তখন ১৯৭১। ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকায় সংবাদ সংগ্রহে ব্যস্ত তুখোড় সাংবাদিক আতাউস সামাদ। তিনি তখন করাচির ‘দ্য সান’ পত্রিকার পূর্ব পাকিস্তান ব্যুরো চিফ। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক, শীর্ষস্থানী রাজনৈতিক নেতা ও উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তারা ভিড় করছেন ঢাকায়। বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও অন্য দলের নেতাদের সঙ্গে চলছে আলোচনার পর আলোচনা। আতাউস সামাদ স্পষ্টই বুঝতে পারছিলেন একটা ভীষণ কিছু হতে যাচ্ছে। কী হতে যাচ্ছে তা জানা দরকার। নিজে না জানলে পত্রিকায় লিখবেন কী? জনগণকে জানাবেন কী? তাই এদিক-ওদিক ছুটছিলেন আতাউস সামাদ।
এর মধ্যে একবার গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ৩২ নাম্বারের বাড়িতেও। নেতাকর্মীরা চলে যাওয়ার পর দেখা পেলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। জানতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যা, স্বাধীনতা দিয়ে গেলাম। এখন এটি রক্ষা করা তোদের দায়িত্ব।’
সেই রাতে ঢাকার হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে অবস্থান করছিলেন নানা দেশের সাংবাদিকরা। সেখানে ছিলেন তুখোড় সাংবাদিক আতাউস সামাদের বন্ধু সাংবাদিক দাউদ সোবহানি। ওই হোটেল থেকে ফোন করলেন সোবহানি: ‘তুম কাহা হো?’ ফোন পেয়েই আঁতকে উঠলেন আতাউস সামাদ। সোবহানী বললেন, ‘ট্যাংক নিকাল গয়া। ভাবি আর বাচ্চা লোগোকো লে কার নিচে চলা যাও।’
মুহূর্তের মধ্যেই যেন পড়ে গেলেন একটা অনিশ্চতায়। এই রকম একটা অনিশ্চয়তায় পড়তে হতে পারে- সেটা আগে থেকেই আঁচ করছিলেন আতাউস সামাদ। আঁচ করেছিল গোটা জাতিই। যে কারণে মনে মনে প্রস্তুতি ছিল তাঁদের। সেই প্রস্তুতির জন্য বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ মার্চের ভাষণেই তো একটা প্রবল ইঙ্গিত ছিল। ২৫ মার্চের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ আর ধ্বংসলীলার মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনটার দিকে একবার ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করে আতাউস সামাদের। মনে পড়ে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র, কিশোরগঞ্জের গ্রাম-মাঠে ঘুরে বেড়ানো, মাছ ধরা আর ছুটাছুটি। ছুটিতে পরিবারের সাথে হুগলি থেকে ট্রেনে বাড়ি ফেরার দিনগুলো মনে পড়ে।
১৯৩৭ সালে ১৬ নভেম্বর ময়মনসিংহে জন্ম আতাউস সামাদের। গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের সতেরদবিরায়। বাবা আব্দুস সামাদ এবং মা সায়েরা বানু। বাবা ছিলেন ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক, পরে তিনি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের জনশিক্ষা বিভাগের দ্বিতীয় শীর্ষপদ সহকারী জনশিক্ষা পরিচালক হয়েছিলেন। বাবা-মায়ের ষষ্ঠ সন্তান এবং দ্বিতীয় ছেলে আতাউস সামাদ। বাবার চাকরির সুবাদে শৈশব ও কৈশোর কেটেছে হুগলি, কলকাতা, জলপাইগুড়ি, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল ও ঢাকায়। ছোটবেলায় খুব ডানপিটে ছিলেন তিনি। প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছেন পরিবারেই। পরে ভর্তি হয়েছিলেন প্রাথমিক জলপাইগুড়ির ইন্দ্রাজমহল মিডল ইংলিশ স্কুলে। সেখান থেকে সিলেট গভর্নমেন্ট স্কুল এবং বরিশালের একটি স্কুল। উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন বরিশালের বিএম কলেজে ১৯৫২ সালে। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার আগেই চলে আসেন ঢাকায়।
সেই ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রবল উত্তাপের দিনগুলোতে তিনি এসেছিলেন ঢাকায়। ভর্তি হয়েছিলেন জগন্নাথ কলেজে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেরিয়েছেন। বাউন্ডুলেপনা তো তাকে পেয়ে বসেছিল ছোটবেলা থেকেই। সেই বাউন্ডুলে মন নিয়ে কী মনোযোগী ছাত্র হওয়া যায়? জগন্নাথ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিলের তো এই কারণেই। ভর্তি হয়েছিলেন সলিমুল্লাহ নাইট কলেজে। সেখানে পড়ার সময় শুরু করেন কারওয়ান বাজারের বিড়ির ফ্যাক্টরির ম্যানেজারি। এরপর শুরু করেন সাংবাদিকতা। শুরু করেন ‘সচিত্র সন্ধানী’তে ১৯৫৬ সালে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পড়ার সময় ১৯৫৯ সালে যোগ দেন ‘দৈনিক সংবাদে’। