১৯৬৮ সালের ১ জানুয়ারি ঈদের দিন। গ্রেপ্তার হয়ে গেলে আবার কবে সন্তানদের কাছে পাবেন- এটা ভেবে কমান্ডার আবদুর রউফ পরিবারের সবাইকে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচির একটি সমুদ্র সৈকতে গেলেন, সন্তানদের বাঙালি দোকান থেকে মিষ্টি খাওয়ালেন, হৈ চৈ করলেন। রাতে বাসায় ফিরে জানলেন, নেভির একজন কর্মকর্তা বাসায় এসে খোঁজ নিয়ে গেছেন। আবদুর রউফ আর তাঁর স্ত্রীর বোঝার বাকি রইল না, সময় কাছে চলে এসেছে।
রউফ আগেই জেনেছেন, পাকিস্তান নৌবাহিনীর কর্মকর্তা কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন গ্রেপ্তার হয়ে গেছেন। মোয়াজ্জেমকে যে কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই একই কারণে তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হবে- এটা মনে মনে নিশ্চিত হয়েই ছিলেন রউফ। তবু বুকে সাহস নিয়ে মাত্র কয়েকদিন আগেই ঢাকা থেকে ফিরে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে কাজে যোগ দিলেন। এর মধ্যে একদিন খবর পেলেন লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
স্ত্রী এসব কিছুই জানেন না। তাই এর মধ্যেই একদিন স্ত্রীকে কাছে ডেকে বললেন, ‘দেখ পাকিস্তান সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী ও সিভিল কিছু বাঙালি কর্মকর্তা দেশকে সশস্ত্র অভ্যূত্থানের মাধ্যমে স্বাধীন করার একটি উদ্যোগ নিয়েছে। আমি নিজেও তাতে জড়িত। বোধ হয়, ঘটনাটি পাকিস্তানের গোয়েন্দারা জেনে গেছেন, তাঁরা একে একে আমাদের লোকজনকে গ্রেপ্তার করছে। আমাকেও যে কোনো সময় গ্রেপ্তার করা হতে পারে’ স্বামীর মুখ থেকে এমন কথা শুনে একেবারে চুপসে গেলেন স্ত্রী।
স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ভয় পেয়ে লাভ নেই। যা হবার হবে। যদি আমাকে গ্রেপ্তার করে তাহলে তুমি গাড়িটা বিক্রি করে বাচ্চাদের নিয়ে বাংলাদেশে চলে যাবে। স্ত্রী কান্নাকাটি করলেন, কিন্তু আবদুর রউফ কিছুটা স্বস্তি পেলেন; আর যাবতীয় কিছুর জন্যই তৈরি হয়ে রইলেন।
এর মধ্যেই ঈদ উদযাপন করলেন। ঈদের পরদিন ২ জানুয়ারি সকালবেলাতেই সেই নেভির অফিসার বাসায় চলে আসেন এবং বললেন, ডিউটিতে যেতে হবে। আবদুর রউফের বোঝার বাকি রইল না, ডিউটির নামে নিয়ে আসলে গ্রেপ্তার করবে। এবার তাহলে পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে।
পরিবার বলতে স্ত্রী, তিন মেয়ে আর এক ছেলে। ছেলেটার বয়স তখন মাত্র ছয় মাস, সে ঘুমাচ্ছে। সবার বড় মেয়ে পাঁচ বছরের। এদের কেউ তো এসব বুঝবে না। কেন তাদের বাবাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে আবদুর রউফ সন্তানদের দোতলা বাড়ির ভিতরের একটি কক্ষে পাঠিয়ে দিলেন। আর নিজে কাপড়-চোপড় পড়ে তৈরি হয়ে নিলেন। খেতে ইচ্ছে করছিল না, তবু স্ত্রীর হাতে ‘শেষবারের’ মতো মনে করে দু’মুঠো ভাত খেলেন। যদি আর কোনোদিন দেখা না হয়। বেরিয়ে যাওয়ার মুখে- ছেলেকে বিছানা থেকে তুলে কোলে নিয়ে একটু আদর করলেন, মেয়েদের আদর করলেন। তারপরই পাকিস্তান নৌ বাহিনীর একটি গাড়িতে করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। অবুঝ সন্তানরা জানল না, তাদের বাবা কোথায় যাচ্ছে, কারা নিয়ে যাচ্ছে, কেন নিয়ে যাচ্ছে। পেছনে শুধু পড়ে রইল স্ত্রীর চোখের জল আর পরিবারের জন্য বিশাল এক অনিশ্চয়তা।
আবদুর রউফকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হল মনরো আইল্যান্ডে। সেখানে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এলেন। জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু হল। তাঁরা বলল, বাঙালি কর্মকর্তাদের তৎপরতা সম্পর্কে যা জানেন লিখে দিতে। কিন্তু রউফ বললেন, যদি কিছু জানার থাকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও। আর যে কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেটা পলিটিক্যাল কারণ। সুতরাং যা করার করেন। এরপর একটা সিভিলিয়ান বাড়িতে নিয়ে বন্দি করে রাখল। সেখানে একজন নিয়মিত পাহারা দেয়। পাশের ঘরেই ছিলেন বন্ধু রহমান, মানে মতিউর রহমান। তারপর থেকে তো পরিবারের সঙ্গে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। মধ্য জানুয়ারির দিকে সবাইকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হল। এখানে এসে তিনি পরিচিত-অপরিচিত আরো অনেককে পেলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও এই প্রথম তাঁর দেখা হল। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ইলেকটেড বডিস ডিসকোয়ালিফাইড অর্ডার (এবডো) নামে একটি নির্দেশ জারি করেন। যার মূল কথা হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত রাজনীতিকরা যাতে তাঁর কাছে আত্মসমর্পন করেন। যারা আত্মসমর্পন করবেন না তাদের বিরুদ্ধে তিনি গণ্ডায় গণ্ডায় সামরিক আদালতে মামলা দেবেন বলে হুঁশিয়ারি দেন। মামলার ভয়ে অনেকেই তখন আইয়ুব খানের কাছে আত্মসমপর্ণ করেন। কিন্তু শেখ মুজিব ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি আত্মসমর্পন করেননি। তাঁর বিরুদ্ধে আইয়ুব সরকার ২৮টি মামলা দিয়েছিল। তিনি সেগুলো মোকাবেলা করেছিলেন। আবদুল রউফের তখন ধারণা হয়েছিল, এই সেই ব্যক্তি যিনি আসলে বাঙালির মুক্তির জন্য সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে পারেন। সেই বঙ্গবন্ধুকে আবদুর রউফ প্রথম দেখলেন, তাও একই মামলায় কারাগারের সঙ্গী হিসেবে। এমনিতেই পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই, তার উপর যে ধরনের রাজনৈতিক অপরাধে বন্দি করা হয়েছে তাতে ফাঁসিও হয়ে যেতে পারে- এই শঙ্কার মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটা আবদুর রউফকে কিছুটা আত্মবিশ্বাসী করে তুলল। তারপর তো বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জনের নামে অভিযোগ গঠন করে মামলাই শুরু হয়ে গেল।
ঢাকায় আনার কিছুদিন পর আবদুর রউফের পরিবার জানতে পারল, বন্দিদের তাদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে দিচ্ছে। তাখন তাঁরা ভৈরব থেকে ঢাকায় এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। আদালতে মামলা শুরু হওয়ার পর অবশ্য নিয়মিতভাবেই অভিযুক্তদের সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা দেখা করতে পারতেন।
যখন আগরতলা মামলার বিচার চলছিল তখন বঙ্গবন্ধুসহ এই মামলার সব আসামিই মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এমন নির্যাতন করা হয়েছে কয়েকজন তো মানসিক রোগী হয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁরা এটা বুঝতে পারছিলেন বাইরে তাদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে। সাংবাদিকদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু মাওলানা ভাসানির কাছে খবর পাঠান। পূর্ব পাকিস্তানের সব দল মিলে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্তদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করার চেষ্টা করছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার ইচ্ছে করেই এই মামলার নাম দিয়েছিল ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা‘। আইনগতভাবে এই মামলার নাম ‘শেখ মুজিবুর রহমান বনাম সরকার ও অন্যান্য’। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা যেন প্রতিবেদনে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ উল্লেখ করেন। সাংবাদিকরা প্রতিবেদনের স্বার্থে সেটা করেছিলেন। এই নামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সরকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য আসামিদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ভারত সরকার পাকিস্তান ভাঙার চেষ্টা করছে এটি মানুষকে বোঝাতে পারলে তাঁরা ক্ষেপে যাবেন। রাস্তায় আসামিদের ফাঁসির দাবিতে মিছিল করবে।কিন্তু সেটি ভেস্তে যায়।
স্বাধীনতা যুদ্ধেরও প্রায় ১০ বছর আগে নৌবাহিনীর কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনসহ কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাত থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করার অভিপ্রায় নিয়ে বাঙালি সেনাদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। অস্ত্রের মাধ্যমে তাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশ করতে চেয়েছিলেন। সেই প্রক্রিয়া ছিল বলতে গেলে, আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার মতোই। সবাই জেনেবুঝে মৃত্যুকে হাতে নিয়ে গোপন এই বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত হন। এই প্রক্রিয়া এতটাই গোপনীয় ছিল যে, সেনা, নৌ বা বিমান বাহিনী প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা ‘নিউক্লিয়াস’ ছিল। এক দলের সঙ্গে আরেক দলের কারোর যোগাযোগ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। মামলার অভিযুক্ত সার্জেন্ট আবদুল জলিল সাহেবের মতে, সরাসরি এই দলের সঙ্গে হয়তো কয়েকশ লোক জড়িত ছিল। কিন্তু তাদের সমর্থক ছিল হাজার হাজার। পুরু এই প্রক্রিয়াটি কয়েকজন বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমেই পরিচালিত হত। বাকি সবাই নিজ নিজ ‘নিউক্লিয়াস’কে কেন্দ্র করে কাজ করতেন। দলের মূল নেতৃত্ব থেকে নির্দেশ আসত, সেটা সাধারণ সদস্যরা পালন করতেন। কোথাও কোনো অবিশ্বাস বা বিশৃঙ্খলার বিন্দুমাত্র চাপ ছিল না। বাঙালি সেনারা অস্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেবে এটাই ছিল মূল বিষয়। কিন্তু অস্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলেই তো হবে না, সেটা টিকিয়েও রাখতে হবে। আর সেকারণেই এই প্রক্রিয়ার পেছনে রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলই দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবে। বিপ্লবী দলের নেতৃত্ব সেজন্য পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু এভাবে দেশ স্বাধীনের পরিকল্পনা শুনে সব রাজনৈতিক নেতাই ভড়কে যান, তাতে সমর্থন দেওয়া তো দূর অস্ত। ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে একবার বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানে আসলেন। পশ্চিম পাকিস্তানে এলে সাধারণত তিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মেয়ে আখতার সোলেমানের বাসায় উঠতেন। সেখানে গিয়েই একদিন বিপ্লবী দলের কয়েকজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেই বাঙালি সেনাদের অনেকবারই কথা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনার কথা শুনে বললেন, ‘গো এহেড, আই এম উইথ ইউ‘। বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা এতে ব্যাপক উৎসাহ পেলেন, তাঁরা আরো জোর কদমে কাজ চালিয়ে গেলেন। এই পরিকল্পনার শেষ দিকে যুক্ত হয়েছিলেন আবদুল রউফ। কারণ, তিনি অন্যদের তুলনায় নৌ বাহিনীতে প্রবেশ করেছিলেন বেশ দেরিতে।
কমান্ডার আবদুর রউফের জন্ম ১৯৩৩ সালের ১১ নভেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব পৌরসভার এক সভ্রান্ত মুসলিম পরিবার, নানার বাড়ি ভৈরব উপজেলার তুলাতুলিতে। বাবা মৌলভী আবদুল লতিফ ছিলেন ভৈরব পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত মেয়র (পরিবারের দেওয়া তথ্য)। মা কর্পুরনেছা বেগম ছিলেন গৃহিনী। এই দম্পতির পাঁচ ছেলে আর দুই মেয়ে। সবার বড় মেয়ে হাজেরা রহমান, আবদুর রউফ, আবদুল্লাহ আল বাকী, আবদুল্লাহ আল কাফি, আবদুল্লাহ আল সাদি, আবদুল্লাহ আল হাদি, সবার ছোট বোন আফসিয়া দোজা।
আবদুল রউফের পড়াশোনার শুরু নানাবাড়ির এক মক্তবে। দুই বছর সেখানে আরবি শেখার পর বাবা তাকে নিয়ে এসে ভৈরবের কে বি হাই স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। সেখান থেকেই মেট্রিক পাস করেন। তারপর ঢাকা কলেজে এসে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। সেখানে থাকতেন নূপুর ভিলা হাসেমবাগ হোস্টেলে। সেখানে বামপন্থী সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁকে কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। তিনি ক্রীড়া সম্পাদক পদে জয়লাভ করলেন। তারপর পারিবারিক কারণে চলে যান কুমিল্লায়। সেখানে তাঁর চাচা মিন্নাত আলী সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। সেখানকার কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন স্নাতক শ্রেণিতে। আগে থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যোগ ছিল, এখানে এসে সেটা আরো জোরালো হয়। বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি সেখানকার কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। কিন্তু স্নাতক পরীক্ষা দেওয়ার দুই-তিন মাস আগে রাজনৈতিক দাঙ্গা-ফ্যাসাদের কারণে তাঁর পক্ষে সেখানে থাকা প্রাণ সংশয়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। তখন কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল রউফের বাবাকে বললেন, ছেলেকে সেখান থেকে নিয়ে যেতে। সেখান থেকে ফিরে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হন স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ইতিহাস বিভাগে। থাকতেন ফজলুল হক হলে। তখন পুরোদমে বামপন্থী রাজনৈতিক দল ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হয়ে যান। হল সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়ার সময়ই ১৯৫৬ সালে আবদুর রউফ বিয়ে করেন নরসিংদী জেলার কানিজ ফাতেমাকে। বিয়ের পর ১৯৫৭ সালের শেষ দিকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করে বেশ কিছুদিন বেকার ছিলেন। এ সময় তিনি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড করে ফেলেন। বেকার জীবনেই প্রথম সন্তানের বাবা হন। তারপর যোগ দেন বিএফ শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে। গ্রুপ ক্যাপ্টন ডোগার সাহেব ছিলেন এই বিশেষায়িত স্কুলের উদ্যোক্তা। কিন্তু তাঁর মনে ছিল নৌবাহিনীতে যোগ দেওয়ার বাসনা। ১৯৬১ সালে তিনি নৌবাহিনীর শিক্ষা কোরে যোগ দিলেন। চট্টগ্রাম থেকে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হল পশ্চিম পাকিস্তানের নেভাল বেইস হেমালিয়া ম্যানোরা দ্বীপে। সেখানে এডুকেশন কোরের প্রশিক্ষণে যোগ দিলেন। সেখানকার অফিসার্স মেসে থেকে কয়েক দিনের মধ্যেই বুঝতে পারলেন পাঞ্জাবি-বাঙালি বৈষম্যের বিষয়টি। মেসের ক্যান্টিনে অধিকাংশই ছিলেন পাঞ্জাবি অফিসার। তাদের রুচি ও অভ্যাস অনুযায়ী প্রধান খাদ্য হিসেবে রুটি তৈরি করা হত। বাঙালিদের জন্য ভাতের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু আবদুর রউফের তো ভাত চাই। তিনি মাছে-ভাতে বাঙালি। পর পর কয়েকদিন কোর্স কমান্ডারকে গিয়ে বললেন, ‘আমি ভাত খেয়ে অভ্যস্ত, আমি ভাত খেতে চাই।’ কিন্তু কোনো কাজ হল না। ভাতের দাবি নিয়ে গেলেন বেইসের সেকেন্ড ইন কমান্ডের কাছে। তিনি বিরক্ত হয়ে নানা কায়দা-কানুন দেখিয়ে বিদায় করে দিলেন। তখন রউফের মাথায় জেদ চেপে যায়। তিনি বললেন, হয় ভাত দাও, নয় তো বিদায় করে দাও। পাঞ্জাবি কর্মকর্তা পুলিশের ভয় দেখালেন। উল্টো রউফ বললেন, পুলিশ তাঁর কিচ্ছু করতে পারবে না। সেকেন্ড ইন কমান্ড ক্ষেপে গেলেন। তবে শেষ পর্যন্ত অনেক দেন-দরবার করে রউফ ভাতের দাবি আদায় করতে পেরেছিলেন। মেসে শুধু তাঁর জন্যই একা ভাত রান্না করা হত। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে রউফ সব পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত বাঙালি নাবিকদের মধ্যেই পরিচিত হয়ে উঠলেন।
ছয় সপ্তাহের প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬২ সালের জানুয়ারি মাসে আবদুর রউফ পোস্টিং পেলেন করাচির পিএনএস কাসাস নেভাল ঘাঁটিতে। সেখানে যে মেসে উঠলেন, তাতে বেশ কিছু বাঙালি কর্মকর্তা দেখে স্বস্তি পেলেন। কিছুদিন কাজ করার পর বদলি করে দিল মনরো দ্বীপে। সেটি মূলত একটি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। নতুন যোগ দেওয়া নাবিকদের এখানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হত।
১৯৬৪ সালের আবদুর রউফের বাবা মারা যান। পারিবারিক কারণ দেখিয়ে তখন তিনি চট্টগ্রামে বদলি হয়ে আসেন। এক বছরেরও কম সময় সেখান থেকে ১৯৬৫ সালের শুরুতে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় আজিমপুরে একটি রিক্রুটিং কার্যালয় আছে, সেখানে নেভির লিয়াঁজো অফিসার হিসেবে যোগ দেন। সেখানে এসেও প্রত্যক্ষ করেন বিহারি, পাঞ্জাবিদের বাঙালি বিদ্বেষ। বাঙালি ছেলেদের সব ঠিক থাকার পরও বাদ দিয়ে দেওয়া হত। দশ জনের মধ্যে একজনকে নেয়। বিপরীতে আবদুর রউফ চেষ্টা করতেন, বাঙালি ছেলেদের যত বেশি সম্ভব বাহিনীতে নেওয়ার। এ নিয়ে পাঞ্জাবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। একদিন অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল অব আর্মির কাছে বৈষম্যের কথা বলে ফেলেন। এর দুদিন পরই তাঁকে ১৯৬৬ সালের জুলাই মাসে পশ্চিম পাকিস্তানের কারচাসে বদলি কর দেওয়া হল।
এই সময়টা, মানে ঢাকায় বসবাস করার সময়টা আবদুর রউফের জীবনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, একজন পরিপূর্ণ রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট মানুষ এমন একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন, যেখানে প্রকাশ্যে রাজনীতির চর্চা একেবারেই নিষিদ্ধ। ঢাকায় এসে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অনেক বন্ধু ও রাজনৈতিক সহকর্মীকে পেয়ে গেলেন। স্বাভাবতই তাদের মাধ্যমে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিনিয়ত জানতে থাকলেন এবং এটা বুঝলেন, আসলে পূর্ব বাংলার মানুষ একটা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এর মধ্যে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফাও দিয়ে দিয়েছেন। ফলে বাঙালিদের মধ্যে অন্যরকম তেজ তৈরি হয়ে গেছে। রউফও পলিটিক্যালি ‘ম্যাচিউর‘- এই অবস্থার মধ্যে তিনি কারচাসে বদলি হলেন।
কারচাসে যোগ দিয়েই ফ্যামিলি কোয়ার্টার পাননি। ফলে পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে থাকে। তিনি উঠলেন সেখানে লেফটেন্যান্ট মোল্লা মোহাম্মদ মতিউর রহমানের বাসায়। মতিউর রহমান সাহেব আগে থেকেই অস্ত্রের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করার উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত। ততদিনে এই উদ্যোগের কথা বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। সবাই চেষ্টা করছেন গোপনে যত বেশি মানুষের কাছে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার বিষয়টি তুলে ধরার। এই মতিউর রহমান সাহেবই একদিন বিষয়টি আবদুর রউফের কাছে তুলে ধরেন। রউফ ভাবলেন, এই লোকগুলো তো ধরা পড়া যাবে। তার উপর বাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী, এই ধরনের কর্মকাণ্ডের কথা জানলে উপরের মহলে রিপোর্ট করা। কিন্তু তিনি তো বাঙালি, তিনিও চান দেশ স্বাধীন হোক। ফলে রিপোর্ট করার বিষয়টি মাথায়ই আনলেন না, উপরন্তু এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে ফেললেন।
