দীর্ঘ বন্দি জীবনের ধকল তখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি আগরতলা মামলার ২৪ নম্বর অভিযুক্ত কর্নেল শামসুল আলম। এর মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। মার্চে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির ওপর আক্রমণ করে। কয়েকদিন পরেই বড় ভাই শামসুজ্জামানকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে যায়। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম টেলিফোন এক্সচেঞ্জের উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা। সেনাবাহিনী তাঁকে হত্যা করে। সেই শোক কাটিয়ে উঠার আগেই স্ত্রীর বড় বোনের স্বামী কাজী গোলাম আনসারকে তুলে নিয়ে যায়। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরের উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা। তাঁকে সভার কথা বলে ডাকবাংলোয় নিয়ে যায়। তিনি আর ফিরে আসেননি। যুদ্ধে এক ছেলে হারানো মা শামসুল আলমকে আগলে রাখেন। কোথাও যেতে দেবেন না।
প্রতিদিনই ঢাকা থেকে মানুষ চলে যাচ্ছে ভারতে। কুমিল্লা সীমান্ত দিয়েই বেশি যাচ্ছে। শামসুল আলমের শহর ছাড়ার কোনো উপায় নেই। মাত্র দুই মাস আগে ছেলে জন্ম নিয়েছে। ঘরে সদ্যপ্রসূতি স্ত্রী, ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে, বৃদ্ধ মা তাদের নিয়ে কোথায় যাবেন একা শামসুল আলম। যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরে আছেন, আর প্রতিদিন হত্যাযজ্ঞের খবর পাচ্ছেন।
জুনের প্রথম দিকে সবাইকে নিয়ে ঢাকার শান্তিনগরের বাসা থেকে ভারতের দিকে পথ দেন। বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে কুমিল্লা সীমান্ত পর্যন্ত যান। সেখানে গিয়ে খবর পান সামনে রাজাকারদের ব্যাপক নিরাপত্তা তল্লাশি। বাধ্য হয়ে আবার জীবন হাতে নিয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে শান্তিনগরের বাসায় উঠেন। সাতদিন পর বাসার পাশের দুটি ছেলে ভারত যাবে। তাঁরা আগেও ঘুরে এসেছে। তাদের সঙ্গে কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যান। তবে এবার একা, পরিবার রেখে যান ঢাকায়।
আগরতলায় গিয়ে কিছুদিন ছিলেন মেঘালয়ের কাছে বিডিএফ সদর দপ্তরে। পরে সেখান থেকে কলকাতা যান। গিয়ে হাজির হন থিয়েটার রোডে। সেখানে শামসুল হক সাহেবের (পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল হিসেবে অবসর নেন।) অধীনে কাজ শুরু করেন। মূলত কাজ ছিল প্রতিটি সেক্টরের চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে সীমিত সাধ্যের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। বিজয়ের আগ পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। এই সময়ে পরিবারের কোনো সংবাদ নিতে পারেননি। পরিবারও জানে না তিনি কোথায় আছেন।
২২ ডিসেম্বর থিয়েটার রোডে বসে আছেন। এ সময়ে এ কে খন্দাকর এসে জানালেন, একটি ছোট উড়োজাহাজ ঢাকা যাচ্ছে তিনিও চাইলে যেতে পারেন। তৎক্ষণাৎ তৈরি হয়ে উড়োজাহাজে এসে উঠলেন। সেখানে ব্যারিস্টার আবুল মনসুর (মেজর জেনারেল মঞ্জুরের ভাই), আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাকসহ কয়েকজন ছিলেন।
পকেটে কোনো পয়সা নেই। বাসায় যাবেন কীভাবে। ব্যারিস্টার মনসুরকে বলেলেন। মনসুর বললেন, চিন্তা নেই। আমার কাছে পয়সা আছে। চলেন আপনাকে বাসায় দিয়ে আমি বাসায় ফিরব। শান্তিনগরে নেমে এক আজানা আতঙ্কে মন কেঁপে উঠল। জানেন না পরিবার কেমন আছে, আদৌ আছে কিনা, বাসায় গিয়ে কী দেখবেন? ভয়ে ভয়ে বাসার দিকে যাচ্ছেন আর এসব ভাবছেন। এর মধ্যেই পাড়ার একটা ছেলে ডাক দিয়ে বলল, ভাই কি এখন আসলেন। যান বাসায় যান। সবাই ভাল আছে।
এটা শুনে বুক থেকে যেন পাথর নেমে গেল কর্নেল শামসুল আলমের।
