কবি জসীম উদ্দীন তখন বাংলা কবিতাঁর উজ্জ্বল নক্ষত্র। পল্লীকবির বাসা তখন কমলাপুরে। ১৯৬৫ সালে আজিমপুর থেকে কমলাপুরে নিজেদের বাড়িতে এসে উঠেছে আলম খানের পরিবার। বাবার নতুন বাড়ি। প্রতিবেশীরাও বলতে গেলে সবাই নতুন। পল্লীকবির ছেলে ফিরোজ ছিলেন কিশোর আলম খানের বন্ধু।ফিরোজের সাথে বন্ধুত্বের সুবাদে মাঝে মধ্যে কবি জসিম উদ্দিনের বাড়িতে যেতেন আলম খান। কবি জসীম উদ্দীন মুগদা বা মন্ডো গ্রামের দিকে হাঁটতে চলে যেতেন। আলম খানকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন প্রায়ই। গুনগুন করে গান গাইতেন কবি জসীম উদ্দীন। খুব গম্ভীর, মোটা গলা ছিল তাঁর। সঙ্গে আলম খানও গান গাইতেন। কবি জসীম উদ্দীন বলতেন, ‘বাহ, তুইও তো গান জানিসরে!’ আলম খান বলতেন, ‘হ্যাঁ, টুকটাক শিখি আরকি।’ কবি জসীম উদ্দীন বললেন, ‘তুই গান শিখ, ভালো করবি।’ আলম খানের পরিণত জীবনে পল্লীকবির এই কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল।
বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে খ্যাতনামা সুরের জাদুকরের নাম আলম খান। বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক। চলচ্চিত্রের গানে অবদানের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক ও সুরকার বিভাগে সাতবার বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
আলম খান ১৯৪৪ সালের ২২ অক্টোবর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের সিরাজগঞ্জের বানিয়াগাতি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পুরো নাম খুরশিদ আলম খান। ডাকনাম আলম খান। তাঁর বাবা আফতাব উদ্দিন খান ছিলেন সেক্রেটারিয়েট হেন্স ডিপার্টমেন্ট এর এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার ও মা জোবেদা খানম ছিলেন গৃহিণী। তাঁর মা জোবেদা খানম ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার দরবারের এক শিল্পীর বংশধর। সিরাজগঞ্জে এক বছর থাকার পর বাবার চাকরির সুবাদে কলকাতায় চলে যান। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বাবার সাথে ফিরে আসেন ঢাকায়। তারপর ঢাকাতেই স্থায়ী হন এবং সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলে থাকাকালীন তাঁর গানের প্রতি ঝোঁক সৃষ্টি হয়। পাঁচ ভাই তিন বোনের মধ্যে আলম খান মেজো। বাংলাদেশের প্রখ্যাত পপ সঙ্গীত শিল্পী আজম খান ছিলেন তাঁর ছোট ভাই।
আজিমপুর কলোনীতে থাকাবস্থায় আট-নয় বছর বয়সেই প্রতিবেশী বড় ভাই রতন এর উৎসাহে বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখা শুরু করেন এবং সেইখানে প্রথম সা-রে-গা-মা’র হাতেখড়ি হয়। প্রথম দিকে আলম খানের বাবার গান শেখানোর ইচ্ছে ছিল না কিন্তু মায়ের উৎসাহে আলম খান গান বাজনা চালিয়ে যান। পরবর্তীতে কিশোর আলম খানের অতি আগ্রহ দেখে ওস্তাদের কাছে তালিম নিতে নিয়ে যান বাবা আফতাব উদ্দিন খান। ওস্তাদ ননী চ্যাটার্জীর কাছে সঙ্গীতের উপর তালিম নেন। দশ-এগারো বছর বয়সে রাস্তায় একজন লোককে ব্যাঞ্জো বাজিয়ে ঘুরে ঘুরে অর্থ উপার্জন করতে দেখেন। রাস্তার সেই ব্যাঞ্জো বাদকের পিছে পিছে ঘুরতেন এবং একদিন ব্যান্ড বাজানোর ইচ্ছে প্রকাশ করেন এবং লোকটির কথামতো নিজে একটা ব্যান্ড কিনেন এবং এরপর সেটা দিয়েই শিখেন। আগে রতন ভাইয়ের কাছ থেকে সা-রে-গা-মা শেখায় নতুন করে তা শিখতে