১৯৬৭ সালের প্রথম দিকের ঘটনা। লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান সাহেব কমান্ডার আবদুর রউফকে একদিন মার্টিন কোয়ার্টার এলাকায় একটি বাসায় নিয়ে গেলেন। সেখানে সার্জেন্ট আবদুল জলিল, সার্জেন্ট জহুরুল হকসহ আরো অনেকেই ছিলেন। সেই প্রথম দেশকে স্বাধীন করার জন্য যারা গোপনে সংগঠিত হচ্ছেন তাদের সঙ্গে কথা বললেন। পুরো বিষয়টি সম্পর্কে একটা ধারণা হল। তিনি সবার সঙ্গে কাজে লেগে গেলেন।
এরই মধ্যে লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান এই কাজের সুবিধার জন্যই ঢাকায় বদলি নিয়ে চলে এলেন। আবদুর রউফ ছুটি নিয়ে ঢাকায় আসেন। দুজনে মিলে সেই সময়ের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা জিল্লুর রহমান, কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, প্রকৌশলী গোলাম মর্তুজাসহ বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক দেখা করলেন। এ ছাড়া সাধারণ পরিচিতদের সঙ্গেও কথা বললেন। পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে রিপোর্ট দিলেন, বাঙালিরা স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত।
এরপর ডিসেম্বরে আবার ঢাকায় আসলেন। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ রাতে তাঁর করাচিতে ফিরে যাওয়ার কথা। তার আগে এই প্রক্রিয়ার প্রধান সংগঠক কমান্ডার মোয়োজ্জেম হোসেনের সঙ্গে বৈঠক ঠিক হল। সন্ধ্যায় কাম্পালা রেস্টুরেন্টে দুজনে দেখা করবেন। কিন্তু তার আগেই খবর পেলেন, বৈঠক হবে না, কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রউফ বুঝে ফেললেন, গ্রেপ্তার শুরু হয়ে গেছে। তাঁকে গ্রেপ্তার করাটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সব ধরনের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গেলেন। কাজে যোগ দিলেন কিন্তু মনের মধ্যে সারাক্ষণই একটা আতঙ্ক। ২০ ডিসেম্বর খবর পেলেন মতিউর রহমান গ্রেপ্তার হয়েছেন।জানুয়ারির ১ তারিখ ছিল ঈদের দিন। আবদুর রউফ জানেন এদিন গ্রেপ্তার করা হবে না। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটালেন। ২ জানুয়ারি তিনিও গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন।একটা দ্বীপে নিয়ে গিয়ে যিনি জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন তিনি বললেন, যা কিছু জানা আছে লিখে দিতে। তিনি সরাসরি বলে দিলেন, লিখতে পারবেন না। কিছু জানার থাকলে জেনে নিতে।
জানুয়ারির মাঝামাঝিতে পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রামে স্থানান্তর করে দেওয়া হল। সেখানে নেভাল বেইসে ছোট একটা কামরায় একা বন্দি করে রাখা হল। বুঝতে পারলেন, আশেপাশের রুমেও কেউ আছে। অনেক পরে জানতে পারেন সেখানে বন্দি আছেন কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন। সময় যত যেতে লাগল বুঝতে পারলেন পরিচিত-অপরিচিত আরো অনেকেই আছেন। প্রথমে খোঁজ পেলেন পুরনো বন্ধু মতিউর রহমানের। সেখানে প্রায় দেড় মাস রাখার পর মার্চের প্রথম দিকে নিয়ে আসা হল ঢাকায়। পশ্চিম পাকিস্তানে আরো যারা বন্দি হয়েছিলেন সবাইকে একত্রিত করা হল। আবদুর রউফ বুঝতে পারলেন সরকার মামলার জন্য তৈরি হচ্ছে। ঢাকায় এসে আবদুল রউফ নিজের কক্ষে পাকিস্তানের সিএসপি কর্মকর্তা আহমেদ ফজলুর রহমানকে সঙ্গী হিসেবে পেলেন। কিছুদিন পরে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে সঙ্গী হিসেবে পেলেন কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন আর মতিউর রহমানকে। পাশের কক্ষে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও কর্নেল শামসুল আলম। সবাই একসঙ্গে একত্রিত হওয়া বা কথা বলার সুযোগ পেলেন মামলা চালু হওয়ার পর। মামলায় হাজিরা দিতে একসঙ্গে সবাইকে একটি প্রিজন ভ্যানে করে নিয়ে যেত। সবাই এক কণ্ঠে গাইতেন ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’।
