সময়টা ১৯৭১। অবরুদ্ধ বাংলাদেশ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভয়ে সচরাচর রাস্তায় নামছে না কেউ। আগুন, আর্তনাদ, পাকিস্তানি হানাদারদের ট্যাঙ্ক, লরির আওয়াজ, গুলির আওয়াজ, গোঙানি, নিস্তব্ধতা, বুটের থপথপ।এই রকম এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো তরুণ ও প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বারও অসহায়।
যুদ্ধের শুরুতে বাসায় ছিলেন আব্দুল জব্বার। ভাবলেন, বাসায় থাকলে মারা পড়তে হবে। মরতে যখন হবে, তখন এভাবে মরে যাওয়ার কোনো মানে নেই। নামডাক তো কিছু হয়েছে। সবাই শিল্পী হিসেবে চেনে। কণ্ঠ চেনে। যে দেশ খ্যাতি ও পরিচিতি দিয়েছে, সেই দেশ অবরুদ্ধ। দেশের মানুষ অবরুদ্ধ। দেশের মহানায়ক অবরুদ্ধ। তাঁর কি কোন দায়িত্ব নেই? পালিয়ে থেকে মরে যাব? না, তা হয় না! লড়তে লড়তে মরব। পালিয়ে থেকে ভীতুর মতো মরব না।
আব্দুল জব্বার সিদ্ধান্ত নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বাসা থেকে। ছায়ায় লুকিয়ে, দেয়াল টপকে, এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে, অলিগলি মারিয়ে পৌঁছে গেলেন তিনি। পৌঁছে গেলেন ধানমণ্ডি ৩২ নাম্বারে।বঙ্গবন্ধু বাসায় ছিলেন না। তিনিও অবরুদ্ধ। ছিল তাঁর অসহায় পরিবার। ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী ফজিলাতুন্নেসা। দেখা করলেন তাঁর সঙ্গে। কথা বললেন। যেন যুদ্ধে যাওয়ার আগে আশীর্বাদ নিলেন, যেন যাওয়ার আগে শেষ দেখা দেখে গেলেন, যেন যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ভালো থাকবেন, আমরা আছি আপনার ভাইয়েরা, আপনার সন্তানেরা।
রায়ের বাজার দিয়ে বুড়িগঙ্গায় নেমে যাওয়ার আগে একবার দেখে নিলেন প্রিয় ঢাকা শহরটাকে। তারপর নেমে গেলেন। সাঁতরে পার হতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনলেন। তাঁর কণ্ঠ চেনে মানুষ। কিন্তু তাঁর চেহারা তো সবাই চেনে না। সাঁতরে কিছুদূর যাওয়ার পর নৌকার মাঝি আর কিছু স্থানীয় লোকজন তাঁকে সন্দেহ করে বসল। তিনি তখন বুঝতে পারলেন, ভুল একটা হয়ে গেছে। একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন তিনি। আর সেকারণে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করে নদী পার হতে যেয়ে বিপদ ডেকে আনলেন।
স্থানীয় লোকজন ও নৌকার মাঝি আব্দুল জব্বারকে পাকিস্তানি হানাদারদের অনুচর ভাবলেন। তাঁরা কিছুতেই বিশ্বাস করছেন না যে, তিনি তা নন। এরকম যুদ্ধের পরিস্থিতিতে মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হয়, যে কাউকে সন্দেহ হয়। এটাই স্বাভাবিক। নিজেকে বোঝালেন তিনি। লোকগুলোকে বোঝালেন। বারবার বোঝালেন। লোকগুলো যেন কী বুঝলেন। তাঁকে নিয়ে গেলেন আওয়ামী লীগের এক স্থানীয় নেতার বাসায়। নেতা আব্দুল জব্বারকে চিনতে পারলেন। তিনি মাঝিকে বললেন, আব্দুল জব্বারকে নদী পার করে দাও।
মাঝি নদী পার করে দিলেন। বুড়িগঙ্গা পার হয়ে আব্দুল জব্বার ভাবলেন কারো সাহায্য নেবেন। কিন্তু সাহায্য নিতেও তাঁর ভয় করছিল। কাকে বিশ্বাস করে আবার ভুল করবেন। তাঁর চেয়ে হাঁটবেন তিনি। অন্য আরো অনেক অসহায় মানুষের মতো হাঁটবেন তিনি। হেঁটে হেঁটেই যাবেন নিজের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। ১৯৩৮ সালের ৭ নভেম্বর ওই গ্রামেই তো জন্ম হয়েছিল। সব সময় ওই গ্রামের মানুষগুলোকেই তো নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষ মনে হয় তাঁর। এই দুঃসময়ে যেদিকেই যান, তাঁদের দেখে তারপর যাবেন।
