শহিদুল আলম তখন একটি কাজের সুবাদে আয়ারল্যান্ডে গেছেন। সেখানে তিনি যে বাসায় উঠেছেন, সেই বাসায় ছোট্ট একটি শিশু ছিল। শহিদুল শিশুটির সামনেই পকেটে থাকা খুচরো পয়সাগুলো বের করে টেবিলে রাখছিলেন। শহিদুলের পকেটে পয়সা দেখে শিশুটি তো খুব অবাক! কারণ শিশুটি জানতো শহিদুল বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশের নাগরিক, দরিদ্র মানুষের কাছে পয়সা থাকার কথা না! সে বাংলাদেশকে দরিদ্র মানুষের দেশ হিসেবেই চেনে। শিশুটি তখন শহিদুলকে প্রশ্ন করে, তাঁর পকেটে এই পয়সা কী করে এলো? সেই ঘটনাটা শহিদুলের মনকে খুব নাড়া দিয়েছিলো। বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি পাঁচ বছরের শিশুরও কী ভীষণ বাজে ধারণা যে, এই দেশের মানুষের তো পকেটে পয়সা থাকতে নেই!
বাংলাদেশ সম্পর্কে এই ভাবনার ক্ষেত্রে শিশুটির হয়তো কোনো ভূমিকাই নেই। কিন্তু শিশুটি যেখান থেকে বাংলাদেশকে দেখেছে বা জেনেছে সেখানে বাংলাদেশেকে এভাবেই তুলে ধরা হয়েছে। এই যে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশকে পশ্চিমা গণমাধ্যমের এভাবে তুলে ধরা, এর পেছনে সুস্পষ্ট একটি রাজনৈতিক বার্তা আছে। বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ, তার নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে- এগুলো অস্বীকার করার কিছু নেই; কিন্তু এই ভূখণ্ডের মানুষের তো জীবন-সংগ্রাম, আবেগ-অনুভূতি, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল রয়েছে, সেগুলোও তো বলার রয়েছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম চিরকাল সেই সত্যকে চাপা দিয়ে গেছে।
একেবারে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণেই শহিদুল আলমের আলোকচিত্রের জগতে আসা। তিনি ছবি তুলেছেন বা তুলছেন রাজনৈতিক কারণেই। তিনি বাংলাদেশকে যেভাবে দেখছেন বা দুনিয়াকে যেভাবে দেশটাকে দেখাতে চান, রাজনৈতিক বার্তা দিতে চান- তার জন্য একটা মাধ্যম প্রয়োজন। শহিদুলের কাছে সেই ভাষা-মাধ্যম হচ্ছে আলোকচিত্র। হ্যাঁ, অবশ্যই সেটা একমাত্র অবলম্বন নয়, আরো অনেক অস্ত্র বা হাতিয়ার হয়তো আছে, তবে তাঁর কাছে এটাই প্রথম, প্রধান, শক্তিশালী আর কার্যকরী আধেয়। এ দেশের অধিকাংশ মানুষই লেখাপড়া করতে পারে না, ফলে তাঁকে বোঝার বা বোঝানোর জন্য আলোকচিত্রটা ভাল মাধ্যম। ফলে অনেকটা প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের মতোই শহিদুলেরও উপলwä, ‘আমি যা বলতে চাই, আলোকচিত্রে তা বলা সম্ভব। যদি কখনো মনে হয়, বলতে পারছি না তখন হয়তো আমি কলম ধরবো, প্রয়োজন হলে বন্দুকও। কথা বলার জন্য যখন যে হাতিয়ারটা দরকার, তখন সেটাই ব্যবহার করতে হবে।’
শহিদুল নিজেকে অবশ্যই শান্তিবাদী ভাবেন, তবে গান্ধীবাদী নন; সবকিছু চুপ করে নীরবে হজম করতে রাজি নন।
