সেলিনা হোসেন একই সাথে কথাসাহিত্যিক, গবেষক এবং প্রাবন্ধিক। তাঁর লেখার জগত্ বাংলাদেশের মানুষ, তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। জীবনের গভীর উপলব্ধির প্রকাশকে তিনি শুধু কথাসাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, শাণিত ও শক্তিশালী গদ্যের নির্মাণে প্রবন্ধের আকারেও উপস্থাপন করেছেন। বেশ কয়েকটি উপন্যাসে তিনি বাংলার লোক-পুরাণের উজ্জ্বল চরিত্রসমূহকে নতুনভাবে এনেছেন। তাঁর উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে সমকালের সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব্ব সংকটের সামগ্রিকতা। বাঙালির অহংকার ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তাঁর লেখায় নতুনমাত্রা যোগ করেছে।
জন্ম ও পরিবার
সেলিনা হোসেনের পৈতৃক নিবাস বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার হাজীরপাড়া গ্রামে।। বাবা এ কে মোশাররফ হোসেন ছিলেন রাজশাহী রেশম শিল্প কারখানার পরিচালক। মা মরিয়মন্নেসা বকুল ছিলেন গৃহিণী। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ছিলেন। স্বামীর চাকরির টাকা দিয়ে সংসারের সব খরচ সুন্দরভাবে চালাতেন, খুব ভালো রান্না করতেন। ছেলেমেয়েরা কে কোথায় পড়াশুনা করবে তার সিদ্ধান্তও নিজেই নিতেন। অবসর সময়ে রেডিওতে খেয়াল শুনতেন, বাগান করতেন আর ফুলগাছ ভালোবাসতেন।
সেলিনা হোসেনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন রাজশাহী শহরে। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। তাঁর বড় বোনের নাম সুরাইয়া। সুরাইয়া ১৯৫৪ সালে ভারতেশ্বরী হোমস থেকে ইস্ট পাকিস্তান এডুকেশন বোর্ডে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় মেধা তালিকায় অষ্টম স্থান অধিকার করেন। ভাইবোনেরা সবাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
শৈশবকাল
বাবার কর্মস্থল বগুড়ায় তাঁর শৈশব কাটে। শৈশবে তিনি অবাধ স্বাধীনতা ও উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠেন। মাঠে ঘাটে, প্রান্তরে, নদীতে, ঘুরে বেড়ানো, গাছ বাওয়া, কখনও অনেক উচুঁ গাছে চড়ে বাবাকে দেখে বকা খাওয়ার ভয়ে লাফ দিয়ে পালিয়ে যাওয়া, ভাইবোন এবং অন্যান্য ছেলেমেয়ের সঙ্গে হল্লা করতে করতে স্কুলে যাওয়া ছিল তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক কাজের একটি। তাঁরা যেখানে থাকতেন সেটা ছিলো রেশম চাষের এলাকা। বিশাল বিশাল তুতের বাগান। তাঁর বাবা ছিলেন সেই অফিসের বড়বাবু। সেই এলাকার ভেতরে ছিলো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসস্থান, ডাকবাংলো রেশম-কীট পোষার ঘর। তুতের বাগান পার হয়ে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের পাকা সড়ক ধরে পুলিশ লাইনের ভেতর দিয়ে কিংবা পাশ দিয়ে স্কুলে যেতেন। স্কুল থেকে ফেরার পথে টিলায় উঠে পুলিশদের বন্দুকের গুলি থেকে বেরিয়ে আসা সীসা কুড়িয়ে হানিফের দোকান থেকে মুড়ি- মুড়কি, খুব ছোট ছোট রঙিন লজেন্স নিয়ে চিবুতে চিবুতে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের পাকা সড়ক ধরে বাড়ি ফেরার মধ্যে পেতেন এক অনাবিল আনন্দ। বাড়ির কাছাকাছি এসে কে আগে পৌঁছবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলতো চার ভাইবোনের মধ্যে। বাড়ি ফিরে পেটপুরে ভাত খেয়ে ছুটতেন মাঠের দিকে। গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, ছি-বুড়ি ইত্যাদি একেকরকম খেলা খেলতেন একেকদিন। সন্ধ্যা নামলেই ঘরে ফিরে হারিকেনের আলোয় পড়তে বসতেন।
তাঁর বাবা ছিলেন ভীষণ রাগী। ফলে বাবাকে ভাইবোনেরা খুব ভয় পেতেন। চার-পাঁচ বছর বয়সের ছোট বোন লাকির মৃত্যু তাঁর বাবাকে একদম বদলে দেয়। লাকির নেফ্রাইটিস অসুখ হয়েছিল। সে সময়ে ভালো চিকিত্সা না থাকায় লাকির নানারকম চিকিত্সা চলতে লাগল। একজন কবিরাজ লাকিকে রাতে ধানের ওপর বসে থাকা শিশির খাওয়ানোর উপদেশ দেন। ছোট বোনকে সুস্থ করার জন্য ভাইবোনদের সঙ্গে তিনিও ধানক্ষেতে গিয়ে শিশির ঝরিয়ে বাটি ভরে নিয়ে আসতেন। কিন্তু এরপরও ছোট বোনকে হারাতে হলো। কন্যাকে হারিয়ে তাঁর বাবা একেবারে শান্ত হয়ে যান। আর কোনোদিন কোনো ছেলেমেয়ের গায়ে হাত তোলেননি।
শিক্ষাজীবন
পঞ্চাশ দশকে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় বগুড়ার লতিফপুর প্রাইমারি স্কুলে। সেসময়ে কাগজ কলমে লেখার রেওয়াজ না থাকায় পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত তিনি স্লেটে লিখতেন। স্লেটে শিক্ষক তাদের বিভিন্ন প্রশ্ন লিখতে দিতেন এবং সেগুলো ঠিক হলো কিনা একজন আরেকজনকে যাচাই করতে দিতেন। একবার শিক্ষক একজনের স্লেট অন্যজনকে শুদ্ধ করতে দেন। তাঁর কাছে যার স্লেটটি পড়ে সে তাঁর স্লেটে সঠিক উত্তরের জায়গায় টিক মার্ক এবং ভুল উত্তরের জায়গায় ক্রস চিহ্ন দেন। কিন্তু তাঁর স্লেটটি যে ছেলেটির হাতে পড়ে সে দুষ্টুমি করে সঠিক বানান হিজিবিজি করে কেটে দিয়ে স্লেটটি স্যারকে দেখায়। ফলে বোঝাই গেল না স্লেটে কী লেখা ছিল। এটা দেখে তিনি রাগে দুঃখে ভীষণ কাঁদেন। কিন্তু সাহস করে স্যারকে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ছেলেটি তার যেসব বানান কেটেছে সেগুলো মুছে তিনি আবার লিখে দিবেন। স্যারের অনুমতি মিলল। তিনি বানানগুলো শুদ্ধ করে লিখে স্যারকে দেখান। স্যার তো ছেলেটির কূটবুদ্ধি দেখে ভীষণ রেগে গিয়ে দু’ঘা লাগিয়ে দেন। পাশ থেকে অন্য সহপাঠীরা এ নিয়ে তাঁকে ব্যঙ্গ করে বলল, ‘দেখতে পুঁচকে হলে কী হবে, সাহস আছে।’ তিনি তাদের কথা গায়ে মাখলেন না বরং না শোনার ভান করে এড়িয়ে গেলেন। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রতিদিন তাদের একটি লাইন উচ্চারণ করাতেন ‘কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল’। সকলের সঙ্গে তিনিও চিত্কার করে লাইনটি বলতে আনন্দ পেতেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি বগুড়ায় ভি, এম (ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল) গার্লস স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। বাবার বদলির চাকরির কারণে এরপর তাঁরা রাজশাহীতে চলে আসেন। এখানে এসে রাজশাহীর পি এন গার্লস স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। এই বিদ্যালয় থেকে ১৯৬২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপর রাজশাহী মহিলা কলেজে আই এ ক্লাসে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন এই কলেজের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী।