তবে কুষ্টিয়া যাওয়ার আগে বুড়িগঙ্গার ওপারে যে আত্মীয় বাড়ি সেখানে বিশ্রাম নেবেন। ওই আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে ঠিক করলেন, সীমান্ত পার হতে হবে। কলকাতা যেতে হবে। সেখানে যাওয়ার আগে দোহার। দোহার থেকে নবাবগঞ্জ। হাঁটছেন তিনি। হেঁটে হেঁটেই পৌঁছলেন কুষ্টিয়ায় গ্রামের বাড়িতে। সেখান থেকে আবার হাঁটা শুরু করলেন তিনি। মানুষ হাঁটছে। বাঙালি হাঁটছে। হাজার বছর ধরেই তো হাঁটছে। স্বাধীনতার জন্য, মুক্তির জন্য হাঁটছে। হাঁটছে অসহায় মানুষ একটু আশ্রয়ের জন্য। নিজেকে তিনি এই হাঁটতে থাকা, অসহায়, মুক্তিকামী, শোষণ-নির্যাতনে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া, মরিয়া হয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া মানুষদের থেকে আলাদা ভাবতে পারলেন না। ভাবতে ভাবতে তাঁর ভালো লাগল। হাঁটতে তাঁর ভাল লাগছিল। হাঁটতে হাঁটতে মেহেরপুর হয়ে, যশোর হয়ে, বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে তিনি ঢুকে গেলেন ভারতে।
আব্দুল জব্বার কলকাতায় গিয়েই যোগ দিলেন স্বাধীন বাংলা বেতারে। তাঁর যুদ্ধ তো গানের যুদ্ধ। সঙ্গীতের মাধ্যমে মানুষকে জাগিয়ে তোলার যুদ্ধ তাঁর। স্বাধীন বাংলা বেতারে গাওয়া শুরু করলেন তিনি স্বাধীনতার গান, মুক্তির গান। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য, সাধারণ বাঙালির জন্য, নিপীড়িত অসহায় মানুষের জন্য মনোবল ও প্রেরণার গান গাইলেন তিনি। তিনি গাইলেন ‘সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্মরণে, আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই তাদের স্মৃতির চরণে।’
মুক্তিযুদ্ধে কেউ অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, কেউ বা সেবা, সহযোগিতা ও আশ্রয় দিয়ে দেশকে মুক্ত করার সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন, কেউ কণ্ঠ ও সুর দিয়ে উজ্জীবিত রেখেছেন মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সহায়তাকারীদের। আব্দুল জব্বার একজন কণ্ঠযোদ্ধা। তাঁর কণ্ঠ মরণপণ লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে উজ্জীবিত করেছে লাখো মুক্তিযোদ্ধাকে, উজ্জীবিত করেছে বাঙালি জাতিকে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গাওয়ার পাশাপাশি ওই সময়ে মুম্বাইয়ে গিয়ে জনপ্রিয় গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে সাথে নিয়ে গান গেয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত পড়ে তোলেন তিনি। আব্দুল জব্বার তখন কলকাতা থেকে আগরতলা গিয়েও মুক্তিযুদ্ধের উজ্জীবনী গান গেয়ে আসতেন।
জনপ্রিয় ও কালজয়ী অসংখ্য গানের কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার ১৯৫৮ সালে বেতারে গান গাওয়া শুরু করেন। চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেন ১৯৬২ সালে। ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে যখন টেলিভিশন চালু হয় তখন সেখানে তিনি গান গাওয়া শুরু করেন। আব্দুল জব্বাররা যখন গান গাওয়া শুরু করেন তখন সময়টা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গানের একেবারে স্বর্ণযুগ। চলচ্চিত্রের গানের সেই সুবর্ণ সময় এমনি এমনি তৈরি হয়নি। গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী ও যন্ত্রশিল্পীদের আন্তরিকতা ও আত্মনিবেদনের কারণেই এক একটি গান হয়ে উঠেছিল ব্যাপক জনপ্রিয়। আন্তরিকতা, আবেগ ও আত্মনিবেদনের নজির হিসেবে ‘এক বুক জ্বালা নিয়ে গানটির কথাই বলা যাক। মাস্তান ছবিতে গীতিকার আহমেদ জামান চৌধুরীর লেখা এই গানটি গেয়েছিলেন আব্দুল জব্বার। স্মৃতিচারণ করে শিল্পী আব্দুল জব্বার জানিয়েছেন, এই গানে কণ্ঠ দিতে গিয়ে খুব আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। গানটি গাইতে গাইতে মনে পড়ে গিয়েছিল এক বাল্যবন্ধুর কথা। সেই বন্ধু তখন খুব কষ্টে ছিল। এ কারণেই গানটিতে যে আবেগ দরকার ছিল তা তিনি দিতে পেরেছিলেন।