কর্নেল শামসুল আলমের জন্ম ব্রিটিশ ভারতে, ঢাকায় ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি। মা রওশন আক্তার ছিলেন ঢাকার মেয়ে। লালবাগে তাঁদের আদি বাড়ি। সেখানেই নানাবাড়িতে তাঁর জন্ম। বাবা শামসুজ্জোহা যদিও উত্তরবঙ্গের রংপুরের মানুষ। কিন্তু কাজের সূত্রে থাকতেন কলকাতায়। সেখানকার চিৎপুর রেলওয়ে হাসপাতালে মেডিকেল কর্মকর্তা ছিলেন।
সবার বড় বোন তৈয়বা বেগম। বড় ভাই শামসুজ্জামান, মেঝ ভাই শামসুল ইসলাম আর শামসুল আলম সবার ছোট। লেখাপড়ার শুরু কলকাতার শ্যামবাজারের ডাফ স্কুলে। এটা মিশনারিদের একটি স্কুল ছিল। সেখানে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর চলে যান স্কটিশ চার্জ কলেজিয়েট স্কুলে। শামসুল আর তার মেঝ ভাই একই ক্লাসে পড়তেন। বেশ স্বচ্ছল পরিবার ছিল। সেই ১৯৩০ এর দশকের শেষ দিকে পরিবারের গাড়ি করে তারা স্কুলে যেতেন। দুর্ভাগ্যবশত ১৯৪০ সালে প্যারাটাইফয়েট রোগে ডা. শামসুজ্জামান মারা যান। তখন পরিবার অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়। মা সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় বাবার বাড়ি চলে আসেন। এখানে আবার নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে মেট্রিক পাস করেন। শামসুল আলমের পরিবার ঢাকায় আসার পরও ব্রিটিশ ভারত সাত বছর ছিল। সেই সময়ে ব্রিটিশবিরোধি আন্দোলনের বিভিন্ন কাহিনী ক্ষুদিরাম বসু, মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার এসব বিপ্লবীদের জীবনী তাঁকে খুব টানত। পুরান ঢাকার সেই রক্ষণশীলতার মধ্যেও শামসুল আলমের পরিবারের একটা সাংস্কৃতিক আবহ ছিল। ভাইবোনেরা কেউ নিয়ম করে গান শেখেনি কিন্তু সবাই কমবেশি গাইতে পারত, এর প্রতি ঝোঁক ছিল। এর মধ্যে ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা হল। হত্যা, ধ্বংস, দেশভাগ, একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সাক্ষী শামসুল আলম।
১৯৫০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৫১ সালে চিকিৎসাবিদ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন। সেই সময়টায় পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চলছে। সেখানে বেশ ভালভাবেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। সে কারণে নির্দিষ্ট সময়ের দুই বছর পর ১৯৫৭ সালে এমবিবিএস পাস করে বের হন। ডাক্তারি পাস করে বের হওয়ার পর তিনি ‘মাটির পাহাড়’ নামে চলচ্চিত্র নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বিনোদন পত্রিকা চিত্রালীর সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ ছিলেন তাঁর বন্ধু। তাঁর সূত্রেই সেই সময় তিনি ওই চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। পরিচালক ছিলেন মহিউদ্দিন। সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকও এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কাফে খান আর সুলতানা জামান ছিলেন ছবির নায়ক-নায়িকা। চিত্রালী পত্রিকা যখন বের হয় তখন শামসুল আলমও এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অন্য অনেকের মতো মুসলমানের জন্য আলাদা দেশ, পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি শামসুল আলমেরও সহমর্মিতা ছিল।
মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না শামসুল আলম। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ে নানা কর্মকাণ্ডে তিনি নিয়মিত ছিলেন। কলেজে ভর্তি হওয়ার এক বছরের মাথায় ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্তের মিছিলে যোগ দেন। পরে মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে অংশ নেন। সেই সময় মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে নির্মাণকাজ চলছিল। ঠিকাদার ছিলেন পুরান ঢাকার পিয়ারু সরদার। সেখান থেকেই মালপত্র নিয়েই রাতের মধ্যে তৈরি করা হল প্রথম শহীদ মিনার। অগ্রজ ডা. বদরুল আলম এর ডিজাইন করেছিলেন। এসব কাজের সঙ্গে একজন নেতৃস্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে সরাসরি ভূমিকা রাখেন। পরে তো সেই শহীদ মিনার পকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভেঙেই দিল।
