সময়টা ১৯৬৮। কলকাতার এক অনুষ্ঠানে গান গাইছিলেন বশির আহমেদ। ততদিনে হিন্দি, উর্দু ও বাংলা চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়ে বেশ জনপ্রিয় তিনি। নিজের জন্মের শহর কলকাতার ওই অনুষ্ঠানে তাই দর্শকও ভালোই ছিল। ওই অনুষ্ঠানেই উপস্থিত ছিলেন নেপালি তরুণী লিলি সিনহা। বিশ্বভারতীয় শিক্ষার্থী লিলির সমবয়সী চাচাত বোন মালা সিনহা তখন মুম্বাই চলচ্চিত্রের বড় তারকা। শিল্প-সংস্কৃতির পারিবারিক ঐতিহ্য লিলির রক্তে। গানে লিলিরও রয়েছে স্বভাবগত দক্ষতা। এই দক্ষতার গুণেই গুণী শিল্পী চিনতে ভুল করলেন না তিনি। মুগ্ধ হলেন বশির আহমেদের গানে। অনুষ্ঠানের পর তাদের কথা ও পরিচয়। লিলি সিনহার এই মুগ্ধতা আর কাটেনি। সারা জীবনের জন্য গাঁটছড়া বাঁধেন বশির আহমেদের সঙ্গে। বিয়ের পর তাঁর নাম হয় মিনা বশির। মিনা বশিরও বাংলা গানের এক স্বনামধন্য শিল্পী।
কলকাতা থেকে মুম্বাই, মুম্বাই থেকে লাহোর, লাহোর থেকে ঢাকা। গানের ভেলায় ভেসে ভেসে বাংলাদেশের রাজধানীকে স্থায়ী ঠিকানা বানিয়েছেন বশির আহমেদ ও মিনা বশির। ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাড়িতে তারা যখন উঠেছেন জীবন তখন ফুলে-ফলে সুশোভিত। গড়ে তুলেছেন অদ্ভুত সুন্দর এক পরিবার। গানের জগতের লোকজনের কাছেও এই পরিবারটি হয়ে ওঠে বিশেষ। এই পরিবারে মিশে গেছে চার দেশ ও পাঁচ ভাষা। বাড়িটির একই পরিবারে মিশে গেছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপাল।
উপমহাদেশের চারটি দেশের পাঁচটি ভাষায়ই গান গেয়েছেন বশির আহমেদ ও মিনা বশির। বশির আহমেদ ও মিনা বশিরের ছেলে রাজা বশির, মেয়ে হুমায়রা বশির। রাজা ও হুমায়রা মায়ের সাথে কথা বলছেন নেপালি ভাষায়, বাবার সাথে উর্দুতে। বাইরে কিংবা অতিথির সাথে কথা বলছেন বাংলায়। এই তিনটি ভাষার পাশাপাশি স্বাভাবিকভাবেই এই পরিবারে আছে আরো দুটির ভাষার আনাগোনা। একটি হিন্দি আর একটি ইংরেজি।
উপমহাদেশের সন্তান ছিলেন বশির আহমেদ। গানেও তিনি ছিলেন অখণ্ড মানুষ। শিল্পী, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও গীতিকার ছিলেন এই উপমহাদেশের। পাকিস্তানের মানুষের কাছে তাঁর যেমন জনপ্রিয়তা, তেমনই বাংলাদেশের বাংলা গানের মানুষের কাছেও।
বাংলা সঙ্গীতাঙ্গনে তিনি ছিলেন উজ্জ্বলতম একটি নক্ষত্রের নাম। শিল্পী বশির আহমেদের স্থান অসংখ্য ভক্তের হৃদয়ে। সঙ্গীতের প্রতি যে প্রগাঢ় মমতা আর ভালবাসার দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেছেন, সেই ধারাবাহিকতায় নতুন প্রজন্মও সময়ের হাত ধরে উদ্দীপ্ত। অসংখ্য গানই শুধু নয়, বাংলাদেশের সঙ্গীতের অনেক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের গুরুও ছিলেন বশির আহমেদ।
মানুষের জীবন যে একটা ভ্রমণকাহিনী তা আক্ষরিক অর্থেই সত্য হয়েছিল শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার বশির আহমেদের জীবনে। জন্ম হয়েছিল কলকাতার খিদিরপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৩৯ সালের ১৮ নভেম্বর। তাঁর বাবার নাম নাসির আহমেদ। খুব ছোটবেলা থেকেই বশির আহমেদ ছিলেন সঙ্গীতপাগল। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ওস্তাদ বেলায়েত হোসেন খান বাকার কাছে সঙ্গীতচর্চা শুরু হয় তাঁর।