কলেজ শিক্ষক প্রফেসর আব্দুল হাফিজ ১৯৬৩-৬৪ সালে এ্যালেন গিন্সবার্গের ‘হাউল’ বইটি তাকে পড়তে দেন। বইটি পড়ে তিনি অভিভূত হয়ে যান। তাঁর লেখালেখির শুরু ৬৪ বা ৬৫ সালের দিকে। এসময় তার শিক্ষক আব্দুল হাফিজ তাকে পরামর্শ দেন, যদি সে শুধুমাত্র মেয়েদের পাতায় লেখালেখি করে তাহলে সেও একটা বৃত্তের মধ্যে আটকে যাবে। রাজশাহী কলেজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ১৯৬৪ সালে রাজশাহী আন্তঃবিভাগীয় সাহিত্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। তিনি এই প্রতিযোগিতায় গল্প লিখে প্রথম হয়ে চ্যাম্পিয়ানশিপ গোল্ড মেডেল পান। বিষয়গুলো ছিল বাংলা ও ইংরেজী কবিতা আবৃত্তি, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা, ছোট গল্প লেখা, ইংরেজীতে নির্ধারিত বক্তৃতা। এ বছরই রাজশাহী মহিলা কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে শিক্ষকরা শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসের নাট্যরূপ মঞ্চস্থ করেন। তাঁরা সেলিনা হোসেনকে ‘মেহেরজান’-এর ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য নির্বাচিত করেন। এটা ছিল তাঁর জীবনের প্রথম অভিনয়। তাঁর বিপরীতে তাতারীর ভূমিকায় অভিনয় করে তাঁরই বান্ধবী সুফিয়া। সুফিয়া ছিলো বেশ বড়সড় লম্বা। আর ওর পাশে তাঁকে বেশ ছোট মনে হতো। রিহার্সেলের সময় সবাই তাঁকে নিয়ে হাসতো। ওদের হাসি দেখে তিনি নার্ভাস হয়ে যেতেন। কিন্তু মঞ্চে অভিনয়ের সময় দু’জনের অসম উচ্চতার কথা ভুলে চরিত্রের মাঝে মিশে চমত্কার অভিনয় করে সুনাম অর্জন করেন। সেলিনা হোসেন রাজশাহী মহিলা মহাবিদ্যালয় থেকে আই.এ. পাশ করে ঐ কলেজেই অনার্স ক্লাসে ভর্তি হন। তাঁদের নিয়েই কলেজটি অনার্স খোলার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু একবছর পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পাওয়ায় তিনি ও আর সহপাঠী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ মাযহারুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন। অধ্যক্ষ তাঁদের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি করতে অপারগতা প্রকাশ করে প্রথম বর্ষে ভর্তি হবার পরামর্শ দেন। একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে একটা বছর নষ্ট হয়ে যাবে একথা ভেবে তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। তাই তাঁরা দুজনে উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসউল হকের সঙ্গে দেখা করে নিজেদের সমস্যার কথা জানান। উপাচার্য তাঁদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। এর কয়েকদিন পর বাংলা বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানেন তাঁরা দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হতে পারবেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ঢাকার ‘পূবালী’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প ছাপা হয়। ড. মাযহারুল ইসলাম, ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এবং ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলামের সম্পাদনায় ‘উত্তর অন্বেষা’, ‘পূর্বমেঘ’ এবং ঢাকার ‘মাহে নও’, ‘পূবালী’ পত্রিকাতে তাঁর লেখা ছাপা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে তিনি রাজনীতিতে অংশ নেন। তিনি ছাত্রী ইউনিয়নে (মতিয়া গ্রুপে) যোগ দেন। দলের পক্ষে সভা-মিছিলে অংশ নেন। তিনি মন্নুজান হলের ছাত্রী সংসদের সাধারণ সম্পাদিকা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের (রাকসু) দু’বার সহকারী কমনরুম সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র পরিষদ বছরে একবার সাহিত্য প্রতিযোগিতার এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। তিনি ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করাসহ নাটকে অভিনয় করেন। সে সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক এবং জিন্নাহ হলের প্রভোষ্ট ছিলেন ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। জিন্নাহ হলের বার্ষিক নাটকে অভিনয় করার জন্য তিনি সেলিনা হোসেনকে নায়িকা নির্বাচিত করে অভিনয় করতে বলেন। সেলিনা সঙ্গে সঙ্গে অভিনয় করতে প্রবল আপত্তি জানান। অধ্যাপক সিদ্দিকী তাঁর বাবার কাছে ফোন করে বলেন যে ‘আপনার মেয়ে আমার কথা শুনছেনা।’ শেষ পর্যর্ন্ত শিক্ষকের তাগাদা এবং বাবার বকাবকিতে তাঁকে রাজি হতে হয়। তিনি ‘ক্ষুধা’ নাটকে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য প্রতিযোগিতায় চারবার চ্যাম্পিয়ন হন।
কর্মজীবন
সেলিনা হোসেনের কর্মজীবন শুরু হয় বাংলা একাডেমীর গবেষণা সহকারী হিসেবে, ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে। তিনি ১৯৬৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে চাকরী পাওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকাতে উপসম্পাদকীয়তে নিয়মিত লিখতেন। ১৯৭০ সালে দুটো চাকরীর ইন্টারভিউয়ের জন্য চিঠি পান। একটি বাংলা একাডেমিতে অন্যটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে সরকারী কলেজের জন্য। বাংলা একাডেমীর চাকরীর ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন বাংলা একাডেমীর তৎকালীন পরিচালক কবীর চৌধুরী, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, আবদুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দীন প্রমুখ। তিনি বাংলা একাডেমীতে গবেষণা সহকারী পদের জন্য ইন্টারভিউ দেন। একই দিনে একই সময়ে সেখানে পান্ডুলিপি পাঠক পদেও ইন্টারভিউ হচ্ছিল। ড. মুহম্মদ এনামুল হক তাঁকে বললেন, ‘পুথি পড়তে পার?’ তিনি বলেন ‘পারি।’ ড. মুহম্মদ এনামুল হক সেলিনার দিকে তাকিয়ে চারশত বছর আগের পান্ডুলিপি ঠেলে দিয়ে বললেন ‘পড়ো।’ সেলিনা সুর করে পুথি পড়ে শোনান। কারণ এম এ ক্লাসে তাঁদের পুরনো পান্ডুলিপি পাঠ করা শেখানো হতো। ভীষণ রাগী পন্ডিত মানুষ ড. মুহম্মদ এনামুল হক তাঁর নিভূল পাঠ শুনে এমন একটি হাসি দেন যা সেলিনা কখনও ভুলেননি। ড. এনামুল হক তখনও জানতেন না যে ‘ড. মো. এনামুল হক স্বর্ণপদক প্রতিযোগিতায়’ যে প্রবন্ধটি জমা দিয়েছিলেন তার জন্য তিনিই নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেন প্রবন্ধটিও চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এর পাশাপাশি পাবলিক সার্ভিস কমিশনে সরকারি কলেজের চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে বোর্ডে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে পান। এম.এ. পাশ করার পরে তাঁর শিক্ষক আব্দুল হাফিজ তাঁকে বলেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে লেখা প্রকাশিত গল্পগুলো নিয়ে একটি বই করতে। যে বইটি তাঁর বায়োডাটাকে খানিকটুকু সমৃদ্ধ করবে। সে সময়ে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ঢাকা টেলিভিশনে বই বিষয়ে একটি অনুষ্ঠান করতেন। সেই অনুষ্ঠানে তিনি সেলিনা হোসেনের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উত্স থেকে নিরন্তর’ আলোচনা করেছিলেন। ইন্টারভিউ বোর্ডে মুনীর চৌধুরী সেলিনাকে বলেন, ‘গল্পগুলোতো ভালোই লিখেছ।’ কলেজের চাকরিটাও তাঁর হয়। তাঁকে পোস্টিং দেওয়া হয় সিলেটের এম সি কলেজে। সে সময়ে তাঁর ছোট মেয়ে লারার বয়স দু’মাস থাকায় তিনি কলেজের চাকরিটি গ্রহণ না করে সরকারি কলেজের থেকে অর্ধেক বেতনে বাংলা একাডেমীর চাকরিটিতে যোগদান করেন। সেসময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে আসা একটি মেয়ের ঢাকার মতো অজানা অচেনা বন্ধুহীন আত্মীয়হীন শহরে একসঙ্গে দুটো চাকরি যোগাড় করা খুব আয়াসসাধ্য কাজ ছিল না।
কর্মরত অবস্থায় তিনি বাংলা একাডেমীর ‘অভিধান প্রকল্প’, ‘বিজ্ঞান বিশ্বকোষ প্রকল্প’, ‘বিখ্যাত লেখকদের রচনাবলী প্রকাশ’, ‘লেখক অভিধান’, ‘চরিতাভিধান’ এবং ‘একশত এক সিরিজের’ গ্রন্থগুলো প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও ২০ বছরেরও বেশি সময় ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমীর প্রথম মহিলা পরিচালক হন। ২০০৪ সালের ১৪ জুন চাকুরি থেকে অবসর নেন।
পারিবারিক জীবন
