‘সুপাত্র পেয়ে ছোট বয়সেই ফুফুকে বসতে হলো বিয়ের পিঁড়িতে। ফুফুর বুক ফাটা কান্না, অনশন কোনটাই টিকল না। পড়া বন্ধ হয়ে গেল। ম্যাট্রিক পাশের সাধ জনমের মত শেষ হয়ে গেল। মুরুব্বীরা সুপাত্রে কন্যাদান করে মহাপূণ্য অর্জন করে ধন্য হলেন। ফুফুর হৃদয়বিদারক কান্না আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তখন আমি সাত বছরের মেয়ে। সে স্মৃতিটা এখনো ছবি হয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। একটু বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই এই ছেলে-মেয়ের বৈষম্যের আচরণ দেখে দেখে আমার কচি মনে একটু একটু করে ক্ষোভ জমা হতে থাকে। যতই বড় হতে থাকি ততই ক্ষোভের পরিমান বাড়তে থাকে।’
উপরের কথাগুলি বলেছেন রওশন আরা রশিদ। আজীবন সংগ্রামী এই মানুষ তাঁর কাজের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন ছেলে-মেয়ে আলাদা নয়। সেই শৈশব থেকে শুরু করে জীবনের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত অধিকাংশ সময়ই ব্যয় করেছেন শিক্ষা অর্জন ও শিক্ষাদানে। শিক্ষক জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তিনি তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন। ছেলেবেলায় দেখা ফুফুর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ার করুণ স্মৃতিটি বুকে নিয়েই তিনি নারীদের শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সর্বদা উৎসাহ যুগিয়েছেন ও এজন্য সর্বদা কাজ করেছেন। তিনি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলব্ধি করেছেন যে একটা সমাজের বা রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নতি নির্ভর করে তার শিক্ষা ও সংস্কৃতির উপর। সেক্ষেত্রে এদেশের অর্ধেক নারী সমাজ একেবারে পিছিয়ে রয়েছে। তাই নারী শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে তিনি বেছে নেন শিক্ষাকতা জীবন।
রওশন আরা রশিদ জন্মগ্রহন করেন ১৯৪৩ সালে, জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার কালিয়াপুর গ্রামের তালুকদার বাড়িতে। হযরত শাহ্ জামাল (রঃ) এর পূণ্যস্মৃতি বিজড়িত নয়নাভিরাম সৌন্দর্যমন্ডিত, গারো পাহাড়ের পাদদেশে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র বিধৌত জেলা জামালপুর। বাংলাদেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে খ্যাতি সম্পন্ন অনেক ব্যক্তিত্ব জন্মগ্রহণ করেন এই জামালপুর জেলায়। তাঁর কর্মের জন্য রওশন আরা রশিদও এই জেলার গুণীজনদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
রওশন আরা রশিদ-এর বাবার নাম এ কে এম আব্দুর রশিদ। তিনি ছিলেন প্রকৌশলী। তিনি ইন্ডিয়ান গভর্মেন্টের অধীনে চাকুরী করতেন। তাঁর মার নাম জোবেদা খাতুন। তিনি সহজ সরল একজন গৃহিণী ছিলেন। তিনি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। ওই সময় এরচেয়ে বেশী পড়াশুনা করার সুযোগ খুব অল্প সংখ্যক মেয়ের ভাগ্যে জুটতো। এ কে এম আব্দুর রশিদ ও জোবেদা খাতুনের ৯ ছেলেমেয়ে। ৫ মেয়ে ও ৪ ছেলে । রওশন আরা রশিদ ছিলেন ভাই-বোনদের মধ্যে সবার বড়।
রওশন আরা রশিদ-এর দাদার নাম ছমির উদ্দিন তালুকদার। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার কালিয়াপুর গ্রামের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন তিনি। ধর্মপরায়নতা, সততা ও আদর্শনিষ্ঠার কারণে গ্রামের সবাই তাঁকে খুব পছন্দ করতো। মানুষের সুখে-দুঃখে তিনি পাশে থাকতেন ও সেবা করতেন। অন্যদেরকে তিনি সবার সেবা করার জন্য উৎসাহ দিতেন। বলতেন, ‘মানব সেবা বড় ইবাদত’। গ্রামের লোকজন তাঁকে তালুকদার সাহেব নামেই ডাকতো। তিনি ন্যায় বিচারক ছিলেন। কালিয়াপুর গ্রামের সব মানুষ তাদের যেকোন বিপদ-আপদে ও সালিশ-বিচারে তাঁর কাছে আসতো।
