১৯৬৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর। দিনটি ছিল সবার জন্য খুব খুশির ও ঐতিহাসিক একটি দিন। কারণ এদিনটিতে টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয়। আর তিনিই ছিলেন প্রথম শিল্পী, যিনি প্রথম এই নতুন মিডিয়াতে গান পরিবেশন করেন এবং এজন্য তিনি নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করেন । তাঁর জন্য আরও একটি বিস্ময় অপেক্ষা করছিল, টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হওয়ার ঠিক তিনদিন পর ২৭ ডিসেম্বর ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’ নামে প্রথম সঙ্গীত শিক্ষা বিষয়ক একটি অনুষ্ঠানের প্রচার শুরু হয়। এই অনুষ্ঠানে তাঁকে শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়। তিনি তখন বুঝতে পারছিলেন না প্রস্তাবটি গ্রহণ করবেন কিনা। কারণ তিনি নিজেই তখন শিক্ষানবিশ ছিলেন। তখনকার টেলিভিশনের জেনারেল ম্যানেজার এবং অনুষ্ঠান প্রযোজক প্রখ্যাত শিল্পী কলীম শরাফী (তাঁর কলীম চাচা) এবং প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এবং প্রযোজক মুস্তাফা মনোয়ার (তাঁর মন্টু ভাই) তাঁকে প্রস্তাবটি গ্রহণ করার জন্য উৎসাহিত করেন। তাঁদের উৎসাহে তিনি এই প্রস্তাবে রাজি হন এবং ১২-১৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানটি ছিল সাপ্তাহিক। শনিবার সন্ধ্যায় প্রচার হতো। সেসময় সব অনুষ্ঠানই সরাসরি প্রচার করা হতো। তখন ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট বিল্ডিং-এ মাঝারি সাইজের একমাত্র স্টুডিও ছিল এবং প্রতিদিন সন্ধ্যায় ৩-৪ ঘন্টা ধরে এই স্টুডিও থেকে অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো।
বিস্ময়করভাবে ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’ নামের এই অনুষ্ঠানটি তখন খুব জনপ্রিয় হয় এবং তিনি প্রথম ‘বউ কথা কও বউ কথা কও, কও কথা অভিমানীনি—’ নামের একটি নজরুল সঙ্গীত শেখানোর মধ্য দিয়ে এই অনুষ্ঠানটি শুরু করেন। শিক্ষার্থীরা বয়সে তাঁর চেয়ে খুব বেশি ছোট ছিল না। তারা সবাই তখন কিশোর কিশোরী ছিল। তারা তাঁকে আপা ডাকত। তাদের মধ্যে এখন কেউ কেউ জনপ্রিয় টিভি এবং রেডিও শিল্পী। খুব আনন্দের সাথে তিনি এই অনুষ্ঠানটি করতেন, যদিও তিনি শুরুতে এই অনুষ্ঠানের সফলতা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। দীর্ঘ দুই বছর এই অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায় এবং অল্প বিরতির পর আবার এটির প্রচার শুরু হয়।
পুনরায় এই অনুষ্ঠানটির প্রচার শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন সময় প্রখ্যাত নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ফিরোজা বেগম, খান আতাউর রহমান ও সুরকার, শিল্পী আজাদ রহমান এই অনুষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। নি:সন্দেহে তাঁরা সবাই খুব অভিজ্ঞ ও ভাল শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবারও তাঁকে এই অনুষ্ঠানে গান শেখানো শুরু করার জন্য অনেক করে তাকে অনুরোধ করা হয় এবং তিনি তাতে রাজি হন। এই সময় কিশোর কিশোরীরা তাঁকে আপা বলে ডাকত কিন্তু তিনি তাদেরকে বলেন, তাঁকে খালামনি বলে ডাকতে। তখন থেকে তিনি তাদের খালামনি হয়ে যান। আর এই সময় থেকে অনুষ্ঠানটির নাম হয় ‘এসো গান শিখি’।
