অভিনেত্রী, গায়িকা ও পরিচালক শিমুল ইউসুফের তখন কৈশোর। তখন মুক্তিযুদ্ধ, তখন ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট। সকাল বেলায় নিজের ঘরে বসে রেওয়াজ করছেন শিমুল ইউসুফ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢুকে গেল তাদের বাড়িতে। ‘আলতাফ মাহমুদ কোন হ্যায়?’ পাকিস্তানি হানাদারদের আওয়াজ পেয়েই নির্ভয়ে ছুটে এলেন সুরকার ও সংস্কৃতিকর্মী আলতাফ মাহমুদ। হানাদার বাহিনীর কাছে তুলে ধরলেন নিজের পরিচয়। তারা আটক করে এনেছিল আরো চার মুক্তিযোদ্ধাকে। আলতাফ মাহমুদকে তাঁদের সঙ্গে দাঁড় করাল পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র ও বিস্ফোরকের কথা আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন শনাক্তকারী আব্দুস সামাদ। সামাদই দেখিয়ে দিলেন আলতাফ মাহমুদ কোথায় রেখেছেন অস্ত্রশস্ত্র? হানাদাররা তাঁকে নিয়ে গেল সেখানে। মাটির নিচে রেখেছিলেন অস্ত্রশস্ত্র। মাটি খুঁড়ে অস্ত্র বের করতে বলল তাঁকে। তা না করলে খুন করবে তাঁকে এবং পরিবারের সবাইকে। পরিবারের সবাইকে হত্যার হুমকিতে বিচলিত হলেন আলতাফ মাহমুদ। হানাদাররা গুণতে শুরু করল- এক, দুই, তিন। একা একাই খুঁড়তে থাকলেন তিনি। ক্লান্ত হয়ে পড়তেই আলতাফ মাহমুদকে আঘাত করছিল পাকিস্তানি সেনারা। অস্ত্রশস্ত্র বের করে দেওয়ার পরই আলতাফ মাহমুদের হাত বেঁধে ফেলল হানাদাররা। নিয়ে চলল তাকে। জানালায় দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছিলেন চৌদ্দ বছরের কিশোরী শিমুল ইউসুফ। হানাদাররা তাঁকে নিয়ে যাওয়ার সময় একবার এক মুহূর্তের জন্য শিমুল ইউসুফের দিকে ফিরে চাইলেন আলতাফ মাহমুদ। শিমুল ইউসুফের মনে হলো, মুহূর্তটি যেন মুহূর্ত নয়, মুহূর্তটি যেন অনন্তকাল। কী বলতে চাইলেন তিনি এভাবে তাকিয়ে?
শহীদ আলতাফ মাহমুদ ছিলেন শিমুল ইউসুফের বড় বোন ঝিনু বিল্লাহর স্বামী। মাত্র চার বছর বয়সে ১৯৬১ সালে বাবা মেহতের বিল্লাহকে হারান শিমুল ইউসুফ। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন আলতাফ মাহমুদই। শাসন ও আদর দুইই পেয়েছেন আলতাফ মাহমুদের কাছ থেকে। পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর আবদার করতেন আলতাফ মাহমুদের কাছেই। প্রতিদিন সকালে রেওয়াজ করতে না বসলে চোখ রাঙিয়ে তাঁকে শাসন করতেন আলতাফ মাহমুদই। কখনোই তাঁকে বোনের বর ভাবেননি। ভেবেছেন নিজের বড়ভাই। ভেবেছেন নিজের গানের গুরু হিসেবে। হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় গুরু ও বড়ভাই আলতাফ মাহমুদ সেই যে এক মুহূর্তের জন্য পেছন ফিরে তার দিকে তাকালেন তাতেই বদলে গেল শিমুল ইউসুফের জীবন।
