‘‘একদিন বিকেলবেলা জ্যাঠামশায় সত্যিই তাঁকে সঙ্গে করে আমাদের বাড়ি নিয়ে এলেন। সেদিন শ্রী মজুমদারের হাতে ছিল একটি ক্যামেরা। জ্যাঠামশায়েরর ছেলের বিয়েতে কলকাতা যেতে হবে। পাসপোর্ট করার জন্য মা ও আমার ছবি সেদিন তুলে দিয়েছিলেন। তারপর বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে বসানো হলো তাঁকে। জ্যাঠামশায়ের নির্দেশে হারমোনিয়াম ও তবলা আনা হলো। দুরু দুরু বুকে আমি আমার শ্রেষ্ঠ গানখানি ‘অন্তর মন্দিরে জাগো জাগো মাধবকৃষ্ণ গোপাল’ অনেক কায়দা-কসরত করে গেয়ে শোনালাম। সবাই যেমন বাহবা দেয়, ঠিক সেইভাবে ইনিও আমার গান শুনে চমৎকৃত হবেন এই রকম একটা আশা মনে হয়ত ছিল। ভয়ে ভয়ে তাঁর মুখের দিকে চকিতে তাকিয়ে দেখলাম, বিরক্তিতে মুখখানি তাঁর ভরে গেছে। ঘাড় ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। বাবাও আমার মতো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন কন্যার প্রশংসা শোনার জন্যে। একেবারে নিশ্চুপ অবস্থা দেখে বাবা জিজ্ঞেস করলেন– ‘কেমন শুনলে?’ ধৈর্যের বাঁধ বুঝি আর রাখা গেল না। অসহিষ্ণু গলায় বললেন, ‘সবটাই তো বেসুরো।’ জ্যাঠামশায় তখন বললেন, ‘তুই মাঝে মাঝে এসে ওকে একটু দেখিয়ে দিস না।’ আবারও কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বললেন, ‘আমার কাছে শিখতে হলে এতো দিন যা শিখেছে সব ভুলতে হবে।’ বাবা তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন, ‘তুমি ওর ভার নাও, একেবারে আজই ক, খ থেকে ওকে শেখাও।’’
সঙ্গীত বিশারদ বারীণ মজুমদারের কাছে প্রথমদিনের তালিম নেওয়ার কথা প্রখ্যাত ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পী ইলা মজুমদার তাঁর ‘দিনগুলি মোর’ গ্রন্থে এভাবেই স্মৃতিচারণ করেছেন।
‘‘জন্ম হয়েছিল আমার ‘পাবনা’ নামের ছোট্ট একটা জেলার ততোধিক ছোট একটা গ্রাম, আমার মামার বাড়ি ‘নরিনা’তে (নন্যে)। গ্রাম ছোট হলেও সেখানকার জমিদার স্বর্গীয় সুরেশচন্দ্র মজুমদার, যিনি আমার দাদামশায় (মা’র বাবা) ছিলেন প্রবল প্রতাপান্বিত একজন ব্যক্তি। তাঁর শাসন, স্নেহ আর যত্নে গ্রামখানি ফুলে ফলে শস্য সম্পদে ভরে থাকা এক সোনার গ্রাম ছিল। পটে আঁকা ছবির মতো ছিল তার রূপ। অমন সুন্দর ভর-ভরন্ত একটা গ্রাম আমি আর দেখিনি। গ্রামের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে ‘করতোয়া’ নামের স্বচ্ছতোয়া এক রুপোলি নদী। যার রূপে বিভোর হয়ে স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও এক সময় কতো যে কবিতা, কতো যে গান, কতো যে কথা লিখে গেছেন বলে শুনেছি।’’
নিজের মামাবাড়ি সম্পর্কে এভাবেই বলেছেন ইলা মজুমদার । জন্ম মামাবাড়িতে হলেও শৈশব কেটেছে মূলত পাবনা জেলা শহর থেকে মাইল ছয়েক দূরে আরেক গ্রাম রহিমপুরে। রহিমপুর গ্রামেই ছিলো তাঁর পূর্বপুরুষের জমিদারি। জমিদারি ছিল তাঁর বাবার ঠাকুরদা বৃন্দাবনবিহারী মজুমদারের আমলে। জমিদারি প্রথার বিলোপ এবং সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছিল ইলা মজুমদারের পূর্বপুরুষের পরিবারও। দাদা ললিতবিহারী মজুমদার ছিলেন পাবনা জজকোর্টের প্রভাবশালী মোক্তার। বাবাও ছিলেন আইনপেশায়। ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেছিলেন ইলা মজুমদারের বাবা অনিল মজুমদার। ওকালতি করলেও মানবিক চেতনা এবং উচ্চ মূল্যবোধের কারণে তিনি পেশায় অর্থের চেয়ে সেবাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। যে কারণে বিত্তবৈভবে সমৃদ্ধ ছিলেন না তিনি, ছিলেন চিত্তবৈভবে সমৃদ্ধ।