তিনি যখন গান নিয়ে পড়াশুনা করার জন্য লন্ডনে যান এবং পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়া সরকারের আমন্ত্রণে সেখানে যান তখন তিনি এসব দেশের টেলিভিশনে প্রচারিত বাচ্চাদের অনুষ্ঠানগুলো দেখেন। তিনি খেয়াল করেন এসব দেশের বাচ্চাদের অনুষ্ঠানগুলো একই সাথে শিক্ষণীয় এবং আনন্দদায়ক হয়। সেখানকার শিশুরা আনন্দের মধ্যে দিয়ে শিখছে। তিনি লক্ষ্য করলেন অনুষ্ঠানগুলোতে মজার ও হাসির চরিত্র আছে। চরিত্রগুলো হলো- পাপেট ও মাপেট। আর এখান থেকে তিনি ‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠানে পাপেট এর ব্যবহার শুরু করেন।
সিলভিয়া মুর্তুজা নামে এক ব্রিটিশ বন্ধুর সাথে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি নিজেই একজন পাপেটার। তিনি নিজে বানিয়ে তাঁকে একটি খরগোশ ও একটি ব্যাঙ উপহার দেন। তিনি তাদের নাম রাখেন- মিঠু ও মন্টি। মিঠুর চরিত্রটিতে কন্ঠ দেন তাঁর বড় ছেলে রুবাইয়াত এবং মন্টির চরিত্রে কন্ঠ দেন বাংলাদেশি অভিনেতা শেখর। এভাবেই বাংলাদেশ টেলিভিশনে ১৯৭৫ সালে দুটি জনপ্রিয় পাপেটের জন্ম হয়। তাঁরা শুধু শিশুদের নয় বড়দের কাছেও এখন পর্যন্ত জনপ্রিয়।
একসময় পশ্চিম বাংলার দর্শকরা খুব সহজেই বিটিভির অনুষ্ঠান দেখতে পেত। সেখানকার দর্শকদের কাছ থেকে তিনি প্রচুর চিঠি পেতেন, যারা লিখতেন এই অনুষ্ঠানটি তাঁদের খুব ভাল লাগে। সেসময তিনি পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতেন এবং সেসব অনুষ্ঠানে তাঁর নাম ঘোষণার সময় নামের শেষে খালামনি ব্যবহৃত হতো। এটা তাঁর জন্য খুব আনন্দের বিষয় ছিল। এই অনুষ্ঠানগুলোতে প্রচুর শিশু-কিশোররা আসত এবং তাঁকে ‘এসো গান শিখি’র গানগুলো গাইতে হতো। এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিটিভির এই অনুষ্ঠানটি দর্শকরা দেখতে পায়। প্রবাসীরা চাইলে এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের ছেলে-মেয়েকে বাংলা গান শেখাতে পারেন।
এতক্ষণ আমরা যাঁর কথা বলছি আমার বিশ্বাস আপনারা সবাই বুঝতে পেরেছেন, তিনি কে? ফেরদৌসী রহমান। হ্যাঁ, শিল্পী ফেরদৌসী রহমানের কথাই আমরা বলছি।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগতের মুস্টিমেয় কজন ব্যক্তি যারা বাংলাদেশে প্রখ্যাত হয়েছেন এবং নিজেদেরকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিনত করেছেন তাঁদের মধ্যে ফেরদৌসী রহমান অন্যতম। তিনি শুধু ভাল গান করেন এটিই মুখ্য বিষয় নয়, তিনি তাঁর সমস্ত জীবন গানের জন্য উৎসর্গ করেছেন।
ফেরদৌসী রহমান ১৯৪১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের একটি ছোট ও সুন্দর শহর কোচবিহারে জন্মগ্রহণ করেন। লোকসঙ্গীত শিল্পী, কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও বাংলা লোক সঙ্গীতের সম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদের একমাত্র মেয়ে ফেরদৌসী রহমান। আব্বাসউদ্দীন আহমদ তাঁর চার সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট সন্তানের নাম রাখেন বিখ্যাত পার্সিয়ান কবি ফেরদৌসির নামানুসারে। ফেরদৌসী রহমানের ভাই মোস্তফা কামাল বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি। তাঁর আরেক ভাই মোস্তফা জামান ছোট বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বড় ভাই মোস্তফা জামান আব্বাসী বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী এবং বাংলা লোক সঙ্গীতের একজন গবেষক। তাঁর বাবা আব্বাসউদ্দীন আহমদ এমন একটি পরিবেশে ফেরদৌসী রহমানকে বড় করেছেন যে পরিবেশ তাঁর মনে গানের