সঙ্গীতের উন্মাদনায় তিনি বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন মাত্র ১৫ বছর বয়সে। পালিয়ে সোজা মুম্বাই। ১৯৯৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে বশির আহমেদ বলেছিলেন, ‘সে বয়সে গান ছাড়া আর কিছুই বুঝতাম না। গান আমাকে পেয়ে বসেছিল। রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল গান। বাবা-মাকে না বলেই এক অর্থে পালিয়ে চলে গেলাম। বোম্বে গিয়ে উঠলাম গীতিকার রাজা মেহেদীর বাসায়। তিনি আমাকে ছেলের মতো জানতেন। সুরকার নওশাদের সহকারী ছিলেন মোহাম্মদ শফি। তাঁর সঙ্গেও আমার পরিচয় ঘটল। তিনিই আমাকে গান গাওয়ার সুযোগ করে দিলেন। বোম্বেতে থাকাকালীন সেই ১৯৫৪-৫৫ সালে গীতা দত্ত, আশা ভোঁসলের সঙ্গে ডুয়েট গান গাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তালাত মাহমুদের সঙ্গে সে সময় আমার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে।’ মুম্বাইয়ে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁর কাছে তালিম নেন বশির আহমেদ। তার কাছ থেকে শুধু তালিমই নয় বরং সঙ্গীতের অনুপ্রেরণাও পেয়েছেন তিনি।
নিজে যেভাবে ওস্তাদদের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন শিক্ষার্থীদের কাছেও তেমন নিষ্ঠা ও নিবেদন আশা করতেন বশির আহমেদ। মুম্বাইয়ে গান শেখার সময় একবার একটি ঘটনা ঘটে। তালিম দিতে গিয়ে ওস্তাদের শুরু হয় কাশি। কফ ফেলবার জন্য ওস্তাদ এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। বশির আহমেদও তাকিয়ে দেখলেন। কফ ফেলার কোনো পাত্র না পেয়ে নিজেই দুহাত পেতে দিলেন ওস্তাদের মুখের সামনে। লোক দেখানোর জন্য তিনি তা করেননি। আত্মনিবেদনের উন্মাদনায় তিনি তা করেছিলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এই স্বতঃস্ফূর্ততার প্রতিদান তাকে দুহাত ভরেই দিয়েছিল প্রকৃতি। সঙ্গীতে তিনি তা পেয়েছিলেন।
শিল্পী কনকচাঁপা একেবারে যখন শিশু তখনই তার বাবা বশির আহমেদের কাছে গান শেখার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই স্মৃতিচারণ করে কনকচাঁপা বলেন, ‘শিল্পী বশির আহমেদ শুধু আমার গানের শিক্ষক ছিলেন তা কিন্তু নয়, একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য যা দরকার, তার অনেক কিছুই শিখিয়েছেন। একজন মানুষ কতটা ভালো এবং কত বেশি সৎ হতে পারেন, তা তাঁকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। নিয়মনীতিতে বেশ কঠোর ছিলেন। আমরা একসঙ্গে অনেকে তাঁর কাছে গান শিখতাম। আমাকেই অনেক বেশি স্নেহ করতেন। তাঁর শাসনও ছিল বেশ কঠোর। সেটা আমার এখনকার বয়স পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ওস্তাদজি হঠাৎ করেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্লাসে নতুন কিছু ধুন শোনাতেন এবং সেগুলো ক্লাসে শিখে নিতে বলতেন। কিন্তু কোনো কিছু নোট করতে দিতেন না। আবার হঠাৎ করেই ক্লাসে পড়া ধরতেন। আমিও চেষ্টা করতাম ওস্তাদজির শেখানো ধুনগুলো সঠিকভাবে গাওয়ার।’
