গলায় দীর্ঘ পুঁতির মালা, কপালের টিপ ঠিক টিপ নয়, তিলকের মতো, মাথার শীর্ষে চুল ঝুঁটি করে বাঁধা আর পরনের কাপড় কালো রঙের-এই ইমেজ আমাদের মন শিহরিত করে রেখেছিল। আমাদের মানে শুধু পুরুষদের নয়, নারীরও হৃদয় অনুভব করেছে বিস্ময়ের কম্পন। সদ্যোজাত তরতাজা ধর্মকাতর রাষ্ট্রে পঞ্চাশের দশকের শুরুতে কী করে এই অভিব্যক্তি ফুটিয়ে এক মুসলিম নারী চলনে-বলনে এবং শিল্পের চর্চায় অভূতপূর্ব স্বকীয়তার জানান দিলেন! যে শিল্পকে দুষ্টবুদ্ধির গোঁড়া মানুষেরা মুর্তির চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারে না, এমনকি ডিগ্রিধারীরাও যখন জানেননি, ভাস্কর্যশিল্প বলতে কি বুঝায়, তখন এদেশের আধুনিক ভাস্কর্যের পথিকৃত নভেরা আহমেদ আমাদের শিল্পমঞ্চে সগৌরবে আবির্ভুত হন।
আবুল হাসনাত এর সম্পাদনায় নভেরা আহমেদ বইয়ে নভেরা সম্পর্কে মইনুদ্দীন খালেদ উপরের কথাটি বলেছেন। নভেরা : ভাস্কর্যজননী, মইনুদ্দীন খালেদ, পৃষ্ঠা-২১১
তাঁর সৃষ্টির জন্য, তাঁর সাহসী মনোভাবের জন্য, আপসহীন জীবনযাপনের পথ বেছে নেয়ার জন্য নভেরা আহমেদ তাঁর যুগে ছিলেন অনন্য। শিল্পকলার ইতিহাসে নভেরা আহমেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে।
১৯৩৯ সালের ২৯ মার্চ বাংলাদেশের সুন্দরবনে নভেরা আহমেদ জন্মগ্রহণ করেন। নভেরা নামটি রাখেন তার চাচা। এটি ফার্সি শব্দ, যার অর্থ নবাগত, নতুন জন্ম। তার বাবার নাম সৈয়দ আহমেদ। সুন্দরবন অঞ্চলে তার বাবা চাকরি করতেন। চট্টগ্রামের আসকারদিঘির উত্তর পাড় ছিল তাঁর পৈতৃক নিবাস। পরবর্তীতে চাকরিসূত্রে তার বাবা কিছুদিন কলকাতায় বাস করেন। আর সেকারণে কলকাতা শহরে নভেরার শৈশব কেটেছে । তিনি এসএসসি পাস করেন কলকাতার লরেটা স্কুল থেকে ।
শৈশবে কলকাতাতেই নভেরা আহমেদ নাচ ও গান শেখেন। তাঁর মা মাটি দিয়ে বিভিন্ন রকম পুতুল, পাখি, ফুল ও ঘরবাড়ি তৈরী করতেন। মায়ের এই শখটাই তাঁকে ভাস্কর হওয়ার পেছনে দিক নির্দেশনা দিয়েছিল। দেশভাগের পর নভেরার বাবা বদলি হয়ে কুমিল্লায় চলে আসেন। কুমিল্লায় এসে নভেরা সেখানকার ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। বাবার অবসর গ্রহণের পর তাঁরা সবাই তাঁদের আদি নিবাস চট্টগ্রামে চলে আসেন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
এরই মধ্যে এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে নভেরার বিয়ে হয়েছিল। অল্পদিনের মধ্যেই সে বিয়ে ভেঙ্গে যায়। চট্টগ্রামে আসার পর চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন নভেরা। এইসময় নজরুলের এক জন্মোৎসবে নভেরা চট্টগ্রামের জুবলী হলে এক ঘন্টা নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন। আবার তাঁকে বিয়ে দেয়ার জন্য তাঁর মা-বাবা অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু বিয়েতে তিনি রাজি না হয়ে ১৯৫০ সালে লণ্ডন যওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। শিল্পী হওয়ার নিশ্চিত কোন পরিকল্পনা ছিল না তার। লণ্ডন যাওয়ার সময় তাঁর বাবা বললেন, ‘তুমি ব্যারিস্টার হবে, এদেশের প্রথম মহিলা ব্যারিস্টার।’
নভেরা সংস্কৃতিমনা পরিবারের সন্তান হলেও শিল্পকলাকে পেশা হিসেবে বেছে নেবার ব্যাপারটাকে কোনো অভিভাবকই সেইসময় সহজভাবে মেনে নিতে চাইতেন না। তাঁর মেজো বোন শরীফা আলম লণ্ডনে তখন বিবিসির একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন।
