে কাজ করে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র সামাজিক ইতিবাচক কার্যক্রমকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি নীতি নির্ধারণেও ভূমিকা রাখছে।
তবে তিনি শুধু এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্যই নন বাংলাদেশে যাঁরা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন তিনি তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় নেত্রী। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে নির্যাতিত নারীদের অবস্থা দেখে তিনি অবহেলিত মানুষদের পক্ষে কাজ করার জন্য প্রেরণাবোধ করেন। সেই থেকে আজও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী, ইতিহাসবিদ ড. হামিদা হোসেন।
ড. হামিদা হোসেন পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের একটি শহর হায়দ্রাবাদে ১৯৩৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জেলা জজ ছিলেন। তাঁদের পারিবারিক উপাধি ছিল আকন্দ। হামিদা হোসেনের মা তুরস্কে বড় হন এবং ১৬ বছর বয়সে বিয়ের পর দেশে ফিরে আসেন। বাবা- মায়ের ছয় সন্তানের মধ্যে হামিদা সবার ছোট।
হামিদা হোসেনের শৈশব কেটেছে করাচিতে। জজ বাবা বিভিন্ন জেলায় বদলি হওয়াতে তাঁদের পড়াশোনার ক্ষতি হতো। ছেলে-মেয়েরা যাতে ভালো স্কুলে যেতে পারে সেজন্য হামিদা হোসেনের মা তাঁদেরকে নিয়ে করাচিতে থাকতেন।
হামিদা হোসেন করাচির একটি মিশনারী স্কুলে পড়ালেখা করেছেন। তিনি প্রতিদিন সাইকেলে করে স্কুলে যেতেন। করাচি তখন খুব সংস্কারমুক্ত শহর ছিল। সেখানে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান সম্প্রদায় সবাই মিলেমিশে বাস করত। কেউ কোন পার্থক্য বুঝতে পারত না।
১৯৪৬ সালে অসুস্থতার কারণে তাঁর বাবা অবসর গ্রহণ করায় তাঁরা হায়দ্রাবাদে চলে আসেন। তাঁর অন্যান্য ভাই-বোনদেরকে তখন বোডিং স্কুল-কলেজে পাঠানো হলেও সবার ছোট হওয়াতে তাঁকে তাঁর মা-বাবার সাথেই থাকতে হয়েছিল। হায়দ্রাবাদে এসে তিনি একটি মিশনারী স্কুলে ভর্তি হন। তাঁর পড়াশুনার মাধ্যম ছিল ইংরেজী আর দ্বিতীয় ভাষা ছিলো পার্সি। বাড়িতে মায়ের সাথে তাঁরা সিন্ধিতে কথা বলতেন। এই স্কুল থেকে ১৯৫১-৫২ সালে তিনি মেট্রিক পাশ করেন। ছোট বেলায় সাঁতার কাটতে এবং ডাকটিকেট সংগ্রহ করতে খুব পছন্দ করতেন তিনি। চাচাতো ভাই বোনরাও একই শহরে বাস করতো বলে ছোটবেলায় কখনো তাঁর খেলার সাথীর অভাব হয়নি।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলে করাচি পাকিস্তানের রাজধানী হয়। তবে সে সময় সিন্ধু প্রদেশে কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিলনা বরং হিন্দু- মুসলিম মিলেমিশে শান্তিপূর্ণভাবেই বাস করত। কিন্তু ১৫ই আগস্টের পর হিন্দুরা চলে যাওয়া শুরু করল। আস্তে আস্তে শহর খালি হয়ে গেল। তাঁর স্কুলে অনেক ছাত্র-ছাত্রী হিন্দু হওয়াতে ১৫ই আগস্টের পর তারাও চলে গেল। তারপর বাইরে থেকে মানুষ আসতে শুরু করলো এই এলাকায়, তাদের অনেকেই পাঞ্জাবের দাঙ্গাতে আহত হয়েছিল, তারা সবকিছু ছেড়ে এসেছিল। অনেক সিন্ধি পরিবার তাদেরকে চিকিৎসাসেবা এবং আশ্রয় দিয়েছিল। তাদের সুবিধার জন্য এর কিছুদিন পর সরকার বিশেষ আইন বলবৎ করেছিল। একে একে তারা হিন্দুদের ফেলে যাওয়া বাড়ি দখল করতে শুরু করল এবং তাদের চাকরীগুলো নিয়ে নিল। একটা সময় তারা সব রকম সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করল।