ঢাকায় আসার আগেই উর্দু চলচ্চিত্রে গান গাওয়া শুরু করেন তিনি। ১৯৬০ সালে তালাত মাহমুদের সঙ্গে ঢাকা আসেন গান গাওয়ার জন্যে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাঁরা একসঙ্গে স্টেজে গান করেন। তারপর ফিরে গেলেও গানের টানেই কিছুদিন পরপর ঢাকা আসতেন বশির আহমেদ। এই আসা-যাওয়ার মধ্যে এখানে উর্দু চলচ্চিত্র ‘তালাশ’-এ (১৯৬৩) গান গাওয়ার সুযোগ পান। তখন চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তাফিজ তার ‘সাগর’ ছবির জন্য গান লিখতে বশির আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বশির আহমেদ সেই ছবির গান লেখেন এবং চমৎকারভাবে গেয়েছিলেন ‘জো দেখা প্যায়ার তেরা’ শীর্ষক গানটি। একইভাবে ওস্তাদ রবিন ঘোষও (বাংলা সঙ্গীতজগতের আরেক কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব) তার সঙ্গীত পরিচালনার ছবির গান লেখার জন্য বশির আহমেদকে অনুরোধ করেন। ১৯৬৪ সালে ‘কারোয়ান’ ছবির জন্য বশির আহমেদ গান লিখেছিলেন এবং অসাধারণ গেয়েছিলেন।
বাংলা গানের এই নক্ষত্রের গাওয়া ও লেখা কালজয়ী অনেক উর্দু গান রয়েছে। এদেশে তৎকালীন সময়ে উর্দু চলচ্চিত্র নির্মিত হতো নিয়মিত। আর উর্দু ছবির গানের প্রয়োজনেই কদর বাড়তে শুরু করলো বশির আহমেদের। তাঁর কণ্ঠটিও ছিল উর্দু গানের। ‘তালাশ’ ছবিতে নায়ক রহমানের ঠোঁটে তাঁর জনপ্রিয় গান ছিল-‘কুছ আপনি কাহিয়ে, কুছ মেরি সুনিয়ে’। এরপর জহির রায়হানের উর্দু ছবি ‘সঙ্গম’ (১৯৬৪)-এ গান করেন। বশির আহমেদ উর্দুভাষার গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পীও। উর্দু চলচ্চিত্র ‘কারওয়াঁ’ (১৯৬৪)-তে তাঁর নিজের লেখা ও সুরে ‘যব তুম আকেলে হোগে হাম ইয়াদ আয়েঙ্গে’ জনপ্রিয় হয়। রেডিও পাকিস্তানে ষাটের দশকে সবচেয়ে বেশি বাজতো গানটি। তার গাওয়া গানে সমৃদ্ধ ছবিগুলোর মধ্যে ‘সাগর’, ‘কারোয়ান’, ‘ইন্ধন’, ‘কঙ্গন’, ‘দর্শন’ ও ‘মিলন’ উল্লেখযোগ্য। শবনম ও রহমান অভিনীত ‘দর্শন’ ছবিতে বশির আহমেদ গেয়েছেন গান ‘তুমহারে লিয়ে ইস দিলমে যিতনি মোহাব্বত হ্যায়’ গানটি। উর্দু চলচ্চিত্র ‘দর্শন’ (১৯৬৭) তাঁকে নিয়ে যায় খ্যাতির শীর্ষে। এই চলচ্চিত্রের গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন তিনি। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৭ সালে।
বাংলাদেশের বিখ্যাত এই গায়ক বাঙালি ছিলেন না, এমনকি তিনি বাংলা ভাষাও জানতেন না। তিনি ছিলেন দিল্লির সওদাগর পরিবারের সন্তান। ১৯৬০ সালে কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। বাংলা চলচ্চিত্রে সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করতে থাকেন তিনি। বশির আহমেদ ভারতের অধিবাসী হয়েও বাংলাদেশে এসে গানের সুর ছড়িয়ে দিয়ে ভক্তদের তিনি মুগ্ধ করেছিলেন। তাঁর গাওয়া জনপ্রিয় বাংলা গানের মধ্যে রয়েছে: ‘অনেক সাধের ময়না আমার’, ‘আমাকে পোড়াতে যদি এত লাগে ভাল’, ‘যারে যাবি যদি যা’, ‘পিঞ্জর খুলে দিয়েছি’, ‘ডেকো না আমাকে তুমি কাছে ডেকো না’, ‘কথা বলো না বলো ওগো বন্ধু’, ‘সবাই আমায় প্রেমিক বলে’, ‘ওগো প্রিয়তমা’, ‘খুঁজে খুঁজে জনম গেল’, ‘ঘুম শুধু ছিল দুটি নয়নে’, ‘কাঁকন কার বাজে রুমঝুম’, ‘আমাকে যদি গো তুমি’। এ রকম অসংখ্য গানের শিল্পী বশির আহমেদ। যে গানগুলোর সাথে আজও অজস্র ভক্ত-অনুরাগী স্মৃতির আবেশে হারিয়ে যায়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বশির আহমেদের গাওয়া গানগুলো লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক, ফজল-এ-খোদা, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, খান