পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি, ক্লেটন কোয়াটার্স, বাসা নম্বর জি-১৪/৪। ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের এক রাত।
পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বেইজ করুঙ্গিক্রিক থেকে কিছুটা দূরে করাচি শহরের একটি আবাসিক এলাকায় সার্জেন্ট আব্দুল জলিল স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে খাবার টেবিলে বসেছেন। রাত তখন প্রায় ৮টা। এমন সময় কলিং বেলের শব্দ। জলিল সাহেবের হাত থেমে গেল। পরিবারের অন্য কেউ ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও তিনি বুঝতে পারলেন। সবাইকে টেবিলে বসিয়ে রেখে নিজেই চাবিটা নিয়ে দরজা খুলতে গেলেন। বাইরে পুলিশের সদস্যরাই বেল বাজিয়েছে। জলিল সাহেব নিশ্চিত হয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। তাই হলো, বিমান বাহিনীর পুলিশ সদস্যরা বাড়ি ঘিরে রেখেছে। কয়েকজন এসেছে বাড়ির দরজায়। তাদের একজন ওয়ারেন্ট অফিসার ওসমানী। তিনি সার্জেন্ট জলিলকে তাদের সঙ্গে করাচি শহরেই বিমান বাহিনীর পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। জলিল সাহেব যাওয়ার জন্য মনে মনে তৈরি হয়েই ছিলেন। চাবিটা রেখে কাপড়টা পাল্টে আসার অনুমতি চাইলেন। পুলিশ অনুমতি দিল। পেছনে পুলিশ নিয়ে এসে তিনি ঘরের ভেতর ঢুকলেন। পুলিশ তখন গোটা বাড়ি সার্চ করা শুরু করে দিল। বাড়ির সব কক্ষ খুঁজে দেখল তারা, কোথাও কিছু পেল না। কিন্তু ড্রয়িং রুমের কক্ষের শোকেশ থেকে একটি গ্রেনেড জব্দ করল। এলাকার জনপ্রতিনিধিকে ডেকে একটি জব্দ মালামালের তালিকা তৈরি করা হল। জলিল সাহেব কথা না বাড়িয়ে নিজের শয়নকক্ষে গিয়ে পোশাক পাল্টালেন, স্ত্রীর হাতে চাবির গুছাটা দিলেন। তারপর স্ত্রীকে বললেন, ‘যদি আল্লাহ হায়াত রাখে তাহলে ফিরে আসব। না আসলে মনে করবা দেশের জন্য শহীদ হয়ে গেছি।’
স্ত্রী-সন্তানদের চোখে পানি। পূর্ব পাকিস্তানকে অস্ত্র ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের জন্য যে উদ্যোগ বাঙালি সামরিক কর্মকর্তারা নিয়েছিলেন, ১৯৬৪ সালের শেষ দিক থেকে সেই কর্মকাণ্ডের ‘প্রথম অস্ত্র প্রশিক্ষণকেন্দ্র’ ছিল জলিল সাহেবের এই বাড়িটি। এই বাড়িটির বৈশিষ্ট হচ্ছে, এটি সামরিক এলাকার বাইরে আবাসিক এলাকায়। যদিও সেখানে আর কোনো বাঙালি পরিবার নেই। গোয়েন্দা-দৃষ্টি এড়ানোর জন্য এটি একটি ভাল জায়গা ছিল। তিন বছরের মতো এখানে পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত বাঙালি সেনা ও সিভিল কর্মকর্তাদের বিপ্লবী অংশ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণ দিয়েছেন সার্জেন্ট জহুরুল হক। তিনিও গ্রেপ্তার হয়েছেন।
পুলিশ সেদিন ভাতের থালা থেকে সার্জেন্ট জলিলকে তুলে এনে বরফের পাট্টার উপর ফেলে দিয়েছিল, হাত-পায়ের নখের ভিতর দিয়ে গড়গড়া আগুনের সুঁই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। অসহ্য নির্যাতন তবু তাঁকে মাথা নত করানো যায়নি।
সার্জেন্ট আব্দুল জলিলের জন্ম নরসিংদীর বেলাব থানার সলরাবাদ ইউনিয়নের সররাবাদ গ্রামে ১৯৩৫ সালের ২০ মার্চ। বাবা মো. আবদুল কাদির ছিলেন অবস্থাসম্পন্ন কৃষক। পাশাপাশি তিনি ধানের ব্যবসাও করতেন। সিলেট অঞ্চল থেকে ধান কিনে এনে তিনি কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, আশুগঞ্জ ইত্যাদি স্থানে বিক্রি করতেন। মা মিসেস রহিমা খাতুন গৃহিনী। চার ভাই এক বোনের মধ্যে আব্দুল জলিল সবার বড়। পরিবারটিতে লেখাপড়ার বেশ চল ছিল। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলেই তার হাতেখড়ি। পরে তিনি নদীর ওপারে নারায়ণপুর শরাফাত উল্লাহ হাই স্কুলে ভর্তি হন। একই স্কুলে পড়তেন কবি আলাউদ্দিন আল আজাদও। স্কুলের হেড পণ্ডিত (বাংলা ও অঙ্কের শিক্ষক) ছিলেন আব্দুল জলিলের এক জ্যাঠা (বড় কাকা)। নবম শ্রেণি পর্যন্ত ওই স্কুলে পড়ার পর তিনি চলে যান বাগেরহাটে। সেখানে গিয়ে তদানীন্তন বাগেরহাট মুসলিম হাই স্কুলে ভর্তি হন। আব্দুল জলিলের চাচা তখন বাগেরহাট পি সি সরকারি কলেজের আরবি বিভাগের লেকচারার ছিলেন। মূলত তাঁর সূত্রেই সেখানে যাওয়া। স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করার পর ভর্তি হন বাগেরহাট পি সি সরকারি কলেজে। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। ইব্রাহিম হোসেন লাল, গোরাই ও আব্দুল জলিল সাধারণ ছাত্রদের সংগঠিত করেন। এটা ছিল স্বতস্ফূর্ত একটি ব্যাপার। জে বি বিষ্ণু নামে এক ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন, তিনি ছাত্রদের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সচেতন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেই কলেজেই তিনি সহপাঠী হিসেবে পান কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে। তাঁর সঙ্গে আব্দুল জলিলের বেশ সখ্যতা ছিল। দুজন তখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনাও করতেন। এরই মধ্যে কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন পাকিস্তান নৌ বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। ১৯৫২ সালের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে আরো কয়েকজন বন্ধুর পাল্লায় পড়ে ঢাকায় এসে বিমান বাহিনীতে যোগদানের জন্য পরীক্ষা দেন এবং টিকে যান। পরিবারকে না জানিয়েই তিনি বিমান বাহিনীতে একজন টেকনিশিয়ান হিসেবে যোগ দেন, ঢাকা থেকে তাঁকে পাঠানো হয় চট্টগ্রামে। সেখান থেকে চিঠির মাধ্যমে পরিবারকে বিষয়টি জানান। কয়েকদিন পর জাহাজে করে কর্তৃপক্ষ তাঁকে প্রশিক্ষণের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে পাঠিয়ে দেয়।
পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে বাঙালি হিসেবে এক ভয়ানক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন সার্জেন্ট আব্দুল জলিল। তিনি দেখলেন, সেখানে বাঙালি কর্মকর্তা কিংবা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য সবাই আসলে নির্যাতনের শিকার। অপমান আর অপদস্ত হওয়া ছাড়া তাদের যেন আর কিছুই করার নেই। প্রশিক্ষণ চলছিল নর্থ ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার প্রদেশের কোহাটে। এটা করাচি থেকে প্রায় ৯০০ মাইল দূরে। সেখানে বাঙালিদের গান শোনার ব্যবস্থা ছিল না। বিমান বাহিনীর মেসে একটি মাত্র রেডিও ছিল। আর তাতে করাচি স্টেশন থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সকাল ৮টায় একটা বাংলা গানের অনুষ্ঠান হত। প্রত্যেক রেডিও স্টেশন সেটা রিলে করত। সেটা ছিল বাঙালি কর্মকর্তাদের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। যখনি আটটা বাজত তখন পাঞ্জাবিরা রেডিওর নব ঘুরিয়ে অন্য স্টেশনে নিয়ে যেত। এ নিয়ে বাঙালি-পাঞ্জাবি মারামারিও হয়েছে। মারামারিতে আহত হয়ে আব্দুল জলিলসহ কয়েকজন এক মাসের বেশি সময় হাসপাতালেও ছিলেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়নি। যদিও তাদের বিরুদ্ধে একটি ‘কোর্ট অব ইনকোয়ারি‘ হয়েছিল। কিন্তু প্রতিবেদন আব্দুল জলিলদের পক্ষে গিয়েছিল। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের প্রতি বাঙালি সেনাদের মনে ক্ষোভের মাত্রা আরো বাড়ে।
কোহাটে এক বছরের মতো প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ফের করাচি ফিরে এলেন আব্দুল জলিল। এখানে এসে তিনি বিমান বাহিনীর র্যাডারের উপর প্রশিক্ষণ নেন এবং কাজ করেন। পরে তাঁকে বদলি করা হয় লাহোরে। লাহোরে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি এক বছরের প্রশিক্ষণের জন্য আমেরিকা চলে যান। সেখানে বিমান বাহিনীর নিজস্ব পেশাগত প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক্সের উপরও তিনি প্রশিক্ষণ নেন। সেখান থেকে ফিরে এসে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বেইজ বাদিনে কাজে যোগ দেন। সেখান থেকে ফের করাচিতেই ফিরে আসেন। সেখানকার করুঙ্গিক্রিক এয়ার বেইসে কাজ করতেন। আর থাকতেন করাচি শহরের আবাসিক এলাকা ১৪/৪ ক্লেটন কোয়াটার্সে।
এখানে থাকা অবস্থাতেই পরিচয় হয় ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজুল্লাহর সঙ্গে। তিনি বহু আগে থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার জন্য কাজ করছিলেন। তাঁর সঙ্গে আরো অনেককেই তিনি গোপনে যুক্ত করে নিয়েছিলেন। এই মফিজুল্লার অনুপ্রেরণাতেই মূলত আব্দুল জলিল সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। ধীরে ধীরে মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান, কমান্ডার আব্দুর রউফ প্রমুখের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় এবং পুরো প্রক্রিয়াটি বুঝতে পারেন। তাদের পরামর্শেই নিজের বাসায় চূড়ান্ত ঝুঁকি নিয়ে প্রথম প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করেন সার্জেন্ট আব্দুল জলিল। আর সেখান থেকে তাঁকে একদিন ধরে নিয়ে যায় বিমান বাহিনীর পুলিশের কর্মকর্তারা।