ছোটবেলা থেকে এক অবাধ স্বাধীনতার মধ্যে বেড়ে ওঠেন সেলিনা। তাঁর বাবা-মা দুজনেরই একটি অসাধারণ গুণ ছিলো – মেয়েরা লেখাপড়া শিখবে। তাঁর বড় দুই বোন পড়তেন ভারতেশ্বরী হোমসে। তাঁর দাদা চাইতেন অল্প লেখাপড়া শিখিয়ে নাতনীদের বিয়ে দেবেন। কিন্তু তাঁর বাবা এর বিরোধিতা করেন। তাঁর মা ছোট ছেলের জন্মের সময় প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর বড় দুই বোন মাকে এ অবস্থায় রেখে হোস্টেলে ফিরতে রাজি হলেন না। মা মেয়েদের পড়াশুনার ক্ষতি করে নিজের কাছে রাখার পক্ষপাতি ছিলেন না। বরং মেয়েদের স্কুলে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তাঁর বাবার মাছ ধরা, শিকার করার নেশা ছিলো। বাবার সঙ্গে তিনিও শিকারে যেতেন। এছাড়া বাবা গ্রামের সাধারণ মানুষদের হোমিওপ্যাথিক চিকিত্সা করতেন। তিনি ছিলেন তাঁর কম্পাউণ্ডার। বাবার নির্দেশ পাওয়া মাত্র তিনি নির্দিষ্ট শিশি বের করে পুরিয়া বানিয়ে লোকজনকে দিতেন। এভাবে বাবার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। তাঁদের প্রতি বাবা মার উদার দৃষ্টিভঙ্গী তখন থেকেই তাঁকে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে। কলেজে পড়ার সময় বাড়িতে ঢাকা এবং লাইব্রেরি থেকে পত্রিকা আসত। এসময় থেকেই তাঁর পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অন্য বই পড়ার সুযোগ হয়। অনার্স পড়ার সময়ে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে তাঁর প্রেম হয়। তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পাত্র বাইশ বছরের বড় হওয়ায় অভিভাবকরা প্রথমে বিয়েতে বাধা দেন। পরে অভিভাবকের সম্মতিতে ১৯৬৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তাঁরা বিয়ে করেন। তাঁদের ঘর আলো করে জন্ম নেয় দুই কন্যা সন্তান-লাজিনা মুনা এবং ফারিয়া লারা। ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বরে স্বামী মারা গেলে তিনি দু’সন্তানকে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলেন। তাঁর মায়ের শরীরও ভালো যাচ্ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে হার্টের রোগে ভুগছিলেন। তাঁর বাসায় রেখে মায়ের চিকিত্সা সেবা করছিলেন। ১৯৭৩ সালে তাঁর মা মারা যান। এর কিছুদিন পর আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। আবার মেয়েরা বাবার স্নেহ ভালোবাসায় বেড়ে উঠতে থাকে। পুত্র সাকিব আনোয়ারের জন্ম ১৯৭৭ সালে। তিনি মেয়েদের ভর্তি করে দেন উদয়ন স্কুলে। পড়াশোনার পাশাপাশি ছেলেমেয়েরা ছবি আঁকা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়। ছবি এঁকে ছোট মেয়ে ফারিয়া লারা ১৯৭৮ সালে কোরিয়ান চিলড্রেন সেন্টার পুরস্কার, ১৯৭৯ সালে ফিলিপস বাংলাদেশ পুরস্কার, ১৯৮০ সালে নিপ্পন টেলিভিশন নেটওর্য়াক আয়োজিত প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক, ১৯৮৪ সালে ভারতের শংকর আন্তজার্তিক পুরস্কার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন আয়োজিত জাতীয় পর্যায়ে ‘নতুন কুঁড়ি’ প্রতিযোগিতায় উপস্থিত বক্তৃতায় পুরস্কার অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাজিনা মুনা ১৯৯১ সালে পাবলিক এডমিনিসট্রেশনে স্নাতক ও ১৯৯২ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ফারিয়া লারা ১৯৯২ সালে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক পাশের পরপরই পাইলট হওয়ার জন্য পাইলট প্রশিক্ষণে ভর্তি হন। মা হিসেবে সেলিনা হোসেন মেয়েকে একজন দায়িত্ববান পাইলট হবার জন্য পারিবারিক সহায়তা এবং উত্সাহ দেন। ১৯৯৪ সালে লারা ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাশ করেন।
এবছরই সেলিনা হোসেনের বাবা মারা যান। তখন তিনি লন্ডনে। বৃটিশ কাউন্সিলের বৃত্তি নিয়ে ৪ মাসের জন্য SOAS এ ড. উইলিয়াম বাভিচের সঙ্গে কাজ করেন। লন্ডনে থাকার কারণে বাবাকে আর শেষ দেখা হলো না তাঁর। এর দু’বছর পর লারা পাইলট প্রশিক্ষণে চমত্কার ফলাফল করে ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ সালে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অফ বাংলাদেশের কাছ থেকে প্রাইভেট পাইলটের লাইসেন্স অর্জন করেন। দু-বছর পরে ১৯৯৮ সালের ১৯ মার্চ লারা বাণিজ্যিক পাইলট লাইসেন্স লাভ করেন। এরপরই তিনি পাইলটদের প্রশিক্ষক হওয়ার প্রশিক্ষণ নেন। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম নারী যিনি এই পেশায় আসেন। পাইলট হতে ইচ্ছুক শিক্ষাথীদের ক্লাশ নেওয়ার পাশাপাশি উড্ডয়নের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। পঞ্চাশ ঘন্টার এই প্রশিক্ষণের শেষ দিনটি ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ সালে বরিশাল থেকে ঢাকায় ফেরার পর পোস্তগোলা এলাকায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে লারা মৃত্যুবরণ করে। পুরো পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। বড় মেয়ে লাজিনা মুনা ‘এইচ আই ভি এইডস’ এর ওপর লন্ডন স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন এন্ড হাইজিন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৩ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ছেলে সাকিব আনোয়ার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’বছর শিক্ষকতা করার পর এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে কর্মরত রয়েছে।
ক্ষেত্রভিত্তিক অবদান
ষাটের দশকের মধ্যভাগে রাজশাহী মহিলা কলেজে পড়ার সময়ে তাঁর লেখালেখির সূচনা। সেই সময়ের লেখা নিয়ে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উত্স থেকে নিরন্তর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। তাঁর দুটি গ্রন্থ ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ এবং ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। তাঁর কয়েকটি গল্প নিয়েও নাটক নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি বর্তমানে ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক। ১৯৯৮ সালের ১০ অক্টোবর তাঁর ছোট কন্যা ফারিয়া লারার শোকসভায় মেয়ের নামে কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন। পারিবারিক সিদ্ধান্তে ১৯৯৯ সালে ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন এবং মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার কথা ভেবে রাজেন্দ্রপুরের হালডোবা গ্রামে দুই কক্ষ বিশিষ্ট ‘মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা প্রকল্প’ প্রতিষ্ঠা করেন। অনানুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ভ্রাম্যমান চিকিত্সা কেন্দ্র খোলা হয়। ঢাকা থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা প্রতি শনিবার চিকিত্সাসেবা প্রদান করে। এসব চিকিত্সা সুবিধার মধ্যে ছিল নাক-কান-গলা, হৃদরোগ, চর্মরোগ ও অজীর্ণ অপুষ্টি ইত্যাদি বিষয়ক চিকিত্সা সেবা। চিকিত্সকরা বিনামূল্যে রুগী দেখেন এবং চিকিত্সাপত্রসহ সাধ্যমতো ওষুধ প্রদান করা হয়। এক বছরে এক হাজার রোগীর চিকিত্সা সেবা প্রদান করা হয়। ২০০০ সালের জানুয়ারির ১৫ তারিখ থেকে শুক্রবার ব্যতীত সপ্তাহের বাকি ছয়দিন নিয়মিত চিকিত্সা সেবা প্রদান করা হয়। এই ক্লিনিকের সময়সূচি সকাল ৮টা ৩০ মিনিট থেকে দুপুর ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। এখানে মা ও শিশুদের বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। পুরুষ রোগী এলেও তাদের চিকিত্সা সেবা প্রদান করা হয়। শনিবার দিন ঢাকা থেকে চার জন চিকিত্সক অর্থাত্ মেডিসিনের চিকিত্সক (অপুষ্টি রোগজনিত), গাইনী বিশেষজ্ঞ, চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ, জেনারেল ফিজিশিয়ান চিকিত্সা সেবা প্রদান করেন। অন্যান্য পাঁচ দিন একজন প্যারামেডিক ও দুইজন মেডিক্যাল সহকারী এবং একজন ক্লিনিক সহকারী সেবা প্রদান করেন। ২০০৫ সালের জানুয়ারি থেকে রোগীদের চিকিত্সা সেবাকে আরো প্রসার করার জন্য একটি প্যাথলজিক ইউনিট খোলা হয়। একজন প্যাথলজিক টেকনিশিয়ানের দ্বারা এটি পরিচালনা করা হয়। সপ্তাহে গড়ে ৮০০ থেকে ১ হাজার রোগী বিনামূল্যে চিকিত্সা সেবা পেয়ে থাকেন। এসব রোগীদের বিনামূল্যে এক সপ্তাহের ওষুধ দেওয়া হয়। এছাড়া রোগীদের রক্তের বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নামমাত্র মূল্যে করা হয়। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ২০০৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এখানে ১ লক্ষ ২৪ হাজার ১৬৭ জন রোগী চিকিত্সা সেবা পান। ২০০৬ সালের জানুয়ারি থেকে একজন মহিলা চিকিত্সককে মা ও শিশু রোগীদের সাবর্ক্ষণিকভাবে সেবা প্রদানের জন্য নিয়োগ প্রদান করা হয়। এছাড়া রাজেন্দ্রপুর হালডোবার ইমারজেন্সি রোগীদের জন্য ( জরুরি ভিত্তিতে ) দুটি শয্যা স্থাপন করা হয়। স্বাস্থ্য প্রশিক্ষকদের ভ্রাম্যমাণ ১২টি দল রাজেন্দ্রপুর সংলগ্ন ১২টি গ্রামে স্বাস্থ্য কর্মসূচি স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, এই ১২টি গ্রাম থেকে নারী ও পুরুষ মিলিয়ে ১২ জনকে স্বাস্থ্য সহকারীর প্রশিক্ষণ প্রদান করার ব্যবস্থা ইত্যাদির কাজ করা হয়েছে। এছাড়া ঐসব গ্রামে স্থানীয়ভাবে ধাত্রীবিদ্যায় পারদর্শীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে গর্ভবতী মায়েদের সন্তান প্রসবে যতোটা সম্ভব নিরাপত্তা এবং উপশম প্রদান করার ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করা হবে।
‘মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা’ প্রদানের পাশাপাশি সেলিনা হোসেন ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে গবেষণা ও প্রকাশনা নিয়ে কাজ করছে। সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠান থেকে ‘জেন্ডার বিশ্বকোষ’ প্রকাশ হয়। তিনি বরগুনা জেলায় ‘আমার অধিকার জানতে চাই, বুঝতে চাই’ এই শ্লোগানে মানবাধিকার, নারী ও শিশু অধিকার, শিক্ষা সংস্কৃতি এবং জেন্ডার বৈষম্য নিরসনে সচেতনতা কর্মসূচি নিয়ে কাজ করছেন। এই ইউনিয়নে চারটি স্কুল ও একটি কলেজ আছে। কলেজটি তাঁর শ্বশুরের জমির উপর প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর কন্যা লারার নামে প্রতি বছর এই কলেজের ২৫ জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হয়। সে সঙ্গে প্রতি বছর একাদশ শ্রেণীতে ভর্তিকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করা হয়। শিক্ষাসংস্কৃতির কর্মসূচির অপর দিকটি হচ্ছে প্রাইমারী পর্যায় থেকে ডিগ্রি শ্রেণীতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আনুষ্ঠানিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পুরস্কৃত করা। প্রাইমারী, মাধ্যমিক কলেজ পর্যায়ে একটি করে মোট তিনটি স্বর্ণপদক দেওয়া ছাড়াও ১২টি শ্রেণীতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারী মোট ৩৬ জনকে পুরস্কৃত করা হয়। ২০০২ সাল থেকে প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার আয়োজন করার মধ্য দিয়ে পরবর্তী এপ্রিল মাসের ১৬ তারিখে পাইলট লারার জন্মদিনে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়।
তিনি ‘জেন্ডার ইন মিডিয়া ফোরামে’র আহ্বায়ক। জেন্ডার ইন মিডিয়া ফোরাম মিডিয়া (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স) মাধ্যমে জেন্ডার বিষয়টাকে পর্যালোচনা এবং বিশ্লেষণ করে।
এছাড়াও তিনি গণ সাহায্য সংস্থা, রিসার্চ ইনিসিয়েটিভ বাংলাদেশ, ব্রতী, ইউ এস সি কানাডা-বাংলাদেশ, প্রিপ ট্রাষ্ট, ডি.নেট ইত্যাদি সংস্থার পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে যুক্ত।
তিনি ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে মেলবোর্ণে বসবাসরত বাঙালিদের সংগঠন ‘বাংলা সাহিত্য সংসদে’র আমন্ত্রণে মেলবোর্ণে যান। সেখানে তারা তাঁর সাহিত্যকর্ম বিষয়ে আলোচনা করে, উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়ে অভিনয় করে। তাঁর উপন্যাসভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ অংশ বিশেষ দেখায়। শেষে তাঁকে এশিয়ার নারী বিষয়ে বক্তৃতা করতে বলা হয়। বক্তৃতার পরে তিনি শ্রোতাদের প্রশ্নের উত্তর দেন।
মেলবোর্ণ ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরীতে তিনি নাট্যকার হেরিক ইবসেনের ‘লাভস কমেডি’ নাটকটি খুঁজতে গিয়ে দেখতে পান লাইব্রেরীর বাংলা বইয়ের তাক থেকে বইগুলো গুদামে পাঠান হয়েছে। কারণ সেখানে বাংলাভাষী পাঠকরা বাংলা বই পড়ে না।
তিনি ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে দিল্লির ‘কথা’ সংস্থা আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। এই অনুষ্ঠানে তিনি ‘মাই সিটি: মাই হার্ট মাই ওর্য়াল্ড’ শীর্ষক প্রবন্ধ পড়েন। এই প্রবন্ধে সেলিনা তাঁর শহর ঢাকাকে কেন পছন্দ করেন, কেন পছন্দ করেন না এবং কেন এই শহরকে ভালোবাসেন সে বিষয় তুলে ধরেন।
একই বছরে ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের আইসিসিআর আয়োজিত এশিয়া আফ্রিকার লিটারেরি কনফারেন্সে যোগদান করেন। ‘দ্যা লিটল ম্যাগাজিন সাউথ এশিয়া লিটারেরি এওর্য়াড ফর দি মার্স্টাস ২০০৬ (TLMSALAM ) প্রদানের জুরি বোর্ডের বাংলাদেশের জুরি ছিলেন সেলিনা হোসেন। ‘দ্যা লিটল ম্যাগাজিন’ পত্রিকা প্রাথমিকভাবে গবেষক, পাঠক, লেখক, সম্পাদক এবং প্রকাশকদের সহযোগিতায় বিভিন্ন ভাষার লেখকদের একটি ছোট তালিকা তৈরি করেন। এ তালিকা থেকে পুরস্কারপ্রাপ্তদের মনোনীত করার জন্য সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি জুরিবোর্ড গঠন করা হয়। জুরি বোর্ডের অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ভারত থেকে এ আর অনন্তমুরতি, গুলজার, নবনীতা দেব সেন, মৃণাল পান্ডে, কে শচিদানন্দ, পাকিস্তান থেকে কথাশিল্পী জাহিদা হেনা। জুরি বোর্ড ছোট তালিকা থেকে চূড়ান্ত প্রার্থী নির্বাচন করে। পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রগুলো হলো কবিতা, নাটক, উপন্যাস। কবিতায় নয়জনকে মনোনীত করা হয়। এদের মধ্য থেকে পুরস্কার প্রাপ্ত হন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবি শামসুর রাহমান। নাটকে পাঁচজনকে মনোনীত করা হয়। মনোনীত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে পুরস্কারপ্রাপ্ত হন মারাঠি ভাষার লেখক যাদব টেন্ডুলকার। উপন্যাসে দশজনকে মনোনীত করা হয়। এদের মধ্যে মালয়লাম ভাষার লেখক কমলা দাশ পুরস্কারপ্রাপ্ত হন।
সম্মাননা, স্বীকৃতি ও সংবর্ধনা
সেলিনা হোসেন বিভিন্ন সেমিনার, অনুষ্ঠানে অংশ নেন। তিনি ১৯৮০ সালে কুয়ালালামপুরে এশিয়ান কো-পাবলিকেশন প্রোগামে, ১৯৮১ সালে ম্যানিলায় এশিয়ান রাইর্টাস কনফারেন্সে, ১৯৯১ সালে কলকাতায় জিজ্ঞাসা এডুকেশন সোসাইটিতে, ১৯৯৩ সালে লণ্ডনে বিবিসি বাংলা বিভাগের ১৪০০ সন বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে, নব্বই এর দশকে আমস্টারডামের ইউরোপিয়ান নেটওয়ার্ক অব বাংলাদেশ স্টাডিজে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এসব প্রবন্ধ পরবতীর্তে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়। ১৯৯৪ সালে লণ্ডনের সোয়াস- এ উইলিয়াম রেডিচ ও প্রফেসর জে সি রাইটের সঙ্গে বাংলা শব্দার্থতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণা করেছেন। ১৯৯৬ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ বিশ্ব বইমেলায় আনুষ্ঠানিকভাবে অবমুক্ত করেছেন বইমেলার ক্যাটালগ। ১৯৯৭ সালে আসামের শিলচরে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হন। একই বছর অংশগ্রহণ করেন আমেরিকার শিকাগোতে অনুষ্ঠিত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আগরতলা বইমেলায় প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। এবছর দিল্লি ও কাঠমুণ্ডুতে সার্ক লেখক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০০১ সালে ভারতের কেরালা প্রদেশে সাহিত্য উত্সবে যোগ দেন। দেশে ও বিদেশে অনুষ্ঠিত অসংখ্য সাহিত্য সভায় অংশগ্রহণ করেন।