ষাট, সত্তর ও আশির দশকের অনেক চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন আব্দুল জব্বার। সেই সব ছবির জনপ্রিয়তায় ভূমিকা রেখেছে তাঁর কণ্ঠ। অনেক সময় চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তাকে ছাড়িয়ে উঠেছে সেসব গান। এই রকম জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে: ‘সংগম’ (১৯৬৪) ছবির ‘নীল গগন হে’, ‘এতটুকু আশা’ (১৯৬৮) ছবির ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’, ‘পিচ ঢালা পথ’ (১৯৬৮) ছবির ‘পিচ ঢালা এই পথটারে আজ ভালবেসেছি’, ‘ঢেউয়ের পরে ঢেউ’ (১৯৬৮) ছবির ‘সুচরিতা যেয়ো নাকো আর কিছুক্ষণ থাকো’, ‘দ্বীপ নেভে নাই’ (১৯৭০) ছবির ‘পৃথিবী তোমার কোমল মাটিতে কেন’, ‘তারা ভরা রাতে মনে পড়ে বেদনায় গো’, বেঈমান (১৯৭৪) ছবির ‘আমি তো বন্ধু মাতাল নই’, ‘মা’ (১৯৭৭) ছবির ‘বিদায় দাও গো বন্ধু তোমরা’, ‘দাতা হাতেম তাই’ (১৯৭৭) ছবির ‘এ মালিক-ই-জাহান’ ‘সারেং বৌ’ (১৯৭৮) ছবির ‘ও রে নীল দরিয়া, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া’, ‘জয় পরাজয়’ ছবির ‘দু জাহানের মালিক তুমি’, অনুরাগ’ (১৯৭৯) ছবির ‘শত্রু তুমি বন্ধু তুমি, ‘কি গান শোনাবো ও গো বন্ধু’, ‘ঘূর্ণিঝড়’ ছবির ‘একটি মনের আশীষ তুমি’।
আব্দুল জব্বার যেসব চলচ্চিত্রের জন্য গান গেয়েছেন সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সংগম’ (১৯৬৪), ‘নবাব সিরাজউদদৌলা’ (১৯৬৭), ‘উলঝন’ (১৯৬৭), ‘পিচ ঢালা পথ’ (১৯৬৮), ‘এতটুকু আশা’ (১৯৬৮), ‘ঢেউয়ের পরে ঢেউ’ (১৯৬৮), ‘ভানুমতি’ (১৯৬৯), ‘ক খ গ ঘ ঙ’ (১৯৭০), ‘দীপ নেভে নাই’ (১৯৭০), ‘বিনিময়’ (১৯৭০), ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০), ‘নাচের পুতুল’ (১৯৭১), ‘মানুষের মন’ (১৯৭২), ‘স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা’ (১৯৭৩), ‘ঝড়ের পাখি’ (১৯৭৩), ‘আলোর মিছিল’ (১৯৭৪), ‘সূর্যগ্রহণ’ (১৯৭৬), ‘তুফান’ (১৯৭৮), ‘অঙ্গার’ (১৯৭৮), ‘সারেং বৌ’ (১৯৭৮), ‘সখী তুমি কার’ (১৯৮০), এবং ‘কলমিলতা’ (১৯৮১)। এই চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে জহির রায়হানের দুটি চলচ্চিত্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৪ সালের ‘সংগম’ চলচ্চিত্রটি উর্দু ভাষার চলচ্চিত্র। এটি তৎকালীন পাকিস্তানে প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র। যে কারণে এটির একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। ১৯৭০ সালে জহির রায়হান নির্মিত ‘জীবন থেকে নেওয়া’ চলচ্চিত্রটি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রের গোড়াপত্তনের ইতিহাস হয়ে আছে।
আব্দুল জব্বার শ্রোতাদের কাছে এখনো খুব প্রিয় একজন শিল্পী । তার প্রমাণ মেলে বাংলা গান নিয়ে বিবিসির জরিপে। ২০০৬ সালের মার্চ মাস জুড়ে বিবিসি বাংলার শ্রোতারা তাদের বিচারে সেরা পাঁচটি বাংলা গান মনোনীত করে। শ্রোতাদের পছন্দের সেরা পাঁচটি গানের তালিকা নিয়ে বিবিসি বাংলা সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের তালিকা তৈরি করে। সেখানে তিনটি গানই ছিল কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বারের। গানগুলো হচ্ছে- ‘তুমি কি দেখেছ কভু’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ এবং ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’।
অনেক দেশাত্মবোধক গান গেয়েছেন আব্দুল জব্বার। দেশাত্মবোধক গানের প্রতি তাঁর এই টান, এই অনুরাগ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফিরে যান একাত্তরের দিনগুলোতে। বলেন, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। অনেক স্মৃতি আজও আমার চোখের সামনে ভাসে। কোটি মানুষের রক্তের বিনিময় আজ আমাদের বাংলাদেশ। সে সময় আমরা যারা গান করতাম সবাই খুব কষ্ট করে গান গাইতাম। সে সময় থেকে দেশাত্মবোধক গান করি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আমার গাওয়া গান দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। সে অনুপ্রেরণা থেকেই অথবা দেশপ্রেমও বলতে পারেন। সে জায়গা থেকেই দেশাত্মবোধক গান করি।’