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এই সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের প্রচার-প্রকাশনা সম্পাদক হিসেবে হল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন। ১৯৬১ সালে ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করেন। দৈনিক আজাদের পর ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তো ‘পাকিস্তান অবজার্ভার’-এ ছিলেন। এই পত্রিকায় তিনি প্রধান প্রতিবেদকও হয়েছিলেন। এক বছরও হয়নি ‘দ্য সান’-এ যোগ দিয়েছেন। ১৯৫২ সাল থেকে প্রায় বিশ বছর। এই এতদিনে কত পরিস্থিতি তিনি দেখেছেন-ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন- সাংবাদিক হিসেবে আরো কত পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই তো তিনি গিয়েছেন, কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে তিনি কখনো পড়েননি। কোনো পরিস্থিতিতেই নিজে জড়িয়ে গেছেন বলে মনে হয়নি কখনোই।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই রাতে বাসায় ফিরেই ছোট ছোট সন্তানের মুখের দিকে চেয়েই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন তিনি। সিদ্ধান্তটা মনে মনে আরো একটু ঝালাই করার জন্য ছাদে উঠলেন। চারদিকে তখনও দুড়ুম দুড়ুম আওয়াজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন ওদিকের আকশের রং বদলে গেছে আগুনে। একের পর এক শেল ছুটছে। আগুন জ্বলছে রাজারবাগে। আর ভাবলেন না তিনি। মনে মনে যা ঠিক করার ঠিক করে নিয়েছেন। সাহস দিয়ে নিজেকেই নিজে যেন বললেন, আমি আতাউস সামাদ, সাংবাদিক, সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলে তো আমার চলবে না।
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে চারদিকে ব্যস্ততা শুরু হলো আতাউস সামাদের। একদিকে নিজের পরিবারের সুরক্ষা, একদিকে নিজের জীবন ও পেশা, একদিকে নিজের ভাই-ভাস্তেদের মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া, আরেক দিকে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারকে নানা তথ্য দিয়ে সহায়তা করা।
১৯৬৮-৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার রিপোর্ট করেন আতাউস সামাদ। ওই সময় একদিন আদালত চত্বরে তাকে ডেকে চিরকুট ধরিয়ে দিয়েছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিক খান ভাসানীকে দেওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু তখন তাঁকে বলেছিলেন, ‘মাওলানাকে বলবি, এ দেশে আন্দোলন করতে আমাকেও তাকে লাগবে, তাকেও আমার লাগবে।’ মওলানা ভাসানী সেই চিরকুট পেয়েই ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানে নেমেছিলেন। তাঁর আহ্বানে পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন তীব্রতর হয়ে উঠেছিল।
১৯৭১ সালে আতাউস সামাদের বড়ভাই আজিজুস সামাদের তিন ছেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। ছোট ভাই আতিকুস সামাদও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ওই সময় আজিজুস সামাদকে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হতে হয়। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন আশফাকুস সামাদ নিশরাত (বীর উত্তম)। আতাউস সামাদ তখন থাকতেন ২২ নয়পল্টনে বাবার তৈরি বাড়ি ওয়েসিসে অন্য ভাইদের সাথে। বাড়িটি হয়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাঁটি। ওই বাড়ি তল্লাশি চালায় পাকিস্তান বাহিনী। পরিবারের সব সদস্যদেরই কমবেশি অপমানিত হতে হয়। গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেওয়া তরুণদের সাথে ছিল আতাউস সামাদের যোগাযোগ। তাদের জন্য গেরিলা যুদ্ধ কৌশল সংক্রান্ত বই অনুবাদ করে দিয়েছিলেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে তথ্য সরবরাহ করেছেন আতাউস সামাদ। নিজের গাড়িতে করে মুক্তিযোদ্ধাদের এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। মুজিবনগর সরকারের জন্য নানা তথ্য সরবরাহ করতেন তিনি। তথ্য ও সংবাদ সরবরাহ করে সেটি পাঠানো মোটেও সহজ ছিল না। নতুন কাগজ মাটিতে ঘষে তাতে লিখে পুরনো ছেড়া খামে ভরে তা নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিতেন। এসব করতে গিয়ে বিপদের মুখে পড়তে পড়তেও বেঁচে গেছেন বেশ কয়েকবার। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে একবার খবর পেলেন পাকিস্তানি বাহিনী ৩৫ হাজার লোকের জন্য গম চেয়েছে। ওই গম চাওয়া হয়েছিল পাকিস্তান বাহিনীর দোসর বাঙালি প্যারা মিলিটারি বাহিনী গঠনের জন্য। এই খবর দ্রুতই তিনি মুক্তিবাহিনী ও মুজিবনগর সরকারকে পৌঁছে দেন। ক’দিন পর তা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রেডিও স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রে প্রচারিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে এসে, নভেম্বর দিকে, সামাদ পরিবারের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। তখন সাংবাদিকরাও আক্রান্ত হতে থাকেন। হত্যা ও ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে থাকে। আতাউস সামাদকেও বাসায় এসে এবং অফিসে গিয়ে খুঁজতে থাকে পাকিস্তান বাহিনী। আলবদর কমান্ডার চৌধুরী মাইনউদ্দিন একদিন তাঁকে হত্যার দুরভিসন্ধি নিয়ে টেলিফোন করে বাসায় থাকতে বলেন। তখন পুরো পরিবার নিয়ে আত্মগোপনে চলে যান আতাউস সামাদ। আশ্রয় নেন ধলেশ্বরীর ওপারে শ্রীনগর থানার শেখেরনগর গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। উদ্দেশ্য ছিল ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া। কিন্তু ছোট ছোট সন্তান নিয়ে শরণার্থী শিবিরে থাকার বিষয়ে প্রথমে রাজি হননি স্ত্রী কামরুন্নাহার। শেখেরনগরে থাকার সময়ই ডিসেম্বরে রেডিওতে যুদ্ধ জয়ের ঘোষণা শুনতে পান তারা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আতাউস সামাদ যোগ দেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস)। ওই সময় দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাসসে যোগ দিয়ে তাঁর প্রথম রিপোর্টই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের। দিল্লি থেকে সরকারি প্রতিনিধিদের সাথে লন্ডন যান তিনি। সেখান থেকে বঙ্গবঙ্গুর সঙ্গে দেশে ফেরেন। লন্ডনে বঙ্গবন্ধু তাঁকে দেখে বলেছিলেন, ‘তুই এখানে কেন? ঢাকায় চল। তোর কাছে শুনি দেশের খবর কী?’ সে সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার নেন।
দিল্লিতে বাসসের বিশেষ প্রতিনিধি ছিলেন তিনি (১৯৭২-১৯৭৬)। বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ টাইমসেও (১৯৭৮- ১৯৮২)। ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত দীর্ঘ এক যুগ তিনি বাংলাদেশ সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে। অধুনালুপ্ত ‘সাপ্তাহিক এখন’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন তিনি। ২০০৪ সালে আতাউস সামাদ দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় উপদেষ্টা-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ পদে বহাল ছিলেন। উপদেষ্টা-সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ২০০৭ সালে তিনি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবেও কিছুকাল দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে তিনি নিয়মিত নিবন্ধ, প্রবন্ধ ও কলাম লিখেছেন পাকিস্তানের দৈনিক মুসলিম, কুয়েতের আরব টাইমস, লন্ডনের সাউথ ম্যাগাজিন ও ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর এবং বাংলাদেশে সাপ্তাহিক যায় যায় দিন, দৈনিক প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ, সমকাল ও যুগান্তরসহ আরো অনেক পত্রিকায়। তাঁর লেখা ‘এ কালের বয়ান’ গ্রন্থ হিসেবেও সমাদৃত হয়। পেশাগত কারণে তিনি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, তুরস্ক, কুয়েত, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা, লিবিয়া, মিসর, বার্মাসহ আরো অনেক দেশে ভ্রমণ করেছেন।
আতাউস সামাদ বাংলাদেশের জন্ম-পূর্ব উত্তাল দুই দশক, মুক্তিযুদ্ধের দুর্বার সময় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের সামরিক শাসন, গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন ও সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন।
