ছেলেবেলাতে পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে তিনি প্রকৌশলী বাড়ির সন্তান হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর বাবা ও ভাইসহ তাঁদের পরিবারের প্রায় ১২-১৩ জন সদস্য প্রকৌশলী। তাঁর বাবা আবিদ রেজা চৌধুরী ১৯২৯ সালে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পুরকৌশলে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। সিলেটের জাফলং সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় অংশে তিন পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে যে ঝুলন্ত সেতুটি সৌন্দর্য বিলিয়ে যাচ্ছে, সেটি আবিদ রেজা চৌধুরী তৈরি করেছিলেন ১৯৩০সালে। এটি সিলেট অঞ্চলের অন্যতম প্রধান ও প্রথম ঝুলন্ত সেতু।
তিনি যখন খুব ছোট ছিলেন তখন তাঁর বাবার এক রেলওয়ে প্রকৌশলী বন্ধু একদিন তাঁদেরকে আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর বাড়ীতে যাওয়ার জন্য। রেলওয়ে সেলুনে করে (রেলওয়ের উচ্চ পদস্থ অফিসাররা যে কম্পর্টমেন্টে করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতেন) তাঁরা সেখানে গেলেন। সেখানে যেয়ে তিনি দেখলেন রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়াররা যখন পরিদর্শনে যান তখন তাঁরা হ্যাট পরে একটা ট্রলিতে উঠে বসেন আর অন্যরা ট্রলিটিকে ধাক্কা দিয়ে আবার কখনও তাঁরা ট্রলিটি টেনে নিয়ে যায়। ব্যাপারটি তাঁর খুব ভাল লাগল। বেশ রাজকীয় একটা ব্যাপার তাঁর কাছে মনে হলো। তখন তিনি ভাবলেন তিনি রেলে চাকরী করবেন। এর কিছুদিন পর ময়মনসিংহে একবার একটা আইসক্রিম ফ্যাক্টরি দেখতে গেলেন, আইসক্রিম ফ্যাক্টরির আইসক্রিম ভর্তি বিরাট ডীপ ফ্রীজ টাইপের একটা জিনিস দেখে ভাবলেন এখানে চাকরী নিলে তো সারাদিন আইসক্রিম খাওয়া যাবে। আর আইসক্রিম খাওয়ার লোভেই সিদ্ধান্ত নিলেন এই আইসক্রিম ফ্যাক্টরিতেই চাকরী নিবেন তিনি। তবে খুব ছোট বয়সে হ্যাট পড়ে রাজকীয় আসনে ট্রলিতে বসার লোভে রেলের চাকরী অথবা আইসক্রিম খাওয়ার লোভে আইসক্রিম ফ্যাক্টরিতে চাকরী নিতে চাইলেও তা ছিল ক্ষণিকের একটা মোহ। কিছুদিন পরেই তিনি তা ভুলে গিয়েছিলেন।
প্রকৌশলী পরিবার হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই তাঁদের পরিবারে প্রকৌশল বিষয়ে আলোচনা হত। তাঁর বাবা প্রকৌশল সংক্রান্ত কিছু সাময়িকী বাসায় রাখতেন। ছেলেবেলায় না বুঝলেও তিনি এই সাময়িকীর পাতাগুলি উল্টাতেন ছবি দেখার জন্য। এরকম একটা পরিবেশের মধ্যে বেড়ে ওঠার কারণেই হয়তো প্রকৌশল বাড়ির এই ছেলেটি ছেলেবেলা থেকে মনের অজান্তেই প্রকৌশলী হতে চেয়েছেন। চিন্তাভাবনা করে যে প্রকৌশলী হতে চেয়েছেন তা কিন্তু নয়। প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্নটি তাঁর মনের মধ্যে আপনা থেকেই চলে এসেছে। ছেলেবেলায় মনের অজান্তে প্রকৌশলী হতে চাওয়া সেই ছেলেটিই হলেন বর্তমানের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রকৌশলী, গবেষক, শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী।
ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ১৯৪২ সালের ১৫ নভেম্বর সিলেট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ড. চৌধুরীর মা হায়াতুন নেছা চৌধুরী সারাজীবন ঘর সামলেছেন, সন্তানদের করে তুলেছেন সুশিক্ষিত। ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীরা পাঁচ ভাইবোন। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তাঁর অবস্থান তৃতীয়। স্ত্রী সেলিনা নওরোজ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। ব্যক্তিজীবনে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী দুই সন্তানের জনক। বড় সন্তান (মেয়ে) কারিশমা ফারহিন চৌধুরী, পেশায় পুরকৌশলী। ছেলে কাশিফ রেজা চৌধুরী ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রী করেছেন।
ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর শৈশবকাল বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। বাবার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাঁর শৈশবকাল কেটেছে। মাত্র তিন বছর বয়সে সিলেট ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে চলে যান আসামের জোড়হাটে। ১৯৪৭ সালের আগস্টে আবার সিলেটে ফিরে আসেন। এরপর তাঁর বাবা বদলি হয়ে ময়মনসিংহে চলে যান। ১৯৪৯ সালে ময়মনসিংহের বেশ নাম করা একটা কিন্টারগার্ডেন স্কুল আওয়ার লেডি ফাতেমাতে তাঁর বাবা তাঁকে নিয়ে ভর্তি করে দেন। স্কুলটি এখনও আছে। কিন্তু এই স্কুলে তিনি মাত্র দুই দিন যাওয়ার পর আর যাননি। কারণ ভর্তির পর দ্বিতীয় দিন যখন তিনি এই স্কুলে গেলেন তখন বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া মাখন লাগোনো রুটির টিফিনে তাঁর এক সহপাঠি পানি ঢেলে দেওয়ায় তাঁর খুব খারাপ লাগে। বাসায় এসে তিনি বললেন, ‘এই স্কুলে আর আমি যাবই না।’ এরপর তিনি সেই বছর আর স্কুলে গেলেন না, বাসায় শিক্ষক এসে পড়াতেন। পরের বছর ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে ক্লাস ফোরে ভর্তি হলেন।
এখানে দুই বছর পড়ার পর তাঁরা চলে এলেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে তাঁর বাবা তাঁকে নিয়ে গেলেন পুরান ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তির জন্য। এই স্কুলের শিক্ষার মান তখন ঢাকার অন্যান্য স্কুলগুলির চেয়ে অনেক উন্নত ছিল। কিন্তু এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানালেন ক্লাস সেভেনে একজনকে ভর্তি করানো যাবে কিন্তু ক্লাস সিক্সে কোন সিট নেই। তাঁর বড় ভাই তাঁর চেয়ে এক বছরের বড় হওয়ায় তাঁকে সেভেনে ভর্তি করানো হল। কিন্তু তিনি সেই বছর সেন্ট গ্রেগরিজে ভর্তি হতে পারলেন না। প্রিয়নাথ হাইস্কুলে (নবাবপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুল) এসে ভর্তি হলেন। সেখানে তিনি এক বছর পড়েন। ওই সময়ে তিনি থাকতেন ঢাকার কোম্পানি বাগানে (বর্তমানে নটরডেম কলেজের পাশের জায়গাটা)। এর পরের বছর ১৯৫৩ সালে সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হলেন তিনি এবং ১৯৫৩ সালেই তাঁদের পরিবার চলে আসে গোপীবাগে। এরপর ১৯৫৫ সালে তাঁদের পরিবার চলে আসে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে, যেটি ছিল ওই সময়ে সেই এলাকার এক মাত্র পাকা বাড়ি। এই বাড়িটিতেই তিনি এখোনো সপরিবারে বসবাস করছেন।
ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা খুব পছন্দ করতেন। সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে ক্লাস সেভেন-এইটে পড়তে ফুটবলে ইন্টার ক্লাস চ্যাম্পিয়ান হয়ে গেলেন। তাঁরা উপরের ক্লাসের ছেলেদের সাথে খেলেন এবং তাঁদের ক্লাসের ছেলেরা বয়সে ছোট হওয়া সত্বেও তাঁরা চ্যাম্পিয়ান হন। তাঁদেরকে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় টাকা। তাঁদের দলের ১২ জন খেলোয়াড়ের প্রত্যেকের ভাগে ৫ টাকা করে পড়ে। টাকাটা হাতে পাওয়ার পর তাঁদের দলের সবাই মিলে ঠিক করলেন এই টাকা কীভাবে খরচ করা হবে। প্রথমে তাঁরা সবাই মিলে কালা চাঁদ গন্ধ মানিক বলে একটা নামকরা মিষ্টির দোকানে গেলেন মিস্টি খেতে। সেই দোকানে যেয়ে তাঁরা আট আনার মিষ্টি খেলেন। তখন একটা মিষ্টির নাম ছিল ‘এ্যাটম’। বিরাট একটা রসগোল্লা ছিল ‘এ্যাটম’ নামের এই মিষ্টিটি। মিষ্টি খাওয়ার পর ভাবলেন বাকী টাকা কীভাবে খরচ করা যায়। অনেক ভেবে ঠিক করলেন সিনেমা দেখবেন তাঁরা। গুলিস্তানের প্রথম এয়ার কন্ডিশান সিনেমা হলে যেয়ে তাঁরা ‘এ ম্যান ফর্ম লারামি’ নামের ওয়েস্টার্ন সিনেমাটি দেখলেন। এরপর তাঁরা ‘মায়া’ নামের একটা বাংলা সিনেমা দেখলেন।
এভাবে অনেক আনন্দের মধ্যেই কেটে গেল তাঁর স্কুল জীবন। সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল থেকে তিনি ১৯৫৭ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য তিনি ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়)। তিনি ছাত্র জীবনে কখনই খুব বেশি পড়াশুনা করেননি। তাঁর বেশির ভাগ সময় কাটত খেলার মাঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর হলের কোন বন্ধু হয়ত তাঁকে বললেন, এই প্রবলেমটা পারছি না। তিনি তাঁর রুমে গিয়ে সেই প্রবলেম নিয়ে স্টাডি করতেন। যার ফলে দেখা যেত বাসায় ফেরার আগেই তাঁর অনেক পড়াশুনা হয়ে যেত। তাঁর বাসায় ফিরে আর বেশি পড়তে হত না। ১৯৬৩ সালে তিনি প্রথম বিভাগে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন।
