“১৯৭১ সালের প্রতিটি মুহূর্তই আমাকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রেরণা যোগায়। তখন আমি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত ছিলাম। সময় যতই গড়াচ্ছে আমি ক্রমাগত অস্থির হয়ে উঠছিলাম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য। একদিন সকালে পি এ এফ বেস (তেজগাঁও) ঢাকায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে ফ্লাইট লে. সাদ নামক একজন অফিসার ১৪তম ডিভিশন হেডকোয়ার্টারে যাওয়ার জন্য আমার জিপটির জন্য অনুরোধ করে। আমি তাকে জিপটি দিয়ে বললাম সে যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু গাড়ি আর ফিরে আসছে না। আমি অস্বস্তি অনুভব করি। সাদ বেলা ১টার দিকে ফিরে এলো এবং আমার হাতে চাবি দিয়ে নির্বিকারভাবে বলল, ‘তোমার ড্রাইভার বোকার মতো বেয়োনেটের উপর ঝাঁপ দিয়ে মরে গেছে।’ তার পাতানো গল্প শুনে রাগে আমার গা শিরশির করে উঠল। কারণ আমি বুঝতে পারি আমার সম্পর্কে তথ্য নেয়ার জন্য আমার ড্রাইভারকে টর্চার করা হয়েছে। সে কোনো ধরনের তথ্য দেয়নি বলে তাকে হত্যা করা হয়েছে। ফেরার পথে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এভাবে আর চলতে পারে না। এবার প্রতিশোধের পালা। কারণ কাপুরুষের মতো মরা বা বাঁচা দুটোই নিরর্থক।
২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার পূর্বে আমার স্ত্রী ও আমি কবি সুফিয়া কামালের বাসায় যাতায়াত করতাম। এ বাড়িতে সার্বক্ষণিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনা ছিল। আমাদের আলাপ আলোচনার ধরন পরখ করে ছাত্রছাত্রীরা আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইয়া কি মুক্তিযুদ্ধে যেতে আগ্রহী?’ আমার স্ত্রী তাত্ক্ষণিক জবাব দিল, ‘সে তো এই রাস্তাই খুঁজছে।’ আমাদের সম্মতি পেয়ে তারা সেদিন বিকেলেই প্রাথমিক যোগাযোগের জন্য আমার স্ত্রীর হাতে একটা ম্যাগাজিন দিয়ে বলল, ‘হামিদুল্লাহ্ ভাই যেন আজই এই ম্যাগাজিনটি হাতে নিয়ে বিকাল ৪টায় স্টেডিয়ামের প্রভেন্সিয়াল বুক ডিপোর সামনে দাঁড়ায়।’ পরিকল্পনা মতো আমি সেখানে যাওয়ার পর এক তরুণ আমার কাছে এসে সরাসরি বলল, ‘আপনি কি হামিদুল্লাহ্ ভাই?’
