‘একটু দাঁড়াও তো।’
চমকে উঠলাম
‘পেছনে ঘোরো, আবার সামনে, হেঁটে দেখাও, চুল দেখি—দাঁত দেখি।’
ছোট খাট মানুষ দত্তদা বলেই যাচ্ছেন।
আরে, এ তো দেখি কনে দেখার মতো! আমার দিদির বিয়ের সময় এমন হয়েছিল, আমার মনে আছে। বেয়াদপ!
‘কথা তো নিশ্চয় বলতে পরো?’
বিরক্ত হয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ-সূচক ইশারা করি।
‘মাথা নাড়লে চলবে না, শব্দ করে পরিষ্কার করে বলো, তোমার নাম কী?’
আমি চুপ।
আবার বললেন, ‘নাম কী?’
‘মিনা।’
‘পুরো নাম বলো।’
‘মিনা পাল।’
সংলাপ বলো, ‘অ্যাই ছাড়ো, কেউ দেখে ফেলবে।’ দেখি তুমি অভিনয় করতে পারবে কিনা।’
এভাবেই আমার ‘সুতরাং’ ছবির জন্য ইন্টারভিউ শুরু।
দত্তদা বললেন, ‘কৃঞ্চ বাবু, কাল দুপুর ৩ টায় আর কে মিশন রোডে আমাদের অফিসে মিনাকে নিয়ে চলে আসবেন। রিহার্সেল হবে।’
আমি তাহলে পাস!
পরদিন প্রডিউসারের অফিসে গেলাম। এক হাজার এগারো টাকা নিয়ে আমি সাইন করলাম। জীবনের প্রথম রোজগার। শুরু হয়ে গেল নতুন জীবনের গল্প।
সেইসময় একহাজার এগারো টাকা পুঁজি নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় জয় করে নেয়া অভিনেত্রী কবরীর মুখেই আমরা এতক্ষণ উপরের কথাগুলো শুনলাম। তিনি বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র পরিচালক ও রাজনীতিবিদ।
চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজারে বেড়ে ওঠা কিশোরী মিনা পাল। চলচ্চিত্রে কাজ করতে আসার পর সুভাষ দত্ত মিনা পালের নাম বদলে রাখলেন কবরী। রুপালী পর্দায় অভিনেত্রী ‘কবরী’ নামই হয়ে গেল তাঁর নতুন জীবনের পরিচয় । তিনিও ধীরে ধীরে মিনার খোলস পাল্টে কবরী মোড়কে বন্দি হয়ে গেলেন।
১৯৫২ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম শ্রীকৃষ্ণ দাস পাল এবং মা শ্রীমতী লাবণ্যপ্রভা পাল।
তাঁর মা মলাটে রানি ভিক্টোরিয়ার ছবি আঁকা ‘বাল্যশিক্ষা’ বই দিয়ে তাঁর হাতেখড়ি দেন। বইটিতে মাস, ফল, পশুপাখির নাম আর নানা উপদেশ বাণী ছিল। শিশুর চরিত্র গঠনে যা যা প্রয়োজন সবই ছিল বাল্যশিক্ষায়। সকালে তার মা পড়াতেন- ‘সদা সত্য কথা বলিবে, মিথ্যা বলিয়া যদি রাজ্যলাভ হয় তবুও মিথ্যাবলিবার নয়’; তাঁরা সুর করে পড়তেন। তারপর তাঁরা সকালের জলখাবার খেতেন। কোনদিন খই-মোয়া, কোনদিন চিড়া-গুড়। আর শীতের সকালে এর সাথে যোগ হতো ভাপা পিঠা। তাঁর দিদি আলো খাবার পরিবেশন করত । চা চাইলে তাঁর দিদি বলত- ‘ছোটদের চা খেতে হয় না।’ কবরী বলতেন-‘নিজে তো ঠিকই খাস।’ সে জবাব দিত- ‘আমি তো বড়।’ দিদির সাথে কবরীর খুনসুটি লেগেই থাকত সবসময়।
চট্টগ্রামে কবরীরা যে বাড়িতে থাকতেন সেখানে একটা চাপকল ছিল। ভোরে ঘুম থেকে উঠে খালি গায়ে হাফ প্যান্ট পরা অবস্থায় উঠানে চাপকল ঘিরে কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতেন।
পুতুলের বিয়ে, তাদেরকে শ্বশুর বাড়ি পাঠানো, তাদের ছেলেমেয়ে এমন অনেক কাজ নিয়ে ছেলেবেলায় খুব ব্যস্ত থাকতেন তিনি।। বিস্কুটের বাক্স ছিল তাঁর পুতুরের ঘর। পুতুল আর পুতুলের শাড়ি বানিয়ে দেওয়ার জন্য মায়ের কাছে আবদার করতেন । মা পুরনো শাড়ি ছিঁড়ে দিতেন, আবার পাড়ার দরজির কাছ থেকে কখনো কখনো নতুন টুকরা কাপড় চেয়ে আনতেন তিনি। পূজা-ঈদ এলে পুতুলের নতুন কাপড় বানাতেন। মনেহতো পুতুল গুলোর সাথেই তাঁর সংসার।