শামসুল আলমের এখনো মনে আছে, ১৯৪৮ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদে আজম জিন্নাহ প্রথাবারের মতো পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। তখন শামসুল আলম ঢাকা কলেজের ছাত্র। জিন্নাহ তখন পাকিস্তানের একচ্ছত্র নেতা। সবার সঙ্গে তিনিও তখনকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে গেলেন জিন্নাহকে দেখতে। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে জিন্নাহকে দেখলেন। কিন্তু পরে জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে যখন ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ বলে বক্তব্য দিলেন, তখন জনতা এর প্রতিবাদে দাঁড়িয়ে গেল। সেদিন শামসুল আলম ডায়াসের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। জিন্নাহর ওই বক্তব্য শোনার পর ভাষণ শেষ না করেই বাসায় ফিরে আসেন, পাকিস্তানের প্রতি তাঁর মোহ ভেঙে যায়। মেডিকেলে পড়তে এসে ধীরে ধীরে অনুভব করতে পারেন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটা থেকে যেন ধর্মের বাঁধন আলগা হয়ে যাচ্ছে। পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক আর সামাজিক বৈষম্যই যেন বাঙালির মধ্যে রাষ্ট্রটি সম্পর্কে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়।
১৯৫৭ সালে ডাক্তারি পাস করার পর ১৯৫৯ সালে মেডিকেল কলেজের বাঙালি বড় ভাইদের উৎসাহ আর এক ধরনের রোমান্টিসিজমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে ভর্তি হন। ঢাকায় যোগদানের পরই তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হল পশ্চিম পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে। সেখানে সংক্ষিপ্ত বেসিক প্রশিক্ষণের পর রাওয়ালপিন্ডিতে প্রফেশশনাল প্রশিক্ষণ নেন। অ্যাবোটাবাদ আর রাওয়ালপিন্ডিতে থাকতেন ব্যাচেলর মেসে। সেখানে বেশিরভাগই পাঞ্জাবি কর্মকর্তা, হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র বাঙালি। এই সময়টা বাঙালিদের প্রতি পাঞ্জাবিদের যে ঘৃণার মনোভাব সেটা আরো স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন। একই রাষ্ট্রের, একই ধর্মের মানুষ হলেও পাঞ্জাবিরা কখনো বাঙালিদের প্রতি সদাচরণ করত না। সবক্ষেত্রে পাঞ্জাবিদের মানসিক উৎপীড়নের শিকার হতেন বাঙালিরা। একদিন শামসুল আলম আর তাঁর এক বাঙালি বন্ধু ডাইনিংয়ে বসে বাংলায় কথা বলছিলেন। অপরদিকে বসে পাঞ্জাবি ভাষায় গল্প করছিলেন দুই পাঞ্জাবি কোর্সমেট। হঠাৎ করেই তাদের একজন বলে বসলেন, এই তোমরা বাংলায় কথা বলছ কেন? এখানে তো বাংলায় কথা বলা যাবে না, তোমরা ইংরেজিতে কথা বল। এটা শুনে শামসুল আলম অবাক হলেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, এই তোমরা কী ভাষায় কথা বলছ। তাঁরা বলে, পাঞ্জাবি। শামসুল আলম তখন তাদের বলেন, আমরা তো পাকিস্তানের অন্যতম একটি মাতৃভাষায় কথা বলছি, আর তোমারা যে ভাষায় কথা বলছ সেটা তো কোনো ভাষাই না, এটা ডায়ালেক্ট মাত্র। এই কথা বলার পর দুই পাঞ্জাবি চুপ মেরে যায়।
এরকম ছোট-বড় অসংখ্য ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত পশ্চিম পাকিস্তানিদের সম্পর্কে একটা নেতিবাচক মনোভাব শামসুল আলমের মধ্যে জন্ম নিতে থাকে। এর মধ্য দিয়ে ক্ষোভও তৈরি হয়। বুঝতে পারেন, এভাবে এত বৈষম্য নিয়ে একটি রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারেন না। দুই জায়গায় প্রশিক্ষণ শেষ করে গিয়ে যোগ দিলেন কোয়েটায়, সেখান থেকে ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্সের নওসেরার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে কিছুদিন কাজ করেন। পরে তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয় পাকিস্তানের অ্যাটাকফোর্ডে বিশেষ কমান্ডো বাহিনী স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপে (এসএসজি)। সেখানেই শামসুল আলমের সঙ্গে দেখা হয় খালেদ মোশাররফের সঙ্গে। যদিও তাঁর সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল। কিন্তু এবার দেখা হলে দুজনেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলেন এবং পাকিস্তান সম্পর্কে দুজনের মনোভাব প্রায় একইরকম।
পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর চিকিৎসক বন্ধু খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ (পরে ব্রিগেডিয়ার হিসেবে অবসর নেন) তখন করাচিতে থাকেন। ঢাকায় থাকাকালীন দুজন ছিলেন হরিহর আত্মা। খুরশিদ চিঠি দিয়ে শামসুল আলমকে করাচিতে যেতে বলেন। জানালেন, তাঁর সঙ্গে জরুরি কথা আছে, কাজ আছে। একবার ছুটি নিয়ে করাচি যান শামসুল আলম। উঠেন গিয়ে খুরশিদের এখানে। একদিন সন্ধ্যায় খুরশিদ বললেন, চল তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাই। কথা আছে। শামসুল আলমকে তিনি নিয়ে গেলেন নৌবাহিনীর কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের বাসায়। সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়। একপর্যায়ে কমান্ডার মোয়াজ্জেম শামসুল আলমকে বলেন, দেখুন, আমরা তো একটা কিছু করতে চাই। যদি আমরা কিছু করতে চাই তাহলে আপনি কি আমাদের সাহায্য করবেন? শামসুল আলম কোনোকিছু না ভেবেই জবাব দিলেন, হ্যাঁ নিশ্চয়ই করবো।
শামসুল আলম আসলে বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতা সম্পর্কে এই প্রথম পরিপূর্ণভাবে অবগত হলেন। নিজের মনের ভেতর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন সম্পর্কে যে ক্ষোভ ছিল তাতে তিনি নিজেও কিছু একটা করার মনোভাবে ছিলেন। কামন্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাত তাতে যেন কিছুটা উৎসাহই দিল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১৯৬৪ সালের মাঝামাঝি ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে বদলি হয়ে আসলেন। ১৯৬৫ সালে যখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয় তখন তাঁকে একটি সেনা ব্যাটালিয়নের সঙ্গে সিলেট সীমান্ত এলাকায় বদলি করে দেওয়া হয়। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর অসুস্থ হয়ে গেলে ঢাকায় ফিরে আসেন। এ সময় বিয়ে করেন। তারপর ১৯৬৬ সালে আবার বদলি হয়ে কুমিল্লায় চলে গেলেন রিক্রুটিং দলের সদস্য হিসেবে। পরিবার নিয়েই সেখানে থাকেন। কর্নেল শওকত আলী (সাবেক ডেপুটি স্পিকার) সহ বেশ কয়েকজন বন্ধু নিয়মিতই বাসায় আড্ডা দিতেন। সেখানে রাজনৈতিক আলোচনাই মূলত হত। আরও বাঙালি সেনাদের কীভাবে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত করা যায় তার আলোচনাও করতেন। পরিবারকে এসব বিষয় সম্পর্কে না জানালেও স্ত্রী হয়তো কিছুটা বুঝতে পারতেন।
এই সময়ই বন্ধু খুরশিদের কাছ থেকে একটি চিঠি পান। খুরশিদ জানিয়েছেন, কমান্ডার মোয়াজ্জেম বদলি হয়ে চট্টগ্রাম চলে আসছে। তাঁকে যেন শামসুল আলম সাহায্য করেন। এর মধ্যেই একদিন মোয়াজ্জেমের টেলিফোনও পান। কাজের সুবাদে তখন শামসুল আলমকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে হয়। এর মধ্যে একদিন চট্টগ্রাম গিয়ে কৌশলে কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গেও সাক্ষাত করেন। সেই সময়ই কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন বিষয়টি নিয়ে পরিপূর্ণভাবে বলেন। তিনি স্পষ্ট করেই বললেন, বাঙালি সেনা সদস্যদের মাধ্যমে একটি সশস্ত্র অভ্যূত্থান ঘটিয়ে দেশকে স্বাধীন করতে চান। মোয়াজ্জেম তাঁকে কুমিল্লা অঞ্চলের দায়িত্ব নিতে বলেন। সেখানে সেনা সদস্য ও কর্মকর্তাদের মোটিভেট করার দায়িত্ব সানন্দে নিয়ে নেন শামসুল আলম।