আমি বললাম, হ্যাঁ।
সে আমাকে একটি নির্দিষ্ট সময় দিয়ে বলল, ‘আপনার বাড়ির সামনে ২৬ নম্বর সড়কের মোড়ে একটা সবুজ টয়োটা গাড়ি থাকবে। গাড়ি বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যাবে না। আপনারা দ্রুত চলে আসবেন।’ আমি মনে মনে ভাবলাম যত সহজে বলে ফেলল বিষয়টা তত সহজ না।
পরদিন সন্ধ্যা থেকেই বাসার সামনে পায়চারি করতে শুরু করলাম। মাঝে মধ্যেই বাড়ির বাইরে আসছিলাম। সন্ধ্যার দিকে দেখলাম ২৬ নম্বর রোডে গাড়িটা দাঁড়ানো। সুযোগ বুঝে আমরা বেরিয়ে পড়ি। আমাদের দেখেই গাড়ির দরজা খুলে দেয় ড্রাইভার। দ্রুত গাড়ির ভেতরে প্রবেশ করি। গাড়ি চলতে শুরু করল। আমরা পৌঁছে যাই ইস্কাটনের একটি বাড়িতে। সেখান থেকে আরেকটি গাড়ি করে হাটখোলায় পৌঁছি। সদ্য পরিচিত এক শুভানুধ্যায়ীর বাসায় নিজের পরিবারকে রেখে রওয়ানা হলাম অনিশ্চিত এক গন্তব্যে। পাড়ি দিলাম সীমান্তের পথে। পথে যেতে অতি সর্তকতা অবলম্বন করতে হল। আমার সঙ্গে একটি পিস্তল ছিল। আমি যে গাড়িতে যাচ্ছিলাম সে গাড়ির ড্রাইভার পিস্তলটি দেখে ফেলে। সামনে গাড়ি তল্লাশি হচ্ছে দেখে সে আমাকে পিস্তলটি ফেলে দেয়ার জন্য বলল। ফলে বাধ্য হয়েই সিটের পিছনে ও গাড়ির বডির ফাঁকে পিস্তলটি ফেলে দিই। গাড়ি তল্লাশি হয়। আমরা এ যাত্রায় বেঁচে যাই। আর এভাবেই জড়িয়ে পড়ি মহান মুক্তিযুদ্ধে।”
এই কথাগুলো ১১নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার এম হামিদুল্লাহ্ খানের। যিনি নিজ দেশের মানুষকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য পাকিস্তান বিমান বাহিনীর চাকরি ছেড়ে যোগ দেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে এবং মরণপণ লড়াই করে ছিনিয়ে আনেন স্বাধীনতার লাল সূর্যটাকে। তাঁর মতো অসংখ্য বীর যোদ্ধা জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে যুদ্ধ করেছিলেন বলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল।
এম হামিদুল্লাহ্ খান বিক্রমপুর পরগণার লৌহজং থানার মেদিনীমন্ডল গ্রামে ১৯৪০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম এম দবিরউদ্দীন খান এবং মা জসিম উন্নিছা খান। এম দবিরুদ্দীনের পাঁচ ছেলে তিন মেয়ে। এর মধ্যে হামিদুল্লাহ্ খান দ্বিতীয়। হামিদুল্লাহ্ খানের বাবা চাকরি করতেন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে এখানে সেখানে বদলি হতে হয়। হামিদুল্লাহ্ খানের প্রাথমিক পড়ালেখা শুরু হয় গৌহাটি সিলভার জুবলি অ্যাংলো বেঙ্গলি হাই ইংলিশ স্কুলে। বাবার বদলির চাকরির কারণে এই বিদ্যালয়টি ছাড়াও তিনি দেশের অনেক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়, বিচিত্রসব দৃশ্যাবলির ভেতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে তিনি তাঁর শৈশব অতিবাহিত করেছেন। তাঁর শৈশব ছিল এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার। নদী, পাহাড়, গাছগাছালি, ফুল আর পাখি তাঁকে অনেক বেশি আকৃষ্ট করত। বাবার সঙ্গে তাঁকে যেমন থাকতে হয়েছে আবার অনেক সময় একা একাও থাকতে হয়েছে। এতে করে তিনি তাঁর ছেলেবেলা উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছেন অনেক বেশি। তিনি বিশ্বাস করেন, শৈশবের গড়ে ওঠা ব্যক্তিত্ববোধই আজকের হামিদুল্লাহ্ খান। তিনি ১৯৫৪ সালে কাজীর পাগলা এটি ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ভর্তি হন তেজগাঁও টেক্সটাইল কলেজে ৪ বছর মেয়াদি অনার্স কোর্সে। কিন্তু এখানে পড়াকালীন ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে ১ বছর বিরতি দিয়ে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। এরপর ১৯৫৭ সালে এইচএসসি পাশ করেন। মজার ঘটনা হলো একই সঙ্গে তিনি তেজগাঁও টেক্সটাইল কলেজের পড়ালেখাও চালিয়েছেন। কারণ জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হওয়ার পরও টেক্সটাইল কলেজের ভর্তিটি বাতিল করেননি। এইচএসসি পাসের পর জগন্নাথ কলেজেই তিনি বি.