রেজাল্ট বের হওয়ার পরের দিন তিনি তাঁর বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। বিভাগীয় প্রধান তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, আজকে একজন শিক্ষক আসেননি, তুমি তাঁর ক্লাসটা নাও। কোন রকম পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া তাঁকে ৩য় বর্ষের ক্লাস নেওয়ার জন্য পাঠানো হল যেখানে তাঁর সহপাঠিরাও ছিলেন। কোনো কারণে তাঁদের দুই বছর নষ্ট হয়েছে। তিনি কয়েকদিন ক্লাস নিয়েছেন কোন রকম নিয়োগপত্র ছাড়াই। তারপর ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে ১৯৬৩ সালের নভেম্বর মাসে তিনি প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন পুরকৌশল বিভাগে। এভাবেই তাঁর শিক্ষকতা জীবন শুরু হল। ছাত্রজীবন এবং শিক্ষকতা জীবনের মধ্যে তাঁর কোন গ্যাপ ছিল না। পাস করার পরের দিন থেকেই শিক্ষকতা জীবনে প্রবেশ করেছেন তিনি।
তখন প্রকৌশল ক্ষেত্রে দেশে স্নাতকোত্তর পড়ার কোন সুযোগ ছিল না। ফলে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ খুঁজতে লাগলেন এবং খুব তাড়াতাড়ি সেই সুযোগ চলে এল তাঁর জীবনে। ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বার্মাশেল বৃত্তি নিয়ে চলে যান ইংল্যান্ডে। এই বৃত্তি বছরে একটাই দেয়া হতো। সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমএসসি করেন, অ্যাডভান্স স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। থিসিসের বিষয় ছিল, কংক্রিট বিমে ফাটল। ১৯৬৮ সালে তিনি পিএইচডি করেন একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। থিসিসের বিষয় ছিল, কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন অব হাইরাইজ বিল্ডিং।
পিএইচডি শেষ করে ১৯৬৮ সালে দেশে ফিরে তিনি বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এরপর ১৯৭৩ সালে সহযোগী অধ্যাপক ও ১৯৭৬ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০০১ সাল পর্যন্ত বুয়েটে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর মধ্যে কখনো বিভাগীয় প্রধান ছিলেন, ডিন ছিলেন। বুয়েটের কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক ছিলেন প্রায় ১০ বছর। ১৯৭৯ সালে ব্যাংককে UNESCAP- এ কয়েক মাস পরামর্শক হিসেবে ছিলেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে তিনি যুক্তরাজ্যের সারে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং এসোসিয়েট প্রফেসর ছিলেন। মার্চ, ২০০১ থেকে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ পর্যন্ত তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মে, ২০১১-তে এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন।
তিনি ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিআইটির গভর্নিং বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। তিনি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন যুক্তরাজ্যের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের ফেলো। যুক্তরাজ্যের একজন চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়ার, বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটির ফেলো। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটি এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অধ্যাপক চৌধুরী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনের সফটওয়্যার রফতানি এবং আইটি সার্ভিস রপ্তানী-সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৯৭ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত। তিনি প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি টাস্কফোর্সের শুরু থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত একজন সদস্য ছিলেন। এছাড়াও তিনি আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত।