তিনি ১৯৬৯ সালে প্রবন্ধের জন্য পান ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক স্বর্ণপদক, ১৯৮০ সালে উপন্যাসের জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৮১ সালে ‘মগ্নচৈতন্যে শিস’ উপন্যাসের জন্য আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮২ সালে অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ উপন্যাসের জন্য কমর মুশতারী পুরস্কার, ১৯৯৪ সালে ‘অনন্যা’ ও ‘অলক্ত’ পুরস্কার পান। এছাড়া ১৯৯৪- ৯৫ সালে তিনি তাঁর এয়ী উপন্যাস ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ রচনার জন্য ফোর্ড ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ পান। ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ইংরজি, হিন্দি, মারাঠি, কানাড়ি, রুশ, মালে, মালয়ালাম, ফরাসি, জাপানি, ফিনিস, কোরিয়ান প্রভৃতি ভাষার তাঁর বেশ কয়েকটি গল্প অনূদিত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ পায়। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় ‘টানাপোড়েন’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ ২০০১ সালে মালয়ালাম ভাষায় অনূদিত এবং ভারতের কেরালা প্রদেশ থেকে প্রকাশিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ‘যাপিত জীবন’ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ‘নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি’ উপন্যাস পাঠ্যসূচিভুক্ত। শিলচরে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫টি উপন্যাস এম.ফিল. গবেষণাভুক্ত। ২০০৫ সাল থেকে শিকাগোর ওকটন কলেজের সাহিত্য বিভাগ দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্য কোর্সে তাঁর ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসটি পাঠ্যসূচিভুক্ত হয়।
২০১০ সালে একুশে পদক পান সেলিনা হোসেন। ঐ বছরেই রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট উপাধি দেয়।
প্রকাশনা ও সৃষ্টিকর্মের বিবরণ
সেলিনা হোসেনের উপন্যাসের সংখ্যা ২৬টি, গল্পগ্রন্থ ১৮টি, প্রবন্ধগ্রন্থ ৯টি, সম্পাদনা গ্রন্থ ৬টি , শিশুতোষ গ্রন্থ ১২ টি।
কথাসাহিত্য
‘জলোচ্ছাস’ উপন্যাসটি ১৯৭৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি দ্বিতীয় প্রকাশ করে মুক্তধারা। গ্রামবাংলার শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবনে প্রাকৃতিক আকস্মিক আঘাতে পর্যুদস্ত জীবনের ঘটনা ‘জলোচ্ছাস’ উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। একদিন মানুষের জীবনের সাধ মুছে দেয় প্রাকৃতিক জলোচ্ছ্বাস। তবুও সূর্য ওঠে। রোদ ফোটে। মানুষ জীবনের দিকে মুখ ফেরায়। ভাবে, কীভাবে শুরু করবো? কোন মাঠটা ফসলের উপযোগী? কোন জালে ধরা পড়বে রূপোলি ইলিশের ঝাঁক? ‘জলোচ্ছাস’ মানুষের সাহসী জীবনের গল্প। বা জলোচ্ছাস জীবনের নতুন অর্থ খোঁজার প্রান্তিক সীমায় নিয়ে যায় মানুষকে। শুধু নুন-ভাতের বুড়ি- ছোঁয়া জীবন থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলে।
দক্ষিণ বাংলার রাঙাবালি চরের মতো অসংখ্য জনপদে বয়ে যায় নিস্তরঙ্গ সময়। এখানে নদীর সঙ্গে মানুষের গেরস্থালি। সুখে- দুঃখে-আনন্দ-বেদনায় মোচড়ায় জীবনের গ্রন্থিল রশি। এখানে সময় তখনই ভিন্ন অর্থে অভিঘাত তোলে যখন প্রকৃতি বিরূপ হয় মানুষের ওপর। ছোবল দেয় মানুষের হাঁড়িকুড়িতে। ভেঙে দেয় ঘরের চাল উড়িয়ে নেয় গোয়াল ও গরু। এভাবেই চলছে। জীবন থেকে জীবনের সময় গড়ায়-শুরু হয় নতুন বসতি। সূচিত হয় জীবনের নতুন উপাখ্যান।
উপাখ্যানের মানুষেরা এই উপন্যাসেও খুঁজছে বেঁচে থাকার অর্থ-সংগ্রামে ও প্রেমে। দেখেছে কীভাবে টানাপোড়েনে ছিন্নভিন্ন হয় মানুষ-টানাপোড়েনে কাছাকাছি হয় মানুষ। সময়ের সঙ্গে মানুষের বোধে-সংঘাতে-সম্প্রীতিতে জীবন ঘরানা মোড় নেয়। অপরাজেয় মানুষ হার মানে না। নতুন করে জীবনকে অর্থবহ করে তোলার জন্য অমিত শক্তিতে উঠে দাঁড়ায়। ‘জলবতী মেঘের বাতাস’ গল্পগ্রন্থটি ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয়। বইটি বের করে কালিকলম প্রকাশনী।
‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসটি ১৯৭৬ সালে মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমী এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে। প্রথম মুদ্রণ শেষ হলে দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা। এই উপন্যাসে হলদী গাঁয়ের কিশোরী বুড়ির বিপত্নীক চাচাত ভাই গফুরের সঙ্গে বিয়ে হয়। তার কোল জুড়ে যে সন্তান আসে সে একজন প্রতিবন্ধী। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকসেনাদের নৃশংসতা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচানোর জন্য নিজের প্রতিবন্ধী সন্তান রইসকে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। সন্তানের জীবনের বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনে।
‘মগ্ন চৈতন্যে শিস’ ১৯৭৯ সালে প্রথম প্রকাশ হয়। ২০০৪ সালে এর দ্বিতীয় মুদ্রণ বের হয়। উপন্যাসটিতে তিনি ব্যক্তির সংবেদনশীল অনুভবের তীব্রতাকে তুলে ধরেছেন।
‘যাপিত জীবন’ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশ হয় ১৯৮১ সালে। ২০০৪ সালে এর দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হয়। উপন্যাসের নায়ক জাফর প্রতিটি অণুমুহূর্তে ঘোষণা করে বেড়ায় তাঁর বাঙালি অস্তিত্ব। তাঁর শেকড়। নিজের মৃত্তিকারসে জারিত স্বকীয় বিকাশের সমস্ত প্রয়াস ভর করে বাঙালি জাতিসত্তার প্রতিনিধি জাফরের মাঝে। জাফর বাঙালি কন্ঠের বলিষ্ঠ উত্সারণ। মহত্ আদর্শের জন্যে ছোট ছোট জাগতিক মোহকে বিসর্জন দিয়ে উপবাসী জাফর জন্মের ঋণ পরিশোধ করে রাজপথে-মিছিলে মৃত্যুর সাথে আত্মীয়তা করে।
‘নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাস অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে চর্যাপদের সময়কালের পটভূমিতে রচনা করেন। বইটি ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম প্রকাশ হয়। ২০০০ সালে ঢাকার ঐতিহ্য প্রকাশন থেকে চতুর্থবার বইটি প্রকাশিত হয়। ‘চাঁদবেনে’ উপন্যাস ১৯৮৪ সালে সন্ধানী থেকে বের হয়।
‘ক্ষরণ’ ১৯৮৮ সালে প্রকাশ হয়। উপন্যাসটি দহন ক্ষরণ মানুষের জীবনের পটভূমিতে রচিত। ‘পোকা মাকড়ের ঘরবসতি’ ১৯৮৬ সালে প্রকাশ হয়। বইটি প্রকাশ করেছে ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড। এই উপন্যাসের পটভূমি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের জীবনযাপন। নাফ নদীর তীরে ছোট একটি দ্বীপের বুকে এইসব মানুষের বসতি। যারা সাহসী, লড়াকু, স্বপ্নতাড়িত, প্রেমময় মানুষ।
‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ নাচোলের তে-ভাগা আন্দোলনের শিল্পরূপ। এ উপন্যাসে ইলা মিত্রের মতো ইতিহাসের পাত্র-পাত্রীর পাশাপাশি উঠে এসেছে আরো অনেক সাধারণ মানুষের আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা, সফলতা ব্যর্থতা নিয়ে যাদের প্রত্যেকে এক একজন পরিপূর্ণ মানুষ। বইটি ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ হয়। ২০০৩ সালের মার্চে বইটি দ্বিতীয়বার প্রকাশ হয়। ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ ১৯৯২ সালে প্রথম প্রকাশ হয়। ২০০৪ সালে ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ উপন্যাসটির দ্বিতীয় মুদ্রণ বের হয়। ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের নায়ক-নায়িকা কালকেতু ও ফুল্লরার কাহিনী অবলম্বনে উপন্যাসটি লিখেছেন তিনি।
‘নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি’ ১৯৮৭ সালে বের হয়। চল্লিশ দশকের পটভূমিতে লেখা একটি উপন্যাস। গল্পকার সোমেন চন্দ, শহীদ মুনীর চৌধুরী, রণেশ দাশগুপ্ত প্রমুখ বাস্তব চরিত্রের সঙ্গে আরো অনেক কল্পনার চরিত্র এই উপন্যাসে উপজীব্য হয়ে উঠেছে। ‘টানাপোড়েন’ ১৯৯৪ সালে সাহিত্য বিলাস প্রকাশ করে। ‘ওয়ারফ এন্ড উফ’ নামে ইংরেজি ভাষায় ১৯৯৯ সালে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়। পাকিস্তান থেকে উর্দু ভাষায় ২০০৩ সালে মার্শাল বুকস, লাহোর থেকে বের করে। ‘টানাপোড়েন’ মানবজীবনের সম্পর্ক জটিলতার গল্প। একসময় গড়ে ওঠা সম্পর্কের সূত্র, আরেক সময় তা ছিঁড়ে যায়। এর অন্তরালে কাজ করে ব্যক্তি মানুষের নিজস্ব ভাবনা। নিজস্ব নিয়মে জীবন পরিচালনার আকাঙ্ক্ষা এবং নিজস্ব ভুবন কাকে নিয়ে তৈরি হবে সেই তাড়না। প্রবল জলোচ্ছ্বাসে একদিন ভেসে যাওয়া সমুদ্র উপকূলবর্তী কতিপয় গ্রামের মানুষ এই উপন্যাসের চরিত্র।
‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’-এক ১৯৯৪, দুই ১৯৯৫ এবং তিন ১৯৯৬ সালে প্রকাশ করেছে বিদ্যাপ্রকাশ। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক পটভূমিতে তিন খণ্ডে এই বইটি রচিত। ‘৪৭ সাল থেকে ‘৫৮, ‘৫৯ থেকে ‘৬৯ এবং ‘৬৯ থেকে ‘৭৫ পর্যন্ত সময়ের ঘটে যাওয়া ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ এ উপন্যাসের বিষয়বস্তু। এই উপন্যাসের বলিষ্ঠ চরিত্র আলী আহমদ যৌবন থেকে প্রৌঢ় পর্যন্ত দীর্ঘ ইতিহাসের টানাপোড়েনের সাক্ষী।
‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’র তৃতীয় খন্ডে অভ্যুদয় ঘটেছে বাংলাদেশের। যা বাঙালির জীবনের শ্রেষ্ঠ কাল। তারা অর্জন করেছে সব ধর্মের মানুষের জন্য একটি ভূখন্ড। যেখানে প্রতিদিনের গায়ত্রী সন্ধ্যায় মানুষের মঙ্গলধ্বনি বাজে। যে ভুখন্ডে স্থিত করে একটি জাতির স্বপ্নসাধ। সেই স্বপ্নকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে। যিনি বাঙালিকে তার গৌরবময় জীবনের সন্ধান দিয়েছেন।
‘যুদ্ধ’ ১৯৯৮ সালে প্রথম প্রকাশ হয়। ২০০৬ সালে অন্যপ্রকাশ থেকে দ্বিতীয় মুদ্রণ বের হয়। ১৯৭১ সালে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে উপন্যাসটি রচিত। এই উপন্যাসে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মাণ করা হয়েছে ব্যক্তির বেঁচে থাকার সঙ্কট, মূল্যবোধের রূপান্তর, ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুষঙ্গে আঘাত, মৃত্যু, স্বজন হারানোর বেদনার ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা জীবন। এই উপন্যাসে একটি চরিত্র আছে যার কোনো নাম নেই। পুরো উপন্যাস জুড়ে সে একটি প্রতীকী চরিত্র।
‘লারা’ ২০০০ সালে প্রথম প্রকাশ হয়। বের করেছে মাওলা ব্রাদার্স। এই উপন্যাসে সেই জীবনের কথা আছে, যে জীবন যাপিত হচ্ছে আপন নিয়মে। এখানে নানা অনুভূতির কথা আছে, যে অনুভব মানুষকে দীপ্র করে। এখানে রহস্যের কথা আছে, যে রহস্য কোনোদিন মানুষের কাছে উন্মোচিত হয় না।
‘কাঠ কয়লার ছবি’ বইটি ২০০১ সালে প্রকাশ হয়। বইটি বের করে মাওলা ব্রাদার্স। কাঠ কয়লার ছবি একটি লস্ট আইডেনটিটির গল্প। এই উপন্যাসের পটভূমি একটি যুদ্ধ শিশু ও চা বাগানের সেইসব মানুষ, যাদের একদিন নিজ বাসভূমি থেকে জোর করে ধরে এনে চা-শ্রমিক হিসেবে বাগানের কাজে লাগানো হয়েছিল। তাদের মজুরি নির্ধারিত হয়েছিলো নূন্যতম হার তাদেরকে শুধু বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে, যেন তারা শুধুই বেঁচে থাকে এবং ব্যাহত না হয় চা-উত্পাদন। শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এভাবেই চলে আসছে এবং এখনও সেভাবে চলছে।
এদের কাছে এসে দাঁড়ায় একটি যুদ্ধ শিশু। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে একজন শ্রমিক নারীর গর্ভে যার জন্ম। পিতা একজন পাকিস্তানি সৈনিক। জন্মের পরপরই অসুস্থ মাকে না দেখিয়ে শিশুটিকে দিয়ে দেওয়া হয় একটি বিদেশী দম্পতিকে। যারা প্রবল মমতায় ছেলেটিকে বড় করে। একদিন পালক বাবা-মা ছেলেটিকে তার জন্মের কথা বলে। ছেলেটি তার মাকে খুঁজতে বাংলাদেশে আসে।
‘মোহিনীর বিয়ে’ ২০০২ সালে বের হয়। প্রকাশ করেছে মাওলা ব্রাদার্স। এই উপন্যাসে যে মেয়েটির গল্প বলা হয়েছে সেটি শুধু একটি মেয়ের গল্প নয়। এ গল্পের শিকড় সমাজের অনেক গভীরে বিস্তৃত। এই উপন্যাসের চরিত্র রমজান আলী ভালোবাসার নামে প্রতারিত করে নিজ প্রেমিকাকে বিক্রি করে দেয় পতিতালয়। সময়ের পরিধিতে দুজনের জীবন গড়ায়। দুজনে’র আবার দেখা হয় পতিতালয়ে। ততোদিনে রমজান আলী সংসারী এবং পাঁচ কন্যার জনক। পতিতালয়ে প্রাক্তন প্রেমিকাকে গর্ভবতী দেখে সে প্রতারণার নতুন জাল ফাঁদে। প্রেমিকাকে বলে, আমার স্ত্রীও গর্ভবতী। তোমাদের দুজনে’র একই সময়ে সন্তান হবে। তোমার ছেলে হলে আমাকে দিও। ওকে লুকিয়ে আমার স্ত্রীর কোলে দেবো। আমার বংশ রক্ষা হবে। প্রেমিকা বলে, এবার তোমার মেয়ে হলে আমাকে দিও। পতিতালয়ে মেয়েরা সোনা। এভাবেই বদল হয় মোহিনী। শুরু হয় জীবনের টানাপোড়েন।
‘আণবিক আঁধার’ উপন্যাসটি ২০০৩ সালে অন্যপ্রকাশ বের করে। এই উপন্যাস প্রবহমান সময়ের উপন্যাস। এই সময়ের স্রোত জনগোষ্ঠীর যে অংশের অনুকূলে নয় তার নাম নারী। প্রশান্তি এই নারী সমাজের প্রতিনিধি। প্রশান্তিকে লড়াই করতে হচ্ছে এক অস্বাভাবিক আঁধারের বিরুদ্ধে। যে আঁধার প্রাকৃতিক নয়, যে আঁধারের সৌন্দর্য মানব হৃদয়কে উদ্ভাসিত করে না। এই সাময়িক আঁধার মানুষেরই তৈরি, মানুষের বিরুদ্ধে।
‘ঘুমকাতুরে ঈশ্বর’ উপন্যাসটি ২০০৪ সালে বের হয়। বইটি বের করে মাওলা ব্রাদার্স। এই উপন্যাসে নদী ভাঙ্গা মানুষের জীবনের গল্প প্রতিধ্বনিত হয়েছে। যাদের নদী সূত্রীয় জীবনযাপনের অভ্যস্ত যাত্রায় সামান্যই ছুঁয়ে থাকে শস্য এবং শস্যের স্বপ্ন। উপন্যাসের চরিত্র মনির ও শুকতারার মতো যুবক-যুবতী বেঁচে থাকার পীড়নে যৌনতা বিক্রি করে। কিন্তু জীবন থেকে ভালোবাসা নিঃশোষিত হয় না তাদের। প্রয়োজন মিটে গেলে আবার ফিরে আসে ঘরে।
‘মর্গের নীল পাখি’ উপন্যাসটি ২০০৫ সালে প্রকাশ হয়। বইটি প্রকাশ করে অন্যপ্রকাশ। মর্গ এই উপন্যাসের একটি চরিত্র। বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া মৃত্যুর ঘটনা, কখনো ব্যক্তিগত শোককে ছাড়িয়ে রাষ্ট্রের কাছে জিজ্ঞাসা চিহ্ন হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। মৃত্যুর পরে মর্গই তো সেই জায়গা যেখানে শব হয়ে ঢুকতে হয়, যখন মৃত্যু আর স্বাভাবিক মৃত্যু থাকে না। আইনের নিয়মে এখানে শবব্যবচ্ছেদ সম্পন্ন হয়, কিন্তু মেটে না জীবনের মূল্য।
এই উপন্যাসের একদল ছেলেমেয়ে মর্গের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে নিজেদের বয়স্ক হতে দেখেছে। কখনো পরিবারের প্রবল কষ্টে মর্গের ব্যবচ্ছেদের পরে বেওয়ারিশ হয়ে গেছে লাশ। ছেলেমেয়েরা বদলে দিচ্ছে রাষ্ট্রের সংজ্ঞা। বলছে রাষ্ট্র নিজেই বেওয়ারিশ লাশ বহনকারী আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়ি। এতকিছুর ভেতর দিয়ে ছেলেমেয়েরা বেঁচে থাকার অর্থ খোঁজে!