কম. ভর্তি হন। এখানে দুইবছর পড়ার পর চাকরিতে যোগ দেওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত বি.কম. ফাইনাল পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি তাঁর। তিনি ১৯৬০ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর রিসালপুর একাডেমিতে যোগদান করেন। সেখানে দুই বছর প্রশিক্ষণ শেষে কমিশন প্রাপ্ত হন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নৃশংস বাঙালী হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে বিদ্রোহ করেন তিনি। অধিকার বঞ্চিত স্বজাতির শোষণ শাসন আর দুর্ভোগ থেকে মুক্তির আকাঙ্খায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর চাকরি ছেড়ে যোগ দেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার পর প্রথমে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সর্ববৃহত্ গেরিলা ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দেন। ভারতের বিহার রাজ্যের চাকুলিয়ায় প্রবাসী সরকারের প্রধান সামরিক প্রতিনিধি হিসেবে এখানে কাজ শুরু করেন। সেইসঙ্গে চাকুলিয়ায় সি-এন-সি স্পেশাল ব্যাচের সফল ট্রেনিং পরিচালনা করেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর এম এ জি ওসমানী তাঁকে উত্তর ফ্রন্টে পোস্টিং দিয়ে পাঠান। এটি ছিল ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তেলঢালায় মেজর জিয়ার কমান্ড অধীন ২নং সেক্টর এবং জেডফোর্সের হেড কোর্য়াটার। সেখানে পৌঁছামাত্র মেজর জিয়া তাঁকে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তর রংপুর ও ময়মনসিংহ জেলার বিপরীতে মেঘালয়ের নদীবন্দরে স্থাপিত মানকাচর সাব সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেন। তিনি ঐ ঘাঁটি থেকে রংপুরের কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলায় অবস্থিত শত্রু ঘাঁটিসমূহে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। একই সঙ্গে রৌমারি ও রাজিবপুর থানাধীন ৫৫০ বর্গমাইল স্বাধীন অঞ্চলের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পান।
দিনটি ছিল ৩ নভেম্বর। এদিন তিনি ১১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন। এ সেক্টরের অধীনস্ত ৮টি সাব সেক্টরের দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত হয়। তিনি সফলতার সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত হামিদুল্লাহ্ খানের যুদ্ধের ব্যাপক সফলতার বিশদ বিবরণ পাঠানো হয় (সিটরেপ অর্থাত্ সিচ্যুয়েশনাল রিপোর্ট এর মাধ্যমে) তত্কালীন প্রবাসী সরকারের সদর দপ্তর ৮নং থিয়েটার রোডে। প্রবাসী সরকার ঐ সাফল্যের মূল্যায়ন করে তাঁকে ফিল্ড পদোন্নতি দিয়ে স্কোয়াড্রন লিডার পদে উন্নীত করেন। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তিনি আনুমানিক ২২৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি বিশাল বাহিনীকে নেতৃত্ব দেন। তাঁর অসাধারণ নেতৃত্বগুণ ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে দারুণ সফলতা আসে। তিনি মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ঢাকা অভিযানে অংশগ্রহণ করে ১৫/ ১৬ ডিসেম্বর রাজধানীর উপকন্ঠে সাভার ও জয়দেবপুর পৌঁছান। কিন্তু তখনই ঘটে বিপত্তি। বিডিএফ হেডকোর্য়াটার থেকে নির্দেশ দেয়া হয় সদলবলে ঢাকায় অগ্রসর হওয়া যাবেনা। অর্থাত্ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি একটি কমান্ডো ইউনিট নিয়ে বিকল্প পথে তত্কালীন তেজগাঁও আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে চলে আসেন। এভাবে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বর্বর হানাদাররা আত্মসমর্পণ করে এবং দেশ স্বাধীন হয়।