সেই সময়ে অনেক মুসলিম সিন্ধিরা তাদের মেয়েদের পড়ালেখা করতে পাঠাতো না। হামিদা হোসেনের পরিবার ছিল আলাদা প্রকৃতির। করাচিতে সেন্ট জোসেফ মিশনারিতে তিনি পড়ালেখা শুরু করেন। আর হায়দ্রাবাদে এসে ‘সেন্ট মেরী’স মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। হায়দ্রাবাদে কলেজের প্রথম বর্ষে পড়াশুনা করার সময় ‘নিউইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউন’-এর আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে ৩ মাস আমেরিকায় ভ্রমণের সুযোগ পান। সেখানে তিনি একটি আমেরিকান পরিবারের সাথে থেকে স্কুলে যেতেন। সতের বছর বয়সে তিনি বৃত্তি নিয়ে আমেরিকার ওয়েলেসলি কলেজে পড়তে যান। সেখানে তিনি ৩ বছর পড়ালেখা করেন। এরও অনেক পরে ‘৭০-এর দশকে হামিদা হোসেন অক্সফোর্ডের ‘সেন্ট এন্টোনি’স কলেজ থেকে আধুনিক ইতিহাসের ওপর পিএইচডি করেছেন। তাঁর থিসিসের বিষয় ছিল “ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে বাংলার বস্ত্রশিল্পের উৎপাদন”।
আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পরে তিনি করাচিতে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স-এর গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে তাঁকে জার্নাল সম্পাদনা করতে হতো। এরপর তিনি করাচীতে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ঢাকায় আসার পর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের ঢাকা অফিসে যোগ দেন। এছাড়াও তিনি করাচি থেকে প্রকাশিত রাজনৈতিক সাপ্তাহিক ‘আউটলুক’ -এ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেছেন। আইয়ুব খানের সামরিক সরকার এক সময় এটি বাজেয়াপ্ত করে। ১৯৬৮ সালে তাঁরা কিছু বন্ধু ‘ফোরাম’ নামের একটি রাজনৈতিক সাপ্তাহিক বের করার সিদ্ধান্ত নিলে হামিদা হোসেন এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রেহমান সোবহান ছিলেন এর নির্বাহী সম্পাদক। ১৯৭১ সালে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল মার্চের ৩য় সপ্তাহে।
স্বাধীনতার পর তিনি মুক্তিযুদ্ধে স্বামী-সন্তান হারা বিধবা অসহায় নারীদের জন্য কাজ করেন। সেই সময় সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে তাদেরকে সাহায্য করেন। ১৯৭৪ সালে তাঁরা সামগ্র বাংলাদেশ থেকে সংগৃহীত কারুশিল্প নিয়ে জাতীয় পর্যায়ের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। এই প্রদর্শনীটি ‘কারিকা’ এবং ‘হস্তশিল্পী সমিতি’ গঠনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কারিকাতে হামিদা হোসেন ২/৩ বছর মহাসচিব হিসেবে কাজ করেন। এরপর রওশন জাহান ও সালমা সোবহানের সাথে গার্মেন্টস শিল্পে নারী শ্রমিকদের উপর একটি গবেষণা শেষ করেন। পরবর্তীতে এই গবেষণার প্রতিবেদন ইউনির্ভাসিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও তিনি নাগরিক উদ্যোগ ও রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস বাংলাদেশ (রিইব) নামের আরও দুটি প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। এই প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত ভূমি বিষয়ক বিবাদ নিষ্পত্তি বিশেষ করে ভূমিহীন পরিবারের নারীদের অধিকারের বিষয়টি নিয়ে কাজ করে এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে গবেষণায় সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে তাদের জীবন জীবিকার মানোন্নয়নের পথ খুঁজে বের করতে সহায়তা করে।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শুরু করে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের রিসার্চ এন্ড এ্যাডভোকেসি পরিচালক হিসেবে প্রায় ২৯ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এখানে তিনি মানবাধিকার, সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা বিশেষত নারী অধিকার ইত্যাদি সম্পর্কিত গবেষণার কাজও করেছেন।