হয়নি। সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে পড়ার সময়ই বন্ধুদের নিয়ে অর্কেস্ট্রা গ্রুপ করলেন নিতান্ত শখের বশে। তাঁর প্রথম সংগঠনের নাম ‘ঋতূ শিল্পগোষ্ঠী’ যারা বিনা পয়সায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন। ১৯৬১ সালে মঞ্চ নাটক ‘ভাড়াটে বাড়ী’ তে আবহ সঙ্গীতের কাজ করে দেড় শ’ টাকা আয় করেন, সহযোগী মিউজিসিয়ানদের দিয়ে আলম খান পেয়েছিলেন ৪৫ টাকা যা ছিল সংগীত জীবনে তাঁর প্রথম রোজগার। আর এভাবেই তিনি পেশাদার সংগীত পরিচালনায় যুক্ত হয়েছিলেন। ঐ মঞ্চ নাটকের কাজের পর পিটিভি’র প্রযোজক সাকিনা সারোয়ার বাচ্চাদের একটি অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব দেন যা করার পর বেশ সাড়া পরে যায় আর এইভাবেই টেলিভিশনে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান। বাচ্চাদের অনুষ্ঠানের সফলতায় তৎকালীন পিটিভির প্রযোজক আতিকুল হক চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল মামুনসহ অনেকের নজরে পড়েন। নাট্যাচার্য আবদুল্লাহ আল মামুন রচিত বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম ধারাবাহিকে সুরারোপ করে গড়লেন ইতিহাস, সেই ‘সংসপ্তক’ নাটকের টাইটেল মিউজিক আজও মানুষ মনে রেখেছে। যার ফলে পরবর্তীতে আবদুল্লাহ আল মামুনের মঞ্চনাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘ইডিয়ট’সহ বেশকিছু নাটকের সঙ্গীত পরিচালনা করেন আলম খান। খুব সহজেই বয়সে বছর তিনেকের বড় আবদুল্লাহ আল মামুনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়ে যায় তাঁর। টেলিভিশন নাটক, বিভিন্ন অনুষ্ঠান, মঞ্চ নাটকের কাজ করে জনপ্রিয়তা পেয়ে যান আলম খান। ১৯৭০ সালেই পরিচালক আব্দুল জব্বার খানের ‘কাঁচ কাঁটা হীরে’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। প্রথম ছবিতেই আলম খানের পরিচালনায় শিল্পী রুপা খান ও শিল্পী এম এ হামিদ ‘জলতরঙ্গ মন আমার সা-রে-মা-পা-নি-সা বাজে…’ ও ‘কাল নয় পরশু, কেউ তো আমার কথা ভাববে…’ শিল্পী: এম, এ, হামিদ এর গাওয়া গান দুটো দর্শকদের কাছে জনপ্রিয়তা পায়। যার ফলে আলমগীর কুমকুমের একটি ছবিতে সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পান কিন্তু ততদিনে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় কাজটা শেষ হয়ে উঠেনি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আলম খান পরিবারের সাথে ঢাকাতেই ছিলেন। তাঁর অন্য দুই ছোট ভাই মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। আলম খান সরাসরি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ না করলেও ছোট ভাই আজম খানের অনেক অপারেশনে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিরাপদ স্থানে রাখার সহায়তা করতেন। আজম খানের দলের সহযোগী যোদ্ধা রানা প্রায় সময় আলম খানের কাছে স্টেনগান, গ্রেনেড রেখে নিরাপদ স্থানে চলে যেতেন। অপারেশনের সময় এসে রাতের আঁধারে আলম খানের কাছ থেকে কখনও স্টেনগান, কখনও গ্রেনেডগুলো নিয়ে যেতেন আবার কাজ শেষে স্টেনগানগুলো আলম খানের কাছে রেখে যেতেন।