ছেলেবেলায় রওশন আরা রশিদ-এর পারিবারিক নাম ছিল রওশন আরা। ভর্তির সময় স্কুলের খাতায় তাঁর নাম লেখানো হয় রওশন আরা। এই সময় পরিবারের অনেকে তাঁকে রওশন আরা তালুকদার বলেও ডাকতেন। পরবর্তীতে নিজের নামের সাথে বাবার নামের শেষ শব্দ যুক্ত করে দেন তিনি। ফলে তাঁর নাম হয়ে যায় রওশন আরা রশিদ। এই নামেই তিনি পরিচিতি লাভ করেন।
তাঁর ছেলেবেলায় তিনি দেখেছেন মুসলমান মেয়েদের পড়াশুনা না করানোটা ওই সময় একটা ঐতিহ্যের ব্যাপার ছিল। মেয়েদের বেশি পড়াশুনা করালে বিয়ে হয় না, এটাই ছিল তখনকার মুসলমানদের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা। তাদেরকে বিয়ের পূর্বে আদর্শ বধু হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলির সবক দেওয়া হত। কোরআন শিক্ষার সাথে সাথে মেয়েদেরকে আদর্শ বধু হওয়ার জন্য শেখানো হতো চলন বলন, পর্দা পুশিদা, আদব কায়দা নম্রত ভদ্রতাসহ আরও অনেক গুণাবলি।
রওশন আরা রশিদের পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। বাবার কাছে। বর্ণমালা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বাবা তাঁকে পড়াশুনার ব্যাপারে সরাসরি সহযোগিতা করেছেন। বাবার কারণেই তাঁর শিক্ষা জীবন থেকে তিনি ছিটকে পড়েননি। তাঁর বাবা গণিতে খুব তুখোর ছিলেন। বলতে গেলে তাঁর বাবা ছাত্র অবস্থাতেই গণিত পড়াতেন। কারণ ক্লাসে ঢুকেই গণিত শিক্ষক বলতেন-“রশিদ’ অমুক অধ্যায়ের অত নাম্বার অংকটা বোর্ডে করে দে।” এই হুকুম দিয়ে শিক্ষক চেয়ারে বসে টেবিলের উপর পা তুলে চোখ বন্ধ করে থাকতেন। যেদিন তিনি অংক পারতেন না সেদিন পিঠে পড়ত বাঁশের কঞ্চির বাড়ি। কাজেই পরের দিন ক্লাসে যা করানো হবে তা আগের দিন শিখে তিনি স্কুলে যেতেন। ছেলেমেয়েদেরকে পড়ানোর সময় কেউ অংক না পারলে বা অংক ভুল করলে একটা থাপ্পড় মেরে রওশন আরা রশিদের বাবা বলতেন “ যে অংক পারে না, সে আমার সন্তান না।” সেসময় প্রাইভেট পড়ার কোন চল ছিল না। নিজে নিজেই পড়ত সবাই, কোন কিছু না পারলে বাবা-মা, চাচা, মামা,বড় ভাইদের সাহায্য নিত।
বাবার সরকারী চাকুরীর কারণে ছেলেবেলায় রওশন আরা জামালপুর থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ঘুরে বেড়িয়েছেন। ৭/৮ বছর বয়সে তাঁরা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন এবং শাজাহানপুরে বসবাস শুরু করেন।
১৯৫৫ সালে তিনি কামরুননেসা স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। এর পূর্বে পড়তেন পুরানা পল্টনের রোকেয়া মেমোরিয়াল স্কুলে। সেসময় কামরুননেসা স্কুলটি মেয়েদের আদর্শ ও বিখ্যাত বিদ্যাপিঠ ছিল। খুবই শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল স্কুলের পরিবেশ। সেইসময় কামরুননেসা স্কুলের ভিতরে একটা বড় পুকুর ছিল আর পুকুর পাড়ে ছিল অনেক বড় বড় গাছ। সেই গাছগুলোতে বংশপরম্পরায় বাস করত অনেক বানর। রওশন আরা রশিদ অন্যান্য বন্ধবীদের সাথে ক্লাসের অবসরে যখন গাছের ছায়ায় পুকুর পাড়ে বসে টিফিন খেতেন তখন বানররা এসে টুপ করে তাদের টিফিন নিয়ে যেত। কখনও কখনও বানররা এসে তাদের ওড়না, বইপুস্তকও নিয়ে যেত। এখন সেখানে আর কোন বানরের অস্তিত্ব নেই।
