১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। সিপাহী বিদ্রোহের আড়ালে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস তখন তুঙ্গে। পাকিস্তানী হানাদারদের বুলেট থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া আবু ওসমানকে তত্কালীন গুলশানের বাড়িতে হত্যা করতে আসে সিপাহীরা। আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সমর্থনই ছিল তাঁর অপরাধ। সেইসময় তিনি বাসায় ছিলেন না। কিন্তু সিপাহীদের ধারণা তিনি হয়তো বাসার ভিতরেই কোথাও লুকিয়ে আছেন। তাই প্রত্যেকটা ঘরের আনাচে কানাচে তারা চালাতে থাকে বেপরোয়া গুলি। ফলে বাসায় যারা ছিলেন মুহূর্তের মধ্যেই তাদেরকে চলে যেতে হলো অন্য দুনিয়ায়। নাজিয়া খানম। তিনি ছিলেন আবু ওসমানের প্রাণপ্রিয় স্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধে সারা বাংলার নারী জাতির একজন প্রতিনিধি। ৭ নভেম্বর সিপাহীদের বুলেটে তিনি ঝাঁঝড়া হয়ে যান। অথচ তাঁর অনুপ্রেরণায় আবু ওসমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সফল সেক্টর কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে আবু ওসমান আজও কাজ করে যাচ্ছেন তাঁর স্ত্রীর অদৃশ্য ইশারায়। স্ত্রীকে হারিয়ে ৩৩ বছর ধরে আবু ওসমান চৌধুরী একাকী ও নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করছেন। স্ত্রীর প্রতি অদৃশ্য ও অগাধ ভালোবাসাই তাঁর বর্তমান সঙ্গী।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, নির্বাচনের রায়কে বানচাল করার জন্য অচিরেই পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) উপরে নেমে আসবে এক বড় রকমের আঘাত। তাই রাওয়ালপিন্ডিতে কর্মরত তত্কালীন মেজর আনোয়ার উল্লাহ ও ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিনের সহায়তায় তিনি পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস-এ (বর্তমান বিজিবি) বদলি নিয়ে ঢাকা আসেন। ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর রাতে ঢাকার বুকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণ ও গণহত্যার খবর পেয়ে মেজর ওসমান ২৬ মার্চ তাঁর বাহিনী সহকারে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সে সময় তাঁর অবস্থান ছিল তত্কালীন কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গা মহকুমা সদরে। ২৭ মার্চ যশোর থেকে আগত একজন পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন ও ৩ জন সৈনিক তাঁর এলাকাতে ছোট একটি সংঘর্ষে নিহত হওয়ার পর মেজর ওসমান আন্তর্জাতিক সীমানায় অবস্থিত তাঁর ৪ কোম্পানি সৈন্যকে অগ্রগামী করে স্থানীয় জনগণের সহায়তা নিয়ে ৩০ মার্চ কুষ্টিয়া আক্রমণ করেন। সেখানে অবস্থানরত ৪ জন অফিসার ও ২শ’ পাকিস্তানী সৈন্যের এক বিরাট বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে কুষ্টিয়া জেলা শত্রুমুক্ত করেন।
আবু ওসমান বুঝতে পারছিলেন যশোরকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে হলে প্রথমে কুষ্টিয়াকে মুক্ত করতে হবে। কারণ পেছনে শত্রু রেখে সামনের শত্রুকে মোকাবেলা করা যায় না। তাই সঙ্গে সঙ্গে ডা. আসহাবুল হক, এডভোকেট ইউনুস আলী ও ব্যারিস্টার বাদল রশীদের সমন্বয়ে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদ ডেকে তাঁদের সঙ্গে আক্রমণের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করেই পরিকল্পনা তৈরি করেন তিনি। নির্দেশনা অনুযায়ী ২৮ মার্চ কোম্পানীগুলো সমবেত হবার পর ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরীকে কুষ্টিয়ার রণাঙ্গনের সার্বিক সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব প্রদান করেন এবং ৩০ মার্চ ভোর ৪ টায় আক্রমণের সময় নির্ধারণ পূর্বক কুষ্টিয়া আক্রমণের নির্দেশ দেন। পরিকল্পনা মোতাবেক সুবেদার মেজর মোজাফফরের কোম্পানী কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন, ক্যাপ্টেন আজমের বাহিনী কুষ্টিয়া