ধরে নিয়ে যাওয়ার পর পরই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান সার্জেন্ট জলিল। বেশ কয়েকদিন তাঁর পরিবার জানতেই পারেনি তিনি কোথায় আছেন। জলিল সাহেবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে খবর পেয়ে পরদিন বিমান বাহিনীর পুলিশের প্রধান করাচি এসে দেখা করে গেলেন। এ সময় একদিন ওয়ারেন্ট অফিসার ওসমানী বললেন, ‘তোমরা যা করেছে, সেটা হয়তো তোমাদের দিক থেকে ঠিক। কিন্তু আমরা তা মানতে পারি না। আর তোমরা বিষয়টাকে এমনভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে যে, আমাদের এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সব বাঙালি সেনা সদস্যের বিচার করা উচিত। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না। কিন্তু আমরা মূল হোতাদের ধরে এমন শাস্তি দেব যে, বাকিরা এর থেকে শিক্ষা নিয়ে শান্ত হয়ে যাবে।’
টানা কয়েকদিন ধরে জিজ্ঞাসাবাদের নামে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করা হল। তারপর একদিন সিদ্ধান্ত হল তাঁকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ঢাকায় নিয়ে আসার আগমুহূর্তে পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাত করার সুযোগ দিল কর্তৃপক্ষ। স্ত্রীকে বললেন, মালামাল পাঠিয়ে দিয়ে ঢাকায় চলে যেতে। পরে সার্জেন্ট জলিলকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখানে এসে তিনি আরো অনেককেই পেলেন যারা আগে থেকেই পরিচিতি। জানতেন, তাঁরা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। তারপর তো বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জনের নামে অভিযোগ গঠন করে মামলাই শুরু হয়ে গেল। সবার মতো তিনিও আইনজীবী নিযুক্ত করলেন। তাঁর আইনজীবী ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধী দলের নেতা আসাদুজ্জামান খান ও তাঁর জুনিয়র নুরুল আলম।
কিন্তু জলিল সাহেব তো মুশকিলে পড়ে গেলেন। কারণ তাঁর নামে অস্ত্র মামলাও আছে। গ্রেনেডটি তাঁর বাসা থেকে জব্দ করা হয়েছে। সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কিন্তু এটার তো প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। আইনজীবীর সঙ্গে, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে, অন্য সঙ্গীদের সঙ্গেও পরামর্শ করলেন। কিন্তু কেউ ভাল কোনো গল্প বানাতে পারল না। শেষে তিনি একটা ফাঁক বের করলেন, জব্দ-তালিকা করার সময় লেখা হয়েছে ‘ডামি হ্যান্ড গ্রেনেড‘। সেটা পাওয়াও গেছে একেবারে সবার সামনে ঘরের শোকেশের মধ্যে। এই দুটি বিষয়কে সামনে রেখে বক্তব্য সাজালেন। একজন ব্রিটিশ র্যাডার বিশেষজ্ঞ চলে যাওয়ার সময় এই গ্রেনেডটি উপহারস্বরূপ তাকে দিয়ে গেছেন। সেটি কোনো তাজা গ্রেনেড নয়, শো-পিস; তাই লেখা হয়েছে ‘ডামি হ্যান্ড গ্রেনেড’। আর একটা শোপিস তো শোকেশেই থাকবে। সবার সামনে। যদি এটা সত্যিই সত্যিই তাজা গ্রেনেড হত তাহলে সবার সামনে রাখার কথা না? লুকিয়ে রাখার কথা। আদালত তাঁর কথাটা গ্রহণ করলেন বলে জলিল সাহেবের মনে হল। কিন্তু আসলে সেটা ডামি কোনো হ্যান্ড গ্রেনেড ছিল না। এটা সত্যি সত্যিই তাজা গ্রেনেড ছিল। তবে প্রশিক্ষণের জন্য এর ভিতর থেকে বিস্ফোরক খুলে নেওয়া হয়। করুঙ্গিক্রিক আর্মামেন্ট (অস্ত্রাগার) থেকে করপোরাল এ কে এম আবদুল হাই বের করে নিয়ে এসেছিলেন। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর স্টোর রুম থেকে এটি নিয়ে আসা হয়েছিল, যাতে সবাই প্রশিক্ষণ নিতে পারে। সেই প্রশিক্ষণ দিতেন বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট জহুরুল হক। কারণ, বিমান বাহিনীর লোকেরা যাতে অস্ত্র প্রশিক্ষণ ভুলে না যায়, সেই কারণেই তাদের মাসে একবার করে ট্রেনিং দেওয়া হত। যেদিন সার্জেন্ট জলিল সাহেবের বাসায় প্রশিক্ষণ হত সেদিন পরিবারের সবাইকে দূরে আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হত। দিনভর সবাই প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজ নিজ কাজে ফিরে যেতেন। প্রত্যেকেই চেষ্টা করতেন নতুন নতুন সদস্যদের দলে ভিড়ানোর।