গল্প
তাঁর প্রথম গল্পের বই ‘উত্স থেকে নিরন্তর’ ১৯৬৯ সালে বের হয়। ‘জলবতী মেঘের বাতাস’ ১৯৭৫ সালে, ‘পদশব্দ’ ১৯৮২ সালে, ‘খোল করতাল’ ১৯৮২ সালে, ‘পরজন্ম’ ১৯৮৬ সালে, ‘খুন ও ভালোবাসা’ ১৯৯০, ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ ১৯৯২ সালে, ‘নির্বাচিত গল্প’ ১৯৯৩ সালে, ‘মতিজানের মেয়েরা’ ১৯৯৫ সালে, ‘দীপান্বিতা’ ১৯৯৭ সালে এবং ‘একটি উপন্যাসের সন্ধানে’ ১৯৯৯ সালে প্রকাশ হয়।’মানুষটি’ একটি গল্পগ্রন্থ। বইটি ১৯৯৩ সালে প্রথম প্রকাশ হয়। বইটি ২০০৪ সালে পুর্নমুদ্রণ করে মীরা প্রকাশন। বইটি ১৫টি গল্পের সংকলন। গল্পগুলো হলো মানুষটি, জলহাওয়া, প্রার্থনা, কষ্টিপাথর, দাঁড়কাক, স্পর্শ, ঘৃণা, ঘরজুড়ে জ্যোত্স্না, বাঁচা, বসন্ত বাউরি, ময়েজের পরাজয়, শব্দ ও কাঁচি, ক্রোধ, উনসত্তর, থুতু।এসব গল্পের কোথাও আছে একজন ব্যক্তির কথা, একজন হতদরিদ্র নারীর কথা, যে ছেলেকে লেখাপড়া শেখানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায়, কিন্তু একদিন ফিরে আসে ছেলের লাশ, সন্ত্রাসীর গুলিতে নিহত হয়ে। এখানে আছে ভালোমানুষকে ভালোবাসার জন্য যুবতীর প্রার্থনা, যে প্রেমিকের কাছে প্রতারিত হয়ে গর্ভবতী হয়। আছে পার্বত্য চট্রগ্রামে জোর করে পাঠানো একজন বাঙালি অভিবাসীর শান্তিবাহিনীর হাতে পুড়ে যাওয়ার ঘটনা। আছে হাওরের গল্প, পাহাড়ি ঢলে ভেসে যায় সোনালি ধান, কৃষকের স্বপ্ন, একজন যুবক নিজের চোখের সামনে দেখতে পায় কীভাবে বদলে যাচ্ছে শহর। গল্পের নায়ক দেখে তার চোখের সামনে একটি অসুন্দর শহর প্রবল হয়ে ওঠে। ওর মুখ ভরে থুতু আসে। এই পতিত জমির অন্ধকার ছেড়ে ও কোথায় পালাবে। এভাবে আরও নানা বিষয়ের গল্প আছে এ বইয়ে। নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে কাহিনী তৈরি হয়েছে। ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ ২০০০ সালে বের হয়। বইটিতে ৭টি গল্প সংকলন হয়েছে। গল্পগুলোতে একাত্তরে বাংলাদেশের নারীর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া যন্ত্রণার দুঃখ বেদনার কথা তুলে ধরেছেন।’গল্প সমগ্র’ বইটি ২০০২ সালে সময় প্রকাশন বের করে। বইটিতে আটটি গল্পের বইয়ের ‘উত্স থেকে নিরন্তর’, ‘জলবতী মেঘের বাতাস’, ‘পরজন্ম’, ‘মানুষটি’, ‘খোল করতাল’, ‘মতিজানের মেয়েরা’, ‘অনূঢ়া পূর্ণিমা’, ‘একালের পান্তাবুড়ি’, গল্পসমগ্র সংকলিত হয়েছে।’ঋতু বসন্তের ফুলকলি’ গল্পের বইটি ২০০৪ সাল প্রকাশ করেছে বিজয় প্রকাশ। বইটিতে দশটি গল্প সংকলিত হয়েছে। গল্পগুলো হলো – গোলাপ ফোটা সকাল, সুখের পিঠে সুখ, স্রোত, ইচ্ছা বাগান কবিতা- আমার ভালোবাসা, অনূঢ়া পূর্ণিমা, শেষ চিঠির পরে, নদে এলো বান, বুকের ভেতর নদী, গোলাপকে ভালোবাসতে হলে, আসিফ আহমদ বন্ধুবরেষু। ‘গোলাপ ফোটা সকাল’ গল্পে লেখক দেখিয়েছেন বাবা মেয়ের মধ্যে সহজ সরল সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক। যে বাবা দেখতে কুৎসিত হওয়ায় প্রতিনিয়ত সমাজের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত নিজেকে আড়াল করে রাখতেন। কারণ পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়- স্বজন সবার কাছে নিজের রূপহীনতার কথা শুনতে শুনতে তার ভেতর জন্মেছিল এক হীনমন্যতাবোধ। কিন্তু তার মেয়ে লেসিনা যখন বাবার রূপ নিয়ে জন্মায় তখন তিনি ভীষণ কষ্ট পেলেও মেয়েকে এই বলে সান্ত্বনা দেয় মানুষের বাইরের সৌন্দর্যটাই আসল নয়, মানুষের আসল সৌন্দর্য তার সুন্দর মন।
গবেষণা ও প্রবন্ধ নিবন্ধ
‘স্বদেশ পরবাসী’ তাঁর প্রথম প্রবন্ধের বই। বইটি ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশ হয়। ‘একাত্তরের ঢাকা’ ১৯৮৯ সালে বের হয়। বইটি বের করে আহমদ পাবলিশিং হাউস। এই বইয়ের পটভূমি একাত্তরের নয়মাসে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, রাজাকার আলবদরদের তাণ্ডবতা প্রভৃতি বিষয়। ‘নির্ভয় করো হে’ ১৯৯৮ সালে প্রকাশ করে অনন্যা। এই প্রবন্ধ গ্রন্থে সংস্কৃতি, সাহিত্য, বঙ্গবন্ধু, স্মৃতি, প্রক্ষিপ্ত ভাবনা, অভিভাষণ, ভ্রমণ, নির্বাচিত কলাম, বিভিন্ন দৈনিক সাপ্তাহিক পত্রিকায় সেলিনা হোসেনের সাক্ষাত্কারগুলো সংকলিত হয়েছে। ‘সংস্কৃতি ও শিশু’ প্রবন্ধে লেখক দেখিয়েছেন কোনো মানুষই সংস্কৃতির বাইরে নয়, শিশুও নয়। কাজেই শিশু সংস্কৃতির এক মহত্ উপাদান, উপাদান এজন্য যে শিশুর আশেপাশের মানুষের-তার মা-বাবার কিংবা শুধু তার মায়ের, যদি বাবা বেঁচে না থাকে কিংবা মাকে ছেড়ে চলে যায় তার পরিবারের, গ্রামের কিংবা শহরের যে পাড়ায় তার জন্ম সে পাড়ার, তার সমাজের- জীবনের অনেকখানি শিশুকে ঘিরে আবর্তিত হয় এবং তাদের জীবনধারণের পদ্ধতি ও জীবন নিয়ে চিন্তা শিশুর অস্তিত্ব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
‘বাংলাদেশের মেয়ে শিশু’ ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে মাওলা ব্রাদার্স প্রথম বের করে। এই বইয়ে বাংলাদেশের মেয়ে-শিশুর অবস্থান পর্যালোচনা করা হয়েছে। এই পর্যালোচনায় ব্যবহৃত হয়েছে প্রাথমিক তথ্য অর্থাত্ মাঠ পর্যায়ের জরিপ, কেসস্টাডি, সাক্ষাত্কার গ্রহণ ইত্যাদি এবং পাশাপাশি পর্যালোচনা করা হয়েছে। এছাড়া মেয়ে শিশু ও বৃহত্তর অর্থে শিশু সম্পর্কিত সরকার কর্তৃক গৃহীত নীতিসমূহও এই বইয়ে যুক্ত করেছেন। বাংলাদেশের মেয়ে শিশুরা যে অরক্ষিত এবং দেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে বসবাস করছে। তারা সামাজিক মূল্যবোধের হাতে ক্রীড়নক তা লেখক এই বইয়ে তুলে ধরেছেন। আবহমানকালের থেকে এ মূল্যবোধ সমাজে বিরাজ করছে। অন্যদিকে মেয়ে শিশুরা মুষ্টিমেয় সাধারণ মানুষের বিকৃত মানসিকতার শিকার। কোনো পরিস্থিতিই স্বাভাবিকভাবে মেয়ে শিশুর জন্য অনুকূল নয়। শারীরিক নির্যাতন যেমন তাদের সহ্য করতে হয়, তেমনি মানসিক নির্যাতন প্রতি পদক্ষেপে তাদের পিষ্ট করে।