জীবনে অনেক বড় বড় পুরস্কার না পেলেও তিনি তাঁর কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট। নারী অধিকার এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যাদের সাথে কাজ করেন তাদেরকে এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে সচেতন করে সক্রিয় কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে পারাটাকেই তিনি তাঁর জীবনের একটা বড় অর্জন বলে মনে করেন।
শিক্ষাজীবনে একটি দৈনিক পত্রিকা আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার হিসেবে তিনি রবীন্দ্র রচনাবলী পেয়েছিলেন। যা তাঁকে এখনো আনন্দ দেয়। নারী অধিকার এবং মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার জন্য ‘অনন্যা শীর্ষ দশ’ পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।
কর্মজীবনের ব্যস্ততার মাঝেও হামিদা হোসেন তাঁর লেখালেখি অব্যাহত রেখেছেন। ১৯৮৮ সালে “Company Weavers of Bengal: Textile Production for the East India Company1750-1813 ” নামে তাঁর থিসিসটি ইউনিভার্সিটি প্রেস, নিউ দিল্লী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৯০ সালে সালমা সোবহান এবং রওশন জাহানের সাথে তাঁর লেখা No Better Options? Women Workers in Bangladesh ” ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৯২ সালে Cole P. Dodge এবং এফ. এইচ. আবেদের সাথে সহ সম্পাদক হিসেবে “Crisis and Development: Coping with Disaster in Bangladesh” বইটি ইউ.পি.এল. থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৯১ সালে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ পূর্বে চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার সাইক্লোন আক্রান্ত হবার পর সবার ভিন্ন ভিন্ন ত্রাণ এবং পুনর্বাসনের অভিজ্ঞতার প্রবন্ধসমূহ সংকলিত হয়েছিল বইটিতে।
১৯৮৭ সালে Oxford University Papers on India, Volume-1 Gi part 2 তে বস্ত্রশিল্পের ইতিহাসের ওপর এবং ১৯৯৬ সালে বস্ত্র এবং বাণিজ্য (Cloth and Commerce) নিয়ে বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সাময়িকী যেমন- Economic and Social History Review, Delhi; Journal of Social Science; Journal of the Asiatic Society of Bangladesh, Dhaka ইত্যাদিতে লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
বিভিন্ন সাময়িকীতে হস্তশিল্পের ওপর তাঁর লেখা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশে মানবাধিকার নামক বইটি তিনি (১৯৯৬ এবং ২০০৭ সালে একটি বার্ষিক প্রতিবেদন) সম্পাদনা করেছেন।
এছাড়াও মানবাধিকার বা নারী অধিকার এর ওপর তাঁর অনেক লেখা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা এবং জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের সাথে হামিদা হোসেন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান থেকে ঢাকার পরীবাগে তাঁর বোনের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। এসে জানলেন এখানে নিউ ভ্যালুস ক্লাব রয়েছে। অধ্যপক খান সারওয়ার মুরশিদ, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ শিক্ষাবিদ এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ড. কামাল হোসেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ান। হামিদা হোসেনের বোনের স্বামীও ঐ ক্লাবের সাথে ঘনিষ্ট। আর সেই সুবাদে ১৯৬২ সালেই ড. কামাল হোসেনের সাথে তাঁর প্রথম দেখা হয় এবং দেখা থেকে প্রেম। এর দু’বছর পর ১৯৬৪ সালে লন্ডনে তাঁদের বিয়ে হয়। ঘটা করে নয় সাদামাটা ভাবে তাঁদের বিয়ে সম্পন্ন হয়।