আলম খান ১৯৬৩ সালে রবিন ঘোষের সহকারী হিসেবে তালাশ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। ১৯৭০ সালে প্রথম চলচ্চিত্রকার আবদুল জব্বার খান পরিচালিত কাচ কাটা হীরে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে এককভাবে সঙ্গীত পরিচালনা শুরু করেন। তাঁর সুরকৃত প্রথম জনপ্রিয় গান স্লোগান ছায়াছবির “তবলার ধেরে কেটে তাক”। এরপর ১৯৭৭ সালে আবদুল্লাহ আল মামুন তাঁর পরিচালিত সারেং বৌ চলচ্চিত্রের গান নিয়ে কথা বলার সময় তাঁর ১৯৬৯ সালের সুর করা একটি মুখরা শুনালে ছবির পরিচালক তা নিতে আগ্রহী হন। ১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সেই ছবির আবদুল জব্বারের কণ্ঠে “ওরে নীল দরিয়া” গানটি তাঁর এক অনন্য সৃষ্টি। ১৯৮২ সালে রজনীগণ্ধা চলচ্চিত্রে সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া “আমি রজনীগণ্ধা ফুলের মত” ও বড় ভালো লোক ছিল চলচ্চিত্রের সৈয়দ শামসুল হকের লেখা এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে “হায়রে মানুষ রঙিন ফানুশ” দর্শকদের মনোযোগ কাড়ে। বড় ভালো লোক ছিল চলচ্চিত্রের জন্য অর্জন করেন জাতীয় চলচ্চিত্ পুরস্কার। ১৯৮৫ সালে তাঁর সুর করা তিন কন্যা চলচ্চিত্রের “তিন কন্যা এক ছবি” গান দিয়ে প্লেব্যাক শুরু করেন কলকাতাঁর নামকরা সঙ্গীত শিল্পী কুমার শানু। নাগ পূর্ণিমা চলচ্চিত্রের এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া রক ধাঁচের “তুমি যেখানে আমি সেখানে”, ভেজা চোখ চলচ্চিত্রের এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে “জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প” গানগুলো শ্রোতাপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁরপর অসংখ্য ছবির সংগীত পরিচালনা করেন। সৃষ্টি করেন একের পর এক শ্রুতিমধুর এবং জনপ্রিয় গান। আলম খানের সুর ও সংগীত পরিচালনায় সৃষ্ট অসংখ্য গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো- ওরে নীল দরিয়া, হীরামতি হীরামতি ও হীরামতি, হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস, আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলিয়ে যাই, ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, কি জাদু করিলা পিরিতি শিখাইলা, বুকে আছে মন, তুমি যেখানে আমি সেখানে, সবাই তো ভালবাসা চায়, ভালবেসে গেলাম শুধু, চাঁদের সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা, আমি একদিন তোমায় না দেখিলে, আজকে না হয় ভালবাসো আর কোনদিন নয়, তেল গেলে ফুরাইয়া, আমি তোমার বধূ তুমি আমার স্বামী, জীবনের গল্প বাকি আছে অল্প, তিন কন্যা এক ছবি, মনে বড় আশা ছিল, দুনিয়াটা মস্ত বড়, ও সাথীরে যেও না কখনো ভুলে, আমি তোমার বধূ, কারে বলে ভালোবাসা, চোখ বুজিলে দুনিয়া আন্ধার, তোরা দ্যাখ, দ্যাখ, দ্যাখরে চাহিয়া, এখানে দুজনে নিরজনে, আজকে না হয় ভালোবাসো, এই জীবনতো একদিন চলতে চলতে থেমে যাবে, বেলি ফুলের মালা পরে, কাল তো ছিলাম ভাল, ওরে ও জান আমারই জান, চুমকি চলেছে একা পথে, ভালবাসিয়া গেলাম ফাঁসিয়া, তুমিতো এখন আমারই কথা ভাবছো, আকাশেতে লক্ষ তারা চাঁদ কিন্তু একটাইরে ইত্যাদি।