তাঁর প্রথম স্কুল ছিল অলংকরণ বালিকা বিদ্যালয়। একটু বড় হলে তাঁর মা তাঁকে জে এম সেন স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করান। মাধ্যমিক স্কুল। সময়মতো স্কুলে পৌঁছাতে সকালে ঘুম থেকে উঠেই দৌড় দিতেন। তাঁর মা স্কুলের ফ্রক ভাঁজ করে বালিশের নিচে রাখতেন। ব্যস ইস্ত্রি হয়ে গেল। ঐ ফ্রক পরে দিদিমার সাথে স্কুলে যেতেন তিনি।
তাঁর বাবার খুব শখ ছিল তাঁর সন্তানেরা কেউ নাচবে, কেউ গাইবে, ছোট ভাই তবলা বাজাবে। মার পুঁথিপাঠ শুনতে বাবা খুব পছন্দ করতেন। তাঁর মা লাল সালু কাপড়ে পুঁথি জড়িয়ে উপরের তাকে যত্ন করে রাখতেন। পুঁথি পড়বার সময় তাঁর মা তাঁদেরকেও সাথে রাখতেন। তাঁরাও যথাসাধ্য পবিত্র হয়ে মার পাশে বসতেন। তিনি কী চমৎকার সুর করে পড়তেন! তাঁর বাবা একটি চেয়ারে বসে পুঁথি পড়া শুনতেন । ভাই-বোনরা মায়ের চারপাশে গোল হয়ে বসে গলা মেলাতেন, সুরে সুরে গাইবার চেষ্টা করতেন। চোখ বন্ধ করে উপভোগ করতেন তাঁর বাবা, একটু একটু গুনগুনও করতেন তিনি।
কোন কোন সন্ধ্যায় তাঁর মার পুঁথি পড়া শেষ না হতেই কালিদাস স্যার চলে আসতেন। ভাই বোনেরা পাটি বিছিয়ে স্যারের কাছে পড়তে বসতেন। আস্তে পড়লে স্যার বলতেন, ‘ফাঁকি দেওয়া চলবে না, আওয়াজ জোরে জোরে।’
প্রায়ই চট্টগ্রামের ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠান হতো। কবরীর বড় বোন লীলা ও লক্ষ্ণী নাচত। এক বোন গাইত। তাঁর জীবনে প্রথম মঞ্চে ওঠা রবীন্দ্রনাথের গানের সাথে নাচের জন্য –‘ হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ুরের মতো নাচেরে।’ তখন টুকটাক নাচতেন তিনি। এরপর মঞ্চে এক/দুবার নেচেছেন। রুনু বিশ্বাস ছিলেন তাঁদের নৃত্যগুরু। তাঁর বাবাকে মামা ডাকতেন। আত্মীয়ের চাইতেও বেশি আপন ছিলেন তিনি। তাঁদের সব ভাইবোনকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন তিনি। শাসন করতেন আবার আদরও করতেন। রুনু বিশ্বাসের কাছে তাঁর নাচের হাতেখড়ি। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বাবা তাঁকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। সেকারণে এখন তাঁর মনেহয় এভাবেই বুঝি তাঁর ভবিষ্যৎ গড়া হচ্ছিল।
চট্টগ্রামে কবরীর বাবাকে সবাই চেনে, সম্মান করে। পাড়ায়, তাঁদের দেশের বাড়িতে, চট্টগ্রাম শহরে মানুষের বিপদে আপদে ছুটে যেতেন তাঁর বাবা। বাড়িতে অতিথি অসময়ে এলেও না খাইয়ে ছাড়তেন না তিনি। গরিব আত্মীয়দের সাহায্য করতেন-তাদের মেয়ের বিয়ে দিতেন। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়ার সুবাদে ডা. কামালের সাথে তাঁর বাবার পরিচয় ঘটে। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক জগতের নামকরা মানুষ। তাঁরই সুবাদে কবরীর চলচ্চিত্রে আসা। রুনু বিশ্বাস আর তাঁর বাবা ঢাকায় তাঁর চলচ্চিত্রে কাজ করার দিনক্ষণ ঠিক করতে লাগলেন। সত্যসাহা যথেষ্ট সাহায্য করেন। কিন্তু এ খবরে তাঁর মার মাথায় যেন বজ্রপাত পড়ে। কিছুতেই তাঁর মা রাজি হচ্ছেন না। বিলাপ করে কাঁদছেন- ‘আমার দুধের বাচ্চাকে আমি দেব না, সিনেমায় গেলে পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যাবে, নষ্ট করে ফেলবে। যদি সিনেমা করতেই হয় পড়া শেষ করার পর ‘। আরও অনেক কিছু বলছিলেন তিনি। তাঁর সহজ সরল মা বুঝতেই পারছেন না- সিনেমার লোকজন ততদিন তাঁর জন্য বসে থাকবে না।