যুদ্ধের পরপরই তিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পুরো উদ্যোমে কাজ শুরু করেন। যোগ দেন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে। কিন্তু দেশের মানুষের প্রতি চরম অত্যাচার আর অনাচারের দিন যিনি জীবনবাজি রেখে বিদ্রোহ করে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাঁর মন সেইসব মানুষের কাছাকাছি থেকেই কাজ করতে বেশি আগ্রহী। কারণ জনযুদ্ধে সম্পৃক্ততার স্মৃতি তাঁর মনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। মাটি ও মানুষের সঙ্গে কাজ করার তাগিদে তিনি ১৯৭৮ সালে বিমান বাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। এরপর শুরু হয় ভিন্ন এক জীবন। মানুষের পাশে দাঁড়াতে বেছে নেন রাজনীতি।
এবার শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস। একদিন সামরিক পোশাক পড়ে তিনি বর্বর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন প্রিয় স্বদেশের জন্য। কিন্তু এবার লড়তে হলো স্বদেশী স্বৈর শাসকের বিরুদ্ধে। এ সময়ের একটি ঘটনাকে (জাফর ড্রাইভার এপিসোড) তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা বলে মনে করেন। ঘটনাটি ঘটে ১৯৮৬ সালে। তখন দেশব্যাপী স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করছে। এ সময়ে তিনি বেগম জিয়ার সঙ্গে এ আন্দোলনে দেশের নানা জায়গায় ঘুরছেন। একদিন ঢাকা ফেরার পথে কালিয়াকৈর থানায় বেগম জিয়ার গাড়ি বহর আটকানো হয়। গাড়ি থেকে নেতা কর্মী সবাইকে নেমে থানায় যেতে হয়। কিন্তু বেগম জিয়া ও তিনি থেকে যান গাড়িতে। এই সুযোগে গাড়িতে থাকা একটি গামছা তিনি তাঁর মাথায় বেঁধে নেন। কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে জানাল বেগম জিয়া গাড়ি নিয়ে চলে যেতে পারেন। এরমধ্যে একজন জিজ্ঞেস করল, ‘ম্যাডাম ওনি কি আপনার গাড়ির ড্রাইভার।’ বেগম জিয়া প্রথমে একটু ইতস্ততবোধ করলেন। পরে বললেন, ‘হ্যাঁ’।
কী নাম?
জাফর ড্রাইভার। এরপর তাদের গাড়ি বহর ছেড়ে দেয়া হল। হামিদুল্লাহ্ খান দ্রুতবেগে গাড়ি ড্রাইভ করে তাঁকে পৌঁছে দেন অজানা গন্তব্যে। এ ঘটনা তাঁর পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনে যথেষ্ট তাত্পর্যপূর্ণ হয়। দীর্ঘ নয় বছর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তিনি মাঠে ময়দানে থেকেছেন। সংগ্রাম আন্দোলনে সম্পৃক্ততার কারণে তিনি দুইবার কারারুদ্ধ হন।
হামিদুল্লাহ্ খান ১৯৬৫ সালে বিয়ে করেন। তাঁর শ্বশুরালয় জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জে। স্ত্রীর নাম রাবেয়া সুলতানা খান। এই দম্পতি তিন সন্তানের জনক জননী। বড় ছেলে তারেক হামিদ খান, মেঝো ছেলে জিয়াদ হামিদ খান ও ছোট ছেলে মুরাদ হামিদ খান। এরমধ্যে ছেলে জিয়াদ পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন ১৯৮১ সালে। বাকি দুই সন্তান উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত।