এর পাশাপাশি ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী নিরন্তর গবেষণা করছেন। এ পর্যন্ত ৬২টি গবেষণাপত্র লিখেছেন, যা দেশী-বিদেশী জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি উঁচু ইমারতের শিয়ার ওয়াল ডিজাইনের সহজ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। পদ্ধতির নাম ছিল “কুল অ্যান্ড চৌধুরী মেথড”। যত দিন উঁচু ইমারত ডিজাইনে কম্পিউটার জনপ্রিয় হয়নি ততদিন এই পদ্ধতি সারা বিশ্বে ব্যবহৃত হতো।
বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব। এই সেতু উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সমগ্র দেশের মধ্যে একটা সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে। এ পাশে টাঙ্গাইল, ওপাশে সিরাজগঞ্জ এরই মধ্যে যমুনার ওপর সেতুটি দাঁড়িয়ে আছে সগর্বে। বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ এই সেতুটি (৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ) নির্মাণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন দেশী-বিদেশী অনেক বিশেষজ্ঞ। এর নকশা প্রণয়ন এবং নির্মাণের সঙ্গে যেসব বিশেষজ্ঞ জড়িত ছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। যমুনা ব্রিজের দেশীয় বিশেষজ্ঞ দলের তিনি চেয়ারম্যান। বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলের তিনি একজন সদস্য। এখানেই তাঁর কীর্তির শেষ নয়। বহুমুখী সাইক্লোন শেল্টার কর্মসূচির টিম লিডার হিসাবে ১৯৯৩ সালে তিনি উপকূলীয় এলাকায় সাইক্লোন শেল্টারের মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করেন। এরপর থেকে ওই এলাকায় তাঁর দলের করা মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী গড়ে উঠেছে সাইক্লোন শেল্টার।
১৯৭৭ সালে তাঁর ওপর সিসমিক জোনিং ম্যাপ এবং ভূমিকম্পরোধী ভবনের বিল্ডিং কোডের আউট লাইন তৈরির দায়িত্ব বর্তায়। তিনি সেই কাজ দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদন করেন। তাঁর সেই ভূমিকম্পরোধী জোনিং ম্যাপ এবং বিল্ডিং কোডের আউট লাইন মেনেই ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত নির্মাণ করা হয় বড় বড় ইমারত। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে যে স্টিয়ারিং কমিটি ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড তৈরি করেছিল, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন সেই কমিটির সদস্য। এমনই সব বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী তিনি। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে তিনি বিদেশেও সমধিক আলোচিত একজন ব্যক্তিত্ব।
বাংলাদেশে যে তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা তৈরি হয়েছে সেই নীতিমালা প্রণয়নের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। এর আগে যে খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করা হয় তার সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। তিনি তথ্যপ্রযুক্তির জন্য একটি সুপারিশমালা তৈরি করেছিলেন। সেখানে ৪৫টি সুপারিশ ছিল। যে সুপারিশগুলো জেআরসি কমিটির সুপারিশ হিসেবে উল্লিখিত ছিল। সেই সুপারিশের অনেকগুলোই বাস্তবায়িত হয়েছে।
ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। ১৯৯৬ সালে সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমানের উপদেষ্টামণ্ডলীর একজন সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে কিছু দিন তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। ফিরে আসার পরপরই সরাসরি বিচারপতি হাবিবুর রহমানের কাছ থেকে প্রস্তাব পেলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার। ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শপথ নিলেন। শপথ নেয়ার পর ওখানেই মিটিং হয়। ওই মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়। কে কোন দফতর পাবেন। তাঁকে দেয়া হয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। তিনি এই দুটো দফতরে কাজ করে খুবই আনন্দ পেয়েছিলেন। কারণ ওই দুটো মন্ত্রণালয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখতে পান সবাই তাঁর ছাত্র, প্রাক্তন সহকর্মী বা পরিচিতজন। ওই সময়টা তাঁদের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিন সপ্তাহ ধরে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছিল। ওই অবস্থা থেকে দেশে স্থিতিশীল অবস্থা ফিরিয়ে আনা ছিল তাঁদের প্রথম কাজ। তাঁরা তা আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে তাঁদের প্রধান কাজ ছিল একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা। এক্ষেত্রেও তাঁরা সফল হয়েছিলেন।
উপদেষ্টা থাকাকালীন তাঁর স্মরণীয় দিন ছিল ১৯৯৬ সালের ২০ মে। ওই দিন সেনাপ্রধানের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির মতদ্বৈততা দেখা দেয়ায় দেশে একটি অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি হয়। যা জাতির জন্য বিপজ্জনক হতে পারত। ওই দিন সারা দিন তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ছিলেন। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। উপদেষ্টা হিসেবে তাঁরা ৮২ দিন দায়িত্ব পালন করেন।
ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন তাঁকে ১৯৯৮ সালে স্বর্ণপদক প্রদান করেছে। গবেষণা এবং শিক্ষায় অবদান রাখার জন্য তিনি ১৯৯৭ সালে পান ড. রশিদ স্বর্ণপদক। রোটারির দেয়া সিড অ্যাওয়ার্ড পান তিনি ২০০০ সালে। লায়ন্স ইন্টারন্যাশনাল (ডিস্ট্রিক-৩১৫) তাঁকে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে অবদান রাখার জন্য স্বর্ণপদক প্রদান করে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
জন্ম: ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ১৯৪২ সালের ১৫ নভেম্বর সিলেট শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
বাবা-মা: তাঁর বাবার নাম আবিদ রেজা চৌধুরী এবং মার নাম হায়াতুন নেছা। ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীরা পাঁচ ভাইবোন। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তাঁর অবস্থান তৃতীয়।
পড়াশুনা: ১৯৪৯ সালে ময়মনসিংহের কিন্টারগার্ডেন স্কুল আওয়ার লেডি ফাতেমাতে তাঁর বাবা তাঁকে ভর্তি করে দেন। কিন্তু এই স্কুলে তিনি মাত্র দুই দিন যাওয়ার পর আর যাননি। কারণ ভর্তির পর দ্বিতীয় দিন যখন তিনি এই স্কুলে গেলেন তখন বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া মাখন লাগোনো রুটির টিফিনে তাঁর এক সহপাঠি পানি ঢেলে দেওয়ায় তাঁর খুব খারাপ লাগে। বাসায় এসে তিনি বললেন, ‘এই স্কুলে আর আমি যাবই না।’ এরপর তিনি সেই বছর আর স্কুলে গেলেন না, বাসায় শিক্ষক এসে পড়াতেন। পরের বছর ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে ক্লাস ফোরে ভর্তি হলেন।
এখানে দুই বছর পড়ার পর তাঁরা চলে এলেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে তাঁর বাবা তাঁকে নিয়ে গেলেন পুরান ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তির জন্য। কিন্তু এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানালেন ক্লাস সেভেনে একজনকে ভর্তি করানো যাবে কিন্তু ক্লাস সিক্সে কোন সিট নেই। প্রিয়নাথ হাইস্কুলে (নবাবপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুল) এসে ভর্তি হলেন। সেখানে তিনি এক বছর পড়েন। এর পরের বছর ১৯৫৩ সালে সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হলেন তিনি। সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল থেকে তিনি ১৯৫৭ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য তিনি ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়)। ১৯৬৩ সালে তিনি প্রথম বিভাগে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বার্মাশেল বৃত্তি নিয়ে চলে যান ইংল্যান্ডে। এই বৃত্তি বছরে একটাই দেয়া হতো। সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমএসসি করেন, অ্যাডভান্স স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। থিসিসের বিষয় ছিল কংক্রিট বিমে ফাটল। ১৯৬৮ সালে তিনি পিএইচডি করেন একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। থিসিসের বিষয় ছিল, কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন অব হাইরাইজ বিল্ডিং।