শিমুল ইউসুফ সারা জীবনেও আলতাফ মাহমুদের সেই তাকানোটা ভুলতে পারেননি। ‘আজ এত বছর পরও আমার মনে হয় তিনি যেন আমাকে একটা দায়িত্ব দিয়েছিলেন সেদিনের সেই এক মুহূর্তের চাউনির মাধ্যমে।’ শিমুল ইউসুফ সেদিনের কথা মনে করে বলেন- ‘তিনি যেন আমার হাতে একটি আলোকবর্তিকা তুলে দিয়েছিলেন সেই তাকানোর মাধ্যমে। তাঁর শক্তি ও বার্তা বয়ে নিয়ে যাওয়ার সেই আলোকবর্তিকা। ওই শেষবার আমি তাকে দেখেছিলাম। সেদিন আলতাফ ভাই সব দায়-দায়িত্ব স্বীকার করায় হানাদার বাহিনী আমার পরিবারের আর সবাইকে রেহাই দিয়েছিল। তাঁর নিখোঁজের পরই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমার দায়িত্ব অনেক, তিনি আমার কাঁধে অনেক দায়িত্ব রেখে গেছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধই আমাকে তাড়িত করেছে, আমার কাজের মধ্যেও তুমি তা দেখতে পাবে।’
শহীদ আলতাফ মাহমুদ শিমুল ইউসুফের জীবনে বিরাট এক অনুপ্রেরণা। শুধু আলতাফ মাহমুদ নন- ওস্তাদ হেলাল উদ্দিন, পি সি গোমেজ এবং আব্দুল লতিফও তাঁর গানের গুরু। তাঁদের কাছে শাস্ত্রীয় ও ঐতিহ্যগত সঙ্গীতের তালিম নেন তিনি। গান দিয়েই শুরু হয়েছিল শিমুল ইউসুফের জীবন। মা-ও গানের দরদ বুঝতেন। বাবার গান আর মায়ের সুর করে কোরআন তেলওয়াত তাকে মুগ্ধ করত তিন-চার বছর বয়সেই। মেয়ের গলায় যে সুর খেলা করে তা মা-ই টের পেয়েছিলেন। চার বছর বয়সেই ওস্তাদের কাছে তালিম নেওয়া শুরু করেন শিমুল ইউসুফ। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই তিনি শিশুশিল্পী হিসেবে মঞ্চে অভিনয় ও সঙ্গীত উপস্থাপন শুরু করেন। ওই বয়সেই তিনি রেডিও টেলিভিশন এবং কচিকাঁচার মেলার অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন।
শিমুল ইউসুফের বড়ভাই লীনু বিল্লাহ ভালো তবলা বাজাতেন। বোন মিনু বিল্লাহর’র ছিল নাচের ঝোঁক। পরিবারে সবার ছোট ছিলেন শিমুল ইউসুফ। ভাইবোনদের সবাই শিল্প-সংস্কৃতির কোনো না কোনো মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন। পরিবারের সাংস্কৃতিক বলয় আর আলতাফ মাহমুদের অনুপ্রেরণায় জীবনে সঙ্গীত সাধকই হওয়ার কথা ভেবেছিলেন শিমুল ইউসুফ। আলতাফ মাহমুদকে হারানোর পর পারিবারিক বিপর্যয়ের চেয়েও বড় ধাক্কা লেগেছিল শিমুল ইউসুফের মনে। সঙ্গীতে আগ্রহ থাকলেও তখন তিনি গুরুকে হারিয়ে পথহারা-দিশাহারা বোধ করেন। এই অবস্থায় তিনি ঝুঁকেছিলে চারুকলার দিকে। ১৯৭৪ সালে বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হন ভারতের বারোদা চারুকলায়। সেখান থেকে ছুটিতে দেশে আসার পর একটি আকস্মিক ঘটনা পাল্টে দেয় তাঁর জীবন। তাঁর দুই ভাই এবং বোন নৃত্যশিল্পী মিনু হক তখন ঢাকা থিয়েটারে যুক্ত। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে ‘বিদায় মোনালিসা’র মঞ্চায়ন হবে। নাটকের প্রধান চরিত্রে যিনি অভিনয় করতেন মঞ্চায়নের আগের দিন তার পরিবার জানিয়ে দিল যে ঢাকার বাইরে মেয়েকে যেতে দেওয়া হবে না। চারুকলায় পড়ার সময় অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে এই নাটকে শিমুল ইউসুফ ও আফজাল হোসেনও অভিনয় করেছিলেন। বিপদ দেখে নাসিরউদ্দীন ইউসুফ তখন শিমুল ইউসুফকে বললেন- ‘তুমি তো শো-টা করেছ, চট্টগ্রামে চলো, ওখানে ওরা টিকিট বিক্রি করেছে। মাত্র দুইটা শো। প্লিজ, উদ্ধার করো।’ সেই যে দুইটা শো তা আর এই জীবনে শেষ হয়নি শিমুল ইউসুফের। সেই থেকে তিনি যুক্ত হয়ে গেলেন ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে। ঢাকা থিয়েটারে তখন তাঁর সবচেয়ে বড় স্বস্তির বিষয় ছিল, তখন ওই দলের নেতৃস্থানীয় সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।
