সে এক ঘোর অন্ধকার কাল। পূর্ববঙ্গের মুসলমান ঘরের ছেলে চিত্রশিল্পী হবে- এটা ভাবাটাও বেদাতি। অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থরা সন্তানদের মাত্র মক্তব-পাঠশালার দিকে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু ছেলে ছবি আঁকবে এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এটাই ছিল সাধারণ চিত্র। কিন্তু ব্যতিক্রমও যে নেই তা তো নয়। নাহলে এদেশের মুসলিম চিত্রকলার ঐতিহ্যের জগত এতো ঋদ্ধ হতো কীভাবে? সেই প্রতিকূলতার মধ্যেও যারা নিজের ইচ্ছাশক্তির জোরে এদেশের চিত্রকলার যুগের গোড়াপত্তন করেছিলেন তাদের অন্যতম কাজী আবুল কাসেম। তিনি প্রথম বাঙালি মুসলিম কার্টুনিস্ট।
কাজী আবুল কাসেমের জন্ম ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে কোনো এক বৃহস্পতিবার রাতে। রাজবাড়ী জেলার পাংশা থানার পারকুলা গ্রামে। কাজী মকবুল আলী আর মেহেরুন নিসা খাতুনের তিন সন্তানের মধ্যে আবুল কাসেম ছিলেন দ্বিতীয়। বড় ভাই কাজী আবুল হোসেন তাঁর চেয়ে বছর দুয়েকের বড় আর ছোট ভাই কাজী মাসুম চার বছরের ছোট।
কাজী আবুল কাসেমের লেখাপড়ার হাতেখড়ি পারকুলা গ্রামের বাছের মুন্সীর পাঠশালায়। কিন্তু সেই পাঠশালাটি ছিল গ্রামে একেবারে শেষ প্রান্তে, ফলে যাতায়াতের কিছুটা অসুবিধা ছিল। তার চেয়ে বড় কথা শিক্ষক বাছের মুন্সী ছাত্রদের প্রচণ্ড প্রহার করতেন। সেই ভয়েও সেই পাঠশালা আর টানেনি কাজী আবুল কাসেমকে। পরে তিনি গ্রামের পাশের আখরজানি নিম্ন প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন। সেই স্কুলেই একদিন এক শিক্ষক ব্ল্যাকবোর্ডে একটি ইলিশ মাছ আঁকলেন। তারপর সব ছাত্রকে সেটা আঁকতে দিলেন। কাজী আবুল কাসেমের আঁকা মাছ দেখে সেই শিক্ষক খুব প্রশংসা করলেন। সেইদিন থেকেই কাজী আবুল কাসেমের ছবি আঁকার ভূতটা মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ে। মা ছেলের ছবি আঁকা দেখে খুব খুশি। তিনিও ছেলেকে ছবি আঁকায় উৎসাহ দেন। পরে একদিন বাড়ির সিন্দুক থেকে বের করে দেন ভারতীয় শিল্পী রবি বর্মার কতগুলো ছবি। সেসব ছবি কাজী আবুল কাসেমের বাবা কিনে এনে বাড়িতে রেখেছিলেন। ‘নৃত্যকরা ডানাকাটা পরীর মতো সুন্দরী নারী মূর্তি, একটা দুটো নয়, অনেকগুলো- নানা ছন্দে, নানা ভঙ্গিতে ছবির পট উজ্জ্বল করে রেখেছে। কত রঙের কত সুন্দর অলংকার। নোটল খোঁপায় ফুলের মঞ্জরী। পটভূমিতে পুষ্পিত কানন, নদী ও নীল আকাশের স্বর্গীয় আবহ।‘ এসব চমৎকার চমৎকার সব ছবি দেখে সেই বালক বয়সেই কাজী আবুল কাসেম মুগ্ধ হয়েছিলেন। ছবি দেখতে দেখতে তার কান্না পেয়ে যায়।