কবরীও কেঁদেছেন কারণ চলচ্চিত্রের শখ তাঁর ছিল না। তাছাড়া তিনি আসলে ভালো করে বুঝতেই পারছিলেন না কী ঘটতে যাচ্ছে । কোন কিশোরী মেয়ের কি তার মা, ভাই-বোন, স্কুল, স্কুল সাথী, খেলার মাঠ, পুতুলের সংসার সবকিছু ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে ? কিন্তু তাঁর কামাল চাচা আর বাবার ইচ্ছের কাছে তাঁর ইচ্ছে অনিচ্ছের কোন মূল্য ছিল না। আর তাঁর বয়সই বা তখন কত?
চলচ্চিত্রে অভিনয় করার জন্য যেদিন তিনি চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসেন সেদিন বাড়ির সবাই কান্নাকাটি করছিল, বিশেষ করে তাঁর মা খুব কান্নাকাটি করছিলেন। ঢাকায় যাওয়ার জন্য স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, ট্রেন যতই কাছে আসছে ততই তিনি মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছিলেন।
কনে বিদায়ের মতো মার বুক থেকে টেনে তাঁকে ট্রেনে ওঠানো হলো। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে কবরী , তাঁর বাবা আর তাঁর আলোদিদি তিনজন সদরঘাটের এক বোর্ডিং এ উঠলেন। মা, ভাই বোন, স্কুলের বন্ধু, এমনকি পুতুল খেলার সাথীদের জন্য তাঁর খুব মায়া হচ্ছিল। কিছুটা বুঝে , কিছুটা না বুঝেই ১৩ বছরের মেয়েটি সবার মুখে হাসি ফুটাতে সংসারের হাল ধরলেন।
নানা কিছুর তালিম শেষে শুটিং শুরু হয়। আজকের অভিজাত গুলশান তখন গ্রাম। এই গুলশানেই ‘সুতরাং’ এর প্রথম লোকেশন। সিনেমায় পা রেখে সত্যিকারের বড় হতে শুরু করেন তিনি। ‘সুতরাং’ ছবি মুক্তির পর চারিদিকে হৈচৈ পড়ে যায়- নতুন অভিনেত্রী নতুন অভিনেতা নতুন পরিচালক সবাই দারুন কাজ করেছে- এক্কেবারে সুপার ডুপার। সাংবাদিক আজিজ মিছির চিত্রালীতে লিখলেন- ‘আসলাম, দেখলাম জয় করলাম।’ পিজি হাসপাতালের ভবনটি আগে শাহবাগ হোটেল ছিল। ওখানে পুরো টিমকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ‘সুতরাং’ ছবিটি কম্বোডিয়ার এক ফেস্টিভ্যালে সেকেন্ড বেষ্ট ফিল্ম পুরস্কার পায়।
তখন নামি দামি অভিনেত্রীর সংজ্ঞা তিনি বুঝতেন না। মন, মগজ, বুদ্ধি কিছুই পোক্ত হয়নি। টাকার লোভ মাথায় বাসা বাঁধেনি। শক্তিশালী এই মিডিয়াকে মোকাবেলা করার জন্য পরিপূর্ণভাবে তৈরী হয়েও আসেননি তিনি। কিন্তু তাঁর প্রথম ছবি ‘সুতরাং’ শুধু বক্স অফিসেই সাফল্য আনেনি, একটি সুন্দর, মার্জিত, বিনোদন ছবি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এখনও অনেকে তাঁকে বলেন, নতুন বিয়ের পর তারা স্ত্রীকে নিয়ে ‘সুতরাং’ দেখেছেন বহুবার, উপহার হিসেবে।
তাঁর বড় ছেলে জন্মাবার পর ‘বাহানা’ চলচ্চিত্রে কাজ করার প্রস্তাব পান তিনি। ওটাই তাঁর দ্বিতীয় চলচ্চিত্র। জহির রায়হানের পরিচালনায় এটিই পাকিস্তানে প্রথম সিনেমাস্কোপ উর্দু ছবি। তারপর খান আতার ‘সোয়ে নদীয়া জাগে পানি’ ছাড়াও আরও কয়েকটি উর্দু ছবিতে কাজ করেন তিনি। যেমন- ইবনে মিজানের ‘মেরে সনম’।