ছোট হলেও পাবনা জেলা শহর ছিল ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকেই শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণেও পাবনার এই সমৃদ্ধি। ১৯৪১ সালে পাবনার যে পরিবারে ইলা মজুমদারের জন্ম সেই পরিবার ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে খুবই অগ্রসর। সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোতে তখন হিন্দুধর্মীয় রক্ষণশীলতা থাকলেও ইলা মজুমদারের মানসিক বিকাশে তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং পরিবারের দাদা, বাবা, জ্যাঠা, ঠাকুমা, পিসিমা, মা এঁদের বেদ, উপনিষদ, গীতা, রামায়ণ, মহাভারত ও চৈতন্য চরিতামৃতের ধর্মীয় গ্রন্থের জ্ঞান এবং নিত্যদিনের পূজা, পার্বণ, আচার, প্রথা ও ব্রতের ঐতিহ্য ইলা মজুমদারকে সমৃদ্ধ করেছে নানাভাবে। বাড়িতে বিভিন্ন উপলক্ষে নাচ, গান ও নাটক হতো। ছেলেরা মেয়ে সেজে নাটকে অভিনয় করতেন। এর বাইরে বাড়ির অন্দরমহলে মঞ্চস্থ নাটকে মেয়েরাও পুরুষ ও নারীর চরিত্রে অভিনয় করতেন। গ্রামীণ সংস্কৃতির চিরন্তন ঐতিহ্য নানা ছড়া ও গান, ব্রতকথা, পাঁচালি ও আচারের নানা গীত, কথা ও কাহিনী ছোটবেলা থেকেই তাঁকে আলোড়িত করেছে। ইলা মজুমদারের শৈশবের আরো একটি বড় আলোড়ন হচ্ছে ভারত তখন নতুন এক সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। বাবা-চাচা থেকে শুরু করে বাড়ির ভিতরের নারীদেরও অনেকে সেই রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে শুধু সচেতনই নন কেউ কেউ তাতে সরাসরি যুক্ত। ভারতবর্ষ তখন প্রস্তুত হচ্ছে ব্রিটিশদের তাড়ানোর জন্য। ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব তখন ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের সম্পন্ন ও শিক্ষিত পরিবারগুলোতেও। সংরক্ষণশীল কিন্তু আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হিন্দু পরিবারগুলোর মধ্যে তখন স্বাধিকারবোধ প্রবল। এই সূত্রে তখন তারা অনেক বেশি উদারও হয়ে উঠেছে। পারিবারিক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আবহ এবং তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা ইলা মজুমদারের প্রজন্মকে আদর্শ ও মূল্যবোধের জায়গা থেকে শৈশবেই গড়ে তুলেছে নতুন আগামীর এক নতুন প্রজন্ম হিসেবে। ইলা মজুমদারের সঙ্গীতের শিক্ষাও শুরু হয়েছে পরিবারেই। পরিবারের জ্যাঠা ও কাকাদের কাছে কিংবা নিকটাত্মীয় ও পরিজনদের কাছেই হারমোনিয়াম ও তবলা সহযোগে তালিম নেওয়া শুরু হয় একেবারে ছেলেবেলাতেই। ধর্মীয় সঙ্গীত দিয়েই শুরু হয়েছিল সেই শিক্ষা। পরে তা ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একেবারে আনুষ্ঠানিক তালিম নেওয়া পর্যন্ত।