বাবা কাজী মকবুল আলী ছিলেন বাড়ি থেকে পাঁচ মাইল দূরে নবাব শামছুল হুদা বাহাদুরের বেগম আসমত উন্নসার পদমদি এস্টেটের পাঁচআনীর নায়েব। মুসলিম বাংলার পথিকৃৎ সাহিত্যিক ‘বিষাদ সিন্ধু‘ খ্যাত মীর মশাররফ হোসেনের সহকর্মী ছিলেন তিনি। ফলে দুজনের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। কাজী মকবুল আলী ছিলেন মীর মশাররফ হোসেনের লেখার ভক্ত। কাজী মকবুল আলী সেই সময়েই বাইসাইকেল চড়ে বাড়ি থেকে প্রতিদিন কাচারিবাড়ি যেতেন। মীর মশাররফ হোসেন মাঝে মধ্যে সাইকেলে চেপে কাজী মকবুল সাহেবের বাড়িতেও আসতেন। খুব অল্প বয়সে, কাজী আবুল কাসেমের বয়স যখন চার বছর তখন তিনি বাবাকে হারান। কাচারিবাড়িতেই তিনি মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার পর ছোট ছোট তিনটি ছেলেকে নিয়ে মা অথৈ সাগরে পড়েন। যদিও কাজী আবুল কাসেমদের বেশ জমিজমা ছিল। কিন্তু সেসব রক্ষা করায় তিনি পারঙ্গম ছিলেন না। বাবা মারা যাওয়ার এক বছরের মাথায় আবুল কাসেম মাকেও হারান। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে তিন ভাই এতিম হয়ে মামাবাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন।
বাবা-মা মারা যাওয়ার পর কাজী আবুল কাসেম ও তার দুই ভাই যেন অথৈ জলে পড়লেন। তিন ভাইকে তাদের নানাবাড়ি নিয়ে যাওয়া হল। নানা মৌলবি কাজী জনাব আলী ছিলেন ওই এলাকার সভ্রান্ত মুসলিম ব্যক্তিত্ব। তিনি মশহুর পীর সাহেব নামে খ্যাত ছিলেন। তিনি এলাকার মান্যগণ্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। নানাবাড়ি যাওয়ার সময় ছবি আঁকার নেশাটাও আবুল কাসেমের সঙ্গে গেল। তার ধারণা ছিল, ছবি আঁকলে নিশ্চয়ই বাড়ির সবাই প্রশংসা করবে। কিন্তু মামাবাড়ির লোকজন ছিলেন খুবই রক্ষণশীল। তাঁর উপর পীর সাহেবের বাড়ি। সেখানে ছবি আঁকা তো হারাম। তবু আবুল কাসেম লুকিয়ে লুকিয়ে ছবি আঁকেন। এই ছবি আঁকার অপরাধে তাঁকে মামাদের হাতে মার খেতে হয়েছে। একদিন ছবি আঁকার সাধের খাতাটাই টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন মামা। আবুল কাসেমের কাছে এটা ছিল মারের চেয়ে বেশি কষ্টের। তার এতদিনের আঁকা সব ছবি ওই খাতাটাতেই ছিল।
আর মামাবাড়ি থাকার অভিজ্ঞতাও ছিল ভয়ানক রকমের নির্মমতার।তিন ভাইকে মামা-মামীরা ক্রীতদাসের মতো ব্যবহার করতেন। সারা দিন তাদেরই কাজকর্ম করতে হত। নানা স্থানীয় একটি উচ্চ প্রাইমারি স্কুলে দুই ভাইকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এসবের মধ্যে পড়াশুনা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। আবুল কাসেমের বড় ভাই তো পড়াশোনা ছেড়েই দিলেন।এর মধ্যেই একদিন এক মামা বললেন, ‘এখন তো তোরা বড় হয়েছিস। তোদের জমিজমার অভাব নেই। এবার দেশে ফিরে যা।‘ অগত্যা তিন ভাইকে আবার বাবার ভিটেতে ফিরে আসতে হলো।
১৯২৬ সালে ফরিদপুর শহরের এক খ্রিস্টান পার্দ্রি রেভারেন্ড বার্বার কাজী আবুল কাসেমের ছবি আঁকা দেখে খুব মুগ্ধ হলেন। ওই বছরের জুলাই মাসে তিনি তাকে কলকাতায় নিয়ে গেলেন এবং সেখানে গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তির চেষ্টা করলেন। আবুল কাসেম সেখানে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হলেন বটে কিন্তু বয়সের কারণে তাঁকে ভর্তি হতে দেওয়া হল না। তখন ১৮ বছরের নীচে কাউকে ভর্তি করা হত না। ফলে তিনি আবার দেশে ফিরে আসেন এবং স্থানীয় বালিয়াকান্দি