১৯৬২ সালের একদিন। মালেকা বেগম তখন বাংলায় অনার্স পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মিছিল বেরিয়েছিল সেদিন। সেই মিছিলে হঠাৎ পুলিশের হামলা। পুলিশি হয়রানি ও গ্রেফতার এড়াতে যে যেদিকে পারেন চলে গেছেন। রাস্তা একেবারে ফাঁকা। মাঝ রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় মালেকা বেগম। তাকে দেখে ছুটে এলেন সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ (প্রয়াত সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব)। এলোপাতাড়ি টিয়ারশেলের হাত থেকে বাঁচাতে মালেকা বেগমকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন পাশের ড্রেনে। পড়লেন নিজেও। ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে মিছিলের সেই নির্ভীক, স্নিগ্ধদর্শন, শ্যামলা মেয়েটিই আজকের মালেকা বেগম- একাধারে নারীনেত্রী, জেন্ডার বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক, লেখক ও অধ্যাপক।
পারিবারিকভাবে ভাইয়ের প্রভাবে মার্কসবাদের প্রতি আগ্রহ জাগে মালেকা বেগমের। সেই সময়ের ছাত্রীরা ছিলেন রাজনীতিতে আগ্রহী। লীলা নাগ প্রতিষ্ঠিত ঢাকার নারীশিক্ষা মন্দির স্কুলে (১৯৫৪-১৯৬০) পড়া শেষে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ১৯৬১ সালে বকশীবাজারে ইডেন কলেজে আইএ পড়ার সময়ে অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরীর রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি প্রচ্ছন্ন আকর্ষণ ও শ্রদ্ধা মালেকা বেগমের চেতনায় সমসাময়িক ছাত্র আন্দোলনের বিষয়ে জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছিল। এরপর সেই আগ্রহ আরো বাড়তে থাকে।
শুধু ১৯৬২ নয়, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতেও মিছিলের সামনে ছিলেন মালেকা বেগম। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা আর কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটির ১১ দফায় সাড়া দিয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে তখন ফুঁসছে বাংলার ছাত্রজনতা। পাকিস্তান সরকারের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে বেরিয়েছে দশ হাজার ছাত্রজনতার বিরাট মিছিল। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারির এই মিছিলের সামনে ছাত্রীরা। তাদের মধ্যে আছেন মালেকা বেগম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিলটি বেরিয়ে কেবল এগিয়েছে চানখারপুল পর্যন্ত। পুলিশ সেখানেই থামিয়ে দেয় মিছিলটি। এই মিছিলের পেছন দিকে আমানুল্লাহ আসাদুজ্জামান (শহীদ আসাদ নামেই এখন পরিচিত)। ওই অবস্থায় খুব কাছ থেকে আসাদকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় এক পুলিশ কর্মকর্তা। শহীদ হন আসাদ।
আসাদদের আত্মত্যাগ, ছাত্রসমাজের আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন আর মালেকা বেগমের মতো আরো অনেক ছাত্রছাত্রীর সাহস, সংগ্রাম ও সঠিক যাত্রার ফসল আজকের এই বাংলাদেশ। ষাটের রাজপথে জাতির উত্থানের আন্দোলনে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ে, একাত্তরে স্বাধীনতা লাভের পর দেশ গঠনে সামগ্রিক ভূমিকায় থেকেছেন মালেকা বেগম। পরে এসে নিবিড়ভাবে মনোযোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের নারী সমাজের উন্নয়নে। কাজ করেছেন নারীদের অধিকার সচেতন করে তোলা এবং নারীর সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে। এখনও কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামের নারী পর্যন্ত বিস্তৃত তার কাজের পরিধি। ধ্যান-ধারণার দিক থেকে তিনি নারীবাদী। নারীবাদের একেবারের হালনাগাদ তত্ত্ব ও তথ্যের ব্যাপারে তিনি ওয়াকিফহাল। একইভাবে তিনি খেয়াল রাখেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে কীভাবে নারী উন্নয়ন চিন্তার প্রয়োগ ঘটাতে হবে, কীভাবে নারী উন্নয়ন চিন্তার তত্ত্ব ও তথ্যের প্রয়োগ ঘটিয়ে বাংলাদেশের সমাজে সর্বোচ্চ সুফল পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্মের পর থেকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে নারী উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন তিনি। তাঁর ও তাঁদের চিন্তা, পদক্ষেপ ও পরামর্শের পথ ধরেই নারী নির্যাতন ও যৌতুক বন্ধের নানা আইন ও পদক্ষেপ। নারীর সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন তথা নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করা এবং নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ দূর করার ক্ষেত্রে আইন ও বিধিমালার মাধ্যমে বাংলাদেশে এখন যে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা কাঠামো আছে তাতে প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্ন ভূমিকা আছে মালেকা বেগমের।