তৃঞ্চা জাগিয়েছে। বাবার মতো একজন ভাল শিক্ষক এবং বাড়িতে সঙ্গীতের এমন পরিবেশের কারণে তাঁর গানের এই দীর্ঘ পথ অনেক ছেলেবেলা থেকেই শুরু হয়েছিল। মাত্র ৬ বছর বয়সে কলকাতায় তিনি প্রথম স্টেজে গান করেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তাঁরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। সেবছরই রেডিওতে প্রথমবারের মতো ‘খেলাঘর’ নামে একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৫৫ সালে তিনি রেডিওতে প্রথম গান গাইতে শুরু করেন। বয়সে অনেক ছোট হওয়ার কারণে রেডিওতে গান গাওয়ার জন্য তাঁকে বিশেষভাবে অনুমতি নিতে হয়েছিল। ১৯৫৫ সালের আগষ্টের এক সকালে রেডিওতে তাঁর প্রথম অনুষ্ঠান হয়। যেখানে তিনি রাগের একটি খেয়াল ‘মিয়ান কি তরী’ গেয়েছিলেন । তাঁর বাবার তত্ত্বাবধানে থেকে তখনকার বিখ্যাত ওস্তাদ আবদুল গফুর খান, মোহাম্মদ হোসেন খসরু, ওস্তাদ ইউসুফ খান কোরেশি, ওস্তাদ কাদের জামিরি, ওস্তাদ মুনশি রইসউদ্দিন, ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খান, ওস্তাদ মুনির হোসেন, ওস্তাদ মাস্তান গামা এবং শেষে ওস্তাদ নাজাকাত আলী খান এবং সালামাত আলী খানের কাছে তালিম নেন।
১৯৫৭ সালে করাচিতে এইচএমভি থেকে তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয় । যেখানে তাঁর দুটি লোক গান যুক্ত হয়েছিল। গান দুটি সেইসময় খুব জনপ্রিয় হয়। গান দুটি হলো- ‘আমার প্রাণের ব্যথা কে বুঝিবে সই,’ এবং ‘আমায় ঘর ছাড়া করিলি’। ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিনি ‘ওই যে আকাশ নীল হলো আজ তোমার প্রেমে’ গানটি গাইলেন। তিনি ইতিমধ্যে বিভিন্ন সিনেমায় প্লেব্যাক শুরু করেছেন। তিনি ‘আসিয়া’ নামের সিনেমাতে প্রথম প্লেব্যাক করেন। যদিও এই সিনেমাটি অনেক পরে মুক্তি পেয়েছে। তাঁর গান নিয়ে প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘এ দেশ তোমার আমার’। অপরদিকে সেইসময় পূর্ব পাকিস্তানের প্রযোজকরা সকল বাঙ্গালি শিল্পী ও টেকনিশিয়ানদেরকে নিয়ে উর্দু সিনেমা বানানো শুরু করেন। এরকম প্রথম সিনেমা ‘চন্দা’। তাৎক্ষণিকভাবে সিনেমাটি পাকিস্তানের দুই অংশেই দারুন জনপ্রিয় হয়। এই সিনেমার বেশিরভাগ গানই ফেরদৌসী রহমানের গাওয়া। গানগুলি তিনি উর্দুতে গেয়েছিলেন। এই গানগুলোর মাধ্যমে তিনি সমগ্র পাকিস্তানে জনপ্রিয় শিল্পী হয়ে ওঠেন। পাকিস্তানের উভয় অংশের বেশিরভাগ সিনেমাতে তিনি নিয়মিতভাবে প্লেব্যাক করেন। ১৯৬৭ সালে ‘বেষ্ট অব ফেরদৌসী’ নামে এইচএমভি থেকে তাঁর সিডি প্রকাশিত হয় । তিনি ক্ল্যাসিক্যাল, খেয়াল, ঠুমরি, গজল, গীত, নজরুল সংগীত, আধুনিক বাংলা গান, ভাওআইয়া, ভাটিয়ালি এবং সব ধরনের লোক সঙ্গীতই গেয়েছেন । তাঁর ৫০০-এরও বেশি রেকর্ড,অনেক ক্যাসেট ও সিডি আছে যেগুলো ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
গানের মতো পড়াশুনায়ও তিনি অসাধারণ প্রতিভাধর ছিলেন। সেন্ট জেভিয়ার্স কনভেন্ট স্কুলে তিন জন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে তিনি ছিলেন সবসময় প্রথম। ১৯৫৬ সালে বাংলা বাজার সরকারী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং ছেলেদের মধ্যে ৭ম স্থান লাভ করে সোনার মেডেল জয়লাভ করেন। দুবছর পর ১৯৫৮ সালে ইডেন কলেজ থেকে এইচএসসিতে মেধা তালিকায় সারা দেশের মধ্যে ১২তম হয়েছিলেন। এরপর ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি নেয়ার জন্য সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৬৩ সালে গানের জন্য তিনি ইউনেসকো পুরস্কার লাভ করেন। এরপর তিনি ছয় মাসের জন্য লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ অফ মিউজিকে স্টাফ নোটেশন পড়তে যান।