জীবনে অনেক পদক, সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন শিল্পী আব্দুল জব্বার। তবে তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো ‘বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক’। ১৯৭৩ সালে তিনি এটি লাভ করেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমার সঙ্গীত জীবনের প্রাপ্তিটা অনেক বিশাল। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্জন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছিলাম। সে সময় তিনি আমাকে বলেছিলেন, তোমার বিখ্যাত হওয়ার দরকার নেই, তুমি গান করে যাও। তোমাকে আমি আজ জাতীয় গায়কের মর্যাদা দিলাম। এটি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।’’ শিল্পী আব্দুল জব্বার ১৯৮০ সালে ‘একুশে পদক’ এবং ১৯৯৬ সালে ‘স্বাধীনতা পদক’ এ ভূষিত হন। এছাড়া তিনি বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের নামে ‘জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
আব্দুল জব্বার পারিবারিক জীবনে এক সন্তানের জনক। পুত্র মিথুন জব্বার যুক্তরাষ্ট্রে সঙ্গীতে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। দেশে গান শিখেছেন বুলবুল ললিতকলা একাডেমির প্রধান ওস্তাদ ফজলুল হক এবং পরে ওস্তাদ করিম শাহাবুদ্দিনের কাছে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গাওয়া গানের অ্যালবাম ‘স্মৃতির বাড়ি’। প্রথম স্ত্রী শাহীন জব্বার গীতিকার। আব্দুল জব্বারের দ্বিতীয় স্ত্রী রোকেয়া জব্বার মিতা মারা যান ২০১৩ সালে।
শিল্পী আব্দুল জব্বার একজন আত্মনিবেদিত গায়ক। এই ধরনের গায়কের তৃপ্তি থাকে না। কোনো শিল্পীই তৃপ্ত হতে পারেন না। যত ভালো গানই থাকুক আরো ভালো গাওয়ার চেষ্টায় থাকেন তিনি। গান গেয়ে তৃপ্ত হতে পারেননি আব্দুল জব্বারও। অর্থের জন্য নয়, শ্রোতাদের ভালবাসার জন্যই গেয়েছেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘স্মৃতি তো অনেক আছে। তবে সে সময়কার সবচেয়ে বেশি যেটি মনে পড়ে, রাতের পর রাত অনেক কষ্ট করেছি। না খেয়ে থেকেছি, কিন্তু আমরা কেউ গান বন্ধ করিনি। এক দিকে মনের শংকা কি ঘটতে পারে, অন্যদিকে গানকে জেনেছি ধ্যান-জ্ঞান। চোখ বন্ধ করলেও সে সময়কার স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে আসে।
২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিল্পী আব্দুল জব্বার বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর চিকিৎসা বাবদ ২০ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন। কিন্তু চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা প্রয়োজন। এখন এত বড় অঙ্কের টাকা কীভাবে জোগাড় হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কথাও জানান তিনি। আক্ষেপ করে শিল্পী বলেন, ‘যখন লাইফ সাপোর্টে থাকব তখন দেখতে যাবেন! মারা গেলে শহীদ মিনারে নিয়ে ফুল দেবেন! দাফন করার সময় রাষ্ট্রীয় স্যালুট দেবেন!’কান্নাজড়িত কণ্ঠে আরও বলেন, ‘এসবের আমার কিছু দরকার নেই। আমি আরও কিছুদিন বাঁচতে চাই।
শিল্পীর সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২০১৭ সালের ৩০ আগষ্ট তাঁর মৃত্যুর পর অনেক সম্মান জানানো হয়েছে তাঁকে। কিন্তু টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা করানো হয়নি তাঁর। আরও কিছুদিন বাঁচার সাধ পূরণ হয়নি শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জব্বারের।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