ভাস্কর্য অধ্যয়ন করার জন্য লণ্ডনের ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টসে ১৯৫০ সালে তিনি ভর্তি হন। এই পেশাকে অনেকেই তখন ‘অ-নারীসুলভ’ পেশা হিসেবেই দেখত। এখান থেকেই তিনি ভাস্কর্যে ন্যাশনাল ডিপ্লোমা অর্জন করেন। ভাস্কর্যের উপর উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য তিনি ১৯৫৪ সালে ইতালির ফ্লেরেন্সে যান। ইউরোপের বিভিন্ন জাদুঘর, ভাস্কর্যইত্যাদি দেখা শেষে ১৯৫৬ সালে শিল্পী হামিদুর রাহমানের সঙ্গে দেশে আসেন। ১৯৫৭ সালে এই শিল্পীদ্বয় শহীদ মিনার গড়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। শিল্পী হামিদুর রহমানকে মিনার গড়ার কাজে সহযোগিতা করেছিলেন নভেরা। হামিদুর রহমানের সঙ্গে নভেরার প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল। এ সম্পর্ক ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত সচল ছিল। শোনা যায় এক রুশীয় ভদ্রলোকের সঙ্গে ব্যাংককে নভেরার পরিচয় হয় । তিনি স্থপতি হলেও তার নেশা ছিল ফটোগ্রাফি । তিনি ফ্রান্সের নাগরিক কিন্তু তার পূর্বপুরুষেরা রুশ দেশের । দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে এই রুশীয়-ফরাসি গ্রেগোয়া দ্য ব্রুনস নামের মানুষটির সঙ্গে শিল্পিত সংসার যাপন করেছেন নভেরা।
তিনি লণ্ডনে স্থায়ীভাবে থাকতে পারতেন, কিন্তু তিনি নিজের দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে আসার পর তিনি অনেকগুলো প্রতিকূলতার মুখোমুখি হন। শিল্পকলার জন্য পূর্বপাকিস্তানে তখন অর্থ ছিল না, নিজের মতো করে চলতে চায় এমন ব্যক্তিদের প্রতি সহনশীল সমাজও ছিল না। এখনকার মতো তখনও ভাস্কর্যকে ইসলামবিরোধী শিল্পআঙ্গিক বলে মনেকরতো সবাই।
প্রতিকূলতাগুলো প্রযুক্তিগতও ছিল। ক্যাম্বারওয়েলে নভেরা সেদিক থেকে নিরাপদ ছিলেন, মাটি দিয়ে মানবমডেল থেকে অ্যাকাডেমিক অনুশীলন করেছেন এবং ধাতুতে ঢালাই করেছেন। পূর্বপাকিস্তানের সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতি ছিল । ধাতব ঢালাইয়ের কোনো ব্যবস্থাই এখানে ছিল না এবং কাজের ক্ষেত্রে মডেল জোগাড় করার জন্য তাঁকে খুব সমস্যায় পড়তে হয়। সেকারণে নভেরাকে এখানে সহজলভ্য উপকরণের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে কাজ করতে হয়, যেমন সিমেন্ট, প্লাস্টার ও কাঠ। তাঁর গড়নগুলিকেও সেটার সঙ্গে সেভাবে সরলায়ন করতে হয়।
তেজগাঁওয়ে অবস্থিত একজন শিল্পপতির বাসস্থানের আঙিনায় ১৯৫৮ সালে নভেরা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম আধুনিক প্রাঙ্গণ ভাস্কর্য। কাজটার শিরোনাম ‘কাউ অ্যান্ড টু ফিগার্স’ ( গরু এবং দুটি অবয়ব)। নভেরার বন্ধুরা স্মরণ করেন যে, তিনি বাংলার গ্রাম্যজীবনের স্বরূপ উপস্থাপনের বিষয়ে এতটাই নিবেদিত ছিলেন যে মাঝেমধ্যে তিনি এর বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য স্টুডিও থেকে উধাও হয়ে যেতেন। চলে যেতেন গ্রামের মানুষদের সঙ্গে থাকতে এবং তাদের দু:খ-শোকের ভাগীদার হতে। অতএব ‘কাউ অ্যান্ড টু ফিগার্স’ শ্র্রদ্ধা নিবেদন করে কৃষককে এবং কৃষকের গরুকে যার উপর সে নির্ভর করে। নভেরা যে বাঙ্গালি পরিচয়ের সন্ধান করছিলেন এ ভাস্কর্যটা তার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
নভেরা বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের একমাত্র ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার নির্মাণে ভূমিকা রাখেন। তাঁর মতো ভাস্করদের কাজ দিয়ে নগরীকে সাজিয়ে তোলা তাঁর স্বপ্ন ছিল।