১৯৫৯ সালে প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে ফেরদৌসী রহমানের ক্যারিয়ারের শুরু। প্রখ্যাত পরিচালক এহতেশাম ‘এদেশ তোমার আমার’ ছবিটি পরিচালনা করেন এবং মুক্তি দেন। বাংলাদেশের সিনেমা জগতের আরেক দিকপাল খান আতাউর রহমান এই সিনেমাটির সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এই সিনেমাতে ফেরদৌসী রহমান প্লেব্যাক করেন। তিনি প্রথম প্লেব্যাক করেন ফতেহ লোহানীর পরিচালনায় আসিয়া সিনেমাতে । এটি রেকর্ড করা হয় ১৯৫৯ সালে। সেটি মুক্তি পায় ১৯৬০ সালে। তাঁর বাবা আব্বাসউদ্দীন আহমদ এই সিনেমার সঙ্গীতের সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন। পরে আবদুল আহাদ ও সমর দাসের পরিচালনায় কাজটি শেষ হয়। আসিয়া সিনেমাটি সেসময় পাকিস্তানে ‘বেষ্ট ফিল্ম এ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করে। তাঁর বাবা আব্বাসউদ্দীন সবসময় চাইতেন ফেরদৌসী রহমান প্লেব্যাক শিল্পী হবেন।
এহতেশামের রাজধানীর বুকে সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৬০ সালে। এই সিনেমাতে ফেরদৌসী রহমান প্রথম সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেন। তাঁর সহপরিচালক ছিলেন রবিন ঘোষ, যাঁর সাথে তিনি পরে প্রচুর কাজ করেন। মুস্তাফিজের পরিচালনায় ‘হারানো দিন’ সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৬১ সালে। এই সিনেমার অনেক জনপ্রিয় গানে কন্ঠ দেন তিনি।
১৯৬২ সালে সালাউদ্দীনের পরিচালনায় ‘সূর্যস্নান’ সিনেমাটি মুক্তি পায়, যেখানে খান আতাউর রহমান সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। বাঙলা সিনেমায় প্রথমবারের মতো সূর্যস্নান এ একটি উর্দু গান ছিল। গানটি ছিল ক্ল্যাসিক্যাল ধরনের। এই গানটি গেয়ে ফেরদৌসী রহমানের খুব ভাল লেগেছিল কারণ তিনি ক্লাসিক্যাল গানও করেন।
এহতেশামের ‘চন্দা’ মুক্তি পায় ১৯৬২ সালে। এটি প্রথম উর্দু সিনেমা যেটা পুরোপুরি বাঙ্গালি প্রেক্ষাপটে নির্মিত হয়েছিল। এহতেশাম দুই পাকিস্তানেই সিনেমাটি জনপ্রিয় করার জন্য এটি তৈরী করেন এবং সফল হন। এই সিনেমাতে ফেরদৌসী রহমান ‘ও পরদেশিয়া’সহ আরও অনেক গান গেয়েছিলেন এবং সেসময় গানগুলো খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।
১৯৬৩ সালে মুস্তাফিজ ‘তালাশ’ সিনেমাটি তৈরী করেন। এই সিনেমার খুবই জনপ্রিয় গান ‘ কুচ আপনি কহিয়ে, কুচ মেরি সুনিয়ে’ গানটি তিনি গেয়েছিলেন। এই গানটি বশির আহমেদও গেয়েছিলেন।
১৯৬৪ সালে ‘সুতরাং’ সিনেমাটি মুক্তি পায়। এটি ছিল সুভাষ দত্তের প্রথম পরিচালনার সিনেমা। এটিতে সত্য সাহা সঙ্গীত পরিচালনা করেন। কবরী এই সিনেমাতে প্রথম অভিনয় করেন এবং সৈয়দ শামসুল হক গান লিখেন। এই সিনেমার খুব জনপ্রিয় গানটিতে ‘পরানে দোলা দিল এ কোন ভ্রমরা’ ফেরদৌসী কন্ঠ দেন। এই সিনেমার অপর জনপ্রিয় গানটি ‘ নদী বাঁকা জানি, চাঁদ বাঁকা জানি’ দ্বৈত কন্ঠে গেয়েছেন ফেরদৌসী রহমান ও মুস্তাফা জামান আব্বাসী।
১৯৬৭ সালে সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ সিনেমাটি মুক্তি পায় । এই সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ‘যার ছায়া পড়েছে’ তিনি গেয়েছিলেন। তিনি আলতাফ মাহমুদের পরিচালনায় অনেক গানে কন্ঠ দেন যেগুলি খুবই জনপ্রিয় হয়।