কামরুননেসা স্কুল থেকে ১৯৫৯ সালে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। তখন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে খুব কম সংখ্যক মেয়ে পাস করত। আর প্রথম বিভাগের সংখ্যা ছিল আরও কম। তাঁকে সনাতনী ধারায় ফেলতে পারেননি তাঁর পরিবার। প্রায়ই তিনি ভাবতেন, ছেলেদেরকে পড়াশুনার জন্য অনেক সুযোগ সুবিধা দেয়া হয় আর মেয়েদেরকে পড়াশুনায় বাধা দেয়া হয়। একথা ভেবে তিনি মনে মনে জিদ করেন, আমিই প্রমাণ করে দিব যে, মেয়েরা শত বাধা বিপত্তির মাঝেও ইচ্ছা করলে পড়াশুনা করে ভালো অবস্থানে যেতে পারে। জেদ করে পড়াশুনা করতেন তিনি। রওশন আরা খুব ভাল ছাত্রী ছিলেন।
মেয়ের পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ দেখে এবং ভাল রেজাল্ট দেখে তাঁর বাবা তাঁকে পড়াতে চাইতেন কিন্তু আত্মীয় স্বজনরা বলতেন মেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়া উচিত। তাঁরা ভাল ভাল বিয়ের প্রস্তাব আনতেন। এসব বিয়ের প্রস্তাবে কোনভাবেই রাজি হতেন না রওশন আরা। তাঁরা তিন বোনই পড়াশুনা করতেন এবং গান-নাচ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তাঁর বোনরা গান গাইতেন আর তিনি নাচ পছন্দ করতেন।
তাঁর বাবার বদলীর চাকরী হওয়ার কারণে তিনি পারস্য, ইরাক,ইরান, দিল্লী, কলকাতাসহ আরও অনেক জায়গায় চাকরী করেছেন। অনেক দেশে চাকরী করার ফলে তাঁর বাবার মানসিকতা অনেক উন্নত ছিল। তাঁর মেয়েদেরকে তিনি পড়াতে চাইতেন। কিন্তু তাঁর চাচারা, দাদী ও অন্য আত্মীয় স্বজনরা রওশন আরাকে বলতেন, তুই আর কত পড়বি। ম্যাট্রিক পাস করছিস। আর কত পড়তে হবে? অনেক পড়াশুনা করছিস। আর করতে হবে না। এখন বাচ্চা পালতে হবে, রাঁধতে হবে, সংসার দেখতে হবে এটাই মেয়েদের প্রধান কাজ। পড়াশুনা করে আর লাভ কী হবে?
উত্তরে রওশন আরা বলতেন, ‘লাভ ক্ষতির চিন্তা আমি করি না। যতদূর পারি পড়াশুনা করব।’ ১৯৬২ সালে তিনি ইডেন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। তিনি সবসময় গণিত আর বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর পেতেন।
তিনি ছেলেবেলা থেকে খুব গল্পের বই পড়তেন। কেউ যেন টের না পায় সেজন্য তিনি রাতের বেলা হারিকেনের চারপাশ কাগজ দিয়ে মুড়ে শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়তেন । স্কুল জীবনেই তিনি শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্রের অনেক বই পড়ে শেষ করেছেন। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় তিনি কবিতা ও নাটক লিখেছেন এবং নাটকে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
চট্টগ্রামে থাকার সময় বন্ধুরা মিলে ১৯৬৬ সালে একটা প্রামাণ্য চিত্র তৈরী করেন। সেখানে তিনি নাচ-গান করেন। এক অনুষ্ঠানে তিনি হরিণ শিকারের নৃত্য করেন। বনের মধ্য গিয়ে কিভাবে হরিণ শিকার করে তা নৃত্যের মাধ্যমে তুলে ধরেন। ১৯৬৭-৬৮ সালে ওই নৃত্যে গোল্ড মেডেল পান তিনি।
রওশন আরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে অনার্স ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে অনার্স ডিগ্রী লাভ করেন। অনার্সে তিনি দ্বিতীয় বিভাগ পেয়ে প্রথম স্থান লাভ করেন। কেউ প্রথম বিভাগ না পাওয়ায় তিনি সে বছর বিভাগের সেরা শিক্ষার্থীর মর্যাদা লাভ করেন। ৩টি বৃত্তি লাভ করেন তিনি – ট্যালেন্ট স্কলারশিপ, ডিপার্টমেন্টাল স্কলারশিপ ও ময়মনসিংহ স্কলারশিপ। বেতন দিতে হতো না তাঁকে। বই কেনার জন্য তিনি ৪০০ টাকা পেতেন। ১৯৬৬ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে এম. এ ডিগ্রী লাভ করেন।
ভারতে এমবিএ পড়ার জন্য ১৯৬৭ সালে সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা তাঁকে যেতে দেননি। তাঁরা বলেন – ‘যদি যেতে হয় তাহলে বিয়ে করে স্বামীকে নিয়ে যাও’।