হামিদুল্লাহ্ খান জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত (১৯৭৯, ১৯৯১ ও ১৯৯৬) হন তিন তিনবার। তাঁর নির্বাচনী আসন ছিল ঢাকার অদূরে মুন্সিগঞ্জ ২। সংসদ সদস্য থাকাকালীন তিনি ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে জেনারেল এসেমব্লির প্লেনারি সেশনে নামিবিয়া, প্যালেস্টাইন ইত্যাদি সমস্যার উপর বক্তৃতা করেন। তিনি ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট’-এর কনভেনর হিসেবে ঐ প্রতিষ্ঠানকে ক্রমাগত লোকসানি প্রতিষ্ঠান থেকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। এ সংস্থার ব্যাপক উন্নয়নে তিনি বহুবিধ কার্যক্রম শুরু করেন। সংসদ সদস্য থাকাকালীন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য, মন্ত্রীর পদমর্যাদায় হজ্জ্ব ডেলিগেশনের নেতৃত্ব দিয়ে সৌদি সরকারের মাননীয় মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা ও চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তিনি প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও অনুমিত হিসাব সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিদ্যুত্ জ্বালানি এবং সড়ক ও যানবাহন সংক্রান্ত সাব কমিটি সমূহের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অস্ট্রেলিয়ার স্যার স্টিফেন্স নিনিয়ানের সভাপতিত্বে আয়োজিত সরকার ও বিরোধীদলের সংলাপে বলিষ্ঠ বক্তব্য রেখে প্রশংসিত হন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও ইংরেজ আমল থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর গবেষণা এবং একাধিক পুস্তক রচনা করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ এর রণক্ষেত্রে অসাধারণ নেতৃত্বের মূল্যায়ন হিসেবে ঢাকা শহরের অভিজাত বনানী এলাকায় ২৩ নম্বর সড়কটি তাঁর নামে নামকরণ করে তাঁকে সম্মানিত করেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
জন্ম
এম হামিদুল্লাহ্ খান বিক্রমপুর পরগণার লৌহজং থানার মেদিনীমন্ডল গ্রামে ১৯৪০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম এম দবিরুদ্দীন খান এবং মা জসিম উন্নিছা খান।
শৈশব
তাঁর শৈশব কাটে স্কুলের মতোই বিভিন্ন স্থানে। শৈশব প্রসঙ্গে তিনি বলেন- আমার শৈশব ছিল এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার। নদী,পাহাড়, গাছগাছালি আর ফুল পাখি আমাকে অনেক বেশি আকৃষ্ট করত। বাবার সঙ্গে আমাকে যেমন থাকতে হয়েছে আবার অনেক সময় একা একাও থাকতে হয়েছে। এতে করে আমি আমার ছেলেবেলা দারুণ উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছি।
পড়ালেখা
প্রাথমিক পড়ালেখা শুরু হয় গৌহাটি সিলভার জুবলি আ্যংলো বেঙ্গলি হাই ইংলিশ স্কুলে। এই বিদ্যালয়টি ছাড়াও তিনি দেশের অনেক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। রাঙামাটি মিশনারি স্কুল তার মধ্যে অন্যতম। তিনি ১৯৫৪ সালে কাজীর পাগলা এটি ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ভর্তি হন তেজগাঁও টেক্সটাইল কলেজে ৪ বছর মেয়াদি অনার্স কোর্সে। কিন্তু এখানে পড়াকালীন ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে ১ বছর বিরতি দিয়ে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। এরপর ১৯৫৭ সালে এইচএসসি পাস করেন। মজার ঘটনা হলো একই সঙ্গে তিনি তেজগাঁও টেক্সটাইল কলেজের পড়ালেখাও চালিয়ে যেতে থাকলেন। কারণ জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হওয়ার পরও টেক্সটাইল কলেজের ভর্তিটি বাতিল করেননি। এইচএসসি পাসের পর জগন্নাথ কলেজেই তিনি বি. কম.-এ ভর্তি হন। এখানে দুইবছর পড়ার পর শেষ পর্যন্ত ফাইনাল পরীক্ষা দেয়া হয়নি চাকরিতে যোগদানের জন্য।
পেশা