ছুটি শেষ হয়ে গেল, কিন্তু ভারতের বরোদায় আর ফেরা হলো না শিমুল ইউসুফের। মা-ও বললেন যে আর যেতে হবে না। দুদিন পর নাসিরউদ্দিন ইউসুফ পাণ্ডুলিপি দিলেন ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’ নাটকের। বললেন- একটু পড়ে দেখ তো, কী সুর করা যায়। তিনি আরো জড়িয়ে গেলেন। পাণ্ডুলিপি পড়তে গিয়ে শিমুল ইউসুফের মনে হলো মঞ্চটা আসলে তাঁরই জায়গা। তারপর চলতে থাকল একের পর এক মঞ্চে অভিনয়। মুনতাসির ফ্যান্টাসিতে গান ছিল আঠারটি। সবগুলো গানে কণ্ঠ ও সুর দিয়েছিলেন শিমুল ইউসুফ। মুনতাসির ফ্যান্টাসি ছিল মিউজিক্যাল কমেডি। অভিনয়, গান গাওয়া আর গানে সুর করা- সব মিলে এই নাটক ছিল শিমুল ইউসুফের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ।
ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ায় চারুকলায় তো আর পড়া হয়নি শিমুল ইউসুফের, কিন্তু পড়াশোনা তিনি ছাড়েননি। সারাজীবন পড়াশোনার মধ্যেই থেকেছেন। সারা জীবন শেখার মধ্যেই থেকেছেন। নাচ, গান ও থিয়েটারের চর্চা করেছেন অভিনিবেশ সহকারের বিদ্যায়তনিক চর্চার মতোই। পাশাপাশি চলেছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও।
শিমুল ইউসুফের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা মতিঝিল সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে। ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ থেকে বিএসএস অর্নাস পাস করেন তিনি। ১৯৮২ সালে একই অনুষদ থেকে এমএস ডিগ্রি লাভ করেন। মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর মা আমেনা বিল্লাহ ছিলেন খুবই দৃঢ়। বলতেন, ছেলেরা যা কিছু একটা করে খেতে পারবে, কিন্তু তোমাদের পড়াশোনা করতেই হবে, সবাইকে উচ্চশিক্ষিত হতে হবে।
‘বিদায় মোনালিসা’ আর ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’র আগেও নাটকে অভিনয় করেছেন শিমুল ইউসুফ। ১৯৭২ সালে আব্দুল্লাহ আল মামুনের একটি নাটকে অভিনয় করেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছিল সেই নাটক। প্রদর্শনী থেকে যে আয় হয়েছিল তা তুলে দেওয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। প্রথম যেদিন মঞ্চে দাঁড়িয়েছিলেন নাটকের জন্য সেদিন পা কাঁপছিল তাঁর; বুক ধরফর করছিল, মনে হচ্ছিল- সব ভুলে গেছেন, কিছু পারবেন না। সেই যে অনুভূতি তা এখনো আছে। এখনো মঞ্চে উঠলে তাঁর মনে হয়- সব ভুলে গিয়েছেন, কিছু পারবেন না, কিন্তু মঞ্চে প্রথম কদম ফেলার পরপরই সব ঠিক