স্বাধীনতা যুদ্ধেরও প্রায় সাত বছর আগে নৌবাহিনীর কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনসহ কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাত থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করার অভিপ্রায় নিয়ে বাঙালি সেনাদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। অস্ত্রের মাধ্যমে তাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশ করতে চেয়েছিলেন। সেই প্রক্রিয়া ছিল বলতে গেলে, আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার মতোই। সবাই জেনেবুঝে মৃত্যুকে হাতে নিয়ে গোপন এই বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত হন। এই প্রক্রিয়া এতটাই গোপনীয় ছিল যে, সেনা, নৌ বা বিমান বাহিনী প্রত্যেক বাহিনীর জন্য আলাদা আলাদা ‘নিউক্লিয়াস’ ছিল। এক দলের সঙ্গে আরেক দলের কারোর যোগাযোগ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। সার্জেন্ট জলিল সাহেবের মতে, সরাসরি এই দলের সঙ্গে হয়তো কয়েকশ লোক জড়িত ছিল। কিন্তু তাদের সমর্থক ছিল হাজার হাজার। পুরু এই প্রক্রিয়াটি কয়েকজন বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমেই পরিচালিত হত। বাকি সবাই নিজ নিজ ‘নিউক্লিয়াস’কে কেন্দ্র করে কাজ করতেন। দলের মূল নেতৃত্ব থেকে নির্দেশ আসত, সেটা সাধারণ সদস্যরা পালন করতেন। কোথাও কোনো অবিশ্বাস বা বিশৃঙ্খলার বিন্দুমাত্র চাপ ছিল না। বাঙালি সেনারা অস্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেবে এটাই ছিল মূল বিষয়। কিন্তু অস্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলেই তো হবে না, সেটা টিকিয়েও রাখতে হবে। আর সেকারণেই এই প্রক্রিয়ার পেছনে রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলই দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবে। বিপ্লবী দলের নেতৃত্ব সেজন্য পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু এভাবে দেশ স্বাধীনের পরিকল্পনা শুনে সব রাজনৈতিক নেতাই ভড়কে যান, তাতে সমর্থন দেওয়া তো দূর অস্ত। ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে একবার বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানে আসলেন। পশ্চিম পাকিস্তানে এলে সাধারণত তিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মেয়ে আখতার সোলেমানের বাসায় উঠতেন। সেখানে গিয়েই একদিন বিপ্লবী দলের কয়েকজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেই সেনাদের অনেকবারই কথা হয়েছে, তার মধ্যে একবার সার্জেন্ট জলিল উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনার কথা শুনেই বলে দিলেন, ‘গো এহেড, আই এম উইথ ইউ’। বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা এতে ব্যাপক উৎসাহ পেলেন, তাঁরা আরো জোর কদমে কাজ চালিয়ে গেলেন।
যখন আগরতলা মামলার বিচার চলছিল তখন বঙ্গবন্ধুসহ এই মামলার সব আসামিই মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এমন নির্যাতন করা হয়েছে কয়েকজন তো মানসিক রোগী হয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁরা এটা বুঝতে পারছিলেন বাইরে তাদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে। সাংবাদিকদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু মাওলানা ভাসানির কাছে খবর পাঠিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের সব দল মিলে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্তদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করার চেষ্টা করছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার ইচ্ছে করেই এই মামলার নাম দিয়েছিল ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। আইনগতভাবে এই মামলার নাম ‘শেখ মুজিবুর রহমান বনাম সরকার ও অন্যান্য ’। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা যেন প্রতিবেদনে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ উল্লেখ করেন। সাংবাদিকরা প্রতিবেদনের স্বার্থে সেটা করেছিলেন। এই নামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সরকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য আসামিদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ভারত সরকার পাকিস্তান ভাঙার চেষ্টা করছে এটি মানুষকে বোঝাতে পারলে তাঁরা ক্ষেপে যাবেন। রাস্তায় আসামিদের ফাঁসির দাবিতে মিছিল করবে। এই পরিস্থিতির মধ্যেও আসামিদের একে অপরের প্রতি আন্তরিকতা, ভালবাসায়, সহযোগিতায় কোনো ঘাটতি ছিল না।