এটা তো ঠিক, যুগ যখন বদলাচ্ছে, তখন আলোকচিত্রের সঙ্গেও নতুন নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। আলোকচিত্রীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভূমিকা রাখছে। এর সঙ্গে প্রতিনিয়ত নিজেকে যুক্ত রাখতে হচ্ছে। ফলে শহিদুল আলম নিজেকে শুধু একজন আলোকচিত্রী শিল্পী হিসেবেই আবদ্ধ রাখেন না। একইসঙ্গে লেখক, আন্দোলনকারী, সংগঠক, এমনকি জনমুখপাত্র হিসেবেও ভূমিকা নেন। এর সবকিছুর সমন্বয়ের মত ও পথ তাঁর রাজনৈতিক-ভাষ্য, তিনি সেটাই প্রচার করতে চান।
এই যে আলোকচিত্রকে রাজনৈতিক ভাষায় দেখানোটা, এর মধ্যে যেমন দেশীয় শোষক-শোষিতের লড়াই-সংগ্রামের বীজ উপ্ত আছে, ঠিক তেমনি আছে পাশ্চাত্যের আধিপত্যবাদী ‘শিল্প-সুষমার‘ মোড়কে প্রাচ্যের খেটে-খাওয়া মানুষের জীবন-বাস্তবতার কাঠামো দিয়ে চ্যালেঞ্জ জানানোর বিষয়টিও। শহিদুল মনে করেন, এই প্রাচ্যকে এতোদিন পাশ্চাত্য দেখেছে, তার নিজের অভিপ্রায়-রুচি-ভাব আর রাজনীতি দিয়ে। পাশ্চাত্যই এই গল্প তৈরি করে তার নিজের গল্পকার দিয়ে।
গণমাধ্যম যার হাতে, ভাষা যার হাতে- সেই নির্ধারণ করেন গল্পটা কেমন হবে। ইতিহাসে এভাবেই সবকিছু হয়ে আসছে। প্রাচ্যকে সবসময় দেখা হয়েছে শ্বেতাঙ্গ আলোকচিত্রীর চোখ দিয়ে, লেন্স দিয়ে, কলম দিয়ে। তাঁরা এই দেশটাকে একটা বন্যা, মহামারি, দুর্ভিক্ষের দেশ হিসেবে বিদেশের মানুষের কাছে পরিচিত করেছে। এখন সময় এসেছে তাকে উল্টে দেখার। আর তার জন্য প্রয়োজন গল্পকারের পরিবর্তনের। শুধু গল্পকারের পরিবর্তন হলেও কখনো কখনো বাস্তবতা অধরা থেকে যেতে পারে। ফলে এখন একটি গল্প যে ভাষায় বলা হলো, ঠিক তার পরের গল্পটি একই ভাষায় বললে মানুষ তা গ্রহণ না-ও করতে পারে। গল্পের প্রয়োজনেই যেমন গল্পকারের পরিবর্তন দরকার হয়, ঠিক তেমনি ভিন্ন ভিন্ন গল্পের জন্যও ভিন্ন ভিন্ন ভাষার প্রয়োজন আছে। শহিদুল আলম তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তা দেখেছেন। র্যাবের ক্রসফায়ার নিয়ে তাঁর আলোকচিত্র সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তিনি নিজেও কল্পনা করতে পারেননি এর ব্যাপ্তি গোটা ভূ-গোলকে ছড়িয়ে পড়বে। সেটা সম্ভব হয়েছিল ভিন্ন গল্পের কারণেই। কিন্তু তারপর তিনি যখন পাহাড়ের আদিবাসী নেত্রী নিখোঁজ কল্পনা চাকমাকে নিয়ে কাজ করেছেন, তখন ভিন্ন ভাষায় ভিন্ন গল্প বলেছেন। পাহাড়ের আদিবাসীদের গ্রামে নির্যাতন বা শ্রমঘনশিল্প গার্মেন্টে শ্রমিকদের পুড়িয়ে মারার ঘটনায় ভিন্ন ভিন্ন উপকরণকে তিনি ক্যানভাসে নিয়ে এসেছেন। কিংবা ইদানিং তিনি দেশের মসজিদে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন, এর প্রত্যেকটির পেছনে কিন্তু আলোকচিত্রের ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় গল্প রয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন ক্ষমতার লড়াইকে শহিদুল মোকাবেলা করার চেষ্টা করেছেন একই মাধ্যমের ভিন্ন ভিন্ন ভাষা দিয়ে। শহিদুল আলম শিল্পের এই চিরন্তন পরিবর্তনকে দেখছেন একজন শিল্পীর শৈল্পিক বিস্তার ও কলা-কৌশল হিসেবে।