১৯৫৬ সালে লণ্ডন থেকে দেশে ফিরে তিনি শিল্পী জয়নুল আবেদিনের উদ্যোগে অনুদান পেয়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের দেয়ালে নির্মাণ করেন পূর্ব বাংলার প্রথম ফ্রিজ বা ম্যুরালটি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের দেয়ালে নভেরার উচ্চাবচ (রিলিফ) ভাস্কর্যে গড়নগুলি আবারও বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোক ভাস্কর্যের অবয়ব থেকে নেয়া: হাতি ঘোড়া, গরু এবং অবশ্যই মানুষ। মিয়ানমার ভ্রমণ থেকে বৌদ্ধ বিষয়বস্তু গ্রহণ করেছিলেন তিনি। বুদ্ধের প্রতিমুর্তি এবং তাঁর অহিংসার শিক্ষা নভেরাকে প্রণোদিত করে ‘পিস’ (শান্তি) শিরোণামে প্রমাণাকারের চেয়ে বড় ভাস্কর্য নির্মাণ করতে। ‘পিস’ কাজটার সঙ্গে সম্পর্কিত আরেকটি কাজ ‘গিভ আস দিস ডে’ (আমাদের এ দিন দাও) শিরোনামে ভাস্কর্যে আমরা দেখি একদল মানুষের অপূর্ব উপস্থাপনা, অনেক মানুষ, প্রত্যেকেই একাকী এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যেকেই নিজস্ব ব্যক্তিগত স্থানে অবস্থিত এবং প্রত্যেকেই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।
বাইরের কোনো সহযোগী ছাড়া নভেরা সাধারণত তাঁর কাজগুলো একাই করেছিলেন । তাঁকে এটা অনেক বিড়ম্বনা দিয়েছে। এ ধরনের বড় মাত্রার ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য অপরিহার্য কারিগরি অথবা শ্রমিক সহযোগীও তাঁর ছিল না । এমনকি প্রয়োজনীয় অর্থবলও তাঁর ছিল না। ঢাকায় তিনি সামান্য পৃষ্ঠপোষণ পেয়েছিলেন কিন্তু তার উপর জীবন নির্বাহ করতে না পেরে নভেরা ঢাকার শিল্পজগৎ থেকে উধাও হয়ে যান। নিজেদের বাসগৃহ এবং কলকারখানা ভাস্কর্য দিয়ে অলংকৃত করতে চান এমন ধনী ব্যক্তির সংখ্যা সে সময় পূর্বপাকিস্তানে খুব কম ছিল। তদানীন্তন পশ্চিমপাকিস্তানে অধিক পরিমানে ধনবান ব্যক্তি পাবেন এ আশা নিয়ে তিনি ১৯৬০ সালে সেখানে চলে যান। সেখানে তারা তাকে কাজের ফরমায়েশ দিবেন। সেখানেও তিনি আশাহত হন এবং তাঁর শৈশবের নাচের প্রতিভাকে আবার জাগ্রত করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি নাচের প্রশিক্ষণ নিতে ভারত চলে যান। সে সময় তিনি গুরুতর আহত হওয়ার কারণে বাকি জীবন তাঁকে লাঠিতে ভর করে হাঁটতে হয়। এ পর্যায়ে তিনি চিকিৎসার জন্য প্যারিস চলে যান। তিনি আর মাতৃভূমিতে কখনই ফিরে আসেননি। কিন্তু তিনি তাঁর শিল্পচর্চা চালিয়ে যান।
নভেরার সত্যের সন্ধান এবং তাঁর ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ঘোষণা তাঁর জীবনকে একটি বিরামহীন সংগ্রামে পরিণত করে। তাঁর ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং শুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য তিনি তাঁর পরিবারের সকল বন্ধন এবং পরবর্তীসময়ে বন্ধুত্বের সকল বন্ধন ছিন্ন করেন । নভেরা মনে করতেন ভাস্কর্যের মাধ্যমে তিনি তাঁর সত্যের সন্ধান পাবেন। তিনি বৈষয়িক ছিলেন না।
১৯৫৭ সালে কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের দেয়ালে উৎকীর্ণ ফ্রিজ এবং ১৯৫৮ সালে খোলা আকাশের নীচে ভাস্কর্যদুটির দ্বারা নভেরা আহমেদ পূর্বপাকিস্তানের শিল্পজগতে ছোটখাট বিপ্লব সংঘটিত করেছেন। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে নির্মিত ভাস্কর্যগুলোর অধিকাংশই বেশ বড় আকারের- ৫ ফুট থেকে শুরু করে ৭ ফুট ১১ ইঞ্চি পর্যন্ত উচ্চতা বিশিষ্ট।
নভেরা আহমেদ কেবল বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যচর্চার পথিকৃত-শিল্পী নন, পাকিস্তানের শিল্প- ইতিহাসেও তিনি একজন অগ্রগণ্য ভাস্কর। উপরন্তু থাইল্যান্ডের আধুনিক শিল্পচর্চার ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যাংককের প্রদর্শনী একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবার যোগ্য।