খান আতাউর রহমানের পরিচালনায় ১৯৬৭ সালে মুক্তি পায় ‘নওয়াব সিরাজদৌলা’। এটিতে তিনি ‘পথহারা পাখি’ গানটি গেয়েছিলেন। বাংলাদেশে এটিই প্রথম সিনেমা যেটিতে নজরুলের গান ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৯৬৯ সালে ‘নীল আকাশের নীচে’ সিনেমাটি মুক্তি পায়। এটিতে তিনি ‘গান হয়ে এলে যেন বলে’ গানটি গেয়েছিলেন। এটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। আমজাদ হোসেনের পরিচালনায় ‘নয়ন মনি’ সিনেমাতে গান গাওয়ার জন্য ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশান থেকে তিনি ‘শ্রেষ্ঠ প্লে ব্যাক সঙ্গীত শিল্পী’ পুরস্কার গ্রহণ করেন।
১৯৭৬ সালে হারুন উর রশীদের পরিচালনায় ‘মেঘের অনেক রং’ সিনেমাটি মুক্তি পায়। দীর্ঘদিন পর আবার তিনি এই সিনেমাতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এটির জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার গ্রহণ করেন। কিন্তু এরপর তিনি আর সঙ্গীত পরিচালনা করেননি। কারণ তিনি গান নিয়ে পড়াশুনা ও পরিবার নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান। এসব করার পর যেটুকু সময় পান তা তিনি শুধুমাত্র প্লেব্যাক গাওয়ার জন্য ব্যয় করেন।
বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে তিনি ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ইরাক, মালেয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, আফগানিস্তান,রাশিয়া, গ্রীস, মরিশাস, যুগোস্লাভিয়া, আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন।
স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে তিনি প্রথম সরকারী প্রতিষ্ঠানের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদের নিয়ে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন । যুগোস্লাভিয়াতে সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদের প্রধান ছিলেন তিনি। পৃথিবীর যেদেশে তিনি গিয়েছেন সেখানকার ভাষার গান শিখেছেন এবং সেখানকার মানুষের অন্তর জয় করেছেন। উর্দু, পাঞ্জাবী, পশতু, পার্সিয়ান, আরবি, চাইনিজ, রাশিয়ান, জাপানিজ, জার্মান, গ্রীক, আফগানি, থাই, মালয়েশিয়ান,তার্কিশ, ইংরেজিসহ এরকম অনেক ভাষায় গান গেয়েছেন তিনি। বাংলাদেশি শিল্পীদের মধ্যে এটা একটা বিরল ঘটনা।
১৯৬৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্টের ‘প্রাইড অব পারফরমান্স’ মেডেল পান এবং সেসময় প্রেসিডেন্টের ‘প্রাইড অব পারফরমান্স’ মেডেল প্রাপ্ত সবচেয়ে কনিষ্ঠ নারী ছিলেন তিনি। সেই থেকে শুরু। এরপর তিনি দেশি বিদেশি অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হলো-স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন সঙ্গীত শিল্পী জাতীয় পুরস্কার, ন্যাশনাল ফিল্ম এ্যাওয়ার্ড ফর দি বেষ্ট মিউজিক ডিরেক্টর, নাসিরুদ্দীন গোল্ড মেডেল, পাকিস্তান ফিল্ম জার্নালিস্ট এ্যাওয়ার্ড ,বাংলাদেশ ফিল্ম জার্নালিস্ট এ্যাওয়ার্ড ,মাহবুবউল্লাহ গোল্ড মেডেল, জিয়াউর রহমান এ্যাওয়ার্ড, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এ্যাওয়ার্ড, নজরুল গোল্ড মেডেল ফ্রম চুরুলিয়া, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন গোল্ড মেডেল, মেরিল প্রথম আলো লাইফটাইম এ্যাচিভমেন্ট এ্যাওয়ার্ড, সিটিব্যাংক এনএ লাইফটাইম এ্যাচিভমেন্ট এ্যাওয়ার্ড, ওনারারি ফেলোশিপ কনফার্ড বাই বাংলা একাডেমি, লাইফটাইম এ্যাচিভমেন্ট এ্যাওয়ার্ড ফ্রম ইউডা, ডেইলি স্টার এবং স্ট্যানডার্ডচার্টার্ড ব্যাংক লাইফটাইম এ্যাচিভমেন্ট এ্যাওয়ার্ড।