হামিদা হোসেনের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে সারা একজন আইনজীবী। ছোট মেয়ে দিনা চিত্রপরিচালক।
হামিদা হোসেন মনে করেন, সমাজ ও পরিবার উভয়ক্ষেত্রেই গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে। নারীদের ক্ষেত্রে এটা বিশেষ করে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ নারীরা প্রধানত পরিবারের অধনস্ত হয়ে থাকে আর এখান থেকেই পারিবারিক সন্ত্রাসের শুরু হয়। নারীরা পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে আর সমাজে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নীতি ও আইন সংস্কারের জন্য সংগ্রাম করে আসছে। নারী সংগঠনগুলি অনেক দূর এগিয়েছে, কিছু কিছু নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে, তারপরও লিঙ্গ বৈষম্য আর সমধিকারের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: ড. হামিদা হোসেন পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের একটি শহর হায়দ্রাবাদে ১৯৩৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জেলা জজ ছিলেন। তাঁদের পারিবারিক উপাধি ছিল আকন্দ। হামিদা হোসেনের মা তুরস্কে বড় হন এবং ১৬ বছর বয়সে বিয়ের পর দেশে ফিরে আসেন। বাবা- মায়ের ছয় সন্তানের মধ্যে হামিদা সবার ছোট।
পড়াশুনা: জজ বাবা বিভিন্ন জেলায় বদলি হওয়াতে তাঁদের পড়াশোনার ক্ষতি হতো। ছেলে-মেয়েরা যাতে ভালো স্কুলে যেতে পারে সেজন্য হামিদা হোসেনের মা তাঁদেরকে নিয়ে করাচিতে থাকতেন। হামিদা হোসেন করাচির একটি মিশনারি স্কুলে পড়ালেখা করেছেন। তিনি প্রতিদিন সাইকেলে করে স্কুলে যেতেন।
১৯৪৬ সালে অসুস্থতার কারণে তাঁর বাবা অবসর গ্রহণ করায় তাঁরা হায়দ্রাবাদে চলে আসেন। তাঁর অন্যান্য ভাই-বোনদেরকে তখন বোর্ডিং স্কুল-কলেজে পাঠানো হলেও সবার ছোট হওয়াতে তাঁকে তাঁর মা-বাবার সাথেই থাকতে হয়েছিল। হায়দ্রাবাদে এসে তিনি একটি মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। তাঁর পড়াশোনার মাধ্যম ছিল ইংরেজী আর দ্বিতীয় ভাষা ছিলো পার্সি। বাড়িতে মায়ের সাথে তাঁরা সিন্ধিতে কথা বলতেন। এই স্কুল থেকে ১৯৫১-৫২ সালে তিনি মেট্রিক পাশ করেন।
এরপর হায়দ্রাবাদের একটি কলেজে ভর্তি হন তিনি। হায়দ্রাবাদের এই কলেজে প্রথম বর্ষে পড়াশুনা করার সময় নিউইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউন-এর আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে ৩ মাস আমেরিকায় ভ্রমণের সুযোগ পান। সেখানে তিনি একটি আমেরিকান পরিবারের সাথে থেকে স্কুলে যেতেন। সতের বছর বয়সে তিনি বৃত্তি নিয়ে আমেরিকার ওয়েলেসলি কলেজে পড়তে যান। সেখানে তিনি ৩ বছর পড়ালেখা করেন। এরও অনেক পরে ‘৭০-এর দশকে হামিদা হোসেন অক্সফোর্ডের ‘সেন্ট এন্টোনি’স কলেজ থেকে আধুনিক ইতিহাসের ওপর পিএইচডি করেছেন। তাঁর থিসিসের বিষয় ছিল “ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে বাংলার বস্ত্রশিল্পের উৎপাদন”।