দায়িত্ব নিয়ে আসার পর শওকত আলী, ইপিআরের ক্যাপ্টেন মোত্তালেব, আলিম ভূঁইয়া (পরে আগরতলা মামলায় রাজসাক্ষী হয়) সহ আরো অনেক বাঙালি কর্মকর্তাকে শামসুল আলম এ কাজের সঙ্গে যুক্ত করেন। কর্নেল হুদা, আইএসআইয়ের নুরুজ্জামান এরা ঢাকায় থাকলেও তাদের সঙ্গেও যুক্ত হয়। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নানা সময়েই পিকনিকের আয়োজন করা হত। আদতে তখন তাঁরা তাদের অভ্যূত্থান নিয়েই কথা বলতেন।
সেনাবাহিনীর সব অস্ত্র রাখা হত এক জায়গায়, এটাকে বলা হয় কোত। বাঙালি সেনা সদস্যরা নির্দিষ্ট একটি দিনে সেই কোত দখল করে নেবেন তারপর পাঞ্জাবি সেনা সদস্য, কর্মকর্তাদের আত্মসমর্পনে বাধ্য করা হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকে এর সঙ্গে যুক্ত করা হবে।
১৯৬৭ সালের মাঝামঝি আইএসআইয়ের নুরুজ্জামান খবর পাঠল, বিষয়টি বোধ হয় কিছুটা জানাজানি হয়ে গেছে। এখন কিছুদিন চুপচাপ থাকতে হবে। এ নিয়ে তদন্ত হতে থাকলো। এই বছরের শেষ দিকে খবর পেতে থাকলেন কিছু কিছু বাঙালি কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা শুরু হয়ে গেছে। তখন শামসুল আলমও ধরে নিলেন, তিনিও যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হয়ে যেতে পারেন। এই অবস্থার মধ্যেই বছরের শেষ দিকে তিনি একটি কোর্স করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের পিন্ডিতে চলে যান পরিবার নিয়ে। তখন এক মেয়ের জন্ম হয়েছে। তার বয়স এক বছর। এএমসিতে অন্য চিকিৎসকদের সঙ্গে থাকেন। একদিন বিকেলে ক্লাস শেষে বাসায় ফেরার পথে দেখলেন লনে কিছু বাঙালি জড়ো হয়ে গল্প করছে। তাঁরা জানাল, ক্যাপ্টেন হুদাকে গ্রেপ্তার করে এখানেই এনে রাখা হয়েছে। শামসুল আলম তাদের কিছু বললেন না, মনে মনে ধরে নিলেন তাঁরও সময় হয়ে এসেছে। বাসায় এসে শান্তভাবে কাপড়-চোপড় বদলিয়ে স্ত্রীকে বলেলেন, দেখো, ক্যাপ্টন হুদাকে গ্রেপ্তার করেছে। হয়তো আমাকেও করবে। তুমি মানসিকভাবে তৈরি থেক। রাতে খাবার-দাবার শেষ করে বিছানায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এ সময় একজন মেজর এসে পরিচয় নিশ্চিত হয়ে বলল, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।
শামসুল আলমকে নিয়ে রাখা হল অফিসার্স মেসে। সেখানে তিনি একা আর কেউ নেই। তারপর শুরু হল শারীরিক আর মানসিক নির্যাতন। শারীরিকের চেয়ে মানসিক নির্যাতনটাই ছিল বেশি। সন্ধ্যায় হয়তো ধরে নিয়ে গেছে, গভীর রাতে আবার মেসে এনে দিয়ে গেছে। বলল, এখন খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমান। ঘুমাতে যাব এসময় আবার তুলে নিয়ে গেছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। সারা রাত ধরে চলল সেই জিজ্ঞাসাবাদ। যেসব কথা জিজ্ঞাস করে সবই তো ঠিক। তারপর এক ম্যাজিস্টেটকে এনে একটা জবানবন্দি তৈরি করে তাতে স্বাক্ষর নিয়ে নেয়। তারপর ১৯৬৮ সালের প্রথম দিকে ঢাকায় নিয়ে আসে। যে বিমানে করে শামসুল আলমকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় একই বিমানে কর্নেল শওকত আলীও ছিলেন। তবে কাউকে কারো সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। ঢাকায় এনে রাখা ডিভ অফিসার্স মেসে। এর কিছুদিন পরে মামলা শুরু হয়ে যায়। মামলায় মোট ৩৫ জনকে আসামি করা হয়। বঙ্গবন্ধু এই মামলার এক নম্বর আসামি। আর বৈরি সাক্ষী ছিলেন চারজন।
সশ্রস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্য ও বেসামরিক লোকদের গ্রেপ্তারের পর প্রথমদিকে তাঁরা পরিবার থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাদের দেখা করতে দিত না, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা জানতেও পারতেন না তাঁরা কোথায় আছে। কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন শামসুল আলম। গ্রেপ্তারের কয়েকদিন পর তাঁর স্ত্রী পাকিস্তান ইন্টিলিজেন্স অফিসে গিয়ে বললেন, আমি আমার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। তারা তো দেখা করতে দেবেন না। স্ত্রী তখন হুমকি দিয়ে বললেন, দেখ, তোমরা যদি দেখা করতে না দাও তো আমি প্রেসিডেন্টের কাছে যাব। তিনি পড়াশোনা করেছিলেন পিন্ডিতে, প্রেসিডেন্ট আউয়ুব খানের এক মেয়ে তাঁর সহপাঠী ছিলেন। এসব শুনে কর্মকর্তারা একটু ঘাবড়ে গেলেন। যাই হোক শেষ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানেই আটক থাকা অবস্থায় শামসুল আলমের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী দেখা করতে পেরেছিলেন। তবে শর্ত ছিল, বাংলায় কথা বলা যাবে না, উর্দু বা ইংরেজিতে কথা বলতে হবে।