ইলা মজুমদার পড়াশুনা শুরু করেন পরিবারে। বাড়ির পাশে পরিবারের নারীদের কেউ কেউ স্কুল প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষকতায় যুক্ত থাকলেও ছোটবেলায় স্কুলে তাঁর আনুষ্ঠানিক পাঠ নেওয়া হয়নি। পরিবারের মধ্যে এক ধরনের উন্মুক্ত শিক্ষা লাভ করেছেন তিনি। লেখাপড়া ও সঙ্গীত– দুই শিক্ষারই শুরু এভাবেই। স্কুলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ একেবারে ম্যাট্রিক (মাধ্যমিক) পরীক্ষার সময়। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার জন্যই পাবনা গার্লস স্কুল থেকে নিবন্ধন করেন তিনি। ১৯৫৫ সালে সেখান থেকেই মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে। তাঁর জ্যাঠামশায় নলিনী রঞ্জন রায় ছিলেন ওই কলেজের অধ্যক্ষ। পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ১৯৫৭ সালে এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতক করেন। ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে এমএ প্রথমপর্ব এবং পরে ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
ইলা মজুমদার সঙ্গীতে তালিম নেন সঙ্গীত বিশারদ বারীণ মজুমদারের কাছে। পাবনার রাধানগর গ্রামের জমিদারবাড়ির সঙ্গে তাঁদের পরিবারের আত্মীয়তা ছিল। এছাড়া ওই বাড়ির ছোটছেলে নিশেন্দ্রনাথ মজুমদারের সঙ্গে ইলা মজুমদারের জ্যাঠামশায়ের ছিল মধুর সম্পর্ক। নিশেন্দ্রনাথ মজুমদারের বড় ছেলে বারীণ মজুমদার তখন সঙ্গীতের পীঠভূমি লক্ষ্মৌয়ের ‘মরিস কলেজ অব মিউজিক’ থেকে শিক্ষা লাভ শেষে পাবনায় গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। এসময় বারীণ মজুমদারের কাছে ইলা মজুমদার তালিম নেওয়া শুরু করেন। প্রথমদিন তালিম শেষে বারীণ মজুমদার যখন চলে গেলেন তখন বিস্ময়, ভালোলাগা আর রোমাঞ্চে ইলা মজুমদারের মন ভরে উঠেছিলো। সঙ্গীতের মাধুর্য সেদিন তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। বারীণ মজুমদার চলে যাওয়ার পর হঠাৎ দেখলেন ক্যামেরায় ব্যবহার করা ফিল্মের বাক্সটা পড়ে আছে। সেই বাক্সটি কুড়িয়ে নিয়ে পরম যত্নে তুলে রেখে দিলেন তিনি। বারীণ মজুমদার নিয়মিত তাঁকে শেখাতে আসতেন না। যখন আসতেন না তখন গুরুর চিহ্ন হিসেবে ওই বাক্সটিকে পূজা করতেন কিশোরী ইলা মজুমদার।
১৯৫৪ সালের আগের কথা এসব। ১৯৫৪ সালেই প্রথম বড় কোনো অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন ইলা মজুমদার। এর আগে পূজা-পার্বন ও জন্মতিথির নানা অনুষ্ঠানে গাইতেন। ১৯৫৪ সালে পাবনার বনমালি ইনস্টিটিউটে বড় কোনো অনুষ্ঠানে গান গেয়ে প্রথম সবার নজর কাড়েন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ওই অনুষ্ঠানে গাওয়ার জন্য তাঁকে মেডেল দিয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালে ঢাকা আর্ট কাউন্সিলের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সঙ্গীত সম্মেলনের আয়োজন করা হয় তৎকালীন গুলিস্তান হলে। সেখানে পাবনা জেলা থেকে দুজন প্রতিযোগীকে গাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। তাঁদের একজন ছিলেন ইলা মজুমদার। সেই সম্মেলনের প্রতিযোগিতায় ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরে আক্রান্ত অবস্থায় অংশ নেন তিনি। ক্ল্যাসিকালে তিনি প্রথম হন। এই প্রতিযোগিতার পরপরই তিনি বাংলাদেশ বেতারে (তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান) অডিশন দেওয়ার আমন্ত্রণ পান এবং নিয়মিত শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। তখনো তাঁর স্নাতকোত্তর লেখাপড়া শেষ হয়নি। একই বছর সঙ্গীতগুরু বারীণ মজুমদার চলে আসেন ঢাকায়। যোগ দেন বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিক্ষক হিসেবে। সঙ্গীতের তালিম নেওয়াটা তখন আরো অনিয়মিত হয়ে পড়ে। তবে মাঝে মাঝে পাবনায় গেলে ইলা মজুমদারকে শেখাতে যেতেন বারীণ মজুমদার।