আলম খানের প্রথম শ্রোতাপ্রিয় গান ‘স্লোগান’ ছবির। মোহাম্মদ খুরশিদ আলমের গাওয়া ‘তবলার ধেড়ে কেটে তেড়ে কেটে তাক’ ও আবদুল জব্বারের গাওয়া ‘কী সুখ পাও তুমি আমাকে ধুঁকে ধুঁকে পুড়িয়ে’। দুটো গানেরই গীতিকার ছিলেন এই ছবির পরিচালক কবীর আনোয়ার। স্বাধীনতাঁর পর ১৯৭২ সালে আলম খান আবার সংগীত পরিচালনা শুরু করেন ছায়াছবির মাধ্যমে। ভালো সংগীত পরিচালক হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন ‘সারেং বৌ’ ছবির মাধ্যমে। সারেং বৌ ১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি কিংবদন্তী বাংলাদেশী চলচ্চিত্র। ১৯৬১ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বসে উপন্যাসটি লেখেন শহীদুল্লাহ কায়সার। ছবিটি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার আবদুল্লাহ আল মামুন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা নির্মিত এই ছবিটিতে আবদুল জব্বার এর কণ্ঠে গাওয়া ‘ওরে নীল দরিয়া আমায়? দেরে দে ছাড়িয়া’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। গানটির সুরকার আলম খান ও গীতিকার মুকুল চৌধুরী। ‘ওরে নীল দরিয়া, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া…’ কালজয়ী এই গানটি নিয়ে আলম খান এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন- ”গানটির যে সুর, সেটি আমার ১৯৬৯ সালে করা। কিন্তু তখন সুরের ওপর কথা লেখা হয়নি। আমি মনের মতো কোনো দৃশ্য পাইনি বলে কোনো ছবিতে সুরটি ব্যবহার করতে পারিনি। ১৯৭৬-৭৭ সালের দিকে যখন আবদুল্লাহ আল মামুন তাঁর সারেং বউ ছবির গান নিয়ে বসলেন, তখন গল্প শুনে মনে হলো, এই ছবির সারেং এর বাড়ি ফেরার দৃশ্যে সুরটি ব্যবহার করা যায়। গীতিকার মুকুল চৌধুরী ও আমি দুজনই এই ছবির পুরো গল্প পড়ে নিই। এরপর মুকুল চৌধুরীকে এই সুরটা দিয়ে বললাম গান লিখতে। তিনি দুই দিন পর অন্তরাসহ লিখে নিয়ে এলেন। আমি মামুন ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম সারেং কীভাবে বাড়ি ফিরছে। তখন তিনি বললেন, প্রথম অন্তরায় ট্রেনে, দ্বিতীয় অন্তরায় সাম্পানে, এরপর মেঠোপথ ধরে ফিরবে। দৃশ্য অনুযায়ী ট্রেনের ইফেক্ট, সাম্পান, বইঠা, পানির ছপছপ শব্দ এবং শেষে একতারার ইফেক্ট তৈরি করলাম। এই গানে ১২ জন রিদম পেয়ারসহ ২৪ জন বাদ্যযন্ত্রশিল্পী বাজিয়েছিলেন।” বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন সংগ্রামের গল্পে নির্মিত এই ছবিটিতে অভিনয় করেন ফারুক, কবরী, আরিফুল হক, জহিরুল হক, বিলকিস, বুলবুল ইসলাম, ডলি চৌধুরীসহ অনেকে।
আলম খান অনেক সঙ্গীত শিল্পীকে আবিষ্কার করেছেন। জনপ্রিয় শিল্পী এন্ড্রু কিশোর তাঁর হাত ধরেই ইন্ডাস্ট্রিতে আসেন। উপমহাদেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী জীবন্ত কিংবদন্তী কুমার শানুও এই আলম খানেরই আবিষ্কার। ১৯৮৫ সালে শিবলি সাদিকের ‘তিন কন্যা’ ছবির গান দিয়ে কুমার শানু জীবনের প্রথম চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেন যার সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন আলম খান। কুমার শানুকে তখন সবাই শানু ভট্টাচার্য নামে চিনতেন। ৯০’ দশকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতাঁর ’সানন্দা’ ম্যাগাজিনের পূজা সংখ্যায় কুমার শানু নিজের এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- বাংলাদেশের কিংবদন্তী সঙ্গীত পরিচালক আলম খানের সুরে, শিবলি সাদিক পরিচালিত ’তিন কন্যা’ ছবিতে তিনি প্রথম প্লেব্যাক করেন। গানটি ছিল ’তিন কন্যা এক ছবি, সুচন্দা, চম্পা আর ববি, আয়না কাছে আয়না রাখবো তোদের বায়না বলনা কে কি নিবি…’ আলম খান প্রায় তিন শ’ ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। তাঁর সুর করা গানের সংখ্যা দুই হাজারের ওপরে।