ঢাকায় আসার পর আবদুর রউফের পরিবারের সদস্যরা জানতে পারলেন, আসামিদের সঙ্গে দেখা করতে দিচ্ছে। তখন একদিন পরিবারের সদস্যরা গিয়ে আবদুর রউফকে দেখে এলেন। দীর্ঘদিন পর পরিবারের সবাই আবার একত্রিত হলেন। আবদুর রউফের জন্য এই সময়টা ছিল খুবই শঙ্কার। সামরিক বাহিনীর সদস্য হয়ে অস্ত্রের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ করা- এই অপরাধে তাদের ফাঁসি হতে পারে। বলা যেতে পারে, এক ধরনের জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি ৩৫ জন অভিযুক্ত। এর বাইরে চারজন সাক্ষী। সবার পরিবার আতঙ্কে, যে যার মতো চেষ্টা করছেন মানুষগুলো যেন বেঁচে ফিরে আসে। মামলা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলা জুড়ে মানুষের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। জেল থেকেই একদিন বঙ্গবন্ধু মাওলানা ভাসানীর কাছে খবর পাঠালেন, আন্দোলন গড়ে তুলতে। বাইরে যত আন্দোলন হচ্ছে, ততই অভিযুক্ত বাঙালি কর্মকর্তাদের মাঝ থেকে ভয়-ভীতি চলে যাচ্ছে। তাঁরা একটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। মামলার দিন ছাড়া বাকি সময় গল্প-গুজব করেই কাটে। বিকেলে সামনের লনে কিছুক্ষণের জন্য হাঁটতে দেয়। আবদুর রউফ এই প্রথম কাছে থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখলেন; তাও একই কারাগারে বন্দি হিসেবে। ১৯৫৮ সালেই তাঁর মনে হয়েছিল, একমাত্র এই লোকটারই হিম্মত আছে দেশকে স্বাধীন করার। দশ বছরের মাথায় সেই মানুষটাই তাঁর জেল জীবনের সঙ্গী। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেখানে সবারই খুব সখ্যতা গড়ে উঠে। তিনি মাঝে মাঝে আবদুল রউফের ঘরে আসেন আড্ডা দেওয়ার জন্য।
এ বিষয়ে পরে এক স্মৃতিচারণায় তিনি বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমার রুমে আসতেন। এসে বসতেন, এই রউফ তামাক সাজো, আমি সিগারেটের বদলে হুঁকা খেতাম। তামাক সেজে দিলাম, কথাবার্তা বললেন, এখান থেকে ওখানে গেলেন এরকম করতেন।’
ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একটা আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে আবদুর রউফের সঙ্গে। একদিন আবদুর রউফের স্ত্রী চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধু দেখেই ডাক দিলে বললেন, ‘রউফ তোর ছেলেমেয়ে আসছে। ছেলেমেয়েদের আমার কাছে দিয়ে যা তোরা গল্প কর।’ ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে আসার সময় বঙ্গবন্ধু তাদের হাতে নতুন তিনটা নতুন কচকচে পাঁচ টাকার নোট গুজে দিলে বললেন, ‘মিষ্টি কিনে খাবা।’ তখন পাঁচ টাকা মানে অনেক টাকাই। দেখে রউফ বললেন, ‘কী করেন মুজিব ভাই? বাচ্চাদের টাকা দিতে হবে না।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুই জেলে আসিছ, তাই বলে কি ছেলেমেয়েরা মিষ্টি খাবে না।’ বন্দি জীবন আর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে স্মৃতিচারণার এমন ঘটনা আবদুর রউফ তাঁর লেখা কয়েকটি গ্রন্থে উল্লেখ করে গেছেন।
এই সময়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে, সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যার ঘটনা। এই সাদাসিদে মানুষটির সঙ্গে আবদুর রউফের প্রথম দেখা হয়েছিল করাচিতে। সেদিন তিনি দেশ স্বাধীনের পক্ষে বেশ ইমপ্রেসিভ বক্তব্য দিয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালের প্রথম দিক থেকে ১৯৬৮ সালের প্রথম পর্যন্ত এক বছর সময়ের মধ্যে বৈঠকে দুজনের মধ্যে একাধিকবার দেখা হয়েছে। কিন্তু দুজনেই বন্দি হওয়ার পর আর দেখা হয়নি। মামলায় হাজিরা দিতে যাওয়ার সময় আবার দেখা। এ সময় দুজনের মধ্যে অনেক কথাবর্তা হত। একদিন ভোরবেলা সার্জেন্ট জহুরুল হক, আহমেদ ফজলুল হক আর একজন বাইরে বের হলেন। এই সময়টায় বন্দিরা বাথরুমে যেতেন, ওজু সেরে নামাজ পড়তেন। তখনি নিরাপত্তারক্ষীরা সার্জেন্ট জহুরুল হক আর আহমেদ ফজলুল হককে গুলি করে, তাদেরকে বেয়নেট দিয়ে আঘাত করা হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর সার্জেন্ট জহুরুল হক মারা যান আর ভাগ্যক্রমে আহমেদ ফজলুল হক বেঁচে যান। এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে সারা বাংলায় মানুষ পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেন। যার সূত্র ধরে আইয়ুব খান এই মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন এবং ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এই মামলার সব আসামি মুক্তি পান। পরদিন ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়।
মুক্তি পাওয়ার পর আবদুর রউফ গ্রামের বাড়ি ভৈরবে যান। সেখানকার মানুষ তাঁকে ব্যাপকভাবে সংবর্ধনা জানায়। তিনি নৌ বাহিনীর চাকরিতে আর ফিরতে পারলেন না। ১৯৬৯ সালের ৩০ জুন তিনি বাধ্যতামূলক অবসরে যান।