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তখন গড়ে উঠছে। ক্লাস হয় রাজশাহী কলেজে। দর্শনবিভাগে তখন একই ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন ইলা মজুমদার ও কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকসহ মোট ১৩ থেকে ১৪ জন। স্নাতক প্রথমপর্ব পড়ার সময় ১৯৬০ সালের ১ মার্চ সঙ্গীতগুরু বারীণ মজমুদারের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় ইলা মজুমদারের। স্বামীর সঙ্গে বসবাসের জন্য ঢাকায় চলে আসেন তিনি। স্নাতকোত্তর দ্বিতীয়পর্বের পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনা, সঙ্গীতচর্চা, নতুন সংসার, শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ঝক্কি, গর্ভের সন্তান, ঢাকা শহরের পূর্ববঙ্গীয় সংস্কৃতি বলয়– সব মিলিয়ে ইলা মজুমদারের জীবন বাঁক নেয় একটা ‘জটিল আবর্তে’। ইলা মজুমদার আত্মস্মৃতি ‘দিনগুলি মোর’ গ্রন্থে বলছেন, ‘আমাদের দেশে মেয়েদের বিবাহোত্তর জীবন অনেকটাই জন্মান্তরের মতো। বিশেষ করে হিন্দু পরিবারে। নিজেকে একেবারে ঢেলে অন্য ছাঁচে সাজাতে হবে। শত দুঃখ, শত ব্যথা, শত লাঞ্ছনা হজম করে সবার মতে মত মিলিয়ে তাদেরই একজন হয়ে যেতে হবে। যারা তা পারল তারা টিকে গেলো, আর যারা বিদ্রোহ করলো তাদের নাম একেবারে ইতিহাসের পাতায় উঠে যাওয়ার দশা।’
জীবনের এই ‘জটিল আবর্ত’ খুব ভালোভাবেই কাটিয়ে ওঠেন স্থিতধী ইলা মজুমদার। জীবনে নতুন সূর্যোদয়ের মতো ঘটনা ঘটে ১৯৬১ সালেই। ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ওই বছরই তাঁর কোলজুড়ে আসে প্রথম সন্তান কন্যা ‘বাবু’। ইলা মজুমদারও যোগ দেন বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে সঙ্গীতের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে। বুলবুল ললিতকলায় শিক্ষকতার পাশাপাশি সঙ্গীতজ্ঞ বারীণ মজুমদার চেষ্টা চালাতে থাকেন ঢাকায় সঙ্গীত কলেজ প্রতিষ্ঠার। ১৯৬৪ সালের দিকে কার্যক্রম শুরু হয় মিউজিক কলেজের। ইলা মজুমদারও সেখানে যোগ দেন খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে। ততদিনে পূর্ব-পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার সংস্কৃতি অঙ্গনে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন তিনি। হয়ে ওঠেছেন এই অঙ্গনেরই অন্যতম এক প্রতিনিধি, এক অনন্য সঙ্গীত-প্রতিভা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা এবং সঙ্গীতের শিক্ষকতার সূত্রে হয়ে উঠেছেন কারো বন্ধু, কারো দিদি, কারো গুরু এবং কারো নিকটাত্মীয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত বড় কোনো বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েননি ইলা মজুমদার। যুদ্ধের অভিঘাত তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে একেবারে তছনছ করে দেয়। ইলা মজুমদারের সেই বিপর্যয়ের ঘটনা তিনি নিজেই তুলে ধরেছেন ‘দিনগুলি মোর’ গ্রন্থে: ‘‘১৯৭১-এর ভয়াল ২৫ মার্চের রাতেই ২৮, সেগুনবাগিচার ‘কলেজ অব মিউজিক’-এর প্রাঙ্গণে পাকিস্তানি সৈন্যদের আনাগোনা শুরু হয় (পরে এটি ‘আর্মি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ হয়)। আমার স্বামী ছিলেন এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। সারা রাত আমাদের আত্মগোপন করে থাকতে হয় অব্যবহৃত একটি সিঁড়ির তলায়। ২৬ তারিখ ছাত্ররা আমাদের পাশের বাড়িতে কোনোভাবে পার করে দেয় এক বস্ত্রে। ২৭ মার্চ বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী জাহিদুর রহিম নিয়ে যান তাঁর বাসায়। সে রাত কোনোভাবে পার হলে তিনি আর দায়িত্ব নিতে সাহস পান না। তখন মিউজিক কলেজের জি এস মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার নেতৃত্বে আমরা বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে জিঞ্জিরার গ্রামে চলে যাই। ২ এপ্রিলের ভোর তখনও ভালো করে ফোটেনি। অন্ধকারেই পাকসৈন্যের বহর ঝাঁপিয়ে পড়লো গ্রামের নিদ্রিত লোকজনের ওপর। শহর থেকে পালিয়ে আসা হাজার হাজার মানুষের পিছু পিছু আমরা ছুটছিলাম এবং বারবার পড়ে যাচ্ছিলাম। চারদিকে আগুন, গুলি আর মৃত্যুর বিভীষিকা। এরই মাঝে আমাদের কলেজের ভি পি ধর্মদর্শী বড়ুয়া দৌড়ে এসে আমার হাত থেকে আমার মেয়েকে নিয়ে ছুটে চললো। সামনে ধলেশ্বরী নদী নৌকোয় পারি দেওয়ার সময় পাকসেনার গুলিতে নৌকো ডুবে যায়। হারিয়ে যায় আমার সোনার মানিক।’’
অর্থ-বিত্ত নয় সঙ্গীতের ভিতর দিয়ে চিত্তের প্রশান্তি খুঁজেছিলেন ইলা মজুমদার। বারীণ মজুমদার ও ইলা মজুমদাররা যখন উচ্চাঙ্গসঙ্গীত নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন তখনও বাংলাদেশে ধ্রুপদী সঙ্গীত সম্পর্কে ধারণা ছিল মুষ্ঠিমেয় মানুষের। তাঁরা সেই ধারণাকে সম্প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন। সঙ্গীত বিশারদ বারীণ মজুমদার চেয়েছিলেন সঙ্গীতকে শিক্ষাজীবনের অপরিহার্য অংশ করে তুলতে। তাঁর সেই কাজের যোগ্য সঙ্গী ছিলেন ইলা মজুমদার। রেডিও ও টেলিভিশনে ধ্রুপদী সঙ্গীত গাওয়ার পাশাপাশি দুজনই নিবেদিত ছিলেন ধ্রুপদী সঙ্গীত তথা সঙ্গীত সম্পর্কে সাধারণ মানুষের চেতনা ও ধারণা বিস্তৃত করার কাজে। তাঁদের এই কাজে বাঁধা এসেছে বারবার। ১৯৬৩ সালে কাকরাইলের একটি বাসায় সীমিত সামর্থ নিয়ে কলেজ অব মিউজিক (বর্তমানে সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়) শুরু করেন বারীণ মজুমদার। তখন থেকেই তিনি ছিলেন তৎকালীন শাসক মোনেম খাঁর চক্ষশূল। ১৯৭৮ সালে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের (কলেজ অব মিউজিক) অনুদান তসরূপের মিথ্যা অভিযোগে বারীণ মজুমদারকে জেল খাটানো হয়। ১৯৮৯ সাল থেকে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন বারীণ মজুমদার। প্রায়ই মরণাপন্ন হয়ে পড়তেন তিনি। ১৯৯৩ সালে একবার আড়াই মাসের মতো অচেতন অবস্থায় ছিলেন বারীণ মজুমদার। ঢাকায় ২০০১ সালের ৩ অক্টোবর স্বামী সঙ্গীত বিশারদ বারীণ মজুমদারের মৃত্যু হয়। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত চূড়ান্ত উৎকণ্ঠা, অর্থকষ্ট আর বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে প্রথম সন্তান শিশুকন্যাকে হারান ইলা মজুমদার। বারীণ মজুমদার ও ইলা মজুমদার দম্পতির অপর দুই সন্তান পুত্র পার্থ মজুমদার ও বাপ্পা মজুমদার। দুজনই বাবা-মায়ের কাছে সঙ্গীতের উপর পারিবারিক শিক্ষা নিয়েছেন। দুজনই সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক। বাপ্পা মজুমদার তাঁর নিজের ব্যান্ডদল ‘দলছুট’-এর মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। সন্তানদের সঙ্গীত ও মূল্যবোধের শিক্ষা নিয়ে গর্বিত জননী ছিলেন ইলা মজুমদার। সঙ্গীতের তরুণদের নিয়ে ইলা মজুমদার আশাবাদী ছিলেন। তরুণদের কণ্ঠ তাঁকে সেই আশা দিত। তাঁদের সেই স্বাভাবিক সুন্দর কণ্ঠকে কাজে লাগানোর জন্য রাগসঙ্গীতের ওপর ন্যূনতম প্রশিক্ষণ থাকাটা জরুরি বলে মনে করতেন তিনি। উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিল্পী ইলা মজুমদারের প্রিয় রাগ ছিল জয়জয়ন্তি, শঙ্করা, পুরিয়া ধানেশ্রী এবং বাহার।
ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পী ইলা মজুমদার শুধু গুণী শিল্পী ছিলেন না। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান যখন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার স্বপ্ন ও প্রকল্প রচনা করতে থাকে তখন থেকেই নিবেদিতপ্রাণ একদল মানুষ স্বপ্নের সেই দেশকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সঙ্গীতে সমৃদ্ধ করে তোলার ক্ষেত্রে কর্মীর ভূমিকায় নেমেছিলেন। সেই দলে ছিলেন ইলা মজুমদার। সঙ্গীত বিশারদ স্বামী বারীণ মজুমদারের সঙ্গে এই বাংলায় সঙ্গীত শিক্ষা প্রসারে তিনিও কাজ করে গেছেন আজীবন। একেবারে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েই সঙ্গীতের শিক্ষকতা ১৫ বছরের বেশি সময়। সঙ্গীতচর্চা ও শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি লেখালেখিও করতেন। সঙ্গীত ও স্মৃতিচারণসহ তাঁর বিভিন্ন লেখা প্রকাশিত হয়েছে নানা পত্রিকায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: ‘স্মৃতিতে শ্রুতিতে বারীণ মজুমদার’, ‘দিনগুলি মোর’ এবং ‘সঙ্গীতের তত্ত্বকথা’। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অসাধারণ। তাঁর ব্যক্তিত্বের সেই অসাধারণত্বের কারণেই সখ্য গড়ে উঠেছিল সঙ্গীত ও সংস্কৃতি অঙ্গনের সমসাময়িক গুণীদের সঙ্গে।
সঙ্গীত ও সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি গুণীজন সম্মাননা প্রদান করে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে অবদানের জন্য ১৯৫৮ সালে তিনি স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। এছাড়া রত্নগর্ভা মায়ের স্বীকৃতিও পেয়েছিলেন ইলা মজুমদার।
সঙ্গীতশিল্পী ইলা মজুমদার দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস ও রক্তচাপসহ নানা রোগে ভোগার পর ২০১১ সালের ৩ মে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
#
জন্ম ও বংশ পরিচয়:
ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পী ও শিক্ষক ইলা মজুমদারের (১৯৪১-২০১১) জন্ম ১৯৪১ সালে পাবনায় এক জমিদার পরিবারে। বাবা অনিলবিহারী মজুমদার এবং মা নির্মলা মজুমদারের নয় সন্তানের মধ্যে সাতজনের পরে তাঁর জন্ম। ইলা মজুমদারের মায়ের বাবার বাড়ি পাবনার নরিনায় (নন্যে) এবং বাবার বাড়ি একই জেলার রহিমপুরে।
শিক্ষা:
পাবনা গার্লস স্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক (মাধ্যমিক) পরীক্ষা দেন। পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ১৯৫৭ সালে এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতক শেষ করেন। ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে এমএ প্রথমপর্ব এবং পরে ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
সঙ্গীতশিক্ষা:
পারিবারিক বলয়ে মূলত সঙ্গীতশিক্ষার শুরু। পরে কিশোর বয়স থেকে ওস্তাদ বারীণ মজুমদারের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা নেন।
পরিবার:
সঙ্গীতগুরু বারীণ মজুমদারের সঙ্গে বিয়ে হয় ১৯৬০ সালের ১ মার্চ। এই দম্পতির তিন সন্তান। বড় কন্যা কিশোর বয়সে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে নৌকাডুবির ঘটনায় প্রাণ হারায়। তাকে আদর করে ডাকতেন ‘বাবু’ বলে। এরপর দুই ছেলে পার্থ মজুমদার ও বাপ্পা মজুমদার । পার্থ মজুমদার একজন সঙ্গীত পরিচালক। ছোট ছেলে শুভাশীষ মজুমদার বাপ্পা এই সময়ের পপসঙ্গীত তারকা। জনপ্রিয় এই সঙ্গীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদার হিসেবেই পরিচিত।
শিক্ষকতা:
পেশাগত জীবনে শিক্ষকতা করেছেন ইলা মজুমদার। বুলবুল ললিতকলা একাডেমি এবং সঙ্গীত কলেজে শিক্ষকতার পর ১৯৮১ সাল থেকে ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে শিক্ষকতা করেন টানা ২২ বছর। এছাড়া ১৫ বছর তিনি জাতীয় সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন।
গ্রন্থ:
প্রকাশিত গ্রন্থ ‘স্মৃতিতে শ্রুতিতে বারীণ মজুমদার’, ‘দিনগুলি মোর’ এবং ‘সঙ্গীতের তত্ত্বকথা’। প্রথমটি সঙ্গীতগুরু ও জীবনসঙ্গী বারীণ মজুমদারকে নিয়ে এবং দ্বিতীয়টি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। ‘সঙ্গীতের তত্ত্বকথা’ পরিচয় মেলে সঙ্গীত নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার।
পুরস্কার ও সম্মাননা:
সঙ্গীত ও সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি গুণীজন সম্মাননা প্রদান করে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে অবদানের জন্য ১৯৫৮ সালে তিনি স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। এছাড়া রত্মগর্ভা মায়ের স্বীকৃতিও পেয়েছিলেন ইলা মজুমদার।
মৃত্যু:
সঙ্গীতশিল্পী ইলা মজুমদার দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস ও রক্তচাপসহ নানা রোগে ভোগার পর ২০১১ সালের ৩ মে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র: ইলা মজুমদারের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘দিনগুলি মোর’, সাহিত্য প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৫। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও অনলাইন থেকে ইলা মজুমদার ও বারীণ মজুমদারকে নিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন লেখা।
লেখক: ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