কর্মজীবন: আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পরে তিনি করাচিতে ‘পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স’-এর গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে তাঁকে জার্নাল সম্পাদনা করতে হতো। এরপর তিনি করাচিতে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ঢাকায় আসার পর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের ঢাকা অফিসে যোগ দেন। এছাড়াও তিনি করাচি থেকে প্রকাশিত রাজনৈতিক সাপ্তাহিক ‘আউটলুক’ -এ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেছেন। আয়ুব খানের সামরিক সরকার এক সময় এটি বাজেয়াপ্ত করে। ১৯৬৮ সালে তাঁরা কিছু বন্ধু ‘ফোরাম’ নামের একটি রাজনৈতিক সাপ্তাহিক বের করার সিদ্ধান্ত নিলে হামিদা হোসেন এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রেহমান সোবহান ছিলেন এর নির্বাহী সম্পাদক। ১৯৭১ সালে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল মার্চের ৩য় সপ্তাহে।
স্বাধীনতার পর তিনি মুক্তিযুদ্ধে স্বামী-সন্তান হারা বিধবা অসহায় নারীদের জন্য কাজ করেন। সেই সময় সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে তাদেরকে সাহায্য করেন। ১৯৭৪ সালে তাঁরা সামগ্র বাংলাদেশ থেকে সংগৃহীত কারুশিল্প নিয়ে জাতীয় পর্যায়ের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। এই প্রদর্শনীটি ‘কারিকা’ এবং ‘হস্তশিল্পী সমিতি’ গঠনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কারিকাতে হামিদা হোসেন ২/৩ বছর মহাসচিব হিসেবে কাজ করেন। এরপর রওশন জাহান ও সালমা সোবহানের সাথে গার্মেন্টস শিল্পে নারী শ্রমিকদের উপর একটি গবেষণা শেষ করেন। পরবর্তীতে এই গবেষণার প্রতিবেদন ইউনির্ভাসিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও তিনি নাগরিক উদ্যোগ ও রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস বাংলাদেশ (রিইব) নামের আরও দুটি প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। এই প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত ভূমি বিষয়ক বিবাদ নিষ্পত্তি বিশেষ করে ভূমিহীন পরিবারের নারীদের অধিকারের বিষয়টি নিয়ে কাজ করে এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে গবেষণায় সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে তাদের জীবন জীবিকার মানোন্নয়নের পথ খুঁজে বের করতে সহায়তা করে।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শুরু করে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের রিসার্চ এন্ড এ্যাডভোকেসি পরিচালক হিসেবে প্রায় ২৯ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এখানে তিনি মানবাধিকার, সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা বিশেষত নারী অধিকার ইত্যাদি সম্পর্কিত গবেষণার কাজও করেছেন।
সংসার জীবন: ১৯৬৫ সালে আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের সাথে হামিদা হোসেন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান থেকে ঢাকার পরীবাগে তাঁর বোনের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। এসে জানলেন এখানে নিউ ভ্যালুস ক্লাব রয়েছে। অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ শিক্ষাবিদ এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ড. কামাল হোসেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ান। হামিদা হোসেনের বোনের স্বামীও ঐ ক্লাবের সাথে ঘনিষ্ট। আর সেই সুবাদে ১৯৬২ সালেই ড. কামাল হোসেনের সাথে তাঁর প্রথম দেখা হয় এবং দেখা থেকে প্রেম। এর দু’বছর পর ১৯৬৪ সালে লন্ডনে তাঁদের বিয়ে হয়। ঘটা করে নয় সাদামাটা ভাবে তাঁদের বিয়ে সম্পন্ন হয়।
হামিদা হোসেনের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে সারা একজন আইনজীবী। ছোট মেয়ে দিনা চিত্রপরিচালক।
মূল লেখক : ফাতেমা বেগম লাবনী
পুনর্লিখন : মৌরী তানিয়া