‘মুক্ত করো ভয়’ একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ, বিভিন্ন ধরণের গদ্য- রচনা, সমকালীন আর্থ-সামাজিক রাজনীতি বিষয়ে কলাম, বিভিন্ন পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাত্কার, প্রয়াত লেখকদের স্মরণে লেখা এবং বিখ্যাত জনদের কাছ থেকে পাওয়া চিঠিপত্র এই বইটিতে সংকলিত হয়েছে। বইটির প্রকাশকাল ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। প্রকাশ করেছে ঢাকা থেকে অনুপম প্রকাশনী।
‘দূরের দেশ কাছের দেশ’ ২০০৬ সালে প্রকাশ হয়। বইটি প্রকাশ করে অন্যপ্রকাশ। এই বইয়ে তিনি ছয়টি দেশ যেমন- ম্যানিলা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, সুইজারল্যাণ্ড, হল্যাণ্ড, কম্বোডিয়া, কেরালা প্রদেশের ভ্রমণ অভিজ্ঞতাকে রূপায়িত করেছেন।
কিশোর সাহিত্য
তাঁর প্রথম কিশোর উপন্যাস ‘সাগর’ ১৯৯২ সালে বের হয়। বইটি প্রকাশ করে সাহিত্য প্রকাশ। কৃষকের ছেলে সাগর বাপঠাকুরদার পেশা কৃষিকাজকে পেশা হিসেবে বেছে নিলেও তার মনে কোন দুঃখ নেই। তবে বাবার সঙ্গে ক্ষেতে কাজ করার পরেও সে অনেক কিছু করতে চায়, জানতে চায়, দেখতে চায়। ছোট বোন দিঠির সঙ্গে হেসে খেলে দিন কাটাতে কাটাতে সে অনেক রঙিন স্বপ্ন দেখে। এসব স্বপ্নের মধ্যে ভিড় করে দেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তি সংগ্রামে যোগ দেবার স্বপ্নও। ‘বাংলা একাডেমী থেকে গল্পে বর্ণমালা ১৯৯৪ সালে, ‘কাকতাড়ুয়া’ ১৯৯৬ সালে ‘অন্যরকম যাওয়া’ ২০০১ সালে, ‘আকাশপরী’ ২০০১ সালে, ‘জ্যোত্স্নার রঙে আঁকা ছবি’ ২০০২ সালে এবং ‘যখন বৃষ্টি নামে’ ২০০২ সালে প্রকাশ হয়।’বর্ণমালার গল্প’ ১৯৯৭ সালে প্রকাশ হয়। এক একটি বর্ণ দিয়ে কীভাবে সুন্দর সুন্দর গভীর অর্থ, অর্থ থেকে বাক্য এবং বাক্য থেকে জীবনের গল্প তৈরি হয়। যাতে ছোট ছোট সুখ দুঃখ জড়িয়ে থাকে। এই বিষয়টি বইয়ে উঠে এসেছে।’মেয়রের গাড়ি’ ২০০৩ সালে বের হয়। বইটি বের করেছে ঐতিহ্য প্রকাশন।’গল্পটা শেষ হয় না’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শিশুতোষ উপন্যাস। বইটি বের করেছে মাওলা ব্রাদার্স। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০০৬। এই উপন্যাসের নায়ক নিটু একজন স্কুল ছাত্র। তার চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো নিয়ে এই উপন্যাসটি রচিত। দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখার অপরাধে নিটুর বাবাকে জীবন দিতে হয় পাকসেনাদের হাতে। আর চাচা যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হন। এরপর বাড়ির কাজের ছেলে হাবুর বাবা-মাকে পাকসেনারা হত্যা করে। হত্যা করে নিরীহ সাধারণ মানুষদের। পাকসেনাদের এই বর্বরতা নিটুকে ক্ষুব্ধ করে।’কিশোর সমগ্র’ ২০০৪ সালে বের হয়েছে। বইটি বের করেছে সময় প্রকাশন। এই বইটিতে লেখকের নয়টি কিশোর উপন্যাস সংকলিত হয়েছে। এই উপন্যাসগুলো হলো ‘সাগর’, ‘কাকতাড়ুয়া’, ‘বর্ণমালার গল্প’, ‘অন্যরকম যাওয়া’, ‘আকাশপরী’, ‘যখন বৃষ্টি নামে’, ‘জোত্স্নার রঙে আঁকা ছবি’, ‘আমার স্কুল’।
‘বায়ান্নো থেকে একাত্তর’ বইটি ২০০৬ সালে প্রকাশ করেছে মাওলা ব্রার্দাস। এই বইয়ের পটভূমি বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত।
সম্পাদনা
‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ বইটি ২০০৫ সালে প্রকাশ করেছে সাহিত্য বিলাস। বইটিতে উনিশটি শিশুতোষ গল্প রয়েছে। সম্পাদকের নিজেরও একটি গল্প এই বইয়ে সংকলিত হয়েছে। গল্পগুলোতে বাংলাদেশের মানুষ একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে নয় মাস যুদ্ধ করে কীভাবে দেশের স্বাধীনতা লাভ করেছে তার কথা আছে। আছে মানুষের সাহসের ভেতর ফুটে থাকা তার স্বাধীনতার গল্প, মানুষের বেদনার মধ্যেও ফুটে থাকা স্বাধীনতার স্বপ্ন।
‘জেন্ডার বিশ্বকোষ’ একটি সম্পাদনা গ্রন্থ। একশন এইড বাংলাদেশের সহযোগিতায় মাওলা ব্রার্দাস এবং ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন যৌথভাবে ২০০৬ সালে প্রকাশ করে। বইটি বর্ণ আকারে সাজানো হয়েছে এবং দুটি খণ্ডে বের হয়েছে। প্রথম খণ্ড অ থেকে ন ও দ্বিতীয় খণ্ড প থেকে হ পর্যন্ত ভুক্তি সংযুক্ত হয়েছে।
সেলিনা হোসেন এবং মাসুদুজ্জামান বইটি সম্পাদনা করেছেন। নারী সম্পর্কিত অসংখ্য তথ্য সংকলিত করে তা পাঠকের সামনে সহজ-সাবলীল ভাষায় তুলে ধরেছেন। এই বিশ্বকোষে তথ্যসূত্রসহ অনেক ধরনের ভুক্তি অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে তত্ত্বধর্মী ভুক্তি (যেমন জেন্ডার), সংজ্ঞার্থীমূলক ভুক্তি (যেমন সাংস্কৃতিক নারীবাদ), বিষয়ভিত্তিক ভুক্তি (যেমন রাজনীতি/সংখ্যালঘু), ধারণাবাচক ভুক্তি (যেমন পরিবেশ নারীবাদ), ব্যক্তি পরিচিতিমূলক ভুক্তি (যেমন মেরি উলস্টোনক্র্যাফ্ট/বেগম রোকেয়া), পুরাণ ও লোকাচারধর্মী ভুক্তি (যেমন আটলান্ট/ব্রতকথা), বস্তুকেন্দ্রিক ভুক্তি (যেমন ঢেঁকি/কুলা), চিকিত্সাশাস্ত্র সংশ্লিষ্ট ভুক্তি (যেমন এইডস/ গলগণ্ড), প্রবচনধর্মী ভুক্তি (যেমন ‘মাগ জব্দ কিলে, হলুদ জব্দ শিলে’) ইত্যাদি। এসব ভুক্তির সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৬০০। এসব ভুক্তির মধ্যে স্ত্রীবাচক শব্দের ইতিবাচক অর্থ পূর্বসূরিদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে।
এছাড়া নারী শুধু যে প্রাকৃতিক পরিচয়ে পরিচিত নয়, সামাজিক পরিচয়েও পরিচিত, গোটা বিশ্বেও নারী আন্দোলন, নারী সমাজের প্রসার ইত্যাদি এই বইটিতে সন্নিবেশিত হয়েছে। বিশ্বখ্যাত এহরাক ইবসেককে নিয়ে দুটো বই সম্পাদনা করেছেন। সম্পাদনা করেছেন (যৌথ) ‘দক্ষিণ এশিয়ার নারীবাদী গল্প।’
তথ্য সূত্র
১. সাক্ষাত্কার : সেলিনা হোসেন
তারিখ : ২৮.০২.০৬, ২২.০৩.০৬, ১১.০৪.০৬২. জেন্ডার বিশ্বকোষ : সেলিনা হোসেন
মাসুদুজ্জামান সম্পাদিত
প্রকাশক: মাওলা ব্রাদার্স, ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০০৬৩. মুক্ত করো ভয় : সেলিনা হোসেন
প্রকাশক: অনুপম প্রকাশনী
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০০১লেখক : রীতা ভৌমিক