উচ্চ ইংরেজি স্কুলে আবার পড়াশোনা শুরু করেন। লেখাপড়ায় ভাল ছিলেন। ক্লাসে প্রথম হতেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড় অবস্থায় লেখাপড়া বাদ দিয়ে বড় ভাইয়ের সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসাম চলে যান। দুই ভাইয়ের এ যাত্রা ছিল একেবারেই অজানার উদ্দেশ্যে। কারণ, আসামে তাদের পরিচিত কেউ ছিলেন না। বাড়ি থেকে কিছু পয়সা নিয়ে গেলেন। আসামের কামরূপ কামাখ্যা, পাণ্ডুয়া, গৌহাটি, লামডিং ও নাহোরজোন প্রভৃতি অঞ্চলে ঘুরে বেড়ালেন। এসব জায়গার পাহাড়-পর্বত, বন-উপত্যকার ল্যান্ডস্কেপ আঁকেন। টানা ঘুরাঘুরির কারণে একসময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। অর্থ সংকটও দেখা দেয়। তখন কাজী আবুল কাসেম জীবীকার তাগিদে লামডিংয়ে রেলওয়ের এক ঠিকাদারের অধীনে কাজ নিতে বাধ্য হন। সেখানে কাজ করে হাতে কিছু পয়সা আসে। ১৯২৮ সালের দিকে তিনি আসাম ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। কলকাতায় তখন নিজের আত্মীয় বলতে কেউ ছিল না। পরিচিত মানুষও খুব কম ছিল যাদের কাছে যাওয়া যায়। তার মধ্যে সেখানে আর্ট স্কুলে ভর্তির জন্য আবার চেষ্টা করেন। এবার টাকার জন্য পড়তে পারলেন না। তবে এবার আর ফিরে এলেন না। পরিচিত সাংবাদিক বন্ধু শামসুর রহমান চৌধুরীর প্রচেষ্টায় কলকাতার ৩৩-বি হ্যারিসন রোডে এন. মিত্র এন্ড কোং নামের একটি কমার্শিয়াল আর্টের স্টুডিওতে সামান্য বেতনে কাজে লেগে গেলেন। জীবীকার তাগিদে এখানে কাজ শুরু করলেও জায়গাটি ধীরে ধীরে তাঁর প্রাণের খোড়াকও দিতে লাগল। কারণ এন. মিত্র এ্যান্ড কোম্পানিটি ছিল সেই সময়ের কলকাতা শহরের সব নামজাদা শিল্পীদের আড্ডাস্থল। এন মিত্র অর্থাৎ নরেন্দ্রন মিত্র নিজেও শিল্পী ছিলেন। ফলে তিনি নিজে হাতে-কলমে কাজী আবুল কাসেমকে কাজ শেখালেন। সেখানে টানা ১৯৪১ সাল পর্যনন্ত কাজ করেন এবং সেখানের প্রধান চিত্রশিল্পী হয়েছিলেন।
যার সহায়তায় এন মিত্র এ্যান্ড কোম্পানিতে তিনি কাজের সুযোগ পেয়েছিলেন, সেই শামসুর রহমান চৌধুরী তাঁর স্মতিচারণামূলক গ্রন্থ ‘পঁচিশ বছর‘-এ লিখেছেন, ‘‘শিল্পী আবুল কাসেমও প্রায় এই সময়েই আমাদের ‘তাবলীগ‘ (মাসিক পত্রিকা, ১৯২৭-এ প্রকাশিত) অফিসের আড্ডায় এসে হাজির হন চতুর্দশ বর্ষীয় এক ভবঘুরে কিশোর হিসেবে। ছবি আঁকায় তাঁর বেশ হাত আছে দেখে প্রথমত তাঁকে ইন্ডিয়ান আর্ট স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়।কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি জানালেন- এই তথাকথিত আর্ট স্কুলে মোটেই কিছু শিখানো হয় না। কাজেই সেখানে যাওয়া-আসা অর্থহীন। ব্লক মেকার এন. মিত্রের দোকানেই এরপর তাঁকে চাকরি নিয়ে দেওয়া হলো। এর পরের কাহিনী তাঁর নিজস্ব প্রতিভার আত্মবিকাশেরই কাহিনী। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়ই অত:পর তিনি তাঁর পথ করে নিলেন। এবং শিগগির শিল্পী হিসেবে তাঁর রাম এমনভাবে স্বীকৃতি লাভ করলো যে, ‘প্রবাসী’, (প্রবাসী নয়, ভাতরবর্ষ- বদরুল আমীন) ‘বিচিত্রা’ প্রভৃতি অভিজাত পত্রিকায় তাঁর আঁকা ছবি ছাপা হতে লাগল।”