তাঁর উর্দু চলচ্চিত্র কোনটাই ব্যবসা সফল হয়নি। তবে চলচ্চিত্র শিল্প তখন অত্যন্ত মর্যাদা অর্জন করেছিল। খান আতাউর রহমানের ‘সোয়ে নদীয়া জাগে পানি’ মস্কো-তাসখন্দে আফ্রো এশিয়ান ফেস্টিভৗালে প্রচুর প্রশংসা কুড়ায়। পূর্ব-পাকিস্তানের স্টুডিওতে সাব- টাইটেলের ব্যবস্থা ছিল না। তাসখন্দে যাবার পর কর্তৃপক্ষ প্রথমে চলচ্চিত্রটি বাতিল করে দেয়। একদিন সময় চেয়ে নিয়ে তাসখন্দে বসেই খান আতাউর রহমান চলচ্চিত্রটির ইংরেজী সাবটাইটেল করেন। চলচ্চিত্রটি পুরস্কারও পায়। অত্যন্ত মেধাবী ও বহু গুণের অধিকারী ছিলেন খান আতাউর রহমান।
৬৬ থেকে ৭০ সাল পর্যন্ত ঝড়ের বেগে কাজ করেছেন কবরী। দিনরাত কাজ করতেন। শুটিং শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ২ টা -৩টা কখনও কখনও ভোর ৪ টা বেজে যেত । সকালে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখতেন বাচ্চারা ঘুমিয়ে আছে অথবা স্কুলে গেছে। আর রাতে এসে দেখতেন বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে।
এভাবে ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্র দিয়ে অভিনয় জীবনের শুরু করে প্রায় একশ’টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি ৷ এগুলোর মধ্যে হীরামন, রংবাজ, ময়নামতি, চোরাবালি, পারুলের সংসার, বিনিময়, আগন্তুক’সহ জহির রায়হানের তৈরি উর্দু ছবি ‘বাহানা’ এবং ভারতের চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উল্লেখযোগ্য৷
চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ব্যস্ততার মাঝে তাঁর মার চেষ্টায় প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন কবরী। পড়ার অভ্যাসটা সেই শৈশবেই রপ্ত হয়েছিল। যা আজও যায়নি। বহু নমস্য মানুষের সান্নিধ্য যেমন পেয়েছেন, তেমনি চেষ্টা করেছেন সবার কাছ থেকে কিছু না কিছু শেখার। শেখাতে তিনি নিজেও কখনও কার্পণ্য করেননি। তাঁর কাছে কেউ কিছু জানতে চাইলে তিনি যথাসাধ্য সাহায্য করতে চেষ্টা করেন।
‘ময়নামতি’ ছবিটি রিলিজের আগেই ‘রাজ্জাক-কবরী’ জনপ্রিয় জুটি হিসেবে এতটাই পরিচিতি পায় যে গ্রামে শুটিং দেখতে প্রচুর লোক ভিড় করত। কবরী আর রাজ্জাক প্রেমিক-প্রেমিকা। রাজ্জাক কবরী জুটি আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পায়।
৬৯-৭০ সালে আন্দোলনের সময় কবরীর সিনেমা তুঙ্গে। তখন পূর্বপাকিস্তানে প্রতিদিনই মিছিল করা হতো। সবার মধ্যে উত্তেজনা, ভয়। কবরীর বাবাও এসব রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। শেখ মুজিবুর রহমানের কোন মিটিং বাদ দিতেন না তিনি। একবার তো পাঞ্জাবি ছিঁড়ে জুতা হারিয়ে কোনমতে প্রানটুকু নিয়ে বাসায় এলেন। কোন এক মিটিং এ লোকের ধাক্কাধাক্কিতে এসব ঘটে। পরিবারের সবার শত নিষেধ উপেক্ষা করেও লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি মিটিং এ যেতেন। ৬৯-৭০-৭১ সালে রাজনীতির ডামাডোলে দেশ গরম।
যুদ্ধের সময় উৎকন্ঠা আর উদ্বেগের মধ্যে কিছুদিন ঢাকায় থাকার পর তাঁরা ঢাকা ছেড়ে বাবার বাড়ি চট্টগ্রামে যান। সেখানেও উত্তেজনা। নিরাপত্তার কথা ভেবে মা তাঁকে বাড়িতে না রেখে এক আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। কোথাও বেশিদিন টিকতে পারছিলেন না। এক বাসা থেকে আরেক বাসা এভাবে বদল করতে থাকেন। তাঁরা ঢাকা থেকে দুটি গাড়ি নিয়ে চট্রগ্রামে গিয়েছিলেন। কয়েকজন তরুণ এসে বলল- আপা, একটা গাড়ি আমাদের দিন, রসদ আনতে হবে, গাড়ির তেলের কোটা করে দিয়েছে- গাড়িটা আমাদের দিয়ে দিলে যুদ্ধের সময় কাজে লাগবে।