যাই হোক, যে কোনো পরিবর্তন বললেই তো আর হয় না, তার আগে প্রয়োজন গল্পকার তৈরির আয়োজনটি সম্পন্ন করার। অনেকটা বিশ্বকবি রবি ঠাকুরের সেই কথার মতো, সন্ধ্যে বেলায় প্রদীপ জ্বালানোর আগে তো চাই সলতে পাকানোর কাজটা শেষ করা। ছবির গল্পকার বা আলোর ভাষ্যকার তৈরির চিন্তা থেকেই আসে দৃক আর পাঠশালার কথা। যা বাংলাদেশের আলোকচিত্র জগতে গত তিন দশক ধরে ভিন্ন এক আন্তর্জাতিক মাত্রায় কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে এই ধরনের যুগান্তকারী পরিবর্তন আর কখনোই আসেনি।
ঢাকার এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান শহিদুল আলম বাংলাদেশে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন উচ্চ শিক্ষার জন্য। সেখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি নানা সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। লন্ডনে থাকার সময়ই তিনি আলোকচিত্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮৪ সালের শুরুর দিকে দেশে ফিরে আসেন এবং গতানুগতিক ধারার বাইরে ভিন্নভাবে নিজের জীবন-জীবীকার সন্ধান করেন। রাজনৈতিক কারণে যে আলোকচিত্রকে তিনি কর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাঁকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করার চ্যালেঞ্জ নেন। যদিও সেই সময়টা এর জন্য ছিলো একেবারেই অনুপযুক্ত। কারণ, বাংলাদেশে তখন আলোকচিত্রের বাজার ছিলো একেবারেই সীমিত আর সীমাবদ্ধ। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিলো, যে জগতে শহিদুল কাজ করতে এসেছেন, সেখানে কেউ তাঁকে চেনেন না, তিনিও কাউকে চেনেন না। তবু পথ হাঁটা শুরু করলেন। এর সূত্র ধরেই বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, আলোকচিত্রী গোলাম কাসেম ড্যাডি, মঞ্জুরুল আলম বেগ, খান মোহাম্মদ আমির (বিল্টু) প্রমুখের সঙ্গে পরিচয়।
শহিদুল প্রথম আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ শুরু করেন খান মোহাম্মদ আমিরের সঙ্গে ১৯৮৪ সালের জুন মাসে। ‘ফটো ওয়ার্ল্ড‘ নামে একটি কোম্পানি খুলে দুজনে ব্যবসাও শুরু করেন। কাজ ছিলো করপোরেশন, ফ্যাশন, সুন্দরী নারীদের ছবি তোলার মতো বাণিজ্যিক বিষয় নিয়ে। ব্যবসা ভালই হচ্ছিলো, কিন্তু যে কাজ তিনি করতে চান তার যেন নাগাল পাচ্ছিলেন না। ছয় মাস কাজ করার পরই সেই ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে ফ্রি-ল্যান্সার হয়ে যান, আর এই সময়েই সামরিক শাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। আন্দোলনের ছবি তুলতে গিয়ে যেন শহিদুল প্রাণটা পেলেন। আলোকচিত্রী সাংবাদিক হিসেবে তখন কিছু কিছু ছবি ছাপা হচ্ছে, সুনামও কুড়াচ্ছেন। ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কিছু কাজ করেন।