তখন কলকাতায় মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের ‘সওগাত’ পত্রিকা খুব জমজমাট অবস্থা। সেখানেই একদিন নিজের হাতের আঁকা একটি কার্টুন নিয়ে যান ছাপানোর জন্য। সেটা ১৯৩০ সাল। কাজী আবুল কাসেম তখন কিশোর। তার কার্টুন নাসিরউদ্দিন সাহেবের খুব পছন্দ হয়। তিনি সেটা ‘সওগাত‘ পত্রিকায় ছেপে দেন এবং কাজী আবুল কাসেমকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। ১৯৭৪ সালে মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন সেদিনের সেই ঘটনাটির কথা স্মরণ করে এক জায়গায় লিখেছিলেন, “আজ থেকে ৪৪ বছর আগের কথা। সাদাসিদে পোষাক-পরা এক তরুণ তাঁর আঁকা একটি কার্টুন চিত্র নিয়ে ১৯৩৭ সালের অগ্রহায়ণ মাসের একদিন এলেন ‘সওগাত‘ অফিসে। নাম জিজ্ঞাস করতে বল্লেনঃ কাজী আবুল কাসেম। ছবিটি দেখে আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম এই কারণে যে, তখনো পর্যন্ত বাংলার কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলমান সমাজে কোনো চিত্রশিল্পী বা ভাস্করের আবির্ভাব হয়নি।
১৩২৫ সালে ‘সওগাত‘-এর আত্মপ্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ১২ বছর পর এই প্রথম একজন মুসলিম চিত্রশিল্পীর সন্ধান পেয়ে আমি যে কতোটা আনন্দিত হয়েছিলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। শিল্পীকে উৎসাহ দেবার জন্য পরবর্তী সংখ্যা সওগাতেই (পৌষ, ১৩৩৭) আমি তাঁর এই ছবিটি পত্রস্থ করি। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত এটাই তাঁর প্রথম ছবি। সওগাতের পাঠকগণ এর যথেষ্ট প্রশংসা করেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামও ছবিটি দেখে হাসি সম্বরণ করতে পারেননি। এর পরেও সওগাতে এই শিল্পীর আঁকা নানা ধরনের ছবি ছাপা হয়েছিল।
আমার প্রদত্ত উৎসাহ কাজী আবুল কাসেমের শিল্পীজীবনে কতটা কার্যকরী হয়েছিল, তা তিনিই বলতে পারেন। তবে সেই অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের যুগে তিনি যেভাবে সর্বপ্রথম সাহস করে নিষেধের বেড়াজাল ভেঙ্গে চিত্রশিল্পে আত্মনিয়োগ করেছিলেন এবং এই বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত সাধনা করে এক আদর্শ স্থাপন করেছেন। আমাদের সমাজে তা অতুলনীয়।”
কাজী আবুল কাসেম সারা জীবনই মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের সেই অবদান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছিলেন। দেশ ভাগ হওয়ার পর নাসির উদ্দীন ঢাকায় চলে আসার পর দুজনের মধ্যে গভীর সম্পর্ক অটুট ছিলো। ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত তাঁর আঁকা অনেক সুকুমার চিত্র কলকাতা থেকে প্রকাশিত ভারতবর্ষ, বসুমতি, মোহম্মদী, হানাফি, সওগাত বঙ্গলক্ষ্মী পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হত। বলা চলে, সেই সময়ে তিনিই ছিলেন একমাত্র মুসলিম চিত্রকর। সুকুমার চিত্র, ব্যঙ্গচিত্র ও ব্যবহারিক চিত্রে তিনি সফলতা অর্জন করেন।