একবার সার্জেন্ট জলিল সাহেবের শাশুড়ি তাঁকে দেখতে এলেন। তিনি দুধের সর দিয়ে তৈরি পিঠা নিয়ে আসলেন। জলিল সাহেব সব আসামিকেই একটা করে পিঠা দিলেন আর একটা বঙ্গবন্ধুর জন্য রেখে দিলেন। যেদিন আদালতের শুনানিতে যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গাড়িতে দেখা হল তিনি বঙ্গবন্ধুকে পিঠাটা দিলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, সবাইকে দিয়েছ? জলিল সাহেব বললেন, তাঁর এখানে থাকা সব আসামিকেই তিনি দিয়েছেন। একটা তাঁর জন্য নিয়ে এসেছেন। বঙ্গবন্ধু সেই পিঠা থেকে কণামাত্র নিয়ে বাকিটা সবার মধ্যে বিলিয়ে দিতে বললেন। সবাই মিলে একটা পিঠা ভাগ করে খেলেন।
আরেকটা ঘটনা, বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থায় বড় মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিয়ে হয়। বিয়ের পর বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুর জন্য দুই পাতিল মিষ্টি পাঠানো হয়। বঙ্গবন্ধু জলিল সাহেবকে ডেকে বললেন সবার মধ্যে ভাগ করে দিতে। সেই মিষ্টি আনন্দে কাড়াকাড়ি করে সবাই খেল। কিন্তু কেউ কেউ বাদ পড়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধু পরে তাদের জন্য আবার মিষ্টি আনালেন। সব আসামি যখন আদালতে যেত, তখন সবাই মিলেই দেশের গান গাইতেন। সবাই একটা পরিবারের সদস্য হিসেবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতেন। বঙ্গবন্ধুর একটা রসিকতা এখনো আবদুল জলিলের মনে আছে। সেদিন আদালতে মামলায় সাক্ষী দিতে এসেছেন সিরাজুল ইসলাম। তিনি সাধারণ বাঙালির চেয়ে একটু বেশিই কালো ছিলেন। সিরাজকে দেখেই বঙ্গবন্ধু সিএসপি কর্মকর্তা শামসুর রহমান সাহেবকে বললেন, শামসুর রহমান আজকে আমাদের অনেক সুন্দর লাগতাছে। তখন আবদুল জলিল বললেন, ‘মুজিব ভাই, মানুষ আপনাকে গায়ের রঙের জন্য ভালবাসে না, তাঁরা আপনাকে ভালবাসে আপনার বিশাল হৃদয়ের জন্য।’
বিচার চলাকালীন আদালতের নির্দেশে অভিযুক্তদের বাইরের করিডোরে বিকেলে এক ঘণ্টার পায়াচারি করতে দিত। সঙ্গে পাহাড়াও থাকত। সার্জেন্ট জলিল একদিন বঙ্গবন্ধুকে বললেন, আপনি বাইরে পায়াচারি করবেন না। কোনদিন হয়তো দেখা যাবে, এরা আপনাকে গুলি করে দিয়ে বলবে, পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। আপনার রিস্ক নেওয়া ঠিক না। আপনি বাইরে পায়াচারি বন্ধ করে দেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, তিনি পায়াচারি বন্ধ করবেন না। মৃত্যু যদি আসে এমনিতেই মরতে হবে। তিনি পায়াচারি বন্ধ করবেন না। এর কিছুদিন পরেই ঘটল সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ড। সার্জেন্ট জহুরুল হককে বন্দি অবস্থায় ভোররাতে গুলি করে হত্যা করা হল। তখন রেডিওতে প্রচার করা হল। সার্জেন্ট জহুরুল হক পালিয়ে যেতে চেয়েছিলন। তখন তাঁকে গুলি করা হয়েছে।
সেদিনের সেই ঘটনাটি এখনো সার্জেন্ট জলিলের স্মৃতিতে জাজ্জ্বল্যমান। সেদিন ভোর রাত ৫টার মতো হবে। জলিল সাহেব ততক্ষণে জেগে গেছেন। কিন্তু বাইরে বের হওয়ার তো কোনো ব্যবস্থা নেই। নিজের বিছানায় শুয়েই থাকলেন। হঠাৎ করেই বাইরে কয়েকটি গুলির আওয়াজ পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে তাকলেন। ততক্ষণে বাকি সবাই উঠে গেছেন। হই-হুল্লোর চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে।
পরে জলিল সাহেব জানতে পারেন, সার্জেন্ট জহুরুল হক, ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক ও মুজিবুর রহমান সেদিন ভোরবেলায় প্রহরী নিয়ে একসঙ্গে বাথরুমে যান। বাথরুমটা ছিল একটু দূরে। বের হওয়ার পরই জহুরুল ও ফজলুর রহমানকে গুলি করা হয়। পরে মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য সার্জেন্ট জহুরুল হককে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এই দৃশ্য দেখে ফজলুর রহমান মৃতের মতো পড়ে থাকেন, যেন তার উপর বেয়নেট চার্জ না করা হয়। অনেকক্ষণ ধরে দুজন সেখানে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে রইলেন। পরে তাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তখন একজন বাঙালি ডাক্তারকে দায়িত্ব দিয়েছিল দুজনের অপারেশন করার জন্য। তখন চিকিৎসক বললেন, একজনের অপারেশন করে যদি অন্য আরেকজনের অপারেশন করি, তাহলে তার আগেই তিনি রক্তক্ষরণে মারা যাবেন। সার্জেন্ট জহুরুল হক তখন বলেন, ফজলুল হকের অপারেশন করার জন্য। চিকিৎসক শেষ পর্যন্ত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অপারেশন করার কারণে ফজলুর রহমান বেঁচে যান আর জহুরুল হক মারা যান।