বিশ শতকের ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী মালেকা বেগম নারী আন্দোলনে যুক্ত হন ১৯৬৮ সালে। ১৯৬৯ সালে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে গড়ে তোলেন মহিলা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকায় থেকেছে এই সংগঠন। বাংলাদেশের নারী সমাজের সার্বিক উন্নয়নে এখনো অগ্রণী ভূমিকায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। মালেকা বেগমও কাজ করেছেন মুক্তিযুদ্ধে সংগঠক হিসেবে। বাংলাদেশের বিপন্ন মানুষের দুর্দশা তুলে ধরে প্রচারকাজে সক্রিয় ছিলেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে তিনি ছিলেন এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। পরে তিনি এই সংগঠনের সহ-সভাপতি হন।
প্রায় অর্ধশতাব্দি ধরে নারী আন্দোলনের সাথে যুক্ত থেকে মালেকা বেগম যে শুধু নারীর অধিকার নিশ্চিতে সীমাবদ্ধ থেকেছেন তা নয়, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও তিনি সব সময় রেখেছেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। সেই ভূমিকা যেমন মিছিল-বিক্ষোভ-আন্দোলনে তেমনি আবার সংগঠন, সভা-সমিতি-সেমিনার এবং লেখনির মাধ্যমেও।
মালেকা বেগমের যখন জন্ম, ১৯৪৪ সালের ৩ মার্চ, অবিভক্ত ভারতের হুগলি শহরে। সেখানেই ছিল বাবা আব্দুল আজিজের কর্মস্থল। তখন বিশ্বে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে একসঙ্গে অনেকগুলো বড় ঘটনা ঘটছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তখন তছনছ হয়ে যাচ্ছে দুনিয়া। ভাগ হওয়ার জন্য ভিতরে ভিতরে প্রস্তুত হচ্ছে ভারত।
মালেকা বেগমদের পরিবারের জন্য সেই সময়টা ছিল বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়ানোর। ছুটে বেড়ানো মানে কিন্তু ঘুরে বেড়ানো নয়। বাবা আব্দুল আজিজ ছিলেন সরকারি চাকুরে, আয়কর কমকর্তা। তাঁর বদলির কারণেই তখন ঘুরে বেড়াতে হয়েছে তাদের।
মালেকা বেগমের দাদা মুন্সি আনোয়ারউদ্দিন ছিলেন সেই সময়ের জেলা বিচারালয়ের জুরি বোর্ডের সদস্য। বাবা আব্দুল আজিজ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের ছাত্র সংসদের প্রথম সহ-সভাপতি। দাদা ও বাবার বাড়ি কুমিল্লা জেলার পাণ্ডুঘরের কোড়েরপাড়ে। নানি ও মা-খালাদের বাড়ি কুমিল্লা জেলার ভুবনঘর গ্রামে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরপর বাবা-মা, ভাইবোন সবাই বরিশালে চলে আসেন। মালেকা বেগমের ছেলেবেলার অনেকটা সময় কেটেছে বরিশালে। বরিশাল থেকে ফরিদপুর হয়ে মালেকা বেগমদের পরিবার যখন ময়মনসিংহে তখন তার বয়স ছয়।
মালেকা বেগমরা ভাইবোন মিলে ১২ জন। নয় ভাই ও তিন বোন। অধিকাংশই তার বড়। বড় ভাইবোনেরা প্রতিদিন স্কুলে যায়। তাদের স্কুলে যাওয়া দেখতে দেখতে ছোটবেলায়ই প্রবল আগ্রহ তৈরি হয় স্কুলে যাওয়ার। মায়ের কাছে আবদার ও কান্নাকাটি স্কুলে যাওয়ার জন্য। যে কারণে মাত্র ছয় বছর বয়সেই তাকে ভর্তি করা হয় ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে।
মালেকা বেগম ময়মনসিংহে ছিলেন তৃতীয় শ্রেণি পড়া পর্যন্ত। এরপর ১৯৫৪ সাল থেকে তার পরিবারের বসবাস ঢাকায়। ঢাকার ওয়ারিতে এসে ওঠেন তারা। বাবা তখন আয়কর কমিশনার। পুরোনো ঢাকার ওয়ারি তখন সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানেই লীলা নাগ গড়ে তুলেছিলেন নারীশিক্ষা মন্দির (বর্তমানে হাটখোলার শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়)। লীলা নাগ ছিলেন এদেশের নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন আন্দোলনের পূর্বসূরি। নারীশিক্ষা মন্দির থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন মালেকা বেগম ১৯৬০ সালে। এই সময়টায় ধনাঢ্য, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের আবাসকেন্দ্র ছিল ওয়ারি এলাকা। ওয়ারি এলাকার সেই সময়ের সামাজিক পরিবেশের বর্ণনা দিতে গিয়ে ঢাকা