জেলা স্কুল এবং নায়েব সুবেদার মুনিরুজ্জামানের কোম্পানি মোহিনী মিল ও ওয়ারলেস স্টেশন একযোগে আক্রমণ করে। তিন দিকের যুগপত্ আক্রমণে এবং প্রতি কোম্পানীর সৈন্যের পশ্চাতে অনুসরণকারী লাঠি, দা-বল্লম সজ্জিত হাজার হাজার বেসামরিক লোকের জয়বাংলা ধ্বনিতে পাকিস্তানী সেনারা হতবুদ্ধি হয়ে পুলিশ লাইন ও ওয়ারলেস স্টেশন ছেড়ে মূলঘাঁটি জেলা স্কুলে জমায়েত হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পালাবার পথে অধিকাংশ হানাদার সৈন্য নিহত হয়। সেদিন সন্ধ্যার পূর্বেই জেলা স্কুল ব্যতীত সমগ্র শহর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
এই যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহনীর ৩ জন অফিসার ও দুই শতাধিক জোয়ান নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৪ জন শহীদ ও বেশ কয়জন আহত হয়। পরবর্তীকালে পাকিস্তানী বাহিনী কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গার ওপর সীমাহীন অত্যাচার চালালেও এ কথা ভেবে কুষ্টিয়াবাসীর গর্ব করার কারণ আছে যে, হানাদারবাহিনী কর্তৃক ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ শুরু করার প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই নিজ বাহিনীকে অগ্রগামী করে আক্রমণাত্মক ভূমিকা দ্বারা হানাদার বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে একটি জেলাকে শত্রুমুক্ত করার কৃতিত্ব আজ ঐতিহাসিকভাবে একমাত্র মেজর ওসমান ও তাঁর বাহিনী এবং কুষ্টিয়া জেলার ছাত্র জনতার।
২৬ মার্চ ১৯৭১। আবু ওসমান পদ্মা মেঘনার ওপারে কুষ্টিয়া থেকে বরিশাল জেলা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাকে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন নামকরণ করে সে রণাঙ্গনের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার তাঁকে দক্ষিণ পশ্চিমাংশের আঞ্চলিক কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করেন। মে মাসের শেষার্ধে প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানীর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনকে দুই ভাগ করে ৮ নং ও ৯ নং সেক্টরদ্বয় গঠন করা হয় এবং ৮ নং সেক্টরের দায়িত্বে আবু ওসমানকে নিয়োগ করা হয়। প্রাথমিকভাবে সে সময় ওই সেক্টরের অপারেশন এলাকা ছিল কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর ও পটুয়াখালী জেলা। মে মাসের শেষে অপারেশন এলাকা সংকুচিত করে কুষ্টিয়া ও যশোর, খুলনা জেলা সদর, সাতক্ষীরা মহকুমা এবং ফরিদপুরের উত্তরাংশ নিয়ে এই এলাকা পুনর্গঠন করা হয়। এই সেক্টরের প্রধান ছিলেন আবু ওসমান চৌধুরী এবং পরে মেজর এম এ মঞ্জুর। এই সেক্টরের হেডকোয়ার্টার বেনাপোলে থাকলেও কার্যত এ হেডকোয়ার্টারের একটা বড় অংশ ছিল ভারতের কল্যাণী শহরে। সেক্টরের সৈন্যদের মধ্যে ২ হাজারের মতো ছিল নিয়মিত বাহিনী এবং ৮ হাজার ছিল গণবাহিনী। এই সেক্টর ৭টি সাব সেক্টরে বিভক্ত ছিল।
সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পাওয়ার পর পরই আবু ওসমান তাঁর বাহিনী পুনর্গঠন করেন এবং এক পর্যায়ে সম্মুখ সমর পরিহার করে যথাসম্ভব তিনি গেরিলা পদ্ধতিতে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য নির্দেশ দেন। সমস্ত সাব সেক্টরেই তিনি এই নির্দেশ প্রচার করেন। ১৫ মে থেকে নিয়মিতভাবে প্রত্যেক কোম্পানীকে সাপ্তাহিক অপারেশনাল টাস্ক দিতে থাকেন আবু ওসমান। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তিনি প্রতিনিয়তই কোম্পানী থেকে কোম্পানী এলাকা ভ্রমণ, পরিদর্শন ও অপারেশনাল কাজকর্মগুলো সমন্বয় করেন। প্রায় প্রত্যেক অপারেশন টাস্ক সম্পন্ন করতে গিয়ে কিছু না কিছু পাক সেনা হতাহত এবং অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করা হতো। মাঝে মাঝে শত্রুসেনা বন্দিও করা হতো। রাজাকারদের আত্মসমর্পণ ও দালাল নিধন ছিল প্রায় নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ১৯৭১ সালের ২৭ মে ভোর ৪টায় পাকিস্তানিরা ২ কোম্পানী সৈন্য নিয়ে সাতক্ষীরার ডোমরায় অবস্থানরত আবু ওসমান বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। শুরু হয় তীব্র যুদ্ধ। আবু ওসমান তাদেরকে প্রতিহত করতে সমর্থ হন। এরপর মুহূর্মুহু তারা আক্রমণ চালায়। কিন্তু প্রত্যেকবারই ওসমান বাহিনী তাদের এ আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়। ১৭ ঘন্টা স্থায়ী ওই যুদ্ধে পাকিস্তানের প্রায় তিনশ সৈন্য হতাহত হয়। এদিকে পাকিস্তানী ব্যাটালিয়নের দ্বিতীয় কমান্ডার, একজন ক্যাপ্টেন ও কয়েকজন জওয়ানও ওই হামলায় নিহত হন। এ যুদ্ধের পর থেকে ভারতীয় জনসাধারণ বাঙালীদের বীরত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে। এভাবেই চলতে থাকে ওসমানবাহিনীর দৈনন্দিন মুক্তিযুদ্ধ ও শত্রুহনন অভিযান। এক হিসেবে দেখা গেছে, এই সেক্টরে গড়ে প্রতিমাসে ৭০০ শত্রুসেনা নিধন হয়েছে।
১১ আগস্ট আবু ওসমান চৌধুরীকে বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর এম এ মঞ্জুর। আবু ওসমানকে মুক্তিবাহিনীর সদর দফতর মুজিবনগরে এসিসট্যান্ট চিফ অব স্টাফ (লজিস্টিকস) এর দায়িত্ব পরিচালনার নির্দেশ দেয়া হয়। আকস্মিকভাবে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার ঘটনাটি মেনে নিতে পারেননি তিনি। এ সংবাদে সেক্টরের নিয়মিত বাহিনীও অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। ওদিকে মেজর এম এ মঞ্জুর দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁর বাহিনী পুনর্গঠন করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরে ডিসেম্বরে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় মিত্রবাহিনী। যৌথবাহিনী শত্রুদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে একের পর এক এলাকা জয় করতে থাকে। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ মুক্ত হয়। স্বাধীন হওয়ার পর জনমনে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। জয়বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে বাংলার আকাশ বাতাস।
আবু ওসমান চৌধুরী ১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারী বর্তমান চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানাধীন মদনেরগাঁও গ্রামের চৌধুরী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আব্দুল আজিজ চৌধুরী ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। তাঁর মা ছিলেন হাজিগঞ্জ থানাধীন কাঁঠালি গ্রামের কাজী পরিবারের সন্তান। অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন তাঁর মা। জমিদার মিয়ারাজা হাজি তাঁর কনিষ্ঠ ছেলে আব্দুল আজিজ চৌধুরীর বউ হিসেবে ১৯২৮ সালে তাঁকে ঘরে তুলে আনেন। তাঁর নাম ছিল মাজেদা খাতুন। ৯ বছর ঘরকন্নার পর দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে মাজেদা খাতুন অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। মায়ের মৃত্যুর সময় আবু ওসমান চৌধুরীর বয়স ছিল মাত্র দুই বছর।
আবু ওসমান তাঁর নিজ গ্রাম মদনেরগাঁওয়ের ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৪৫ সালে পার্শবর্তী গ্রামে মানিকরাজ জুনিয়র হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণী এ স্কুলে অধ্যয়নের পর ১৯৪৭ সালে তাঁর নিজ গ্রামের চান্দ্রা ইমাম আলী হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে দীর্ঘ ৪ বছর পর ১৯৫১ সালে এ স্কুল থেকেই ১ম বিভাগে এস.এস.সি. পাশ করেন। পরে ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে এইচ.এস.সি.-তে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ, শারীরিক অসুস্থতা ও পারিবারিক নানা সমস্যার কারণে ঢাকা কলেজে এইচ.এস.সি. সম্পন্ন করতে পারেননি তিনি। পরে ১৯৫৪ সালে চাঁদপুর কলেজ থেকে এইচ.এস.সি. ও ১৯৫৭ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে তিনি বি.এ. পাস করেন।