হয়ে যায়, সবকিছু ফিরে আসতে থাকে, সব তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরই একদল মেধাবী তরুণ গড়ে তোলেন মঞ্চদল ঢাকা থিয়েটার। নাট্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ, নাট্যচার্য সেলিম আল দীনের যুগলবন্দিতে ঢাকা থিয়েটার বাংলাদেশের মঞ্চে নিয়ে আসতে থাকে অনন্য সব নাটক। ঢাকা থিয়েটার গড়ে ওঠার কিছুদিনের মধ্যেই এই দলের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি হয়ে ওঠেন শিমুল ইউসুফ। মঞ্চদলের ক্ষেত্রে নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা-অভিনেত্রীর সর্বোচ্চ বোঝাপড়াই মঞ্চের দর্শককে দিতে পারে সর্বোচ্চ নান্দনিক আস্বাদ। নাট্যকার সেলিম আল দীন, নির্দেশক নাসির উদ্দীন ইউসুফ এবং অভিনেত্রী ও কুশলী শিমুল ইউসুফের মধ্যে ছিল সেই পরম বোঝাপড়া। বাংলাদেশের মঞ্চে এই ত্রিমাত্রিক সর্বোচ্চ বোঝাপড়ার অনন্য নজির হয়ে আছেন এই তিনজন।
শিমুল ইউসুফ অভিনয়, সঙ্গীত পরিচালনা, কোরিওগ্রাফি, পোশাক পরিকল্পনা, নির্দেশনা সহযোগিতা এবং পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার মতো কাজগুলো করতে থাকেন। গভীর মনোযোগ আর সার্বক্ষণিক নিবেদিত থাকার মাধ্যমে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দলগত কাজের মধ্যেও স্বকীয়তার ছাপ রাখেন। প্রায় পঞ্চাশ বছরে ঢাকা থিয়েটারের চৌত্রিশটি নাটকের সঙ্গে অভিনয় ছাড়াও নানাভাবে যুক্ত থেকেছেন তিনি। নির্দেশনাও দিয়েছেন নাটকের। শুধু অভিনয়ই করেছেন তেত্রিশটি নাটকের ষোল শতাধিক মঞ্চায়নে। তাঁর অভিনয়ে উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটক মুনতাসির ফ্যান্টাসি, কসাই, চর কাঁকড়া, শকুন্তলা, ফনীমনসা, কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাতহদাই, চাকা, একাত্তরের পালা, যৈবতী কন্যার মন, মার্চেন্ট অব ভেনিস, বনপাংশুল, প্রাচ্য, বিনোদিনী, ধাবমান, নষ্টনীড় এবং দ্য টেম্পেস্ট। যেসব নাটকে অভিনয় করেছেন, যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন, সেই চরিত্রটিই হয়ে উঠতে চেয়েছেন তিনি, হয়ে উঠেছেনও। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় তাঁর কাছে একজীবনে ভিন্ন ভিন্ন জীবনযাপনের মতো, ভিন্ন ভিন্ন জীবন উপভোগের মতো।
প্রায় পঞ্চাশ বছরের অভিনয় জীবনে শিমুল ইউসুফের কাছে তাই তার অভিনীত সবগুলো চরিত্রই প্রিয় ও অবিস্মরণীয়। তবে বিশেষভাবে মনে পড়ার মতো সেলিম আল দীনের নাটক ‘হাতহদাই’য়ের ছুক্কুনি চরিত্র। এই চরিত্রটাকে খুব ভালবেসেছেন তিনি, খুব উপভোগ করেছেন। ছুক্কুনি ছিল ফেনীর চরাঞ্চলের এক হতদরিদ্র মেয়ে। দারিদ্র্য, নিষ্ঠুরতা আর পুরুষশাসিত সমাজের যে চড়াই-উৎরাইয়ের ভিতর দিয়ে সে গিয়েছে সে জীবন ছিল শিমুল ইউসুফের নাগালের বাইরে। ছুক্কুনির ভাষা ফেনীর আঞ্চলিক ভাষা। ওই ভাষাও জানা ছিল না শিমুল ইউসুফের। যে কারণ ওই জীবন, ছুক্কুনির জীবনটা নাটকে যাপন