আবদুর রউফ মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। স্বাভাবিকভাবে চাকরির বেতন দিয়েই পরিবার চালাতেন। এখন চাকরি নেই কিন্তু সংসার তো আছে। সেটা চালাতে হবে। তাই ভৈরবে গিয়ে প্রথমে একটি ওষুধের দোকান দিলেন। কিন্তু সেখানে মন টিকল না। নরসিংদী কলেজে অধ্যক্ষের চাকরি নিলেন। ততদিনের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সঙ্গে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এলাকায় কিছু সংগঠনও গড়ে তুলেছেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে একটা রাজনৈতিক সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেছে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে। ইয়াহিয়া খান আলোচনার নামে বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। জনতাও রাজপথে অবস্থান নিয়েছে, প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত উত্তাল হয়ে উঠছে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এর মধ্যে ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত করে দেন। পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। বুঝতে পারলেন, বিপদ আসন্ন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ কলেজের দায়িত্ব অন্য একজনের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে ভৈরবে চলে আসলেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দান থেকে স্বাধীনতার ডাক দিলেন। এ সময় আবদুর রউফ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মিলে নরসিংদী এবং ভৈরবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করানোর জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করলেন এবং সংগঠিত করলেন। এর পর ২৫ মার্চ তো ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর গণহত্যাই শুরু করে দেয়। ৩ মার্চ থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি ভৈরবেই ছিলেন। এর পর আবদুর রউফ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা জীতেন ঘোষ, রণেশ দাশগুপ্ত, কমরেড বারীণ দত্তের (আবদুস সালাম) স্ত্রী। পরিবার ভৈরবেই থেকে যায়। ভারতে গিয়ে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে যোগ দেন। তিনি মূলত তেজপুর, বাইখোরায় বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দেশের ভিতরে ট্রুপ নিয়ে প্রবেশ করেন ডিসেম্বরের ২ তারিখে। ভৈরবেই একটি ক্যাম্পে অবস্থান করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরেন, ৩১ জানুয়ারির সবার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দেন। তারপর সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ন্যাপের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন। কিন্তু ১৯৭৩ সালে রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে আবার বাংলাদেশ নৌ বাহিনী পুন:গঠনের কাজে যোগ দেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। একই বছরের ১০ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমানের সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। পরের বছরের ১ এপ্রিল জিয়া সরকারই আবদুর রউফকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায়। ২২ বছর পর ১৯৯৮ সালে শেখ হাসিনার সরকার তাঁর হৃত সব মর্যাদা ফিরিয়ে দেন।
মাঝখানের এই সময়টা কলেজে অধ্যাপনা, রাজনীতিসহ নানা সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৭৬ সালের চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। বিদায় নেন ১৯৭৮ সালে। এরপর গড়ে তুলেন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান এফপিএসটিসি। সেখান থেকে বিদায় নেন ২০০২ সালে। ১৯৯৩ সালে যোগ দেন গণফোরামে। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন সংগঠনের নির্বাহী সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেমিওগ্রাফি বিভাগ চালুর ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে।
রউফ-কানিজ দম্পতির তিন মেয়ে এবং এক ছেলে। সবাই নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। বড় মেয়ে লিপিকা লুৎফুন্নেসা ঢাকাতেই থাকেন। সবার ছোট মেয়ে গীতালি হাসান (বদরুন্নেসা) লেখালেখির পাশাপাশি টিভি নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত। মেঝ মেয়ে দীপিকা কামরুন্নেসা মারা গেছেন। সবার ছোট একমাত্র ছেলে আরিফ আবদুর রউফ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।
প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও আমার নাবিক জীবন‘, ‘বন থেকে বন্দর‘, ‘যুগসন্ধির সুরধ্বনি‘, ‘মুক্তিস্নান‘,‘আমার ছেলেবেলা ও ছাত্র রাজনীতি‘, ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘কর্বট কন্যা‘ ও ‘মাতঙ্গী দেবী উপখ্যান‘। এ ছাড়া লিখেছেন অনেক প্রবন্ধ, ছোটগল্প ও কলাম। ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত ‘দেশবন্ধু’ নামে একটি মাসিক পত্রিকার সঙ্গে নীবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ২০০৬ সালে ভৈরব থেকে বের হয় তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক উজান স্রোত। এ ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁকে দেওয়া হয়েছে সম্মাননা। ২০১৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিসাধীন অবস্থান শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন এই বীর বাঙালি।