গ্রাজুয়েশন লাভের পর পরই ১৯৫৭ সালে আবু ওসমান ঢাকা বিমানবন্দরে এয়ারপোর্ট অফিসার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। এই পদের প্রশিক্ষণে থাকাকালীনই তিনি সেনাবাহিনীতে কমিশনের জন্য প্রদত্ত পরীক্ষায় পাস করায় আন্তবাহিনী নির্বাচন বোর্ডে উপস্থিত হবার জন্য আহ্বান পান। সেটিও তিনি সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করেন। ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তানের কোহাটে অবস্থিত অফিসার্স ট্রেনিং স্কুলে (ওটিএস) যোগ দেন। সেখানে ৯ মাসের কঠিন প্রশিক্ষণের পর ১৯৫৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হন। ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি মেজর পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
আবু ওসমান ১৯৬০ সালের ২৫ মার্চ কুমিল্লার মৌলভী পাড়ার মনসুর আহম্মেদের জ্যেষ্ঠ কন্যা নাজিয়া খানমকে বিয়ে করেন। তাঁর দুই কন্যা নাসিমা ওসমান ও ফাওজিয়া ওসমান।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল আবু ওসমান চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণাধীন মেহেরপুরের অন্তর্গত বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আম্রকাননে বিশ্বের ৩৯টি দেশের শতাধিক সাংবাদিকের উপস্থিতিতে নবগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ প্রকাশ্যে বাংলার মাটিতে শপথ গ্রহণ করার পর মেজর ওসমান তাঁর যুদ্ধক্লান্ত এক প্লাটুন সৈন্য দ্বারা মন্ত্রিপরিষদকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। সেই অনুষ্ঠানে মেজর ওসমানের স্ত্রী বেগম নাজিয়া ওসমান সারা বাংলার নারী জাতিরই প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। আবু ওসমানের স্ত্রী ও মেয়েরা তাঁর সাথে যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবস্থান করতেন প্রায়ই। যেকোনো পরিস্থিতিতে থাকার জন্য তাঁরা ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আবু ওসমানের ট্যাকটিক্যাল হেডকোয়ার্টারের একটি কামরায় তাঁরা থাকতেন। সেখানে থেকেই মিসেস ওসমান স্থানীয় সেনাদের খাবার ও পানীয় সরবরাহের দায়িত্ব গ্রহণ করে তা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতেন। এ কাজের ভার তাঁকে কেউ দেয়নি। নিজেই চিন্তা করে তা শুরু করেন। এমনকি সেই রণাঙ্গনের যেসব সেনাদের স্ত্রী পুত্র পরিবার সেখানে থাকত, তাদের খাবার ও পানীয়, টাকা-পয়সা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব তিনি পরিচালনা করতেন। নাজিয়া আবু ওসমানসহ হেডকোয়ার্টারের অন্যান্য অফিসারকে নানাভাবে সাহায্য করতেন। প্রয়োজনে মাটিতে পজিশন নেয়া, পরিখাতে ঢুকে সতর্ক পাহারা দেয়া, ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করা এমনকি অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের ও সেনা সামন্তের স্ট্যাটিসটিক্স মেইনটেইন করাসহ এ জাতীয় বহু কাজে সক্রিয় সাহায্য করতে তিনি অত্যন্ত আনন্দবোধ করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করেননি তিনি এ কথা সত্য, কিন্তু যুদ্ধের পক্ষে তিনি যে সহায়তা করেছেন তা সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
আবু ওসমান চৌধুরী ও তাঁর অধীনস্থ মুক্তিবাহিনী রণাঙ্গনের বহু সংঘর্ষে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু মেজর ওসমানকে তাঁর ন্যায্য পাওনা পদোন্নতি ও পদক থেকে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে বঞ্চিত করা হয়। যুদ্ধোত্তরকালে এক পর্যায়ে মেজর ওসমানকে পদত্যাগ করতেও বাধ্য করা হয়। সে সময় প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্বে ছিলেন। তিনি মেজর ওসমানের পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে যথোচিত অনুসন্ধানের পর মেজর ওসমানকে লেফটেনেন্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি দিয়ে তাঁর কোরের (এএসসি) পরিচালক পদে নিযুক্ত করেন। উক্ত পদে তিন বছর আসীন থাকার পর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী বিদ্রোহে গুলশানের বাড়িতে তাঁকে না পেয়ে সিপাহীরা তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করে। তারপর স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি মোসতাক আহম্মেদ কর্তৃক নিয়োজিত তত্কালীন সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ তাঁকে অন্যায়ভাবে অকালীন অবসর প্রদান করেন।