২০১৩ সালে আলম খান প্রায় তিন বছর পর নতুন করে একটি গানের সুর করেন। এসএ টিভিতে প্রচারিত রিয়েলিটি শো ‘বাংলাদেশি আইডল’- এর জন্য ‘বাংলা গানে বিশ্বজয় আমরা করবই/স্বপ্নের দিগন্তটা হাতে ধরবই’ এমন কথার থিম সং এর সুর করেন আলম খান।
আলম খান ১৯৭৬ সালে হাবিবুননেসা গুলবানুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। গুলবানু একজন গীতিকার। আলম খানের সুরে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ‘তুমি তো এখন আমারই কথা ভাবছো’ গানটির গীতিকার গুলবানু। তাঁদের দুই ছেলে আরমান খান ও আদনান খান। একমাত্র মেয়ে আনিকা খান।
২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে জানা যায় আলম খান ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত। ব্যাংককের একটি হাসপাতালে ৬ জুন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আমার ডান দিকের ফুসফুসের একটি অংশ ফেলে দেওয়া হয়। আজম খান যেদিন মারা যান, সেদিন তিনি ব্যাংককে চিকিৎসাধীন ছিলেন, তাই মৃত্যুর খবরটি তখন তাকে কেউ জানায়নি।
যেসব চলচ্চিত্রের সাথে কাজ করেছেন:
কাচ কাটা হীরে (১৯৭২)সুপ্রভাত (১৯৭৬)কি যে করি (১৯৭৬)গুন্ডা (১৯৭৬)দুস্ত দুশমন (১৯৭৭)সারেং বৌ (১৯৭৮)আসামী হাজির (১৯৭৮)আরাধনা (১৯৭৯)এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী (১৯৮০)বাঁধনহারা (১৯৮১)রজনীগণ্ধা (১৯৮২)বড় ভালো লোক ছিল (১৯৮২)তিন কন্যা (১৯৮৫)নাগ পূর্ণিমা, সারেন্ডার (১৯৮৭)লালু মাস্তান (১৯৮৭)দুই জীবন (১৯৮৮)বীর পুরুষ (১৯৮৮)ভেজা চোখ (১৯৮৮)ভাইজান (১৯৮৯)বজ্রমুষ্টি (১৯৮৯)ভাই ভাই (১৯৯০)অচেনা (১৯৯১)সান্ত্বনা (১৯৯১)ত্যাগ (১৯৯২)বেপরোয়া (১৯৯২)সত্য মিথ্যা (১৯৯২) ঘৃণা (১৯৯৪)কমান্ডার (১৯৯৪)অন্তরে অন্তরে (১৯৯৪)স্বপ্নের ঠিকানা (১৯৯৫)বিশ্বপ্রেমিক (১৯৯৫)সন্ত্রাস (১৯৯৫)এই ঘর এই সংসার (১৯৯৬)প্রিয়জন (১৯৯৬)বিচার হবে (১৯৯৬)কুলি (১৯৯৭)ভন্ড (১৯৯৮)অনন্ত ভালবাসা (১৯৯৯)ম্যাডাম ফুলি (১৯৯৯)মেজর সাহেব (২০০২)মাস্তানের উপর মাস্তান (২০০২)টপ সম্রাট (২০০৩)চাচ্চু (২০০৬)কি যাদু করিলা (২০০৮)এবাদত (২০০৯)কাজের মানুষ (২০০৯)মায়ের চোখ (২০১০)আমার স্বপ্ন আমার সংসার (২০১০)কে আপন কে পর (২০১১)শবনম (২০১৪)সহ আরো অনেক ছবিতে কাজ করেছেন।
পুরস্কার পেয়েছেন: শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক – বড় ভালো লোক ছিল (১৯৮২) শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক – তিন কন্যা (১৯৮৫) শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক – সারেন্ডার (১৯৮৭) শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক – দিনকাল (১৯৯২)শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক – এবাদত (২০০৯)শ্রেষ্ঠ সুরকার – কি যাদু করিলা (২০১০, বাঘের থাবা (১৯৯৯)বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার (৩ বার), চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি পুরস্কার (৪ বার)।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে খ্যতনামা সুরের জাদুকরের নাম আলম খান। তিনি রবিন ঘোষ, আলতাফ মাহমুদ, ননী চ্যাটার্জী, সত্য সাহাসহ আরো অনেকের সাথে কাজ করেছে। ১৯৬৩ সালে রবিন ঘোষের সহকারী হিসেবে ‘তালাশ’ সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনার মাধ্যমে মিডিয়ায় কাজ শুরু করেন আলম খান। ‘বড় ভালো লোক ছিল’ সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন এই সঙ্গীতজ্ঞ।