রওশন আরা রশিদ পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ঢাকার বেগম বদরুন্নেসা কলেজে গণিত বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এখানে তিনি ১৯৬৭ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর ১৯৭৯ সালে তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ইডেন কলেজে যোগ দেন। এই কলেজে ১৯৮৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি কর্মরত ছিলেন। এরপর ১৯৮৪ সালে সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে বেগম বদরুন্নেসা কলেজে যোগ দেন এবং ১৯৯৪ সালের মে পর্যন্ত তিনি এই কলেজে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৪ সালের মে মাসে জামালপুর সরকারী জাহেদা সফির মহিলা কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। এখানে তিনি ১৯৯৬ সালের মার্চ পর্যন্ত কাজ করেন। তিনি এই কলেজে থাকার সময় একটা নতুন বিভাগ খোলেন এবং অনেক উন্নয়ন মূলক কাজ করেন। ১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে তিনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে উপসচিব পদে যোগ দেন। এরপর ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অধ্যাপক ও গণিত বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে তিনি এই কলেজের সহ-অধ্যক্ষ ও ২০০০ সালে তিনি অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই কলেজ থেকেই তিনি ২০০১ সালের আগস্টে অবসর গ্রহণ করেন।
রওশন আরাকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলেন। তাই ইডেন কলেজে থেকে যান। জামালপুরে থাকার সময় তিনি সেখানে মেয়েদের স্কুল বানিয়ে দেন। ছাত্র ভর্তি করানোর সময় তখনকার সরকারী দলের ছেলেরা টাকা নিত। তিনি ভর্তির নির্দিষ্ট নিয়ম করে দেন। ফলে কেউ টাকা দিয়ে ভর্তি করাতে পারতো না। এতে ছেলেরা ক্ষুব্ধ হয় এবং রওশন আরার অফিসকে লক্ষ্য করে বোমা-ককটেল মারে। হুমকি দেয়। তিনি তাতে ভয় পেতেন না। দৃঢ় মনোবলে তাঁর কাজ করে যেতেন।
রওশন আরা ১৯৯৮ সাল থেকে ইডেন কলেজের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কাজ করেন। গণিত বিভাগকে সুন্দর করে সাজান। নিজের চেষ্টায় এই কলেজে তিনি একটি কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করেন। এছাড়া কলেজের অভ্যন্তরে মেয়েদের সুবিধার্থে একটি ব্যাংকের বুথ স্থাপন করেন।
রওশন আরা ১৯৭১ সালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে চট্টগ্রাম সরকারী মহিলা কলেজে পদোন্নতি পান। কিন্তু বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি এই পদোন্নতি গ্রহণ করেননি। পরবর্তীকালে পদোন্নতি পাওয়ার জন্য তাঁকে দীর্ঘ আট বছর অপেক্ষা করতে হয়। তিনি মনে করেন মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ যে ত্যাগ ও তিতীক্ষা দেখিয়েছেন তার তুলনায় এই ত্যাগ অতি নগণ্য। তিনি পাবলিক সার্ভিস কমিশন-এর পরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এস.সি. সিলেবাস কমিটির ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির কার্যকরী পরিষদের সদস্য ছিলেন তিনি। রওশন আরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান পরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং উচ্চ মাধ্যমিক, সম্মান ও বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস-এর পরীক্ষা কমিটির নীতি নির্ধারক কমিটির সদস্য ছিলেন।