বহু কালজয়ী গানের স্রষ্টা ও কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্মরণে, আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই তাদের স্মৃতির চরণে’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রস্টা তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আব্দুল জব্বার হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে কলকাতার বিভিন্ন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্ধুদ্ধ করেছেন। সেই দুঃসময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গেয়েছেন অসংখ্য গান। গলায় হারমোনিয়ম ঝুলিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে গণসংগীত গেয়েছেন তিনি। গান গেয়ে প্রাপ্ত ১২ লাখ টাকা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ তহবিলে দান করেছিলেন। তিনি স্বাধীনতা পদক, একুশে পদকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পদক অর্জন করেছেন।
জন্ম ও পরিচয়:
১৯৩৮ সালের ৭ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশ) কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন আব্দুল জব্বার।
শিক্ষা:
নিজ গ্রামে স্কুল জীবনের পড়াশোনা শেষ করেছেন আব্দুল জব্বার।
পেশা:
১৯৫৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান বেতারে গান গাওয় শুরু করেন তিনি । ১৯৬২ সালে প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য গান করেন। ১৯৬৪ সাল থেকে তিনি বিটিভির নিয়মিত গায়ক হয়ে উঠেন। ১৯৬৪ সালে জহির রায়হান পরিচালিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম রঙ্গিন চলচ্চিত্র সংগম-এর গানে কণ্ঠ দেন। ১৯৬৮ সালে ‘এতটুকু আশা’ ছবিতে সত্য সাহার সুরে তাঁর গাওয়া “তুমি কি দেখেছ কভু” গানটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৬৮ সালে ‘পীচ ঢালা পথ’ ছবিতে রবীন ঘোষের সুরে “পীচ ঢালা এই পথটারে ভালবেসেছি” এবং ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ’ ছবিতে রাজা হোসেন খানের সুরে “সুচরিতা যেওনাকো আর কিছুক্ষণ থাকো” গানে কণ্ঠ দেন। তাঁর একটি কালজয়ী গান ১৯৭৮ সালের ‘সারেং বৌ’ ছবির আলম খানের সুরে “ও..রে নীল দরিয়া”।
পারিবার:
আব্দুল জব্বারের বাবা মো: দখিলউদ্দিন ও মা বেগম ফুলজান। আব্দুল জব্বারের প্রথম স্ত্রী শাহীন জব্বার। শাহীন একজন গীতিকার। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী রোকেয়া জব্বার মিতা। মিতার সাথে জব্বারের পরিচয় হয় একটি মাজারে এবং সেই পরিচয়ের সুবাদে তাঁদের সম্পর্ক বিয়েতে গড়ায়। আব্দুল জব্বারের সন্তান মিথুন জব্বার আমেরিকায় সংগীত বিভাগে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা:
আব্দুল জব্বার ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক, ১৯৮০ সালে একুশে পদক, ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার ও জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
অ্যালবাম:
চার দশকের বেশি সময় ধরে গান করলেও নিজ উদ্যোগে নতুন গান নিয়ে প্রথমবারের মতো অ্যালবাম বের করেন শিল্পী মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার। অ্যালবামে রয়েছে ১০টি নতুন মৌলিক গান। গানের কথা লিখেছেন আমিরুল ইসলাম, আবুল কাশেম প্রমুখ। সুর করেছেন গোলাম সারওয়ার। জীবনের প্রায় শেষভাগে এসে এই ইচ্ছে পূরণ হওয়ায় তিনি অনেক আনন্দিত। ২০১৩ সালের বৈশাখে তাঁর স্মৃতির বাড়ি নামে একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়।
তথ্যসূত্র:
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, সুদীপ দে, মে ২০১৭। বিজয় দিবস উপলক্ষে বেতারে প্রচারিত অনুষ্ঠান ‘আব্দুল জব্বারের গান’। দ্য ডেইলি স্টার । ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৬। সংগৃহীত ১২ জানুয়ারি, ২০১৭। “আজ কালজয়ী গানের স্রষ্টা মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার এর শুভ জন্মদিন”। সঙ্গীতাঙ্গন । ৭ নভেম্বর, ২০১৬। সংগৃহীত ১২ জানুয়ারি, ২০১৭।
লেখক: সুদীপ কুমার দে