শহরের বিখ্যাত চিকিৎসক মম্মথনাথ নন্দীর মেয়ে ইতিহাসবিদ মন্দিরা নন্দী বলেছেন, ‘‘আমাদের ছোটবেলার ঢাকা বিশেষ করে পুরান ঢাকার পরিবেশ ছিল খুবই উদার। মহল্লার মানুষদের মধ্যে প্রগাঢ় আন্তরিকতা ছিল। একটা অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ ছিল। এক মহল্লার মুরব্বিকে অন্য মহল্লায় কঠোরভাবে সম্মান করা হতো। ছোট-বড়দের মধ্যে শাসন-শ্রদ্ধা-ভালবাসার একটা অলিখিত সম্পর্ক ছিল। বড়দের সামনে ছোটরা আদব-লেহাজ নিয়ে চলাফেরা করত। কথাও বলত সেভাবে। সব পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক ছিল আত্মীয়র মতো। এ মহল্লা থেকে ওই মহল্লা- সব মহল্লাই যেন অদৃশ্য এক আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। আমাদের ছোটবেলায় আমরা ঈদ-পুজোর মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পেতাম না।’’ (ইতিহাস কখনো বদলে যায় না, সাক্ষাৎকার, মন্দিরা নন্দী, ২২ মে ২০১৫, দৈনিক জনকণ্ঠ)
মন্দিরা নন্দীর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব ছিল মালেকা বেগমের। বিশ শতকের ষাটের দশকে বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ভারতে চলে যাওয়া মন্দিরা নন্দীর (বর্তমানে ভট্টচার্য) সঙ্গে সেই বন্ধুত্ব এখনও অটুট আছে। ওয়ারি এলাকায় শিশু-কিশোরদের সংস্কৃতি ও শরীর চর্চার জন্য ছিল মুকুল ফৌজ নামের সংগঠন। সেই সংগঠনের সদস্য হিসেবে এবং মন্দিরা নন্দীর মতো একই বয়সীদের পারিবারিক বলয়ের মধ্যে থেকে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক-সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে মালেকা বেগমের। ১৯৬০ সালে ভর্তি হন ইডেন কলেজে। ইডেনে ঢোকার পরই শুরু হয় তার এক নতুন জীবন। রাজনীতি সম্পর্কে গড়ে উঠতে থাকে এক নতুন বোধ।
১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) অর্জন করেন মালেকা বেগম। এই সময়গুলো তার কাটে শ্রেণিকক্ষে আর মিছিলে মিটিংয়ে। বাম রাজনীতিতে তুমুলভাবে সক্রিয় মালেকা বেগম রাজনীতি এবং প্রগতিশীলতার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন সেই ছোটবেলায় তারই বড়ভাই ও ভাবীর কাছ থেকে। বড় ভাই গোলাম কিবরিয়া এবং খালাত বোন নাদিরা বেগম ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সময়ের প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয়। তখন মালেকা বেগমরা থাকেন ময়মনসিংহে। কিবরিয়া ও নাদেরা বেগম কারাবরণ করেছিলেন। পরে এই দুজন দাম্পত্যজীবন শুরু করেন। ছোটবেলায় এই দুজনের প্রগতিশীল জীবনযাপন, চিন্তাভাবনা, রাজনীতি ও ভোগান্তি সম্পর্কে তেমন কিছু বুঝতেন না মালেকা বেগম। তবে তারা পরিবারের সবার আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন। মালেকার মতো শিশুদের কাছে তারা হয়ে উঠেছিলেন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব।
মালেকা বেগম লিখেছেন, ‘‘আমাদের পরিবারে ১৯৫০-এর দশকে রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন বড় ভাই গোলাম কিবরিয়া, ভাবি নাদেরা বেগম ও খালাতো ভাই মুনীর চৌধুরী। ১৯৫০ এর দশকে বড় ভাইয়ের খোঁজে পুলিশ এলে তাদের মুখোমুখি হওয়া, পুলিশের নজর এড়িয়ে ছেলেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করা, স্বামীকে লুকিয়ে (যেহেতু সরকারি অফিসার হওয়ায় বাধা দিতে পারেন) ছেলেমেয়ের রাজনৈতিক কাজে নীরব সমর্থন দেওয়া, সহযোগিতা করা, সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যক্রমে ছেলেমেয়েদের উৎসাহিত করা- মা-র এসব কাজ আমার মনের ভেতর অঙ্কুরোদ্গমে সাহায্য করেছে।’’ (গ্রন্থ: নারী আন্দোলনের পাঁচ দশক/ মালেকা বেগম)
বড় হয়ে কলেজে পড়ার সময় তেমন একটি জীবনের মধ্যেই ঢুকে যান মালেকা বেগম। এরই মধ্যে ১৯৬৬ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। রোকেয়া হলের ভিপি নির্বাচিত হন দুইবার। ডাকসুতে কমনরুম সম্পাদক ছিলেন। রাজনীতির পাশাপাশি রচনা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা এবং নানা সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের স্বার্থ আদায়ের পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতিতেও তাদের ছাত্র আন্দোলনের প্রভাব পড়েছিল। ২০০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে পিএইচ ডি ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৮ সালে মালেকা বেগম ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।