আতাউস সামাদ বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের সংবাদদাতা হিসেবে ঢাকায় যখন কাজ শুরু করেন তখন ১৯৮২ সাল। চলছে সামরিক শাসন। এই সময়ে অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় তাঁকে। তখন জনগণের কাছে প্রকৃত তথ্য জানার অন্যতম মাধ্যম বিবিসি। আতাউস সামাদের সহসী রিপোর্ট তখন সামরিক সরকারকে ব্রিবত করে তোলে। ১৯৮৭ সালে স্বৈরাচার বিরোধী রিপোর্টিংয়ের জন্য তাকে জেলেও যেতে হয়েছে। এরশাদ সরকারের পরের দিনগুলোতে আতাউস সামাদের জন্য পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে উঠেছিল। বিবিসিতে একের পর রিপোর্ট করে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছিলেন তিনি। এই কারণে বিবিসি’র ওপর প্রচন্ড ক্ষোভ ছিল সরকারের। ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময় আতাউস সামাদকে দেখা মাত্র গুলি করার নির্দেশ দেয় স্বৈরাচারী সরকার। ওই সময়ে আতাউস সামাদকেও আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। আত্মগোপনে থেকেও বিবিসি’তে গণঅভ্যুত্থান ও সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করেন। ১৯৯৪-৯৫ সালে নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ নিরসনে দুই নেত্রীকে আলোচনায় বসানোর চেষ্টায় তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের সময় অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন যারা, যারা নির্ভয়ে সেই সরকারের বিরোধিতা করেছেন আতাউস সামাদ তাঁদের অন্যতম।
যুদ্ধ, সেন্সরশিপ, নিষেধাজ্ঞা, সামরিক শাসন ও অগণতান্ত্রিক পরিস্থিতির মধ্যেই কেটেছে আতাউস সামাদের দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনের অধিকাংশ সময়। তিনি জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের যুদ্ধ ও গণহত্যা, ১৯৭৫-এ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জারি করা জরুরি অবস্থা, ১৯৭৬-এর আগস্টে বাংলাদেশে জারি হওয়া সামরিক শাসন, ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসন, ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল-বিরোধী-আন্দোলনসহ সব ধরনের সংকটময় পরিস্থিতিতে নিরলস ও জাতীয় স্বার্থের অনুকূল ভূমিকায় ছিলেন। আতাউস সামাদ সাংবাদিকতা পেশার অধিকার বাস্তবায়নে আন্দোলন করতে গিয়ে চাকরি হারিয়েছেন বারবার। সাংবাদিকদের ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়নের দাবিতে সাংবাদিকরা ধর্মঘট করেছিল টানা সত্তর দিন। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের সব পত্রিকা বন্ধ ছিল। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন আতাউস সামাদ। এর পরিণতিতে পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকা থেকে ১৯৬৯ সালের দিকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।
আতাউস সামাদ সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাংবাদিকদের দাবি আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন সক্রিয়। আজীবন লড়াই করেছেন গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতে। এক্ষেত্রে কাজে লেগেছে শিক্ষার্থী থাকার সময়ের ছাত্র রাজনীতি এবং সরাসরি বিড়ি কারখানায় কাজের অভিজ্ঞতা। পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। তিনি দুই মেয়াদে (১৯৭৯-৭০) পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের (ইপিইউজে) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় সভাপতি ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার। সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে তিনি সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও ছিলেন সক্রিয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘ ২০ বছর।
আতাউস সামাদ ছিলেন সাংবাদিক হিসেবে একেবারে শুরু থেকেই পরিশ্রমী ও নিষ্ঠাবান। রাজনৈকিভাবে তিনি সব সময় চেষ্টা করেছেন সৎ থাকার। মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর আস্থা ছিল অবিচল। যে কারণে সাংবাদিকতা জীবনে সবসময়ই তিনি সচেষ্ট থেকেছেন, সক্রিয় থেকেছেন জনগণের পক্ষে, সামরিক শাসন ও অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, লড়েছেন গণতন্ত্রের পক্ষে। নিজের অবস্থান থেকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা বলিষ্ঠ করার জন্য যতটা করা যায় ততটাই করতে চেয়েছেন তিনি।