আতাউর রহমানসহ আরো অনেকে। ষাটের দশকে রেডিওতে খান আতাউর রহমানের লেখা ও সুরে ‘যা রে যাবি যদি যা’ এবং ‘আমাকে পোড়াতে যদি এত লাগে ভালো’ গান দুটি বশির আহমেদকে বাংলাগানে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। বাংলা গানে লায়লা আরজুমান্দ বানু, আনোয়ার উদ্দীন খান, ফেরদৌসী রহমান, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, ফরিদা ইয়াসমীন প্রমুখ ছিলেন প্রতিষ্ঠিত। তাদের পরে মাহমুদুন্নবী, সৈয়দ আবদুল হাদী, খুরশীদ আলম প্রমুখের পাশাপাশি সংগীতের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হিসেবে আবির্ভূত হন বশির আহমদ।
উচ্চাঙ্গসংগীত গাওয়ার মতো দক্ষ কণ্ঠ ছিল বশির আহমদের। রাগভিত্তিক গানগুলো কত সহজে ধারণ করত তাঁর কণ্ঠ। বশির আহমেদের কণ্ঠে জনপ্রিয়তা পাওয়া ফজল-এ-খোদার লেখা কয়েকটি রাগাশ্রয়ী গানের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। যেমন: ‘ভালোবেসো না/আমাকে আর ভালোবেসো না’, ‘কী করে গাহিব/সুর যেন সেজেও সাজে না’, ‘সজনী রজনী যায় চলে যায়’, ‘ওগো নন্দিনী আনন্দিনী/প্রেম বন্দিনী রজনীগন্ধা’ এবং ‘জীবন শুধু প্রেমের বাঁধন আর কিছু নয়’।
বশির আহমেদের সুরে গান করেছেন ফেরদৌসী রহমান, মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন থেকে শুরু করে তরুণতর অনেক শিল্পী। একইভাবে আবদুল আহাদ, খান আতাউর রহমান, খন্দকার নুরুল আলম, সুবল দাস, রবীন ঘোষ, সত্য সাহা, আজাদ রহমান থেকে শুরু করে ইমন সাহার মতো তরুণ সুরকারের গানও করেছেন বশির আহমেদ।
গান গাওয়া, সুর করা, গান শেখানো এবং গান লেখা- সব মিলে পরিপূর্ণ সংগীত-ব্যক্তিত্ব বলতে যা বোঝায়, বশির আহমেদ ছিলেন তাই। ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি গান ছাড়া অন্য কিছু করেননি। গান ছিল তাঁর নির্ভরতা, তাঁর আশ্রয়।
বাংলা গানকে তিনি মন-প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছেন। বাংলায় গান লিখেছেন ‘বি এ দ্বীপ’ নামে। তাঁর বাংলাগানের প্রতি ভালোবাসার প্রতিদান দিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ তাঁর গান গ্রহণ করে। আমৃত্যু তিনি আমাদের গানের ভুবনকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁর মেধা দিয়ে তাঁর প্রতিভা দিয়ে।
আমাদের দেশে শুধু সংগীতকে পেশা হিসেবে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন। সেই কঠিন কাজটিকেই জীবনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন বশির আহমেদ। শত প্রতিকূলতার মুখেও বিশুদ্ধ সংগীতকে কখনো বিসর্জন দেননি। শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন যাপন করেছেন সংগীত শিল্পের সাধক হয়ে। তাঁর জীবন তাঁর সংগীত আমাদের উত্তর-প্রজন্মকে প্রেরণা জোগাবে, আলো দেখাবে।
শিল্পী বশির আহমেদ বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রারম্ভিক সময়কাল থেকেই সঙ্গীত বিভাগের অন্যতম কর্মকর্তা থেকে শুরু করে একাধিক গানের অনুষ্ঠানের রূপকার ও পরিচালক ছিলেন। যদিও এক পর্যায়ে কিছু অভিমানে দীর্ঘকাল বিটিভি থেকে দূরে ছিলেন বরেণ্য এই শিল্পী।
‘কখনও মেঘ কখনও বৃষ্টি’ ছবিতে গানের জন্য ২০০৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ গায়ক) পান বশির আহমেদ। বশির আহমেদ একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।