পাকিস্তান পেইন্টিং অ্যান্ড স্কাল্পচার এক্সিবিশন আয়োজন হয় ১৯৬১ সালে। দশ বছর বয়সি একটি ছেলে ঘরের কাজে নভেরাকে সে সময় সাহায্য করত। এই প্রদর্শনীর জন্য নভেরা তারই একটি আবক্ষমূর্তি তৈরি করলেন এবং নাম দিলেন চাইল্ড ফিলোসফার । সেই প্রদর্শনীতে তিনি এই ভাস্কর্যের জন্য প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। অবয়বধর্মী ভাস্কর্য এক্সট্রিমিনেটিং এঞ্জেল, ছয় ফুটের অধিক উচ্চতাবিশিষ্ট স্টাইলাইজড ভাস্কর্যটিতে বিধৃত হয়েছে শকুনের শ্বাসরোধকারী একজন নারীর অবয়ব; নারীর হাতে অশুভ শক্তি ও মৃত্যুর পরাভবের প্রতীক।
ভাস্কর হিসেবে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নিজের একটা দৃঢ় অবস্থান তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন নভেরা। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে নির্মিত ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে অধিকাংশই বেশ বড় আকারের; ৫ ফুট থেকে শুরু করে এমনকি ৭ ফুট ১১ ইঞ্চি পর্যন্ত উচ্চতাবিশিষ্ট।
ঢাকার বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে নভেরা আহমেদের কাজের সর্ববৃহৎ সংগ্রহ রয়েছে । এছাড়া প্যারিসে তার স্বামী গেগ্ররী দ্য ব্রুনোর স্টুডিয়োতে ৯টি ভাষ্কর্য ও ৪৩টি অঙ্কিত চিত্র রয়েছে। জাতীয় জাদুঘরের ৩৭ সংখ্যক গ্যালারিতে নভেরা আহমেদের পরিবার ও আরো একটি কাজ প্রদর্শন করা হয়। ফার্মগটের কাছে জনাব এম আর খানের বাড়ীর উদ্যানে পরিবার কাজটি স্থাপিত ছিল যা ২০০১ সালে জাতীয় জাদুঘর সংগ্রহ করে এবং ২০১৬ সালের মধ্যভাগ অবধি জাদুঘরের উদ্যানে সংস্থাপিত রাখে। পরে প্রাকৃতিক ক্ষতি এড়ানোর জন্য তা জাদুঘরের মূল ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে। চট্টগ্রামের রেকিট অ্যান্ড কোলম্যান-এর বাংলাদেশ কার্যালয়ে এবং ঢাকার অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের সামনের উদ্যানে নভেরার আরো দুটি কাজ সংস্থাপিত আছে।
১৯৬০ সালের ৭ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রীয় গণ গ্রন্থাগার প্রাঙ্গনে (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার) পাকিস্তান জাতিসংঘ সমিতির উদ্যোগে এবং এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় নভেরার প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল । ইনার গেজ শিরোনামের ওই প্রদর্শনীটি ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আজম খান প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করেন । দশদিন এই প্রদর্শনী সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। কেবলমাত্র ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে কিছু ভাস্কর্য গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণেও প্রদর্শিত হয়েছিল। প্রায় পঁচাত্তরটি ভাস্কর্য ছিল এই প্রদর্শনীতে । এর প্রায় তিন যুগ পরে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের উদ্যোগে সে প্রদর্শনীর তিরিশটির বেশি ভাস্কর্য সংগৃহীত হয় এবং ১৯৯৮ সালে একত্রে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রদর্শিত হয়।