১৯৮৮ সালে সারা দেশে ভয়াবহ বন্যা হয়। সেই সময়ের একটি ঘটনা শহিদুলের মনে খুব রেখাপাত করে। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক বিভাজনটি শহিদুল আরো স্পষ্টভাবে অনুধাবন করেন। তখন তিনি ব্রিটিশ আলোকচিত্র সংস্থা ‘ইমপেক্ট‘ এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু বন্যার সময় শহিদুলকে কাজ না দিয়ে সংস্থাটি ব্রিটেন থেকে একজন শ্বেতাঙ্গ আলোকচিত্রীকে ঢাকায় পাঠায় ছবি তুলতে। শহিদুল বাংলাদেশের বন্যাকে যেভাবে দেখেন বা বিশ্বকে দেখাতে চান, তাঁরা সেখানে ভিন্ন এক বাংলাদেশকে দেখাতে চান।
শহিদুলের ততদিনে জানা হয়ে গেছে, আলোকচিত্র গ্রন্থাগারের মাধ্যমে মূলত ছবি বিক্রি হয়। তিনি তখনি সিদ্ধান্ত নেন একটি গ্রন্থাগার তৈরি করতে হবে আর এর সদর দপ্তর লন্ডন, প্যারিস বা নিউইয়র্ক না হয়ে ঢাকায় হতে হবে। যাতে এখানকার আলোকচিত্রীরা এর সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করতে পারেন এবং এর সুবিধা ভোগ করতে পারেন। তাঁরা একে নিজেদের চিন্তার বাহক হিসেবে দেখবে। সেই চিন্তা থেকেই ১৯৮৯ সালে দৃকের যাত্রা। বাইরের আলোকচিত্র গ্রন্থাগারগুলোতে যেমন শত শত স্লাইড জমা দিয়ে বছরের পর বছর অপেক্ষা করে আয়ের পথ খুঁজতে হয়, সেখানে দৃক শুরু থেকেই ভিন্ন পথে হাঁটলো। একজন আলোকচিত্রীর একটা ভাল ছবি থাকলেও সেটা নিয়ে তাঁরা বিক্রির চেষ্টা করতেন। সেই টাকা দিয়ে আলোকচিত্রী যেন আরো ফিল্ম কিনে কাজ করতে পারেন। দৃকের শুরুটা এভাবেই। পাঠশালার গল্পও একে ধরেই।
দৃকের আগে এদেশের আলোকচিত্র শিল্পের প্রসার ঘটলেও পেশাদারিত্বের অভাবটা বড় আকারেই ছিলো। অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের শিল্পীরাও একে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করেননি, এমনকি আলোকচিত্র সাংবাদিকরাও স্বতন্ত্রভাবে যারা কাজ করতেন তাদের তেমন একটা গুরুত্ব দেননি। যদিও সেই সময় বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি নিজের মতো করে অনেক কাজ করেছে। সেটাকে খাটো করে দেখার কিছু নেই। শহিদুল নিজেও এতে কাজ করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। ঢাকার বাইরে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বগুড়া ইত্যাদি স্থানে কিছু ‘ক্যামেরা ক্লাব‘ ছিল। তাদের অধিকাংশই ছিলেন সৌখিন। হয়তো কোনো প্রতিযোগিতায় তাঁরা ছবি দিতেন। এসবের মধ্য দিয়ে আলোকচিত্র শিল্পের একটা ভিত্তি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। প্রচুর নিষ্ঠাবান মানুষ এখানে তখন কাজ করেছেন। যদিও সাংবাদিকতা আর স্টুডিওর বাইরেও যে স্বতন্ত্রভাবে কেউ আলোকচিত্র শিল্পমাধ্যমকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন, সেটা তখনো হয়ে উঠেনি। আলোকচিত্র যে একটি সমাজকে ধরে রাখার, প্রতিনিধিত্ব করার, গল্প বলার মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে সেটা ভাবা হয়নি। দৃক বা পাঠশালা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এদেশের আলোকচিত্র শিল্পের এই অধ্যায়গুলো সামনে এগিয়ে যাবার একটা নিশানা পায়। আলোকচিত্র শিল্পীরা একে একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে যেমন পেয়েছেন, ঠিক তেমনি তাঁরা কিন্তু একে ব্যবহারও করেছেন। তাঁরাই এই প্রতিষ্ঠানকে সামনে নিয়ে গেছেন, তাদের কারণেই আজকে পাঠশালা এই অবস্থানে এসেছে।
১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বরে ‘ওয়াল্ড প্রেস ফটো‘ পৃথিবীর চারটি দেশে নবীন আলোকচিত্রীদের জন্য কর্মশালাভিত্তিক প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে বাংলাদেশে পাঠশালা সেই প্রশিক্ষণটি আয়োজন করে। সেই প্রশিক্ষণের নিয়ম ছিল, প্রথমে তিন দিনের একটি কর্মশালা হবে তারপর এক বছর প্রশিক্ষণার্থীরা নিজেদের মতো কাজ করবে। এক বছর পর আবার তিন দিনের একটি কর্মশালা হবে, তারপর আবার এক বছরের বিরতি। দুই বছরের মাথায় আবার তিন দিনের একটি কর্শশালা হবে। অর্থাৎ দুই বছরের মোট নয়দিনের কর্মশালা হবে। বাকি দিনগুলো বিরতি থাকবে। ‘ওয়াল্ড প্রেস ফটো’র কর্মশালা আয়োজনের এটাই ছিল নির্ধারিত নিয়ম। কিন্তু শহিদুল তাদের বললেন, এভাবে দীর্ঘ সময় বিরতি দিয়ে আসলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। বছরের বাকি দিনগুলো শিক্ষার্থীরা কী করবেন? কিন্তু ‘ওয়াল্ড প্রেস ফটো’ তাদের বাজেট সীমাবদ্ধতার কারণে নিজেদের নির্ধারিত নিয়মে অনড় রইল।
তখন শহিদুল আলম ব্রিটেন থেকে আলোকচিত্রী বন্ধু ক্রার্স্টেন ক্লেয়ারকে পাঠশালায় নিয়ে এলেন শিক্ষক হিসেবে। এক বছরের জন্য একটি পাঠক্রম করা হলো। কর্মশালা বাদে বাকি দিনগুলোতে শহিদুল নিজেই ক্লাস নেন। পাঠশালা এখন আলোকচিত্রের উপর তিন বছর মেয়াদী কোর্স করাচ্ছে। পাঠক্রমও এখন আন্তর্জাতিক মানের। এখন ২৬ জন শিক্ষকের মধ্যে ২৪ জনই পাঠশালার প্রাক্তণ শিক্ষার্থী। তাঁরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে নানাভাবে তুলে ধরছেন, পুরস্কার জয় করছেন। যদিও এদেশের গণমাধ্যমে এই সাফল্যের প্রচার খুবই কম। প্রতি দুই বছর পর পর ঢাকায় আন্তর্জাতিক ‘ছবি মেলা‘ হচ্ছে। এর পেছনে প্রধান দায়িত্ব পালন করে দৃক আর পাঠশালা কর্তৃপক্ষই। শুরুতে দক্ষিণ এশিয়ায় এ ধরনের আয়োজন ছিলো ঢাকাতেই প্রথম। এখন অবশ্য চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, নেপালসহ নানা দেশেই হচ্ছে।