এর আগে আরো দুটো ঘটনা ঘটল, আসামিদের যে খাবার দেওয়া হত তা এতটাই খারাপ ছিল যে, খাওয়া যেত না। আসামিরা সেটা ফেলে না দিয়ে জড়ো করে রাখতেন। বিকেলে গরিব অভূক্ত ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পাশের রাস্তা দিয়ে এসে সেই খাবার নিয়ে যেত। প্রহরীরা তাদের কোনো বাধা দিত না। কিন্তু জহুরুল হককে হত্যার আগেরদিন সেই ছোট ছোট বাচ্চারা যখন আসল প্রহরীরা তাদের প্রচণ্ড মারধর করল। যেন ভয়ে তারা আর সেখানে না আসে। এই ঘটনা দেখে জহুরুল হক, স্টুয়ার্ড মুজিব, সুলতান উদ্দিন প্রহরীদের উপর ভীষণ ক্ষেপে যান এবং তাদের গালিগালাজ করেন। জলিল সাহেবের ধারণা, এর সূত্র ধরেই পরদিন নিরাপত্তাকর্মীরা স্টুয়ার্ড মুজিব ও সুলতানকে তাদের ঘর থেকে জোর করে বের করে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাধার মুখে তাঁরা তা করতে পারেননি। এর ঠিক পরদিনই জহুরুল হক ও ফজলুল হকের উপর গুলি চালানো হয়।
জহুরুল হককে হত্যার খবর বাইরে আসলে ঢাকা উত্তাল হয়ে উঠে। আগরতলা মামলার সব আসামিও অনশন শুরু করেন। কারণ, তখন পরিবার বা আইনজীবীদের সঙ্গে তাদের দেখা করতে দেওয়া হচ্ছিল না। অনশনের একপর্যায়ে কর্তৃপক্ষ সবাইকে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দেয়। এরই মধ্যে ঢাকা উত্তাল হয়ে উঠেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আইয়ুব খান পাকিস্তানে গোলটেবিল বৈঠক ডেকেছেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থিত রাখতে চায় পাকিস্তান সরকার, নাহলে গোলটেবিল ভেস্তে যাবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো বন্দি, তিনি কীভাবে যাবেন? আলোচনা উঠল, বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তি নিয়ে যাবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে তাঁর পরিবারের লোকজন ও আসামিরা বললেন, তাঁর প্যারোলে বের হওয়া উচিত হবে না। কারণ, তিনি যদি প্যারোলে বের হয়ে যান তাহলে সরকার কাজ শেষ হয়ে গেলে তাঁকে আবারো এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাবন্দি করতে পারবে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু বের হয়ে গেলে আগরতলা মামলার অন্যসব আসামির তো বিচার হবে। তাই তিনি যেন মামলাটি প্রত্যাহারের দাবি জানান। বঙ্গবন্ধু সেটিই করেছিলেন। সরকার জনতার আন্দোলনের মুখে সবাইকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। এই মামলায় তিনজন বিচাপতি ছিলেন, এদের একজন পশ্চিম পাকিস্তানের আর দুজন বাঙালি। পশ্চিম পাকিস্তানের বিচারপতি জহুরুল হককে হত্যার দিন রাতে উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যে লুঙ্গি পরেই বিমানে চড়ে ইসলামাবাদে পাড়ি দেন। পরে আর তিনি ফিরে আসেননি।
সেই দিনটির কথা আজো মনে আছে সার্জেন্ট আব্দুল জলিলের। সেদিন বঙ্গবন্ধু তাদের কাছে আসলেন। সবাইকে একত্রিত করলেন। তারপরই বললেন, হয়তো তোমাদের সবাইকে আজকেই ছেড়ে দেওয়া হবে। তারপর সবাইকে মুক্ত করে দেয় সরকার। জলিল সাহেব বেরিয়ে নরসিংদীর রায়পুরায় নিজের বাড়িতে চলে গেলেন। বন্দিদশা থেকে বের হয়ে সার্জেন্ট আবদুল জলিল কিন্তু আর নিজের কাজে ফিরতে পারলেন না। তাঁকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য কাজ করা থেকে থেমে থাকেননি সার্জেন্ট আব্দুল জলিল। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের সময় দুই পাকিস্তানের কথা বলা হয়েছিল। স্বাধীন পশ্চিম পাকিস্তান আর স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান। সেই লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিরা গঠন করলেন ‘লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি’। এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হলেন সার্জেন্ট আব্দুল জলিল। এই কমিটির কাজ ছিল সারা দেশে সভা করে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন করা। স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি এই কাজ চালিয়ে গেলেন।