সেই সময়টির একটি চিত্র পাই পটুয়া কামরুল হাসানের জবানিতেও। তিনি লিখেছেন, “সে যুগটি ছিল ‘প্রথম বাঙালি মুসলমানের’ যুগ। আমি বলছি ভারত ভাগ হওয়ার প্রাক্কালের কথা। তখনকার বাঙালি মুসলমানরা শিক্ষা এবং শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নিশ্চিত পদক্ষেপে মাত্র বিচরণ আরম্ভ করছে।এটা এই শতাব্দীর তিন দশকের কথা। তখনকার বাংলাদেশের মাসুলমানরা নতুন চেতনায় চোখ মেলে তাকিয়েছে মাত্র। ১৯৩৫/৩৬ সালে আমার বয়স যখন খুবই অল্প, ছবি আঁকার নেশা তখন থেকেই। অন্য অনেকের মত আমিও একজন রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে। ছবি আঁকা তখনও মোটামুটি নিষিদ্ধ বৃত্তি। অথচ ছবি আঁকা ছাড়া আর কোন ধ্যানজ্ঞান নাই, এমনি যখন পরিস্থিতি তখন স্বাভাবিক ভাবেই এই দুঃসাহসিক কাজে আর কে কোথায় আছে সন্ধান করতে হয়। এমনি সময়েই সেই কিশোর বয়সে মোহাম্মদীর পৃষ্টায় দেখলাম শিল্পী আবুল কাসেম-এর আঁকা ছবি। মুসলমানরা ছবি আঁকছেন। কিছুদিন পরেই জয়নুল আবেদীন, আব্দুল মঈন, এঁদের পরিচয়ও পেলাম বুলবুল এবং সওগাত-এর মাধ্যম।”
কলকাতায় থাকার সময় বিভিন্ন কোম্পানিতে ছবি আঁকার কাজ করেন কাজী আবুল কাসেম। তবে বেশি সময় কাজ করেছেন এন মিত্র অ্যান্ড কোম্পানিতে। সেই সময়ে তাঁর বিরল অভিজ্ঞতা হয় কার্টুনি চলচ্চিত্রের সঙ্গে কাজ করার। মিত্র অ্যান্ড কোম্পানিতে নলিনী নামের একজন সহকর্মী আবুল কাসেমের। একদিন নলিনী মুম্বাই চলে গেলেন কীভাবে কার্টুন ছবি বানাতে হয় তা শেখার জন্য। ছবি বানানোর প্রক্রিয়া শিখে তিনি ফের চলে আসেন কলকাতায়। তিনি এসে কয়েকজনকে এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেন। তার মধ্যে আবুল কাসেমও ছিলেন। তিনিই ছিলেন একমাত্র মুসলিম কার্টুনিস্ট। সেই ছবির নাম ছিল ‘সাবাস’ আর এর প্রধান চরিত্রটি ছিল শেখ চিল্লি। সে সময় তাঁরা প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন ছবিটি বানাতে। প্রতি সেকেন্ডের জন্য তাদের ২২ থেকে ২৪টি করে কার্টুন আঁকতে হয়।
কাজী আবুল কাসেম চল্লিশের গোড়ায় কলকাতায় একটি চাকরি পেলেন। বেশ ভাল চাকরি। ডিপার্টমেন্ট অব ইন্ডাস্ট্রিজ আর্টিস্ট ডিজাইনারের পদ। পরিবার নিয়ে থাকতেন বেনিয়াপুকুর অঞ্চলে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম লেনের একটি বাড়িতে। এর কিছু দিন পরেই দাঙ্গার দামামা বেজে ওঠে। সেই সময়ের একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করে শিল্পী লেখেন, ‘একদিন সকালেবেলা ঐ একই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ চোখে পড়লো এক অদ্ভুত দৃশ্য। একটা চটের বস্তায় বাঁধা ভারি কোনো জিনিস। হতে পারে কোনো গাছের গুঁড়ি বা অন্য কিছু। বাহির থেকে দেখে বোঝা যায় না। বস্তার মুখটা বেশ টাইট করে বাধা, এবং সেই বাঁধনের সঙ্গে কয়েক গজ লম্বা একটা শক্ত রশির শেষ প্রান্তটি ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলেছে নোংরা কাপড় পরা বিশ্রী চেহারার একটা লোক সুরেশ সরকার রোডের দিকে। যতই সে এগিয়ে চলছে চটের বস্তার পিছন দিকে একটা লাল রঙের ছোপ রাস্তার উপর লম্বা দাগ টানতে টানতে চলছে সমানে অনেক দূর পর্যন্ত কি বিভৎস্য দৃশ্য! যখন বুঝতে পারলাম ব্যাপারটার প্রকৃত অর্থ, তখন আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে মাথার চুল পর্যন্ত খাড়া হয়ে উঠলো। ঐ বস্তার মধ্যে নির্ঘাত কোনো মানুষের মৃতদেহ। সদ্য খুন করা মানুষের লাশ। তাই তাজা রক্তের ফিনকি চটের বস্তা ভেদ করে বাইরে চুইয়ে পড়ছে রাস্তার বুকে।’
পঞ্চাশের দশকে কলকাতায় দাঙ্গার পর কাজী আবুল কাসেম পরিবার নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। প্রথম কিছুদিন তিনি খুলনায় বসবাস করেন। তারপর ঢাকায় চলে আসেন। পরিবার নিয়ে থিতু হন কয়েতটুলির আগামসি লেনের একটি বাড়িতে। সেখানেই একটি কমার্শিয়াল ছবি আঁকার স্টুডিও গড়ে তোলেন। নিজে তো কাজ করতেন, পাশাপাশি আরো দুজন সহকর্মীকেও রেখেছিলেন ছবি আঁকার জন্য। এরপর বংশীবাজারের চায়না পল্লীতে। সেখানে কাজের লোক ছিল চারজন। প্রচুর চীনা আর ইরানিরা বসবাস করতেন সেখানে। এরপর মৌলভীবাজারের বেচারাম দেউড়িতে। তারপর ১৯৬৩ সালে জিন্দাবাহার লেনে। তারপর নিজে বাড়ি করে কলাবাগানে চলে আসেন।
মুসলমানদের জন্য ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তান হলেও সেখানে বাঙালিদের অধিকার কতটুকু রক্ষিত হবে তা নিয়ে সংশয় কম ছিলো না। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে আড়াই হাজার মাইলের ব্যবধান। প্রতিষ্ঠার শুরুতেই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে প্রথম বিদ্রোহ দানা বাঁধে। কাজী আবুল কাসেম সরাসরি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না হলেও তিনি রাজনীতি সচেতন মানুষ। ছবি আঁকার পাশাপাশি রাজনৈতিক কার্টুন আঁকেন। সেসব বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়। ব্রিটিশ সরকারের আমলেও নানা রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে ছবি এঁকেছেন আবুল কাসেম। মানুষ সেসবের প্রশংসা করেছে। সরকারের দিক থেকে কখনো কোনো চাপের মধ্যে পড়েননি। কিন্তু পাকিস্তান আমলে এসে তিনি বুঝতে পারলেন, রাজনৈতিক কার্টুন আঁকাটা তাঁর জন্য খুব সহজ হবে না। একবার তিনি পাকিস্তান নিয়েই একটি কার্টুন আঁকলেন। থিমে তিনি দেখালেন, একটি গরু পূর্ব পাকিস্তানের মাঠে ঘাস খাচ্ছে কিন্তু দুধ দিচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে।এই কার্টুন প্রকাশের পর সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়।যাই হোক, এসবের মধ্যেও তিনি ছবি এঁকেই জীবনধারণ করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কার্টুনকে সেই সময়ে পেশা হিসেবে নেওয়া একেবারেই কারো পক্ষে সম্ভব ছিলো না। যদিও সেই সময়ে কার্টুন আঁকার শিল্পীই ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন।