শহিদুল আলমের জন্ম ১৯৫৫ সালে ঢাকাতেই। বাবা ছিলেন বিখ্যাত চিকিৎসক কাজী আবুল মনসুর। মা কাজী আনোয়ারা মনসুর স্কুলশিক্ষিকা। পরিবারটি দেশ ভাগের পর ভারত থেকে ঢাকার আজিমপুরে চলে আসে। এই দম্পতির দুই ছেলে আর এক মেয়ে। বাড়িতে একটি বড় পাঠাগার ছিল। বই পড়ার নেশাটা সেখান থেকেই। কাজী আবুল মনসুর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হয়েছিলেন। সেই সময় তাঁর নিজের প্রচেষ্টা আর উদ্যোগেই দেশে প্রথম ওরস্যালাইন তৈরির কারখানা স্থাপন করেছিলেন। যা এখনো অব্যাহত আছে। কাজী আনোয়ারা মনসুর বিএ পাশ করেছিলেন কলকাতা থেকে। স্বাভাবিকভাবেই সেই সময়কার একটি রক্ষণশীল পরিবারে একজন গৃহবধূ আরো পড়াশোনা করবে- এটা ভাবাই যেন অস্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কাজী আনোয়ারা মনসুর নিজের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তখন এমএ পাশ করেছিলেন। বাংলাদেশে আসার পর তিনি মেয়েদের জন্য একটি স্কুল করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কেউ তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি। শেষে তিনি ১০ টাকা দিয়ে একটি পুরনো তাবু নিয়ে বসে পড়লেন আজিমপুর খেলার মাঠে। ১৪ জন ছেলেমেয়ে নিয়ে শুরু করে দিলেন স্কুলের কাজ। নাম দিলেন ‘আজিমপুর কিন্ডার গার্ডেন ‘। সেটিই এখনকার আজিমপুর অগ্রণী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এই কলেজে শিক্ষকতা করার সময়ই আনোয়ারার মনে হল, বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য তাদের মনোজগতটা খুব গভীরভাবে বোঝা প্রয়োজন। তিনি ৪৬ বছর বয়সে ‘চাইল্ড সাইকোলজি‘ নিয়ে পড়ার জন্য আমেরিকায় চলে গেছেন এবং পিএইচডি শেষ করে আবার স্কুলের কাজে মনোনিবেশ করেন। ৮০ বছর বয়স ch©šÍ তিনি প্রতিদিন স্কুলে যেতেন কাজকর্ম দেখার জন্য।
শুরুতে বুঝতে না পারলেও শহিদুল আলম ও তাঁর ভাই শামসুল আলম একসময় বুঝতে পারেন, তাদের বাবা-মা দুজনই স্ব স্ব ক্ষেত্রে বেশ বিখ্যাত। তাদের মনে হলো, আরে আমরা আমাদের বাবা-মায়ের পরিচয়ে কেন বড় হব? তাঁরা নিজেদের পরিচয়ে বড় হতে চান। ফলে দুই ভাই একদিন বাবা-মাকে গিয়ে বললেন, আমাদের নিজেদের নাম চাই। তাঁরা কারণ জানতে চান। দুই ভাই ব্যাখ্যা দিলেন। বাবা-মা কিন্তু ছেলেদের যুক্তি মেনে নিল। শহিদুল আলমের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল জাহেদ মনসুর। বদলে নামকরণ করা হল শাহেদুল আলম। শাহেদুল মানে পৃথিবীর সাক্ষী। পরে শাহেদুল আলম থেকে হন শহিদুল আলম। শহিদুল মনে করেন, তিনি যা করেন তা তো এক অর্থে কালের সাক্ষী। ফলে নামকরণের স্বার্থকতা আছে।
শহিদুল আলমের প্রতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার শুরু মায়ের হাতে গড়া সেই স্কুলে। তখন সেখানে ছেলেমেয়েরা একসঙ্গেই পড়াশোনা করতো। কিন্তু পড়াশোনার বাইরেও একটা বড় সময় মায়ের সঙ্গে সেই স্কুলেই কাটাতেন। পাঁচ খালাত বোন ছিল, যারা শহিদুল আলমকে ভীষণ আদর করতেন। তাদের সঙ্গেই বড় হয়েছেন তিনি। ছেলেবেলায় মেয়েদের সঙ্গে বেড়ে উঠাকে জীবনের একটি বড় পাওয়া বলে মনে করেন শহিদুল। কারণ, এর মধ্য দিয়েই তিনি মূলত লিঙ্গ বৈষম্যের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠেন। পরে যখন ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করতে