মালেকা বেগমরা ঢাকা শহরের প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন। বিশ শতকের ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানে যখন বাংলাদেশের চেতনা দানা বেঁধে উঠছে। এই চেতনার ধারা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করেছিলেন মালেকা বেগমরা।
মালেকা বেগম বিয়ে করেন ১৯৭০ সালে। সেই সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গী মতিউর রহমানের (প্রখ্যাত সাংবাদিক, দৈনিক প্রথম আলো’র সম্পাদক ও প্রকাশক) সঙ্গে দাম্পত্যজীবন শুরু করেন তিনি। মালেকা বেগমের মতো তখনকার সরকারবিরোধী ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত নারীদের অনেকেই আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গীদের বিয়ে করেন।
১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মালেকা বেগম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আরো অনেকের মতো তিনি ও মতিউর রহমান ভারতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে ঘিরে কার্যক্রম শুরু করেন। সংগঠক হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন মুক্তিযুদ্ধে। ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের দেখাশোনা ও সেবা দেওয়ার পাশাপাশি বিশ্বের প্রভাবশালী নারী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে তাদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে সচেতন করে তোলেন। মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের অসহায় মানুষের প্রতি তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা আদায় করেন।
১৯৯৫ সালে বেইজিং বিশ্বনারী সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। এর আগে-পরে নারী উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বাংলাদেশের নারী উন্নয়ন, সমতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নেওয়া নানা উদ্যোগে নীতি-নির্ধারণী ভূমিকা রাখেন মালেকা বেগম।
নারীনেত্রী ও নারী উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ মালেকা বেগম একাধারে লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক। শিক্ষকতাকে জীবনে পেশা হিসেবে নিতে চেয়েছিলেন মালেকা বেগম। ১৯৬৮ সাল থেকে বছর খানেক ওয়ারি হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন তিনি। এরপর ১৯৭২ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির রিসার্চ স্কলার হিসেবে কাজ করেন মালেকা বেগম। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত কনসার্ন ওম্যান ফর ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ে মাঠকর্মী হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখিতে আগ্রহ ছিল মালেকা বেগমের। সেই সুবাদে যুক্ত হন সাংবাদিকতায়। সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানীতে শুরু করেন প্রদায়কের কাজ। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ছিলেন সেই পত্রিকায়। ১৯৮১ সালে মালেকা বেগম সচিত্র সন্ধানীর নির্বাহী সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। এরপর নারী উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেন তিনি। এর পাশাপাশি চলতে থাকে লেখালেখি। ২০০০ সালে মালেকা বেগম যোগ দেন শিক্ষকতায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ওম্যান অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজের ফ্যাকাল্টি হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। একই বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন ২০১৩ সাল পর্যন্ত। বর্তমানে তিনি সেন্ট্রাল ওম্যান’স ইউনিভার্সিটির সোশিয়োলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারপার্সন।