মুক্তিযুদ্ধের একজন সফল সেক্টর কমান্ডারের প্রতি কর্তৃপক্ষের এমন আচরণেও কর্নেল ওসমান হতাশ হননি। নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট ও প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার এক দুঃসাধ্য কাজে তিনি মনোনিবেশ করেন। অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ১৯৯১ সালের ৭ মার্চ তিনি জাতিকে উপহার প্রদান করেন ১৯৪৭ এর স্বাধীনতা থেকে ১৯৭১ এর স্বাধীনতায় উত্তরণের ধারাবাহিক ইতিহাস সম্বলিত এক অমূল্য গ্রন্থ- ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল এই বইখানি ১৯৯৩ সালে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ কর্তৃক পুরস্কৃত হয় এবং একই বছর ফরিদপুর সাহিত্য ও সংস্কৃতি উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক আলাওল সাহিত্য পুরস্কার দ্বারাও ভূষিত করা হয়। সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি হিসেবে তাঁর তত্ত্বাবধানে এক নজরে ফরিদগঞ্জ নামক একখানি তথ্যবহুল গ্রন্থও তত্পূর্বে প্রকাশিত হয়। তাঁর ‘সময়ের অভিব্যক্তি’ নামক সংকলিত বইটি ১৯৯৬ সালের ১৭ এপ্রিল, ‘সোনালী ভোরের প্রত্যাশা’ সংকলন ১৯৯৬ সালের ২ জুলাই এবং ‘বঙ্গবন্ধু: শতাব্দীর মহানায়ক’ সংকলনটি একই বছর ২ আগস্ট প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নিমিত্তে গঠিত ‘গণ আদালত’ এর অন্যতম বিচারক হিসেবেও তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ এর অন্যতম সংগঠক ও কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে তিনি জাতীয় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের এই বীর সেনা ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে থানার সমস্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ নিরস্ত্র জনগণের তালিকা সম্বলিত অপূর্ব সুন্দর ফরিদগঞ্জ-শহীদ-স্মৃতিস্তম্ভ প্রতিষ্ঠিত করেন। সাংবাদিক ও শিল্প-সমালোচক রফিক ইসলাম কর্তৃক কর্নেল ওসমানকে নিয়ে নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র-‘ He fought for Bangladesh‘ অসলো থেকে ‘সোনালী’ পদকে পুরস্কৃত করা হয়। কর্নেল ওসমান বর্তমানে ঢাকাস্থ ফরিদগঞ্জ থানা সমিতির প্রধান পৃষ্ঠপোষক, চন্দ্রা ইমাম আলী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের কলেজ শাখার ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরূপে ফরিদগঞ্জের শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে এক ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছেন।
আবু ওসমান চৌধুরী আজ জীবন সায়াহ্নের দোরগোড়ায়। ধনসম্পদ গড়ার প্রতি তাঁর নেই কোনো মোহ। ঘরভাড়া ও সরকার থেকে প্রাপ্ত অল্প পেনশন আবু ওসমান চৌধুরীর বর্তমান আয়ের উত্স। তিনি বেশিরভাগ সময়ই পাজামা-পাঞ্জাবি পরেন। বাসার অদূরে অবস্থিত বায়তুল আমান মসজিদে তিনি নামাজ আদায়ের চেষ্টা করেন নিয়মিত। মুক্তিযুদ্ধের একজন সফল সেক্টর কমান্ডার হয়ে কর্নেল ওসমান রাষ্ট্রীয় খেতাব থেকে আজও বঞ্চিত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তিনি নিজ চোখে দেখে যেতে চান। কিন্তু তাঁর এ স্বপ্ন কি আদৌ বাস্তবায়িত হবে! দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেনানীকে দেখতে হয়েছে অপ্রত্যাশিত অনেককিছু। দেখতে হয়েছে স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধীদের গাড়িতে এ দেশের জাতীয় পতাকা ওড়ার দৃশ্য। শহীদদের স্মৃতিসৌধে তাদের পদচারণ। জাতীয় সংসদের পবিত্র আসনে উপবিষ্ট। রাজাকারদের বিচার দাবির যুদ্ধে তিনি আজ অন্যতম বড় কমান্ডার। এই বৃদ্ধ বয়সেই সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-এর অধীনে নিরলসভাবে রাতদিন কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াই এখন আবু ওসমান চৌধুরীর পবিত্র অঙ্গীকার। আমরা তাঁর অবদানের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি।