এছাড়া রোটারী ক্লাবস অব বাংলাদেশ, ইনার হুইল ক্লাবস অব বাংলাদেশ, ভারত এবং যুক্তরাজ্য, বিজনেস এন্ড ক্যারিয়ার ওমেন্স ক্লাব, প্রেসক্লাব অব বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠন থেকে তিনি বিভিন্ন ক্রেস্ট ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের স্যোসাল সার্ভিস সেক্রেটারী, চলচ্চিত্র পুরস্কার কমিটির জাতীয় বিচারক বোর্ডের সম্মানীত সদস্য, ইনার হুইল ক্লাবের সক্রিয় সদস্য, ২০০৩-২০০৪ সালে আই.ডাবলুর জাতীয় প্রতিনিধি ছিলেন।
চীন থেকে ঘুরে এসে ভ্রমণ কাহিনী বিষয়ক ‘গান গেয়ে এলাম’ নামক একটি বই লিখেন তিনি। নজরুল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে তিনি এর সাথে যুক্ত ছিলেন। যখন নাসিরুদ্দীন এর চেয়ারম্যান ছিলেন তখন তিনি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। স্বরলিপি সত্যায়ন বোর্ডের শুরু থেকে তিনি এর সদস্য ছিলেন এবং এখনও এর সাথে যুক্ত আছেন। ফিরোজা বেগমের পর থেকে তিনি নজরুল সঙ্গীত শিল্পী পরিষদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং এই প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
১৯৬৬ সালে ইঞ্জিনিয়ার এবং শিল্পপতি রেজাউর রহমানের সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর দুই ছেলে রুবাইয়াত ও রাজিন। রুবাইয়্যাত রহমান এমআইএস ডিগ্রী অর্জন করেছেন টেক্সাসটেক ইউনিভার্সিটি থেকে। তাঁর ছোট ছেলে রাজিন রহমান বোম্বের আইআইটি থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে এমবিএ করেছেন।
ফেরদৌসী রহমান এখন আব্বাস উদ্দীন সঙ্গীত একাডেমী নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান। এই একাডেমীটি তিনি ১৯৯২ সালে শুধুমাত্র একজন শিক্ষার্থী নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখন কয়েকশ শিক্ষার্থী এই প্রতিষ্ঠানে গান শিখতে আসে। ফেরদৌসী রহমান আশাবাদী খুব শীঘ্রই তিনি এই প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি নিজস্ব ভবন বানাতে সক্ষম হবেন।
তিনি সব ধরনের গান বিশেষ করে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতে ভালবাসেন। অবসরে ছোট গল্প পড়তে, বাগান করতে এবং অন্দরসজ্জা করতে ভালবাসেন। তিনি রান্না বিষয়ক অনুষ্ঠান দেখেন এবং নতুন রেসিপি রান্না করার চেষ্টা করেন। তিনি তাঁর নিজের শাড়ীর নকশা নিজেই করেন। গান নিয়ে ইতোমধ্যেই তিনি অনেক দেশে ঘুরেছেন। তিনি নতুন নতুন জায়গায় যেতে পছন্দ করেন । তিনি পাহাড়ী এলাকায় যেতে খুব ভালবাসেন।
তাঁর প্রিয় শিল্পী উম্মে কুলসুম, ফেইরুজ, নানা মাসকুরি, সন্ধ্যা মুখোপ্যাধ্যায়, আশা ভোশলে, মান্না দে,অজয় চ্যাট্যার্জি, হৈমন্তী শুক্লা, মেহেদী হাসান, ফরিদা খানম, ইকবাল বানুসহ আরও অনেক শিল্পী।
তিনি প্রায় অর্ধশতাব্দি ধরে ২৫০টি সিনেমাতে গান করেন। সেই ১৯৫৯ সাল থেকে এখনও তিনি গেয়ে চলেছেন। যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন বাংলা সিনেমার সহযোগি হয়ে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তিনি।
তথ্যসূত্র: ফেরদৌসী রহমানের নিজস্ব ওয়েবসাইট-http://ferdausi.com থেকে ২০১৭ সালে তথ্যগুলো নেয়া হয়েছে।
লেখক: মৌরী তানিয়া