মালেকা বেগম লিখছেন ষাটের দশক থেকে। তাঁর লেখা গ্রন্থের সংখ্যা তিরিশটিরও বেশি। ভাষার বিকাশে ব্যবহারিক জীবন (১৯৮২), বাংলার নারী আন্দোলন (১৯৮৯), সূর্যসেনের স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা (১৯৯৪), নারী আন্দোলনের পাঁচ দশক (২০০২), যৌতুকের সংস্কৃতি (২০০২), মুক্তিযুদ্ধে নারী (২০১১), রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি (২০১২), শুভ্র সমুজ্জ্বল জীবনের আয়নায় ও অন্যান্য (২০১৬) তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এছাড়া বেগম রোকেয়া, অগ্নিযুগের নারী সংগ্রামী ইলা মিত্র এবং বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী ও কবি সুফিয়া কামালকে নিয়ে রয়েছে তাঁর আলাদা আলাদা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। নারী আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ এক নেত্রী হিসেবেই লিখেছেন মালেকা বেগম।
বাংলাসাহিত্য ও বাঙালি সমাজে নারীদের অবস্থা ও অবস্থান তিনি তার গ্রন্থের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করেছেন। আমাদের সমাজের অনুপ্রেরণাদায়ী নারীদের জীবন উন্মোচিত করেছেন গ্রন্থে গ্রন্থে। একইভাবে তিনি উপস্থাপন করেছেন বিশ শতকের নারী আন্দোলনের নির্ভরযোগ্য ইতিহাস। বাংলাদেশের নারীরা বিশ শতকের শুরু থেকে কীভাবে জীবন-সমাজ ও রাজনীতিতে এগিয়ে এসেছেন, কীভাবে তারা সমাজের অন্যতম কণ্ঠস্বর ও অংশীদার হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন সেই সংগ্রাম ও ইতিহাস বিধৃত আছে তার লেখায়। এসব লেখার মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেছেন সেসব অলঙ্ঘ্য বাধার কথা যা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশের নারীরা। উদার নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনাভিজ্ঞতার আলোকে যাপিত জীবন ও সমাজের দরদ ও দহনভরা বয়ান তুলে ধরেছেন তিনি তার গ্রন্থ ও লেখার মাধ্যমে। পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীতে এখনো তিনি লিখছেন নিয়মিত।
নারী আন্দোলন, নারী নেতৃত্ব, রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন, সাংবাদিকতা, লেখালেখি, অধ্যাপনা এবং জেন্ডার বিশেষজ্ঞ হিসেবে মালেকা বেগমের রয়েছে জীবনব্যাপী অবদান। এসব ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন অনন্যা সাহিত্য পুরস্কারসহ দেশে-বিদেশে নানা সম্মাননা।
নারী আন্দোলনের ভূমিকাই তাঁকে নিয়ে গেছে বৃহত্তর আন্তর্জাতিক পরিসরে। নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি যোগ দিয়েছেন অনেক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। এই সূত্রেই তাঁকে যেতে হয়েছে ভারত, চেক রিপাবলিক, রাশিয়া, ভিয়েতনাম, বুলগেরিয়া, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে।
সংক্ষিপ্ত জীবন
জন্ম ও বাবা-মা: মালেকা বেগমের জন্ম ১৯৪৪ সালের ৩ মার্চ, অবিভক্ত ভারতের হুগলি শহরে। বাবার বাড়ি কুমিল্লায়। বাবা আব্দুল আজিজ ছিলেন আয়কর কমিশনার। মা ফাহিমা বেগম ছিলেন গৃহিনী। মালেকা বেগমরা ১২ ভাইবোন। বাবার চাকরির কারণে ছোটবেলা কেটেছে বরিশাল, ফরিদপুর এবং ময়মনসিংহে।
শিক্ষা: ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে প্রাথমিকের পড়াশোনা শুরু। পরে ঢাকায় এসে ভর্তি হন নারীশিক্ষা মন্দিরে চতুর্থ শ্রেণিতে। সেখান থেকে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ইন্টারমিডিয়েট পড়েন ইডেন কলেজে। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) হন। ১৯৬৬ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে পিএইচ ডি ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৮ সালে মালেকা বেগম ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন স্টাডিজ সেন্টার থেকে পোস্ট ডক্টরেট অর্জন করেন।
কর্মজীবন: নারীনেত্রী মালেকা বেগম একাধারে লেখক, জেন্ডার বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক ও সাংবাদিক। ষাটের দশক থেকে তিনি সরাসরি নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে ছিলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। ওই সময় থেকে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন জাতীয় রাজনীতির প্রগতিশীল ধারায়।
পরিবার: ১৯৭০ সালে আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গী মতিউর রহমানের (প্রখ্যাত সাংবাদিক, দৈনিক প্রথম আলো’র সম্পাদক ও প্রকাশক) সঙ্গে দাম্পত্যজীবন শুরু করেন। মালেকা বেগম এক মেয়ে ও এক ছেলের জননী। মেয়ে মহসিনা বেগম এবং ছেলে মাহমুদুর রহমান। চার নাতি-নাতনি।
তথ্যসূত্র: ২০১৮ সালে নেওয়া মালেকা বেগমের সাক্ষাৎকার এবং তাঁর ‘নারী আন্দোলনের পাঁচ দশক’ গ্রন্থ।
লেখক- ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