জন্ম ও পরিচয়:
তাঁর আসল নাম খুরশিদ আলম খান হলেও তিনি সঙ্গীত অঙ্গনে আলম খান নামে পরিচিত। ১৯৪৪ সালে ২২ অক্টোবর সিরাজগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর আসল নাম খুরশিদ আলম খান হলেও তিনি সঙ্গীত অঙ্গনে আলম খান নামে পরিচিত।
শিক্ষা:
সিরাজগঞ্জে এক বছর থাকার পর বাবার চাকরি সুবাদে কলকাতায় চলে যান আলম খান। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বাবার সাথে ফিরে আসেন ঢাকায়। তাঁরপর ঢাকাতেই স্থায়ী হন এবং সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলে থাকাকালীন তাঁর গানের প্রতি ঝোঁক সৃষ্টি হয়। বাবা আফতাব উদ্দিন প্রথমে অনাগ্রহ দেখালেও মায়ের উৎসাহে গানের চর্চা চালিয়ে যান। পরবর্তীতে তাঁর বাবাই তাকে ওস্তাদ ননী চ্যাটার্জীর কাছে গানের তালিমের জন্য নিয়ে যান।
পেশা:
১৯৬১ সালে মঞ্চ নাটক ’ভাড়াটে বাড়ী’ তে আবহ সঙ্গীতের কাজ করে দেড়শ’ টাকা আয় করেন যেখানে সহযোগী মিউজিসিয়ানদের দিয়ে আলম খান পেয়েছিলেন ৪৫ টাকা যা ছিল সংগীত জীবনে তাঁর প্রথম রোজগার। আর এভাবেই তিনি পেশাদার সংগীত পরিচালনায় যুক্ত হয়েছিলেন।
পারিবার:
আলম খানের পিতাঁর নাম আফতাব উদ্দিন খান। মায়ের নাম জোবেদা খানম। আলম খানেরা মোট ৫ ভাই, ৩ বোন ছিলেন। পপসম্রাট আজম খান তাঁর ছোট ভাই। স্ত্রীর নাম গুলবানু খান। দুই ছেলে আরমান খান ও আদনান খান এবং এক কন্যা আনিকা খানকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার।
পুরস্কার ও সম্মাননা:
বাংলা চলচ্চিত্রকে কালজয়ী গানে ভরপুর করে দেয়ায় স্বীকৃতি স্বরূপ নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন এই গুণী সুরকার। বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনবার। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন সাতবার। প্রযোজক সমিতি পুরস্কার পেয়েছেন চারবার। আজীবন সম্মাননাসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন।
শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক – বড় ভালো লোক ছিল (১৯৮২) শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক – তিন কন্যা (১৯৮৫) শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক – সারেন্ডার (১৯৮৭)শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক-দিনকাল(১৯৯২) শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক-এবাদত (২০০৯) শ্রেষ্ঠ সুরকার-কি যাদু করিলা(২০১০), বাঘের থাবা (১৯৯৯)বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার (৩ বার), চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি পুরস্কার (৪ বার)।
অ্যালবাম:
তাঁর সুরারোপিত কালজয়ী গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘আমি একদিন তোমায় না দেখিলে’, ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’ ইত্যাদি।
তথ্যসূত্র:
‘পুরানো সেই দিনের কথা’য় আলম খান”। দৈনিক ইত্তেফাক। ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩। দৈনিক প্রথম আলো। ২৬ জুলাই, ২০১১। “আমার চাচা আলম খান”। বাংলানিউজ। সংগৃহীত ৮ মে, ২০১৬।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, সুদীপ কুমার দে, মে ২০১৭।
লেখক: সুদীপ কুমার দে