২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। তখন আব্দুল জলিল নরসিংদির গ্রামের বাড়ি ছিলেন। ২৬ মার্চ কিশোরগঞ্জে গিয়ে প্রতিরোধ-সংগ্রামে অংশ নেন। পরে নেত্রকোনা দিয়ে গারো পাহাড়ের সীমান্ত পেরিয়ে মেঘালয়ে চলে যান। সেখান থেকে যান কলকাতায়। কলকাতায় ৫৮ বালিগঞ্জে গিয়ে প্রবাসী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রবাসী সরকারের নির্দেশেই যুক্ত হন ৬ নম্বর সেক্টরে। পরে সেক্টর কমান্ডার এম কে বাশারের নির্দেশে তিনি হেড কোয়াটার্সে চলে আসেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই বিমান বাহিনীর ১৯ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে সার্জেন্ট আব্দুল জলিল ফ্লাইট সার্জেন্ট হিসেবে পদোন্নতি পান। সেসময় ৬ নম্বর সেক্টরের মতিউর রহমানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা বাউরা ক্যাম্পে বিদ্রোহ করে বসেন। সেক্টর কমান্ডার জলিল সাহেবকে নির্দেশ দেন বিষয়টি মীমাংসা করার জন্য। তিনি সেখানে গিয়ে সেটি মীমাংসা করে আসেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন। তখন একদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে তিনি আবদুল জলিলকে বলেন, ত্রাণ দিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না। হয় সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না, না হয় নেতারা খেয়ে ফেলছে, অপচয় হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর এই কথা শুনার পর আবদুল জলিল নিজে থেকে দায়িত্ব নিয়ে ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকা ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় ত্রাণ কাজ পরিচালনা করে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বিমান বাহিনীতে যোগদানের চেষ্টা করলেও আর চাকরিতে ফিরতে পারেননি। এরপর থেকে আগরতলা মামলার আসামিদের নিয়ে ‘ঐতিহাসিক আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন করে স্বাধীনতার চেতনা বাস্তবায়নের পক্ষে কাজ পরিচালনা করে যাচ্ছেন। এই বৃদ্ধ বয়সেও তিনি সেই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে সার্জেন্ট আবদুল জলিল পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলের জনক। তিনি ১৯৫৫ সালে কিশোরগঞ্জের মেয়ে জাহানারা বেগমকে বিয়ে করেন। জাহানারা বেগম আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিশোরগঞ্জ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের তিনি ছিলেন সভানেত্রী। প্রায় তিন দশক সংসার করার পর জাহানারা বেগম ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮৪ সালে মারা যান। পারিবারিক সংকটকালে জাহানারা খুবই দৃঢ় ভূমিকা পালন করেছেন। এটা ঠিক, আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর অনেক বড় বড় কোম্পানি মোটা বেতনের বিনিময়ে আবদুল জলিলের নাম ব্যবহার করতে চেয়েছে। কিন্তু চাকরি না থাকলেও আবদুল জলিল তাদের সেই প্রস্তাবে রাজি হননি। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর দেশের পরিস্থিতি একেবারেই পাল্টে যায়। তখন সার্জেন্ট আবদুল জলিলের জন্য একটা সাধারণ চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যদিও পরে তিনি একটি ইলেকট্রিক কোম্পানিতে কিছুদিন কাজ করেন। এই দম্পতির বড় মেয়ে নাসরিন সুলতানা বর্তমানে আমেরিকায় থাকেন। দ্বিতীয় মেয়ে নাজলী সুলতানা থাকেন রাজধানীর জিগাতলাতে। তৃতীয় মেয়ে ফৌজিয়া জলিল শিক্ষকতার পাশাপাশি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচিত সদস্য। চতুর্থ মেয়ে নুসরাত সুলতানাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। একমাত্র ছেলের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের সময় বলে তাঁর নাম মুক্তি মাহমুদ। তিনি জিগাতলায় থাকেন এবং একটি বেসরকারি চাকরি করেন। সবার ছোট মেয়ে ইতি জলিলের বিয়ে দিয়েছেন টাঙ্গাইলে।