করতে গিয়ে তিনি সেই জীবনের রূপ, রস, মাধুর্য, ক্লেশ, ক্লেদ ও যন্ত্রণা নিংড়ে নিংড়ে উপভোগ করেছেন। তাঁর কাছে তেমনি আর এক উপভোগ্য চরিত্র নটী বিনোদিনী। উনিশ শতকের শেষার্ধ ও বিশ শতকের শুরুতে কলকাতা কেন্দ্রীক বাংলা মঞ্চের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীর আত্মজীবনীর নাট্যরূপে এককাভিনয় করতে গিয়ে নিজের শিল্পীসত্তার সঙ্গে অনেক মিল খুঁজে পেয়েছেন বিনোদিনীর জীবন ও ভাবনার। মনে হয়েছে তা তাঁর নিজের জীবনেরই গল্প। ফিলিপাইনে ২০০৭ সালে এক উৎসবে নদী বিনোদিনীর অংশ বিশেষ উপস্থাপন করেন তিনি। অভিনয় শেষে মন খারাপ করে সবার আড়ালে গিয়ে অনুষ্ঠান মিলানায়তনের পেছনের সিঁড়িতে বসে ছিলেন। ভেবেছিলেন কিছু হয়নি তাঁর অভিনয়। কিন্তু অনুষ্ঠানের শেষ দিকে সবাই তাঁকে খুঁজে নিল। সবাই তাঁর প্রশংসা করল। এমনকি পরদিনও হোটেলের লবিতে অন্য দেশের শিল্পীকুশলীরা তাকে বিনোদিনী বলে ডাকতে লাগল। অভিনয় জীবনে শিমুল ইউসুফের এ এক পরম পাওয়া। দেশে-বিদেশে তাঁর এই রকম প্রাপ্তি অনেক।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টেলিভিশন যখন মধ্যবিত্তের ঘরোয়া বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম তখন তিনি অভিনয় করেন ঘরোয়া, পোস্ট মাস্টার, গ্রন্থিকগণ কহে ও নির্বাসন নাটকে। ঘরোয়া ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম ধারাবাহিক। প্রতি সপ্তাহে প্রচারিত এই নাটক টানা দেড় বছর চলেছিল। সামগ্রিক শিল্পমান এবং নান্দনিক অভিনয়ে বিপুল জনপ্রিয় এই নাটকগুলো আজও দর্শকদের স্মৃতিতাড়িত করে। শিমুল ইউসুফ সঙ্গীত পরিচালনা ও কণ্ঠ দিয়েছেন সূচনা, নদী ও নৌকা, প্রিয়তমেষু, আগামী, একাত্তরের যিশু, ঘুড্ডি (শুধু কণ্ঠ দিয়েছেন) ও গেরিলাসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কারপ্রাপ্ত ১৬টি চলচ্চিত্রে। রেডিও, টেলিভিশন ও মঞ্চে তিনি দুই হাজারের বেশি সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। গণসঙ্গীত, নজরুলসঙ্গীত ও লালনের গান নিয়ে শিমুল ইউসুফের পাঁচটি একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। তাঁর গাওয়া উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’। আবদুল গাফফার চৌধুরীর কথা ও আলতাফ মাহমুদের সুরে এই গানের শিমুল ইউসুফের গায়কিটিই একুশের গান হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করেছে। ভাষা আন্দোলন নিয়ে তাঁর গাওয়া শামসুদ্দিন আহমেদের কথা ও আলতাফ মাহমুদের সুরে আরো একটি উল্লেখযোগ্য গান ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও করিলি রে বাঙ্গালি, তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি’। একুশের গান ও গণসঙ্গীতে শিমুল ইউসুফের গাওয়া গান বিশেষ স্থান নিয়ে আছে।