১৯৭০ সালে ব্যাংককে নভেরার দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় । ব্যাংককে এই প্রদর্শনীটি ছিল ধাতব ভাস্কর্যের প্রথম মুক্তাঙ্গন প্রদর্শনী। এতে নভেরা ধাতব মাধ্যমে কিছু ভাস্কর্য প্রদর্শন করেন। এ-পর্বে নভেরা তাঁর ভাস্কর্যের উপকরণ হিসেবে ব্রোঞ্জ ছাড়াও শিট মেটাল এবং ঝালাইকৃত বা ওয়েলডেড ও স্টেইনলেস স্টিল ব্যবহার করেছেন। ব্যাংকক আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের আয়োজনে প্রদর্শনী চলেছিল ১৯৭০ সালের ১৪ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত আয়োজক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ভবনে। থাইল্যান্ডে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত রব, শিল্পাকর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আলংকারিক শিল্পকলা অনুষদের ডিন যুবরাজ ইয়াৎচাই চিত্রাবংস, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের ডিরেক্টর মাহমুদ-আল-হক প্রদর্শনী আয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। শৌখিন চিত্রকর ও ভাস্কর যুবরাজ কারাবিক চক্রবন্ধু প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করেছিলেন।
তার তৃতীয় একক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল প্যারিসের রিভগেস গ্যালারিতে ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে। প্যারিসে অবস্থানকালে ১৯৮৮ সালে ব্যাংককের আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস যৌথভাবে তার একটি একক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি প্যারিসের গ্যালারি রিভগেসে নভেরা আহমেদের রেট্রোসপেকটিভ প্রদর্শনী শিল্পকর্মের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় একশো দিন ব্যাপী (১৬ জানুয়ারি–২৬ এপ্রিল ২০১৪) প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছে তার ১৯৬৯–২০১৪ কালপর্বের ৫১টি শিল্পকর্ম, যার মধ্যে রয়েছে ৪২টি চিত্রকর্ম ও নয়টি ভাস্কর্য।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ২০১৫ সালে নভেরার জীবন ও আদ্যন্ত শিল্পকর্মের ওপর একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে। ২০১৫ সালের ৭ থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত দুই সপ্তাহব্যাপী প্রদর্শনীটির আয়োজন করা হয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী চিত্রশালায়। এতে নভেরার ৩৫টি শিল্প কর্ম প্রদর্শিত হয়।
ভাস্কর হিসেবে ১৯৬১ সালে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি। ন্যাশনাল এক্সিবিশন অব পেইন্টিং স্কাল্পচার এ্যান্ড গ্রাফিক আর্টস শিরোনমে এই প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া তার ছ’টি ভাস্কর্যের মধ্যে চাইল্ড ফিলোসফার নামে একটি ভাস্কর্য বেস্ট স্কাল্পচারে পুরস্কৃত হয়।
বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন ১৯৯৭ সালে। হাসনাত আবদুল হাই তাকে নিয়ে নভেরা (১৯৯৫) শিরোনামে জীবনী উপন্যাস রচনা করেছেন। নির্মিত হয়েছে প্রামাণ্য চিত্র নহন্যতে (১৯৯৯)। এক সময় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের একটি হলের নামকরণ করা হয়েছিল “ভাস্কর নভেরা আহমেদ হল”। বর্তমানে বাংলা একাডেমী’র একটি হলের নাম নভেরা হল ।
২০১৪ সাল থেকে শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন নভেরা আহমেদ । ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে তার অবস্থার অবনতি ঘটে। মৃত্যুর দুই দিন আগে তিনি কোমায় চলে যান। ৫ মে, মঙ্গলবার প্যারিসের স্থানীয় সময় ভোর তিনটা থেকে চারটার মধ্যে ৭৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র: নভেরা আহমেদ, সম্পাদনা আবুল হাসনাত, বেঙ্গল পাবলিকেশনস লিমিটেড, প্রথম প্রকাশ-জানুয়ারি, ২০১৫
লেখক: মৌরী তানিয়া