মিসেস জাহানারা জলিল মারা যাওয়ার পর ১৯৮৫ সালের সার্জেন্ট আবদুল জলিল বিয়ে করেন রেনু আরা বেগমকে। রেনু আরার প্রথম স্বামী শওকত আলী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁকে ৭৫ পরবর্তী সময়ে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যা করা হয়। রেনু আরার এক মেয়ে রাজিয়া সুলতানা এ্যালি। রেনু আরা নিজেও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। মেয়ে এ্যালি একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। এখন মেয়ে এ্যালির সঙ্গেই রাজধানীতে এই দম্পতি বসবাস করেন।
আগরতলা মামলা সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু তথ্য
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে মু্ক্ত বিশ্বকোষ উইকিকপিডিয়ায় বলা হয়েছে, পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে দায়ের করা একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগ নেতা ও পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেছিল।
১৯৬৮ সালের প্রথম ভাগে মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলাটির পূর্ণ নাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবর রহমান এবং অন্যান্য মামলা’। তবে এটি ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা হিসেবেই বেশি পরিচিত। বিচার কাজ শুরু হয় ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন। বিচারকাজ শেষ হয়- ১৯৬৯ সালের ২২ জানুয়ারি। অভিযুক্তদের মামলা প্রত্যাহার করা হয় এবং সবাই মুক্তি পান।
বিচার কাজ চলে ঢাকা সেনানিবাসের সিগন্যাল অফিসার্স মেসে স্থাপিত বিশেষ আদালতে। ট্রাইব্যুনালে বিচারকদের মধ্যে একজন পশ্চিম পাকিস্তানি আর দুজন পূর্ব পাকিস্তানের। এরা হলেন পশ্চিম পাকিস্তানের এস এ রহমান (ট্রাইব্যুনাল প্রধান) আর পূর্ব পাকিস্তানের বিচারক এম আর খান ও বিচারক মুকুমুল হাকিম।
আসামিরা হচ্ছেন ক্রমান্বয়ে- ১. শেখ মুজিবুর রহমান ২. লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ৩. স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান ৪. এলএস সুলতান উদ্দিন আহমেদ ৫. নূর মোহাম্মদ ৬. আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি ৭. ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজুল্লাহ ৮ এ বি এম আবদুস সামাদ ৯. হাবিলদার দলিল উদ্দিন হাওলাদার ১০. রুহুল কুদ্দুস সিএসপি ১১. ফ্লাইট সার্জেন্ট মো ফজলুল হক ১২. ভূপতি ভূষণ চৌধুরী (মানিক চৌধুরী) ১৩. বিধান কৃষ্ণ সেন ১৪. সুবেদার আবদুর রাজ্জাক ১৫. হাবিলদার মুজিবুর রহমান ১৬. ফ্লাইট সার্জেন্ট আবদুর রাজ্জাক ১৭. সার্জেন্ট জহুরুল হক ১৮. এ বি মো. খুরশীদ ১৯. খান এম শামসুর রহমান সিএসপি ২০. রিসালদার এ কে এম শামসুল হক ২১. হাবিলদার আজিজুল হক ২২. মাহফুজুল বারী ২৩. সার্জেন্ট শামসুল হক ২৪. কর্নেল শামসুল আলম ২৫. মেজর মো. আবদুল মোতালেব ২৬. কর্নেল এম শওকত আলী ২৭. কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা ২৮. ব্রিগেডিয়ার এএনএম নুরুজ্জামান ২৯. ফ্লাইট সার্জেন্ট আবদুল জলিল ৩০. মো. মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী ৩১. লেফটেন্যান্ট এম এম মতিউর রহমান ৩২. সুবেদার এ কে এম তাজুল ইসলাম ৩৩. মো. আলী রেজা ৩৪. ব্রিগেডিয়ার খুরশীদ উদ্দিন আহমেদ ৩৫, কমান্ডার আবদুর রউফ। বৈরি সাক্ষীরা হলেন- ১. এ বি এম ইউসুফ ২. কামাল উদ্দিন ৩. বঙ্কিম চন্দ্র দত্ত ৪. আবুল হোসেন।
কৃতজ্ঞতা
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পর পর দুদিন রাজধানীর পশ্চিম গোড়ানে আবদুল জলিলের বাসভবনে তাঁর সাক্ষাতকার নেওয়া হয়। সেই সাক্ষাতকারের ভিত্তিতেই এই সংক্ষিপ্ত জীবনীটি লেখা হয়েছে।
এ ছাড়া ‘আগরতলা মামলার অনুচ্চারিত ইতিহাস ও শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক’ নামক গ্রন্থের সাহায্যও নেওয়া হয়েছে। আগরতলা মামলার অভিযুক্তদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে রচিত এই প্রামাণ্য গ্রন্থটির সম্পাদক ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন ও নাজনীন হক মিমি। এর মধ্যে নাজনীন হক মিমি শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের আপন ভাতিজি আর ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রভোস্ট। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রচিত এই বইটি প্রকাশ করেছে জার্নিম্যান বুকস (১০/৫ ইস্টার্ন প্লাজা, সোনারগাঁও রোড, ঢাকা ১২০৫)।
লেখক: চন্দন সাহা রায়