সাংবাদিকতায় গৌরবময় অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন আতাউস সামাদ। এছাড়া বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ, বেগম জেবুন্নেসা ও কাজী মাহবুব উল্লাহ জনকল্যাণ ট্রাস্ট পুরস্কার, মহাকাল সৃষ্টি চিন্তা সংঘের ভাষা শহীদ গোল্ড মেডেল, জাগৃতি চলচ্চিত্র পরিষদের শিল্পী কামরুল হাসান স্মৃতিপদক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী জাতীয় স্মৃতি পরিষদের গোল্ড মেডেল এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির মুক্তিযোদ্ধা রিপোর্টার্স পদকসহ নানা পুরস্কার, পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
জন্ম:
আতাউস সামাদের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৬ নভেম্বর ময়মনসিংহে। গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের সতেরদবিরায়। বাবা আব্দুস সামাদ এবং মা সায়েরা বানু।
শৈশব:
বাবার বদলির চাকরির সুবাদে শৈশব ও কৈশোর কেটেছে জলপাইগুড়ি, হুগলি, কলকাতা, সিলেট, বরিশাল, রাজশাহী ও ঢাকায়।
শিক্ষা:
প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পড়াশোনা করেছেন জলপাইগুড়ির ইন্দ্রাজমহল মিডল ইংলিশ স্কুল, সিলেট গভর্নমেন্ট স্কুল এবং বরিশালে। উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন বরিশালের বিএম কলেজে ১৯৫২ সালে। এরপর ১৯৫৩ সালে বাবার বদলির কারণে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। ভর্তি হন সলিমুল্লাহ নাইট কলেজে। সেখান থেকেই উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
পেশা:
পেশাগত জীবনের শুরু ঢাকার কারওয়ান বাজারের একটি বিড়ি ফ্যাক্টরির ম্যানেজারি দিয়ে। ছাত্র অবস্থায় কাজ শুরু করেন ‘সচিত্র সন্ধানী’তে ১৯৫৬ সালে। পরে স্নাতক পড়ার সময় ১৯৫৯ সালে যোগ দেন ‘দৈনিক সংবাদে’। ১৯৬১ সালে ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করেন। অর্ধশতাব্দির সাংবাদিকতা জীবনে তিনি কাজ করেছেন ‘পাকিস্তান অবজার্ভার’, করাচির ‘দ্য সান’, ‘বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা’ (বাসস), ‘বাংলাদেশ টাইমস’ এবং ‘বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস’সহ আরো বেশ কিছু গণমাধ্যমে।
পরিবার:
স্ত্রী কামরুন্নাহার রেনু। তাঁদের দুই কন্যা নাঈমা সামাদ স্বাতী ও সামিয়া সামাদ শান্তা এবং এক পুত্র আশেকুস সামাদ।
মৃত্যু:
২০১২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকার একটি হাসপাতালে।
পুরস্কার ও সম্মাননা:
সাংবাদিকতায় গৌরবময় অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন তিনি। এছাড়া বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ, বেগম জেবুন্নেসা ও কাজী মাহবুব উল্লাহ জনকল্যাণ ট্রাস্ট পুরস্কার, মহাকাল সৃষ্টি চিন্তা সংঘের ভাষা শহীদ গোল্ড মেডেল, জাগৃতি চলচ্চিত্র পরিষদের শিল্পী কামরুল হাসান স্মৃতিপদক, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির মুক্তিযোদ্ধা রিপোর্টার্স পদকসহ নানা পুরস্কার, পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি।
তথ্যসূত্র:
১.আতাউস সামাদকে নিয়ে লেখা এ বি এম মুসা, কামাল লোহানী, শফিক রেহমান, মোহাম্মদ আফজাল হোসেন খোকাসহ আরো অনেকের বিভিন্ন নিবন্ধ। ২. প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘ছুটির দিনে’ ২০০৪ সালে প্রকাশিত প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ‘বিবিসির আতাউস সামাদ এখন’। যায়যায়দিন পত্রিকায় ২০০৮ সালে মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান ও নিশাত মাশফিকার নেওয়া আতাউস সামাদের সাক্ষাৎকার। ৩. আতাউস সামাদের মৃত্যুতে ২০১২ সালে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয় ও প্রতিবেদন। ৪. বিশেষ সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে জাকির হোসেন সম্পাদিত ২০১৪ সালে বিজয় প্রকাশ থেকে প্রকাশিত ‘আতাউস সামাদ জীবনে ও পেশায়’ শীর্ষক গ্রন্থের।
লেখক- ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