তিনি শুধু শিক্ষকতা করেননি। শিক্ষকতার বাইরেও অনেক অসাধারণ কর্মকান্ডে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ গণিত সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ মহিলা বিজ্ঞান সমিতির আজীবন সদস্য ছিলেন। তিনি তাঁর মেধা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে রচনা করেছেন জ্যামিতি ও ব্যবহারিক গণিত বিষয়ে দুইটি বই। তিনি বাংলাদেশ মহিলা সমিতির আজীবন সদস্য ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ক্যাডেট কোর এর একজন কর্মকর্তা ছিলেন। সমাজকল্যাণ মূলক অনেক কাজের সাথেও জড়িত ছিলেন তিনি।
রওশন আরা যখন ক্লাস সেভেনে পড়েন তখন থেকে তাঁর পরিবারের অনেক সদস্য তাঁকে বিয়ে দেয়ার জন্য চেষ্টা করেছিল । কিন্তু তিনি বলেন, ‘এম.এস.সি. পাশ করে বিয়ে করবেন, তার আগে না।’
তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন তখন ওই সময়কার ইন্দোনেশিয়ান এক মন্ত্রীর ছেলে তাঁকে পছন্দ করে এবং রওশন আরার মামার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। রওশন আরা রাজি হননি। তাঁদের গ্রামের একজন সিএসপি। তাঁর প্রতিটি ভাই স্কলারশিপ পেয়েছে। কিন্তু তাঁর বাবা যৌতুক নিয়ে ছেলেদেরকে বিয়ে দেন। ওই লোক একদিন রওশন আরার বাবাকে কথা প্রসঙ্গে বললেন, ‘আপনার নাকি অনেকগুলো মেয়ে। খুব ভালো মেয়ে। আপনার একটা মেয়ে আমার ছেলের জন্য নিতে চাই। আপনার পক্ষে তো ছেলেকে হাজার চল্লিশেক টাকা দিয়ে বিয়ে দেয়া অসম্ভব কিছু না।’ রওশনের বাবা বললেন, ‘আমার মেয়ে যদি নিতে চায় দিব। কোটি টাকা চাইলেও দিব। কিন্তু আমার মেয়ে তা চাইবে না। আর আমিও যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিব না। ছেলে মেয়ে সমান সমান হলে বিয়ে দিব।’
এ এম চৌধূরী, পুরো নাম ড. আব্দুল মোছাব্বির চৌধুরী। তিনি ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কালী নানক স্কলারশিপ পান। তারপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। রওশন আরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন তখন এ এম চৌধুরী তাঁর শিক্ষক ছিলেন। তিনি এপ্লাইড ম্যাথ পড়াতেন। মাত্র তিন মাস এ এম চৌধুরী তাঁর শিক্ষক ছিলেন। এরপর এ এম চৌধূরী Pakistan Research Committee (SUPARCO)-তে যোগদান করে করাচী চলে যান। কিছুদিন পর তিনি লন্ডনে পি,এইচ, ডি, করতে যান। লন্ডন থেকে ফিরে এসে রওশন আরার এক মামার সাথে যোগাযোগ করে তিনি রওশনের খোঁজ নেন। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে পারিবারিকভাবে তাঁদের বিয়ে হয়। বিয়েতে তাঁর বাবা সোনা গয়না কিছু দিতে রাজি হলেন না। বাড়ির সবাই সোনা ছাড়া বিয়ে হবে কি করে এই চিন্তায় পড়ে গেলেন। তখন রওশন আরা বোনদের বললেন, ‘এমিটিসান কিনে নিয়ে আস।’ বিয়ের এনগেজমেন্টের সময় এ এম চৌধুরী তাঁকে সুদৃশ্য একটি প্যাকেট উপহার দেন। সবাই ভেবেছিলেন এরমধ্যে হয়তো আংটি ,কাপড় ইত্যাদি আছে কিন্তু প্যাকেটটি খুলে সবাই অবাক হলো। সবাই দেখল প্যাকেট ভর্তি বই।
এই দম্পতির তিন ছেলেমেয়ে – আনির চৌধুরী, মৃদুল চৌধুরী,ক্যারিনা চৌধুরী। বড়ছেলে আনির চৌধুরী আমেরিকা থেকে কম্পিউটার ও গণিতের উপর পড়াশুনা করেছেন। তিনি দেশে কম্পিউটার বিজনেস করছেন। ছোট ছেলে মৃদুল চৌধুরী, তিনি টেক্সাস ভার্সিটি থেকে পড়াশুনা করেছেন। মেয়ে ক্যারিনা চৌধুরীও টেক্সাস ভার্সিটি থেকে পড়াশুনা করেছেন।
রওশন আরা রশিদ কয়েক বছর ধরে ডিস্টেনিয়া রোগে ভোগার পর ২০১০ সালের ৩০ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র: এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব- প্রফেসর রওশন আরা রশিদ- লেখক: ড. এ.এম.চৌধুরী, প্রকাশক: সাইফুল ইসলাম, প্রথম প্রকাশ: ৩০ জুলাই, ২০১১
লেখক : মৌরী তানিয়া