ঢাকায় আনার পর কিছুদিন শামসুল আলম, কর্নেল শওকত আর খুরশিদকে এক কক্ষে রাখা হয়। তারপর শামসুল আলমকে নিয়ে যাওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কক্ষে। এই প্রথম তিনি বঙ্গবন্ধুকে দেখলেন। পুরো সময়টা তিনি তাঁর সঙ্গেই ছিলেন। এটি কর্নেল শামসুল আলমের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কারাজীবন
কক্ষে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই বঙ্গবন্ধু শামসুল আলমের কাছে আসলেন। বললেন, ‘মেজর সাহেব আপনার তো জেলটেল খেটে অভ্যাস নেই। আমার জেল খেটে অভ্যাস। ভিতরে আমার একটা টাঙ্ক আছে, ওঠার মধ্যে আপনি সব পাবেন। বিছানার চাদর, বালিশের কভার, ধোয়া লুঙ্গি থেকে সুইসূতা পর্য আপনি পাবেন।’
বঙ্গবন্ধুকে রাজনৈতিক নেতার চাইতে একজন মানবিক মানবতাবাদী মানুষ হিসেবে বেশি মূল্যায়ন করেন মেজর শামসুল। সেই সময়ে তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন ফাঁসি নিশ্চিত হবে। বাঁচার কোনো উপায় নেই। স্ত্রী, ছোট একটা বাচ্চা তাঁর জন্য কী করতে পারবে? সবাই হতাশ। অথচ এই অল্প সময়েই বঙ্গবন্ধু শামসুল আলমকে আপনি থেকে তুমি, তুমি থেকে তুই পর্যন্ত সন্বোধন করলেন। তিনি পাইপ আর এরেনমোর খেতেন। রাতে অনেক সময় শামসুল সেসব সাফ করে দিতেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু প্রথম দিনেই সতর্ক করে দেন, ‘কোনো রাজনৈতিক আলোচনা এখানে করা যাবে না।’ তিনি অনেক ব্যক্তিগত বিষয়, পারিবারিক বিষয়াদি শেয়ার করতেন। শামসুল আলমকে সান্ত্বনা দিতেন।
একটা কথা বঙ্গবন্ধু সব সময় শামসুল আলমকে বলতেন, ‘এরা আমাকে আটকায়ে রাখতে পারবে না। তোরাও ছাড়া পাবি। কিচ্ছু হবে না, ঘাবড়াইছ না। ’
শামসুল আলমের ভাষায়, ‘বঙ্গবন্ধুর কথা শুনে, নিজের হাতাশা কেটে গেল। আমার মেয়েটা যখন মার সঙ্গে আমার এখানে আসত, আমার স্ত্রীর পাশ দেখাতে একটু দেরি হত, কিন্তু বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে আমার ঘরের দরজায় চলে আসত। বঙ্গবন্ধু তাঁকে কোলে নিয়ে আদর করতেন। আমার মেয়েকে তিনি ‘পুতুল’ বলতেন। আর আমাকে বলতেন, ‘যা তোরা কথা বল গিয়া। আমি ওকে দেখছি।’ আমার স্ত্রীকেও তিনি খুব স্নেহ করতেন।’
মেসের খাবার বঙ্গবন্ধু পছন্দ করতেন না। তখন ঘরের খাবারের ব্যবস্থা করা যায় কিনা, সেই চেষ্টা করলাম। স্ত্রীকে বললাম, ওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে হিটারের ব্যবস্থা করে দিতে পারে কিনা? হিটারের ব্যবস্থা হওয়ার পর বাইরে থেকে চাল, ডাল, ডিম, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ এসব এনে আমি রান্না করতাম। মেসের খাবারের একঘেয়েমির মধ্যে এটা সুস্বাদু মনে হত।’
একদিন একটা মজার ঘটনা ঘটল। বাঙালি মেজর শফিকুর রহমান নিয়মিত বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে আসতেন। চিকিৎসকদের হয়ত নির্দেশ দেওয়া ছিল, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাংলায় কথা বলা যাবে না। তাঁরা ঊর্দুতে কথা বলতেন। একদিন পরীক্ষা-নীরিক্ষা শেষে যাবার সময় চিকিৎসক বঙ্গবন্ধুকে বলছেন, শেখ সাব মুছে এজাজাত দিজে (শেখ সাব আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিন)। বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘ভাই আপনারে আমি এজাজাত-ফেজাজাত দিতে পারুম না। আপনি যাইতে চান, আপনি আসেন।’