সেই সময়েই ভাষা অন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বর্ণমালা নিয়ে তাঁর আঁকা ব্যঙ্গচিত্র ‘হরফ-খেদা আন্দোলন‘ তমদ্দুন মজলিসের সাপ্তাহিক ‘সৈনিক‘ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এটা ব্যাপক আলোড়ন তোলে। একই কার্টুন তখন অন্যান্য পত্র-পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়। ভাষা আন্দোলনের সভা-সমাবেশে সেই চিত্র ব্যবহার করা হয়। ‘বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ বরকতের রক্ত-রাঙা জামা পতাকার মত করে একটা লম্বালাঠির মাথায় ঝুলিয়ে যে বিশাল প্রতিবাদ মিছিলের জোয়ার নেমেছিল সেই মিছিলে‘ তিনি নিজেও শরিক হয়েছিলেন।
১৯৬০ সালে একবছর অস্থায়ীভাবে টেকস্ট বুক বোর্ডের আর্ট রিভ্যুয়ার এবং ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ফ্রাঙ্কলিন বুক প্রোগ্রামের প্রধান শিল্প নির্দেশক ও শিশু সাহিত্যের বইয়ের রিভ্যুয়ার হিসেবে কাজ করেন।
কাজী আবুল কাসেম ১৯৩৭ সালে হাসিনা বেগমের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। হাসিনা বেগমের বাড়ি ছিল যশোরে, তাঁর বাবা ছিলেন কাজী আবুল কাসেমের মামা। তাদের পাঁচ ছেলে ও চার মেয়ে। প্রফেসর কাজী হাসিন আক্তার পারুল, কাজী খায়রুল বাসার বাবুল, কাজী কামরুজ্জামান, নিলুফার রুবাইয়াত, বিলকিস রুনা, জুলিয়া আক্তার, কাজী মাহমুদ হাসান, কাজী জাহিদ হাসান, কাজী আবুল ফজল।
২০০৪ সালের ১৯ জুলাই ৯২ বছর বয়সে ঢাকা ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে মারা যান এই গুণী শিল্পী। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে- ‘ছড়ার বই কাঁচা মিঠে‘, ‘সবুজ ছড়া‘, ছোটদের গল্পের বই ‘গামা মামার সা. রে গা. মা‘, ‘কাজলা পুষি‘, হেলেন জে জর্ডান থেকে অনুবাদ গ্রন্থ ‘বীজের বুকে সবুজ পাতা‘, ‘হাতেম তায়ী‘, সচিত্র কমিম ‘জাম্বো ভাঁজে ডাম্বেল‘, গানের বই ‘গানগুলো মোর‘।
গুণী এই শিল্পী শিশু সাহিত্যে বাংলা একোডেমি পুরস্কার (১৯৭৮), জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র পুরস্কার, নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৮৯), শিল্পী এস এম সুলতান স্বর্ণপদক (১৯৯৪), মাহবুব উল্লাহ জেবন্নেসা কল্যাণ ট্রাস্ট স্বর্ণপদক, শিশু একাডেমি পুরস্কার, বাংলাদেশ চারুশিল্পী সম্মাননা (১৯৯০), তমদ্দুন মজলিশ মাতৃভাষা পদক (২০০১) ইত্যাদি পুরস্কার পেয়েছেন।
লেখাটির জন্য ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে কাজী আবুল কাসেমের ছেলে কাজী কামরুজ্জামানের সাক্ষাতকার নেওয়া হয়। এ ছাড়া সাংবাদিক সোহরাব হাসান কিছু তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন।
মোহাম্মদ বদরুল আমীন খানের ‘পথিকৃৎ চিত্রশিল্পী কাজী আবুল কাসেম’, কাজী আবুল কাসেমের ৭৬তম জন্মদিন উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণীকা থেকে সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে।
লেখক-চন্দন সাহা রায়