নাচ, গান, অভিনয়- মঞ্চে নিজেকে উপস্থাপনের এই তিন শিল্পমাত্রায় নিজেকে বিকশিত করেছেন শিমুল ইউসুফ। তারপর নিজেকে বিস্তৃত করেছেন শিল্পের নানা শাখায়। শিল্পীর সামাজিক দায়বোধের জায়গা থেকে দেশ ও মানুষের পক্ষে থেকেছেন নিবেদিত ও সোচ্চার। রাজনৈতিক বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেও সাড়া দিয়েছেন বিবেকের পক্ষে, মানবিকতার পক্ষে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে। তা তিনি করেছেন নাটক, চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতের মাধ্যমে, করেছেন সরাসরি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে। রাজনৈতিক আর্দশের জায়গায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্প্রসার চেয়েছেন সব সময়। আর নিজের শিল্পসত্তার দিক থেকে ব্যক্তিগত আদর্শের জায়গায় ছিল কঠোর পরিশ্রম। যা তিনি করেছেন তা তিনি পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই করতে চেয়েছেন। বিশ্বাস করেছেন, কঠোর পরিশ্রমই আসল কথা। যে কঠোর পরিশ্রম করবে না সে শেষপর্যন্ত টিকবে না। এখনো কোনো প্রদর্শনীর আগের দিনগুলো গভীর মনোযোগের জন্য ধ্যানী ও যোগীর মতো হয়ে ওঠেন। কথা বলা একদমই কমিয়ে দেন।
শিমুল ইউসুফ জীবন ও শিল্পের অনুপ্রেরণা খোঁজেন নিজের আশপাশ, নিজের সমাজ, দেশ ও সংস্কৃতি এবং নিজ কাজের ক্ষেত্রে অবদান রাখা বিশ্বের যেকোনো মানুষের মধ্যে। সংস্কৃতির মধ্যে মিলনের সূত্রগুলো খুঁজে নিয়ে নিজের কাজের ক্ষেত্রেও তার প্রয়োগ ঘটাতে চান। ব্যক্তি হিসেবে শিমুল ইউসুফের জীবনে বড় অনুপ্রেরণা আলতাফ মাহমুদ, সেলিম আল দীন এবং নাসির উদ্দীন ইউসুফ। আলতাফ মাহমুদ তাকে দিয়েছেন সঙ্গীত ও সংগ্রামের অনুপ্রেরণা। সেলিম আল দীনের নাটকের ভিতর দিয়েই ছিল শিমুল ইউসুফের যাত্রা। যে কারণে সেলিমের লেখা তার আত্মীকৃত হয়ে গেছে। ওই লেখার মধ্যে নিজের বিস্তার দেখতে পান তিনি। শিমুল ইউসুফকে জীবনপথের সূত্রটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন মা। মা-ই তাঁকে তার স্বভাব চিনিয়ে দিয়েছিলেন, যা তিনি হতে চেয়েছেন ভিতর থেকে তা হওয়ার প্রথম অনুপ্রেরণা তাই তাঁর মা। শিমুল ইউসুফের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরের সহযোগী হয়েছেন স্বামী ও মঞ্চনাটকের সহযাত্রী নাসির উদ্দীন ইউসুফ। ব্যক্তি ও শিল্পী হিসেবে শিমুল ইউসুফের সম্ভাবনাকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় ছিলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। যে কারণে শিমুল ইউসুফ তাঁকে পছন্দের ব্যক্তিত্ব, আদর্শ ব্যক্তিত্ব হিসেবেও আলতাফ মাহমুদ ও সেলিম আল দীনের পাশেই রাখেন। বিয়ের ব্যাপারে শিমুল ইউসুফের একটা দৃঢ়তা ছিল। পারিবারিক আবহের কারণেই ছোটবেলা থেকেই বুঝেছিলেন যে মুক্তিযুদ্ধ করেনি সে তাকে বুঝবে না। যে কারণে মনে মনে ভেবে নিয়েছিলেন, বিয়ে করলে একজন মুক্তিযোদ্ধাকেই করবেন। যার চাওয়া পাওয়ার এতকিছু থাকবে না। জীবনে যা পাবে তা নিয়েই তুষ্ট। নাসির উদ্দীন ইউসুফের ব্যাপারে তিনি বলেন, সেই চুয়াত্তর থেকে ওকে চিনি। তখনও যেমন এখনো তেমন, সে এখনো অনেক প্রাপ্তির বিষয় প্রত্যাখ্যান করতে পারে। নাসির উদ্দীন ইউসুফের সঙ্গে তাঁর বিয়ে ১৯৭৯ সালে।