মামলা চলাকালীন বঙ্গবন্ধুর পাশে বসেই আদালতে যেতেন শামসুল আলম। তখন সব আসামি মিলে ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’ গানটা গাইতেন। বঙ্গবন্ধু সবাইকে গলা মেলাতে বলতেন। তাঁর প্রিয় লাইনগুলো ছিল- ‘ভায়ে ভায়ে এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেউ/ ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি/ আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি’, তিনি গভীরভাবে তাতে গলা মেলাতেন।
সেই সময়ের একটি ঘটনা। আসামিদের নিরাপত্তার জন্য স্থায়ীভাবে কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করতেন। দায়িত্বে থাকা আজাদ-কাশ্মীরের একজন লেফটেন্যান্ট ক্যাম্পে আসতেন। তিনি আবার ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধুকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। তিনি এসে মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গল্প করতেন, শহর থেকে খাবারও নিয়ে আসতেন। মামলা চলাকালীন আদালতের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুকে বিকেলে কিছুটা সময় বাইরে হাঁটতে দেওয়া হত। লেফটেন্যান্ট বঙ্গবন্ধুকে একদিন বললেন, ‘আপনি কাল থেকে আর দেওয়ালের বাইরে যাবেন না।’ বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলেন, ‘কেন?’ লেফটেন্যান্ট বললেন, ‘আমি একটা পরিকল্পনা আঁচ করতে পারছি, আপনি যখন হাঁটতে বেরোবেন তখন আপনাকে গুলি করবে আর রটিয়ে দেওয়া হবে আপনি পালাতে চাইছিলেন।’ সেদিন লেফটেন্যান্ট এটাও জানিয়ে গেলেন, তিনি ছুটিতে বাড়ি যাবেন। পরে এসে আবার দেখা হবে।
পরদিন বঙ্গবন্ধুকে দেওয়ালের বাইরে হাঁটতে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল সেখানে দায়িত্বে থাকা সেনা কর্মকর্তারা। তবে তিনি কৌশলে বাইরে না গিয়ে লনের মধ্যেই হাঁটাহাঁটি করেন।
আজাদ-কাশ্মিরি সেনা কর্মকর্তার পরিবর্তে অন্য একজন পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হল। তিনিও বঙ্গবন্ধুর প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। একদিন পরেই সেই কর্মকর্তা এসে জানালেন, এখানে যে আজাদ-কাশ্মিরি লেফটেন্যান্ট দায়িত্বে ছিলেন তিনি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
বঙ্গবন্ধু ও শামসুল আলম জানতে চাইলেন, কীভাবে মারা গেছেন?
সেই কর্মকর্তা প্রথমে বললেন, ‘শিকারে যাবেন বলে বিছানায় বসে রাইফেলের নল পরিষ্কার করছিলেন। হঠাৎ ট্রিগারে চাপ লেগে গুলি বেরিয়ে যায়, গুলি বুক দিয়ে বেরিয়ে যায়।’
এই কথা বলার পর পরই পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা আবার বললেন, ‘কীসের দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, ওরে তো মারা হয়েছে। কারণ, তিনি আপনাদের একটি তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন। আর সেটা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর বাইরে হাঁটতে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে।’
তার কয়েকদিন পরেই তো সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হল।একদিন ভোর বেলা সার্জেন্ট জহুরুল হক, সার্জেন্ট আহমেদ ফজলুল হক আর একজন বাইরে বের হলেন। এই সময়টায় বন্দিরা বাথরুমে যেতেন, ওজু সেরে নামাজ পড়তেন। তখনি নিরাপত্তারক্ষীরা সার্জেন্ট জহুরুল হক আর আহমেদ ফজলুল হককে গুলি করে, তাদেরকে বেয়নেট দিয়ে আঘাত করা হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর সার্জেন্ট জহুরুল হক মারা যান আর ভাগ্যক্রমে আহমেদ ফজলুল হক বেঁচে যান। এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে সারা বাংলায় মানুষ পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেন। যার সূত্র ধরে আইয়ুব খান এই মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন এবং ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এই মামলার সব আসামি মুক্তি পান।