তিনি তাঁর মাইক্রোবাসটি তাঁদেরকে দিয়ে দিলেন। তিনি জানেন না আর কোনদিন তাঁদের সাথে দেখা হবে কিনা, অচেনা ছেলেগুলোর জন্য তাঁর বুকের ভিতর কেমন মোচড় দিয়ে উঠল।
এরপর চট্টগ্রাম থাকাও নিরাপদ নয় ভেবে তাঁরা টয়োটা গাড়িটা নিয়ে গ্রামের বাড়িতে রওনা দেন। গ্রামের চারিদিক থমথমে, কোন উচ্ছ্বাস নেই। ছেলেবেলায় গ্রামের বাড়িতে যাবার সেই আনন্দ নাই। আগে গ্রামে গেলে জাল দিয়ে তাঁর বাবা মাছ ধরতেন, শহরের লোক দেখতে দূর-স্বজনরা ভিড় করতেন,এসব কিছুই নেই। সব ওলট পালট হয়েছে। কোথায় কী যেন ঘটে গেছে। গেছে তো বটেই, শহরের গণ্ডগোল গ্রামে ঢুকে পড়েছে। বিবিসি, আকাশবাণী রেডিওতে সমানতালে খবর শুনছে গ্রামের সবাই। ছোট রেডিওটাই তখন একমাত্র সম্বল। কয়েকদিনেই তাঁর জুটে গেল বেশ কয়েকজন বন্ধু। তাদের সাথে গায়ের মেঠো পথে হাঁটেন, গল্প করেন। দল বেঁধে পুকুরে স্নান করেন। প্রখ্যাত অভিনেত্রী কবরী অতি সাধারণ মেয়ের মতো গ্রামের মেয়েদের সাথে মিশে গেছেন। মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই একসাথে গ্রামের বাড়িতে আছেন। সবার এক প্রশ্ন দেশ কবে স্বাধীন হবে? দিন দিন গ্রামের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। মাঝে মাঝে রাজাকারদের ভয় ছাড়াও নানান উৎপাত শুরু হয়। লোকজনকে মিছেমিছি আর্মি আসার ভয় দেখানো হয়। আর্মি আসার কথা শুনলেই সবাই ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিতেন। পরে তাঁরা শুনতেন বাড়িঘর লুট করার মতলবে এসব মিথ্যা গুজব ছড়ানো হতো। কবরীর দুশ্চিন্তা বাচ্চাদের নিয়ে। টাকা পয়সা শেষ হয়ে যাচ্ছে এখন কী করবেন তিনি। কবরী গ্রামে এসেছে এ খবর রটে যাওয়ায় গ্রামের সবাই ভয় পেতে শুরু করে। যেকোন সময় পাকিস্তানি আর্মি আক্রমণ করতে পারে। অনেকের ইচ্ছা কবরীরা যেন গ্রাম ছেড়ে চলে যান। তিনি ভাবতেই পারছেন না কোথায় যাবেন। অনেক লোক সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালাচ্ছে।
নিরাপত্তার খাতিরে ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন কবরীও। টানা তিনদিন তিনরাত হেঁটে রামগড়ের নারায়ণহাটে পৌঁছান। সেখানে পৌঁছার পর আর্মি ক্যাপ্টেন কাদেরের সাথে তাঁদের দেখা হয়। দুই সন্তান নিয়ে কবরীর বিচলিত অবস্থা দেখে ক্যাপ্টেন কাদের তাঁদের আস্থা দেন। ক্যাপ্টেন কাদের তাঁদেরকে সাথে নিয়ে সীমান্ত পার করে আগরতলায় পৌঁছে দেন । ক্যাপ্টেন কাদের কবরীর জীবনের দু:সহ ও দু:খের স্মৃতি হয়ে টিকে আছেন। কারণ আগরতলা থেকে ফেরার পথে শহীদ হন তিনি। কবরী বলেন, ‘আমাকে এভাবে পৌঁছাতে না গেলে ক্যাপ্টেন কাদের শহীদ হতেন না।’
কবরী ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল আগরতলা পৌঁছান। হাজার হাজার শরণার্থী সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলো। জায়গার সংকুলান না হওয়ায় কেউ গাছের তলে, কেউ খোলা আকাশের নিচে; সে এক করুণ দৃশ্য। তৎকালীন যুগান্তর পত্রিকার সংবাদিক অনীল ভট্টাচার্য কবরীকে শরণার্থী ক্যাম্পে দেখতে পেয়ে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। কবরী প্রায় ১০-১২ দিন সেখানে অবস্থান করে চলে যান কলকাতার দীপঙ্কর দে’র বাড়িতে। তাঁর কাজ মূলত তখন থেকেই শুরু হয়।