জীবনের পথ পাড়ি দিয়ে শিল্পী বশির আহমেদ ২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল চলে যান না ফেরার দেশে। অনিবার্য নিয়তির বেড়াজালেই যেদিন বশির আহমেদ চলে গেলেন না ফেরার দেশে সেদিন দেশের সঙ্গীতাঙ্গন শোকাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলো। তিনি চলে গেছেন এটা যেমন সত্য, অনুরূপ সত্য যে, গানের মূর্ছনায় অসংখ্য ভক্ত-শ্রোতার হদয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন। সঙ্গীতের প্রতি যে প্রগাঢ় মমতা আর ভালোবাসার দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেছেন, সেই ধারাবাহিকতায় নতুন প্রজন্মও সময়ের হাত ধরে উদ্দীপ্ত হবে।
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন, ‘বশিরের কণ্ঠ ছিল দারুণ মিষ্টি।’ আরেক গুণি শিল্পী ফেরদৌসী রহমান বশির আহমেদের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘ষাটের দশক থেকে আমি বশির ভাইয়ের সঙ্গে চলচ্চিত্রে গান গাওয়া শুরু করি। তখন উর্দু ছবিই হতো বেশি। এরপর যখন বাংলা ছবি নির্মাণ শুরু হল, তখনো আমি তাঁর সঙ্গে জুটি হয়ে অনেক ছবিতে গান করেছি। একসময় আমাদের মধ্যে দারুণ একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। পারিবারিকভাবেও আমাদের মধ্যে একটা দারুণ যোগাযোগ ছিল। কেবল একজন গুণী সঙ্গীতশিল্পীই নন, অসাধারণ ও খুব ভালো মনের মানুষ ছিলেন তিনি। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। যখনই দেখা হতো, একটা হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হতো।’ গাজী মাজহারুল আনোয়ারের সাথে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই শিল্পী বশির আহমেদের সুসম্পর্ক ছিলো। একসঙ্গে অনেক ছবিতে তারা গান করেছেন। বয়সের ব্যবধান বেশি হলেও তাদের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতোই। গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, ‘এক সঙ্গে দুজনে শেষ কাজ করেছিলাম মৌসুমী পরিচালিত ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ ছবিতে।’ বাংলা গানে অন্যতম আরেক গুণী শিল্পী ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীও মনে করেন, ‘বশির আহমেদ ছিলেন আমাদের সঙ্গীতের পুরোধা। গানের জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। এমন নক্ষত্রের উদয় বারবার হয় না। ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী উচ্চারণ: ‘অসময়ে চলে গেলেন তিনি- এটা বলব না। তিনি অনেক কিছুই দিয়ে গেছেন আমাদের।’ কিংবদন্তি শিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদীও বিশ্বাস করেন, ‘বশির আহমেদ ছিলেন একজন মৌলিক শিল্পী। হিন্দি, বাংলা, উর্দু সব ভাষার গানেই তিনি সফল ছিলেন। এমন ভাগ্য নিয়ে সবাই জন্মায় না। তিনি এমনই একজন মানুষ, গানের জন্য কখনোই কোনো কিছুতেই আপস করেননি।’
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
বশির আহমেদ ছিলেন একাধারে সংগীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার ও সংগীত পরিচালক। একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন গুণী এ শিল্পী। তাঁর জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে: ‘অনেক সাধের ময়না আমার’, ‘আমাকে পোড়াতে যদি এত লাগে ভালো’, ‘যারে যাবি যদি যপিঞ্জর খুলে দিয়েছি’, ‘ডেকো না আমারে তুমি/ না কাছে ডেকো ’।