আগরতলা মামলা সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু তথ্য
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে মু্ক্ত বিশ্বকোষ উইকিকপিডিয়ায় বলা হয়েছে, পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে দায়ের করা একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগ নেতা ও পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেছিল।
১৯৬৮ সালের প্রথম ভাগে মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলাটির পূর্ণ নাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবর রহমান গং মামলা‘। তবে এটি ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র‘ মামলা হিসেবেই বেশি পরিচিত। বিচার কাজ শুরু হয় ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন। বিচারকাজ শেষ হয়- ১৯৬৯ সালের ২২ জানুয়ারি। অভিযুক্তদের মামলা প্রত্যাহার করা হয় এবং সবাই মুক্তি পান।
বিচার কাজ চলে ঢাকা সেনানিবাসের সিগন্যাল অফিসার্স মেসে স্থাপিত বিশেষ আদালতে। ট্রাইব্যুনালে বিচারকদের মধ্যে একজন পশ্চিম পাকিস্তানি আর দুজন পূর্ব পাকিস্তানের। এরা হলেন পশ্চিম পাকিস্তানের এস এ রহমান (ট্রাইব্যুনাল প্রধান) আর পূর্ব পাকিস্তানের বিচারক এম আর খান ও বিচারক মুকুমুল হাকিম।
আসামিরা হচ্ছেন ক্রমান্বয়ে- ১. শেখ মুজিবুর রহমান ২. লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ৩. স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান ৪. এলএস সুলতান উদ্দিন আহমেদ ৫. নূর মোহাম্মদ ৬. আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি ৭. ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজুল্লাহ ৮ এ বি এম আবদুস সামাদ ৯. হাবিলদার দলিল উদ্দিন হাওলাদার ১০. রুহুল কুদ্দুস সিএসপি ১১. ফ্লাইট সার্জেন্ট মো ফজলুল হক ১২. ভূপতি ভূষণ চৌধুরী (মানিক চৌধুরী) ১৩. বিধান কৃষ্ণ সেন ১৪. সুবেদার আবদুর রাজ্জাক ১৫. হাবিলদার মুজিবুর রহমান ১৬. ফ্লাইট সার্জেন্ট আবদুর রাজ্জাক ১৭. সার্জেন্ট জহুরুল হক ১৮. এ বি মো. খুরশীদ ১৯. খান এম শামসুর রহমান সিএসপি ২০. রিসালদার এ কে এম শামসুল হক ২১. হাবিলদার আজিজুল হক ২২. মাহফুজুল বারী ২৩. সার্জেন্ট শামসুল হক ২৪. কর্নেল শামসুল আলম ২৫. মেজর মো. আবদুল মোতালেব ২৬. কর্নেল এম শওকত আলী ২৭. কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা ২৮. ব্রিগেডিয়ার এএনএম নুরুজ্জামান ২৯. ফ্লাইট সার্জেন্ট আবদুল জলিল ৩০. মো. মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী ৩১. লেফটেন্যান্ট এম এম মতিউর রহমান ৩২. সুবেদার এ কে এম তাজুল ইসলাম ৩৩. মো. আলী রেজা ৩৪. ব্রিগেডিয়ার খুরশীদ উদ্দিন আহমেদ ৩৫, কমান্ডার আবদুর রউফ। বৈরি সাক্ষীরা হলেন- ১. এ বি এম ইউসুফ ২. কামাল উদ্দিন ৩. বঙ্কিম চন্দ্র দত্ত ৪. আবুল হোসেন।
কৃতজ্ঞতা
২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে রাজধানীর গুলশানের নিকেতনে কমান্ডার আবদুর রউফের ছোট মেয়ে গীতালি হাসানের বাসভবনে তাঁর সাক্ষাতকার নেওয়া হয়। সেই সাক্ষাতকারের ভিত্তিতেই এই সংক্ষিপ্ত জীবনীটি লেখা হয়েছে।
এ ছাড়া ‘আগরতলা মামলার অনুচ্চারিত ইতিহাস ও শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক’ নামক গ্রন্থের সাহায্যও নেওয়া হয়েছে। আগরতলা মামলার অভিযুক্তদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে রচিত এই প্রামাণ্য গ্রন্থটির সম্পাদক ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন ও নাজনীন হক মিমি। এর মধ্যে নাজনীন হক মিমি শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের আপন ভাতিজি আর ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রভোস্ট। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রচিত এই বইটি প্রকাশ করেছে জার্নিম্যান বুকস (১০/৫ ইস্টার্ন প্লাজা, সোনারগাঁও রোড, ঢাকা ১২০৫)।
মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্টের উদ্যোগে কমান্ডার আবদুর রউফের জীবনভিত্তিক তথ্যচিত্র ।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্ট-চট্টগ্রাম কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়া সাক্ষাতকার।
এবং ২০১১ সালের ১১ নভেম্বর প্রকাশিত ‘কমান্ডার আবদুর রউফ সম্মাননা স্মারক’ গ্রন্থ।
লেখক- চন্দন সাহা রায়