এর একদিন আগে ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে মেজর নাসের এসে বঙ্গবন্ধুকে বললেন তাঁর সঙ্গে যাওয়ার জন্য। কিসের জন্য নিয়ে যাচ্ছে সে ব্যাপারে অবশ্য একটু ইঙ্গিতও দিলেন। যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু শামসুল আলমকে বললেন, ‘ভিতরে ট্রাঙ্কের মধ্যে আমার স্যুট আছে, এগুলো একটু আয়রন করে রাখিছ। কেইস উইড্র হয়ে যেতে পারে। এমনও হতে পারে, কাল খুব সকালেই হয়তো আমাকে পিন্ডি যেতে হতে পারে।’ খাওয়া-দাওয়া করে তিনি ১০টার দিকে ঘুমিয়ে গেলেন। রাত ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু ফিরে আসলেন। তাঁর সঙ্গে মেজর নাসের। নাসের এসেই শামসুল আলমকে জড়িয়ে ধরে উর্দু ভাষায় বললেন, ‘কেইস উইড্র হয়ে গেছে। কাল থেকে তোমরা মুক্ত।’ এ সময় বঙ্গবন্ধুও তাকে বললেন, ‘কেইস তো উইড্র হয়ে গেছে। কাল ভোরেই হয়তো আমাকে নিয়ে যাবে। তুই সবাইকে বিষয়টি জানাস। হয়তো সবাই এমনিতেই জেনে যাবে।’
জেল থেকে বেরিয়ে শান্তিনগরে পরিবারের কাছে গেলেন শামসুল আলম। কিন্তু চাকরিতে আর ফিরতে পারলেন না। বাধ্যতামূলক অবসর দিয়ে দিল। কিছুদিন সিটি করপোরেশনে অস্থায়ী চাকরি করলেন, ব্যবসাও করলেন। কিন্তু কোথাও স্থায়ী হতে পারলেন না। সংসার চালানোর জন্য স্ত্রীও একটি স্কুল চালু করলেন।
স্বাধীনতার পরে এসে আবার সেনাবাহিনীতে কাজে যোগ দেন। সেই সময় সেনাবাহিনী থেকে পেনশন কমিট করে প্রায় ২০-২৫ হাজার টাকা নিয়েছিলেন। কর্নেল শওকতও এভাবে টাকা তুললেন। কথা ছিল প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে কেটে নেবে। তখন বেতন ছিল ৯০০ টাকা। ফলে মাস শেষে বেতন পেতেন চারশ টাকা। এই টাকা দিয়ে তো সংসার চলে না। একদিন দুই বন্ধু বঙ্গবন্ধুকে গিয়ে বললেন, এই টাকা দিয়ে তো সংসার চলে না। পেনশন কমিট করে যে টাকা তুলেছি, সেটা মাফ করে দেন। বঙ্গবন্ধু একটু ভেবে বললেন, ‘এটা বাজে দৃষ্টান্ত হবে। আমি এটা করতে পারব না। তবে হ্যাঁ, একটা কাজ করতে পারি। তোরা প্রতি মাসে ১০ টাকা করে দিবি। যতদিন টাকা শেষ না হয়, ততদিন তোদের এই টাকা দিয়ে যেতে হবে।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, কর্নেল তাহের হত্যার পর আর সেনাবাহিনীর চাকরিতে থাকা সমীচিন মনে করলেন না। চাকরি ছেড়ে দিয়ে লিবিয়ায় চলে গেলেন। সেখানে প্রায় তিন বছর কাজ করে দেশে ফিরেন। এরপর টুকটাক কিছু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হন।
শামসুল আলম ১৯৬৬ সালের ২৮ জানুয়ারি জরিন আহমেদকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির এক ছেলে আর এক মেয়ে। বড় মেয়ে শারমিন শাহনাজ মোসাদ্দেক ঢাকায় স্থায়ী। আর ছোট ছেলে সালমান শাহজাদ আলম আমেরিকায় পড়াশোনা শেষ করে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে স্থায়ী হয়েছেন। সেখানে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করেন। স্ত্রী জরিন আহমেদ বছর দুই আগে মারা গেছেন।
তথ্যসূত্র: ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কর্নেল শামসুল আলমের গুলশান-১ নম্বরের বাসায় নেওয়া সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে জীবনীটি লেখা হয়েছে।
এ ছাড়া কিছু তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে ‘আগরতলা মামলার অনুচ্চারিত ইতিহাস ও শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক’ নামক গ্রন্থ থেকে। আগরতলা মামলার অভিযুক্তদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে রচিত এই প্রামাণ্য গ্রন্থটির সম্পাদক ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন ও নাজনীন হক মিমি। এর মধ্যে নাজনীন হক মিমি শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের আপন ভাতিজি আর ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রভোস্ট। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রচিত এই বইটি প্রকাশ করেছে জার্নিম্যান বুকস (১০/৫ ইস্টার্ন প্লাজা, সোনারগাঁও রোড, ঢাকা ১২০৫)।