যান সেখানে স্যোসালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। আন্দোলনের মধ্য দিয়েও এ ব্যাপারে আরো সচেতন হন। পরিবারের মধ্যে মাকে দেখেছেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে। বাবা এক্ষেত্রে কোনোদিন বাধা হয়ে দাঁড়াননি। ছোটবেলা থেকে পরিবারের মধ্যে এই শিক্ষাটা পেয়েছেন। পরবর্তী সময়ে ব্যক্তি জীবনেও শহিদুল আলম সেই চর্চাই অব্যাহত রেখেছেন। মুসলিম শরিয়া আইন অনুযায়ী বোন কম সম্পত্তি পাওয়ার বিধান থাকলেও শহিদুল আলম আর তাঁর বোন কাজী নাজমা করিম পৈত্রিক সম্পত্তি সমান দুইভাগে ভাগ করে নিয়েছেন। পাশাপাশি শহিদুল তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠানেও লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সবসময়ই সোচ্চার।
১৯৮৭ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন চলাকালে লড়াইয়ের ময়দানেই শহিদুল আলমের সঙ্গে পরিচয় হয় লেখক ও নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদের। দুজনই দুজনের খুব ভাল বন্ধু, সাথী। শহীদুল আর রেহনুমা আহমেদ এখনো একইসঙ্গেই লড়াই করছেন। শহীদুলের ভাষায়, তাঁর সবচেয়ে ভাল বন্ধু রেহনুমা। আবার সবচেয়ে ভাল ও কঠোর সমালোচকও রেহনুমা। এটাকে শহিদুল তাঁর জীবনের একটা পাওয়া বলে মনে করেন। শহিদুল মনে করেন, এই কঠোর সমালোচক থাকার কারণেই তিনি সবসময় ‘সোজা পথে চলার‘ সুযোগ পেয়েছেন। নিজের আদর্শ বা দর্শন থেকে একটু বিচ্যুত হলেই আর কেউ কিছু বলুক না বলুক, বাড়িতে একজন বলবেই, ‘শহিদুল কোন দিকে যাচ্ছিস‘। শহিদুল নিজেও তাই করেন। দুজনের এই বোঝাপড়াটাকেই নিজেদের চলার শক্তি, লড়াইয়ের শক্তি বলে মনে করেন তিনি।
শহিদুল আলম আর রেহনুমা আহমেদ খুব সচেতনভাবেই সন্তান নেননি। এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া শহিদুলের জন্যই খুব কঠিন ছিল। কারণ শহিদুল বাচ্চাদের খুবই পছন্দ করেন। কিন্তু তার পরও তাঁরা এটা বিশ্বাস করেন, চারপাশে এতো সন্তান রয়েছে, যারা সুবিধাবঞ্চিত। নতুন করে পৃথিবীতে আরো সন্তান আনার কী প্রয়োজন! একসময় মনে হয়েছিল, পালিত সন্তান নেবেন। কিন্তু A¨vKwUwf÷-জীবনে তাও হয়নি। শহিদুল আলম মনে করেন, ‘পেটের সন্তান নেই তো কী হয়েছে। আমাদের তো অনেক সন্তান। দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে আমি কত সন্তানকে বড় করেছি। আমার তো বিশাল পরিবার। রেহনুমা শিক্ষকতা করেছে। তারও কত সন্তান। আমাদের এত এত সন্তান। এ নিয়ে আমাদের কোনো আফসোস নেই। আমরা মনেও করি না যে, আমাদের সম্পদের প্রয়োজন রয়েছে। দুজনে মিলেই আমরা আমাদের সমস্ত সম্পদ দৃক আর পাঠশালাকে দিয়ে দিয়েছি।’
তথ্যসূত্র : ২০১৭ সালের জুন মাসের শুরুর দিকে রাজধানীর পান্থপথের দৃক গ্যালারিতে ড. শহীদুল আলমের একটি সাক্ষাতকার নেওয়া হয়। তার ভিত্তিতেই এই লেখাটি তৈরি করা হয়েছে।
লেখক-চন্দন সাহা রায়