কবরী মুক্তিযুদ্ধের তহবিল গঠনের কাজ শুরু করেন । তিনি দেখা করেন কলকাতায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হোসেন আলীর সাথে । ‘জয় জোয়ান নাইট’ নামের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় তখন । শ্রীমতি নার্গীস, সুনীল দত্ত, ধর্মেন্দ্র, শত্রুঘ্ন সিনহা, অংশুমান রায়, সলিল চৌধুরীসহ আরো অনেক খ্যাতনামা শিল্পী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। এদের নিয়ে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করেন কবরী। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অনুষ্ঠানে সংগৃহীত টাকা পাঠাতেন । জনমত সৃষ্টি করা তার প্রধান লক্ষ্য ছিলো । আর সেকারণে তিনি বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তব্য পেশ করতে থাকেন।
কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের সামনে একটি অনুষ্ঠানে আয়োজকরা তাঁকে বক্তৃতা দিতে মঞ্চে উঠায়। লোকে লোকারণ্য। জীবনে তো শুধুই অভিনয় করেছেন তিনি, বক্তৃতা তো কখনও করেননি। কি বক্তৃতা করবেন তিনি ভেবে কূল পাচ্ছেন না। একদিকে পূর্ব পাকিস্তানে রুপালি পর্দার শীর্ষ অভিনেত্রী, অন্যদিকে অনাহারক্লিষ্ট কর্মহীন, জীবন-মরণ লড়াইয়ে নামা একজন শরণার্থী। মা-বাবা ভাই বোন আত্মীয় স্বজন সবাইকে ছেড়ে ঘর ছাড়া দেশ ছাড়া তিনি। পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে বাঁচতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দু:খ কষ্ট মান সম্মানের কথা ভাবার সাথে সাথে গলা শুকিয়ে আসে তাঁর। কোন আওয়াজ বের হয় না। তারপরও মঞ্চে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে অনেক কথা বলে ফেলেন তিনি। তাঁদেরকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচাতে বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানাতে না জানাতেই জ্ঞান হারিয়ে মঞ্চে পড়ে যান ।
তখন আকাশবাণি কলকাতা থেকে বাংলা সংবাদের পর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্প্রচার হতো। কবরীর সেদিনের বক্তৃতার অংশ আকাশবাণি কলকাতা থেকে সম্প্রচারিত হলো। তাঁর বক্তৃতার অংশটুকু বারবার বাজাল। সেই বক্তৃতা অনেক মুক্তিযোদ্ধা শুনেছিল। আকাশ বাণিতে কবরীর কন্ঠ শুনে তাঁর মার মনে শান্তি নেমেছিল। তিনি বুঝতে পারলেন তাঁরা তখনও বেঁচে আছেন। অনেক স্বজন তাঁর বাবাকে বলেন, আপনার মেয়ে ভারতে ভাষণ দিয়ে বেড়াচ্ছে। তার কারণে আমরা মারা পড়ব।
তারা মা-বাবা, ভাই-বোনকে গ্রাম ছেড়ে যাবার কথা বলেন। তাদের আচরণে মানসিকভাবে মুষড়ে পড়েছিলেন তাঁর বাবা। একসময় গ্রাম ছাড়লেন তারা। গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে উজ্জিবীত করতে তিনি শুধু কলকাতা-বোম্বে-দিল্লিই নয় ভারতের অনেক শহরেই ছুটে বেরিয়েছেন। দেশ স্বাধীনের পর দেশে ফেরত এলেন। তাঁর মনেহলো হাজার বছর পর যেন দেশে ফিরে এলেন। ঢাকায় ফিরে দেখেন বাসায় কিচ্ছু নেই। তাঁর সংগ্রহের ছবি, জরুরী কাগজপত্র, সার্টিফিকেট কিছুই নেই। বাড়ি লুট, গাড়ি লুট, এ্যাকাউন্ট লুট। বিশ্রী অবস্থা, অর্থকষ্ট চরমে। ফিরে এসে মা-বাবা-ভাই-বোনের সাথে দেখা করার জন্য চট্টগ্রাম যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি আবারও চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন।