অভিনয় জীবনে শিমুল ইউসুফের বড় স্বীকৃতি- সবাই তাকে ‘মঞ্চকুসুম’ হিসেবে জানে। অভিনয় ও সঙ্গীতচর্চায় তাঁর অবদানের জন্য কবি বেগম সুফিয়া কামাল এবং নাট্যকার সেলিম আল দীন তাঁকে এই উপাধিতে ভূষিত করেন। দেশে ও দেশের বাইরে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের শিশুশিল্পী হিসেবে প্রেসিডেন্ট পদক লাভ করেন তিনি। এরপর তিনি পেয়েছেন লোকনাট্যদল পদক, বাচসাস পদক, মোহাম্মদ জাকারিয়া পদক, রুদ্র পদক, নুরুন্নাহার সামাদ পদক, আরণ্যক দীপুস্মৃতি পদক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার পদক, কালচারাল রিপোর্টার্স ইউনিটি পদক, মানবজমিন পাঠক জরিপ সম্মাননা, কচিকাঁচার মেলা আজীবন সম্মাননা এবং সেলিম আল দীন লোকনাট্য সম্মাননা। ঢাকা থিয়েটারের এই প্রজন্মের তারুণ্যকেও নিজের অনুপ্রেরণা ও জীবনীশক্তির উৎস মনে করেন শিমুল ইউসুফ। এই মঞ্চদলের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি তরুণ শিল্পী ও কলাকুশলীদের সবার ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় মায়ের মর্যাদায় অভিষিক্ত।
যে জীবনদর্শনের ওপর দাঁড়িয়ে জীবনযাপন করেন তিনি তা হচ্ছে- ‘সংগ্রাম ছাড়া কোনো জীবন নাই। সেই সংগ্রাম আমি শৈশবেই করেছি, একাত্তরেও করেছি, নাটকের জন্যও করেছি, এখনো করছি এবং ভবিষ্যতের জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও করব। জীবনে এই সংগ্রামকে অস্বীকার করলে তো নিজেকেই প্রতারিত করব, আমি এটা করতে পারব না। যতদিন বাঁচব এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। আমার মনে হয় সংগ্রাম ছাড়া কোনো জীবন পূর্ণতা পায় না।’
সংক্ষিপ্ত জীবনী
জন্ম: অভিনেত্রী, পরিচালক ও গায়িকা শিমুল ইউসুফের জন্ম ১৯৫৭ সালের ২১ মার্চ ঢাকায়। বাবা মেহতের বিল্লাহ ছিলেন ব্যবসায়ী। মা আমেনা বিল্লাহ ছিলেন গৃহিনী। আট ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন শিমুল ইউসুফ। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই গান শুরু করেন তিনি। তখনই রেডিও ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে গাইতেন। শিশু-কিশোর সংগঠন কচিকাঁচার মেলার অনুষ্ঠানেও গান গাইতেন তিনি।
শিক্ষা: মতিঝিল সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর বৃত্তি নিয়ে ১৯৭৪ সালে ভর্তি হন ভারতের বারোদা চারুকলায়। কয়েক মাসের মধ্যেই দেশে ফিরে ঢাকা থিয়েটারে যুক্ত হন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ থেকে ১৯৮০ সালে বিএসএস অর্নাস পাস করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে এমএস ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবন: শিমুল ইউসুফ ঢাকা থিয়েটারে যোগ দেন ১৯৭৪ সালে। ঢাকা থিয়েটারের ৩৪টি নাটকে তিনি অভিনয়, সঙ্গীত পরিচালনা, কোরিয়গ্রাফি, পোশাক পরিকল্পনা, সহকারী নির্দেশক, পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার কাজে যুক্ত ছিলেন। ৩৩টি নাটকের ১৬ শতাধিক মঞ্চায়নে অভিনয় করেছেন তিনি। সেসব মঞ্চনাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: মুনতাসির, কসাই, চর কাঁকড়া, শকুন্তলা, ফনীমনসা, কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাতহদাই, চাকা, একাত্তরের পালা, যৈবতী কন্যার মন, মার্চেন্ট অব ভেনিস, বনপাংশুল, প্রাচ্য, বিনোদিনী, ধাবমান, নষ্টনীড় এবং দ্য টেম্পেস্ট। তাঁর অভিনয়ে উল্লেখযোগ্য টেলিভিশন নাটক: ঘরোয়া, পোস্ট মাস্টার, গ্রন্থিকগণ কহে, নির্বাসন। সঙ্গীত পরিচালনা ও কণ্ঠ দিয়েছেন আগামী, একাত্তরের যিশু, গেরিলাসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কারপ্রাপ্ত ১৬টি চলচ্চিত্রে। দীর্ঘ ৫০ বছরের অভিনয় জীবনে তিনি রেডিও, টেলিভিশন ও মঞ্চে দুই হাজারের বেশি সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। গণসঙ্গীত, নজরুলসঙ্গীত ও লালনের গান নিয়ে শিমুল ইউসুফের পাঁচটি একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে।
পুরস্কার: জীবনে শিমুল ইউসুফের বড় স্বীকৃতি- সবাই তাকে ‘মঞ্চকুসুম’ হিসেবে জানে। অভিনয় ও সঙ্গীতচর্চায় তাঁর অবদানের জন্য কবি বেগম সুফিয়া কামাল এবং নাট্যকার সেলিম আল দীন তাঁকে এই উপাধিতে ভূষিত করেন। দেশে ও দেশের বাইরে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।
পরিবার: ঢাকা থিয়েটারে যুক্ত হওয়ার সূত্রে ১৯৭৪ সাল পরিচয় মুক্তিযোদ্ধা, নাট্যনির্দেশক, চলচ্চিত্রকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফের সঙ্গে। শিমুল ইউসুফ ও নাসির উদ্দীন ইউসুফের বিয়ে ১৯৭৯ সালে। এই দম্পতির একমাত্র সন্তান কন্যা এশা ইউসুফ।
তথ্যসূত্র: ১. ছোট ছোট স্মৃতি- শিমুল ইউসুফ, http://shahidaltafmahmud.com । ২. থিয়েটার আমার দ্বিতীয় সংসার, শিমুল ইউসুফের সাক্ষাৎকার, গৌতম পাণ্ডে, ২১ মার্চ ২০১৭, দৈনিক জনকণ্ঠ। ৩. শিমুল ইউসুফের সাথে আড্ডা-শেখ ফিরোজ আহমেদ, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬, http://www.porospor.com। ৪. ফ্রিডম থ্রো আর্ট অ্যান্ড ইউনিটি, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ত্রপা মজুমদার, কভার স্টোরি, শোবিজ, ২৫ মার্চ ২০১৭, ডেইলি স্টার। ৫. থ্রো দ্য আইস অব শিমুল ইউসুফ- ফাহিম আবরার, ৫ এপ্রিল ২০১৪, ডেইলি স্টার। ৬. আজকের সকালের আমন্ত্রণে শিমুল ইউসুফ, তারা মিউজিক টিভির সাক্ষাৎকারমূলক অনুষ্ঠান, সম্প্রচার ৩ সেপ্টেম্বর ২০১১। ৭. শিমুল ইউসুফের সাক্ষাৎকার- পুনম প্রিয়ম, রূপান্তর, অনুষ্ঠান সম্প্রচার আগস্ট ২০১৫, চ্যানেল আই। ৮. শিমুল ইউসুফের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা।
লেখক- ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