জন্ম ও পরিচয়:
বশির আহমেদের জন্ম কলকাতার খিদিরপুরে। সওদাগর পরিবারে। ১৯৩৯ সালে। উর্দু ছিল তাঁর পরিবারের ভাষা। গানের হাতেখড়ি ওস্তাদ বেলায়েত হোসেন খানের কাছে। গানের জন্য চোদ্দ-পনেরো বছর বয়সে পাড়ি জমান বোম্বে (মুম্বাই)। বাংলাদেশী এই সঙ্গীতশিল্পী পাকিস্তান আমলে আহমেদ রুশদি বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি শিল্পি নূর জাহানের সঙ্গে অনেক উর্দূ গান তিনি গেয়েছেন।
শিক্ষা:
দিল্লির এক পরিবারের সন্তান বশির আহমেদ কলকাতায় ওস্তাদ বেলায়েত হোসেনের কাছ থেকে সঙ্গীত শেখার পর মুম্বাইয়ে চলে যান। সেখানে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ’র কাছে তালিম নেন। ১৯৬৪ সালে সপরিবারে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় আসার আগেই উর্দু চলচ্চিত্রে গান গাওয়া শুরু করে বশির আহমেদ। চলচ্চিত্রে ‘যব তোম একেলে হোগে হাম ইয়াদ আয়েঙ্গে’ গানটি পাকিস্তানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল মাধূর্যে ভরা। রাগ সঙ্গীতেও দখল ছিল তাঁর। ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁর কাছে তালিম নেন তিনি। তালাশ চলচ্চিত্রে বিখ্যাত শিল্পী তালাত মাহমুদের সঙ্গে কাজ করেন।
পেশা:
সংগীতশিল্পী, গীতিকার, সুরকার।
পারিবার:
১৯৩৯ সালের ১৯ নভেম্বর কলকাতার খিদিরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম নাসির আহমেদ। বশির আহমদের স্ত্রী মিনা বশির একজন কণ্ঠশিল্পী। তাঁদের এক মেয়ে এক ছেলে- হোমায়রা বশির ও রাজা বশির। তারাও গানের জগতের মানুষ। বাবার কাছেই তাদের হাতেখড়ি ও গান শেখা। অর্থাৎ বশির আহমদের পরিবার শিল্পী পরিবার।
পুরস্কার ও সম্মাননা:
কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি ছবিতে গানের জন্য ২০০৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ গায়ক) পান। পেয়েছেন একুশে পদকসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা।
বশির আহমেদের গান যে যে চলচ্চিত্রে:
তালাশ, সাগার, কারওয়ান, ইন্ধান মিলন, কাংগান, ধারশান সহ আরো অনেক সিনেমা।
বশির আহমেদের জনপ্রিয় গান:
কুচ আপ্নি কাহিয়ে কুচ মেরি সুনিয়ে, ইয়ে শাম ইয়ে তানহায়ে ইউ চুপ তো মাত রাহিয়ে, আমি রিক্সাওয়ালা মাতওয়ালা, আমাকে পুরাতে যদি এত লাগে ভাল, আমার খাতার প্রতি পাতায়, যারে যাবি যদি যা, অনেক সাধের ময়না আমার, ডেকোনা আমারে তুমি কাছে ডেকো না, মানুষের গান আমি শুনিএ যাবো…।
মৃত্যু:
২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল, শনিবার মোহাম্মদপুরে নিজের বাসায় মারা যান দেশের বরেণ্য সংগীতশিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচালক বশির আহমেদ। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ঈদগাহ গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ ও ক্যানসারে ভুগছিলেন বশির আহমেদ। মৃত্যূকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
তথ্যসূত্র: মে, ২০১৭ সালে রাজা বশীরের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুদীপ কুমার দে।
লেখক- সুদীপ কুমার দে