রাশিয়ায় দেশের বাইরে ১৯৭৩ সালে প্রথম ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যান তিনি। তাসখন্দ শহরের এই ফেস্টিভ্যালে সফর দলে ববিতা, সুজাতা, রাজ্জাক, আজিম, হাসান ইমাম, খান আতাউর রহমান, গোলাম মোস্তফা ছিলেন।
দ্বিতীয়বার মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তিনি ১৯৭৯ সালে গিয়েছিলেন। তিনি এশিয়ান ফেস্টিভ্যালে ডেলিগেট ছিলেন। জুরি হিসেবে মাদ্রিদে ইন্ডিয়ান ফেস্টিভ্যালে আমন্ত্রণ পান। অতিথি হয়ে জার্মানির হার্মবুর্গে শর্টফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও যান । এছাড়া আরও অনেক ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণ করেন তিনি। কবরী ২০০১ সালে বাংলাদেশে মিলেনিয়াম ফেস্টিভ্যাল করেন ।
২০০৫ সালে “আয়না” নামের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন কবরী। এটি নির্মাণের মাধ্যমে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। তিনি এই চলচ্চিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ও করেন । এরপর কবরী রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
নারায়নগঞ্জের ৪ নম্বর আসন থেকে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। যুক্ত রয়েছেন অসংখ্য নারী অধিকার ও সমাজসেবামূলক সংগঠনের সাথে ৷ ১৯৯৬ সালে ঝুঁকি নিয়ে বেবিট্যাক্সি করে উত্তরা থেকে খালেদা জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে জনতার মঞ্চে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন তিনি। ঢাকা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সভায় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সাথে অংশ নেন এবং বক্তৃতা দেন।
কবরী প্রথমে চিত্ত চৌধুরীকে বিয়ে করেন। কিন্তু তাঁদের এ বিয়ে টেকেনি, বিচ্ছেদ হয়। এরপর ১৯৭৮ সালে তিনি বিয়ে করেন সফিউদ্দিন সরোয়ারকে। ২০০৮ সালে সফিউদ্দিন সরোয়ারের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয়। তাঁর ৫ সন্তান। অঞ্জন (বাবুনী), রিজওয়ান (মন্টি), শাকের, জয়নাল (চিশতি) ও শান।
তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার, আজীবন সম্মাননা, বাচসাস পুরষ্কারসহ আরও অনেক পুরষ্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। ২০১৭ সালে অমর একুশে গ্রন্থ মেলোয় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই স্মৃতিটুকু থাক।
মৃত্যু: এপ্রিল ১৭, ২০২১ সালে তিনি সত্তর বছর বয়সে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র: কবরীর লেখা ‘স্মৃতিটুকু থাক’ গ্রন্থ । প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি- ২০১৭, প্রকাশক- বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর পাবলিশিং লিমিটেড (বিপিএল)।
লেখক: মৌরী তানিয়া