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
নাম: আবু ওসমান চৌধুরী
পিতার নাম: আব্দুল আজিজ চৌধুরী
মাতার নাম: মাজেদা খাতুন
জন্ম তারিখ: ১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারি
জন্মস্থান: বর্তমান চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানাধীন মদনেরগাঁও গ্রামের চৌধুরী পরিবারে তাঁর জন্ম।
পরিবার-পরিজন:
আবু ওসমান ১৯৬০ সালের ২৫ মার্চ কুমিল্লার নাজিয়া খানমের সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর দুই কন্যা নাসিমা ওসমান ও ফাওজিয়া ওসমান।
পড়াশুনা:
আবু ওসমান তাঁর নিজ গ্রাম মদনেরগাঁওয়ের ফ্রি পাইমারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৪৭ সালে নিজ গ্রামেরই চান্দ্রা ইমাম আরী হাই স্কুল থেকে ১ম বিভাগে এস.এস.সি. পাশ করেন। পরে ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও শারীরিক ও পারিবারিক নানা সমস্যার কারণে ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট সম্পন্ন করতে পারেননি। পরে ১৯৫৪ সালে চাঁদপুর কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯৫৭ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে তিনি বি.এ. পাস করেন।
সামরিক কর্মকান্ড:
১৯৫৭ সালে আবু ওসমান ঢাকা বিমানবন্দরে এয়ারপোর্ট অফিসার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। এই পদের প্রশিক্ষণে থাকাকালীনই তিনি সেনাবাহিনীতে কমিশনের জন্য প্রদত্ত পরীক্ষা পাস করায় আন্তঃবাহিনী নির্বাচন বোর্ডে উপস্থিত হবার জন্য আহ্বান লাভ করেন। সে বাধা তিনি সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করেন। ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তানের কোহাটে অবস্থিত অফিসার্স ট্রেনিং স্কুলে (ওটিএস) যোগদান করেন। সেখানে ৯ মাসের কঠিন প্রশিক্ষণের পর ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৫৮ পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হন। ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি মেজর পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
সামাজিক কর্মকান্ড:
যুদ্ধাপরাধের বিচারের নিমিত্তে গঠিত গণআদালত-এর বিচারক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সংগঠক ও অন্যতম নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ফরিদগঞ্জ-শহীদ-স্মৃতিস্তম্ভের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তিনি ঢাকাস্থ ফরিদগঞ্জ থানা সমিতির প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-এর অন্যতম নেতা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।
গ্রন্থ:
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম (১৯৭১), এক নজরে ফরিদগঞ্জ (১৯৯০), সময়ের অভিব্যাক্তি (১৯৯৬) সোনালী ভোরের প্রত্যাশা (১৯৯৬) এবং বঙ্গবন্ধু: শতাব্দীর মহানায়ক (১৯৯৬)।
পুরস্কার:
‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ১৯৯৩ সালে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ কর্তৃক পুরস্কৃত হয়। একই বছর ফরিদপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক আলাওল সাহিত্য পুরস্কার দ্বারাও ভূষিত করা হয়।
তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া, স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র-১০ম খন্ড এবং আবু ওসমান চৌধুরী নিজেই ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করেছেন।
লেখক : তমাল হুমায়ুন