কর্মজীবন: বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং এর রেজাল্ট বের হওয়ার পরের দিন তিনি তাঁর বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। বিভাগীয় প্রধান তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, আজকে একজন শিক্ষক আসেননি, তুমি তাঁর ক্লাসটা নাও। কোন রকম পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া তাঁকে ৩য় বর্ষের ক্লাস নেওয়ার জন্য পাঠানো হল যেখানে তাঁর সহপাঠিরাও ছিলেন। কোন কারণে তাঁদের দুই বছর নষ্ট হয়েছে। তিনি কয়েকদিন ক্লাস নিয়েছেন কোন রকম নিয়োগপত্র ছাড়াই। তারপর ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে ১৯৬৩ সালের নভেম্বর মাসে তিনি প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন পুরকৌশল বিভাগে। এভাবেই তাঁর শিক্ষকতা জীবন শুরু হল। ছাত্রজীবন এবং শিক্ষকতা জীবনের মধ্যে তাঁর কোন গ্যাপ ছিল না। পাস করার পরের দিন থেকেই শিক্ষকতা জীবনে প্রবেশ করেছেন তিনি। এরপর পিএইচডি শেষ করে ১৯৬৮ সালে দেশে ফিরে তিনি বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৩ সালে সহযোগী অধ্যাপক ও ১৯৭৬ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০০১ সাল পর্যন্ত বুয়েটে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর মধ্যে কখনো বিভাগীয় প্রধান ছিলেন, ডিন ছিলেন। বুয়েটের কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক ছিলেন প্রায় ১০ বছর। ১৯৭৯ সালে ব্যাংককে UNESCAP- এ কয়েক মাস পরামর্শক হিসেবে ছিলেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে তিনি যুক্তরাজ্যের সারে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং এসোসিয়েট প্রফেসর ছিলেন। মার্চ, ২০০১ থেকে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ পর্যন্ত তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মে, ২০১১-তে এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন।
তিনি ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিআইটির গভর্নিং বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। তিনি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন যুক্তরাজ্যের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের ফেলো। যুক্তরাজ্যের একজন চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়ার, বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটির ফেলো। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটি এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অধ্যাপক চৌধুরী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনের সফটওয়্যার রফতানি এবং আইটি সার্ভিস রপ্তানী-সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৯৭ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত। তিনি প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি টাস্কফোর্সের শুরু থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত একজন সদস্য ছিলেন। এছাড়া তিনি আরো অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও জড়িত।
সংসার জীবন: স্ত্রী সেলিনা নওরোজ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। ব্যক্তিজীবনে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী দুই সন্তানের জনক। বড় সন্তান (মেয়ে) কারিশমা ফারহিন চৌধুরী, পেশায় পুরকৌশলী। ছেলে কাশিফ রেজা চৌধুরী ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রী করেছেন।
মৃত্যু: ২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র : এপ্রিল, ২০০৬ এবং জুন, ২০০৯-এ জামিলুর রেজা চৌধুরীর সরাসরি সাক্ষাৎকার নিয়ে জীবনীটি লেখা হয়েছে।
মূল লেখক: হিটলার এ. হালিম
পূনর্লিখন: গুণীজন দল