১৯৬০ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর রিসালপুর একাডেমিতে যোগদান করেন। সেখানে দুই বছর প্রশিক্ষণ শেষে কমিশন প্রাপ্ত হন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নৃশংস বাঙালি হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে বিদ্রোহ করেন। অধিকার বঞ্চিত স্বজাতির শোষণ শাসন আর দুর্ভোগ থেকে মুক্তির আকাঙ্খায় যোগ দেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার পর প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট পেলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্ববৃহত্ গেরিলা ট্রেনিং ক্যাম্পে। ভারতের বিহার রাজ্যের চাকুলিয়ায় প্রবাসী সরকারের প্রধান সামরিক প্রতিনিধি হিসেবে এখানে কাজ শুরু করেন। সেই সঙ্গে চাকুলিয়ায় সি-এন-সি স্পেশাল ব্যাচের সফল ট্রেনিং পরিচালনা করেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর এম এ জি ওসমানী তাঁকে উত্তর ফ্রন্টে পোস্টিং দিয়ে পাঠান। এটি ছিল ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তেলঢালায় মেজর জিয়ার কমান্ড অধীন ২নং সেক্টর এবং জেডফোর্সের হেড কোর্য়াটার। সেখানে পৌঁছামাত্র মেজর জিয়া তাঁকে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তর রংপুর ও ময়মনসিংহ জেলার বিপরীতে মেঘালয়য়ের নদীবন্দরে স্থাপিত মানকাচর সাব সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেন। তিনি ঐ ঘাটি থেকে রংপুরের কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলায় অবস্থিত শত্রুঘাঁটিসমূহে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। একই সঙ্গে রৌমারি ও রাজিবপুর থানাধীন ৫৫০ বর্গমাইল স্বাধীন অঞ্চলের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পান। ৩ নভেম্বর তিনি ১১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন। এ সেক্টরের অধীনস্ত ৮টি সাব সেক্টরের দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত হয়। তিনি সফলতার সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত হামিদুল্লাহ্ খানের যুদ্ধের ব্যাপক সফলতার বিশদ বিবরণ পাঠানো হয় (সিটরেপ অর্থাত্ সিচ্যুয়েশনাল রিপোর্ট এর মাধ্যমে) তত্কালীন প্রবাসী সরকারের সদর দপ্তর ৮নং থিয়েটার রোডে। প্রবাসী সরকার ঐ সাফল্যের মূল্যায়ন করে তাঁকে ফিল্ড প্রমোশন দিয়ে স্কোয়াড্রন লিডার পদে উন্নীত করেন। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তিনি আনুমানিক ২২৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি বিশাল বাহিনীকে নেতৃত্ব দেন। তাঁর অসাধারণ নেতৃত্ব গুণ ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে দারুণ সফলতা এনে দেন।
রাজনৈতিক জীবন
মাটি ও মানুষের সঙ্গে কাজ করার তাগিদে তিনি ১৯৭৮ সালে বিমান বাহিনী থেকে স্বেচ্ছা অবসরগ্রহণ করেন। এরপর শুরু হয় ভিন্ন এক জীবন। মানুষের পাশে দাঁড়াতে বেছে নেন রাজনীতি। জন মানুষের রাজনীতি সংশ্লিষ্টার দরুণ তিনি জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত (১৯৭৯, ১৯৯১ ও ১৯৯৬) হন তিন তিনবার। তাঁর নির্বাচনী আসন ছিল ঢাকার অদূরে মুন্সিগঞ্জ ২।
পরিবার
হামিদুল্লাহ্ খান ১৯৬৫ সালে বিয়ে করেন। তাঁর শ্বশুরালয় জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জে। স্ত্রীর নাম রাবেয়া সুলতানা খান। এই দম্পতি তিন সন্তানের জনক জননী। বড় ছেলের নাম তারেক হামিদ খান, মেঝো ছেলে জিয়াদ হামিদ খান ও ছোট ছেলে মুরাদ হামিদ খান। এরমধ্যে ছেলে জিয়াদ পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন ১৯৮১ সালে। বাকি দুই সন্তান উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত।
সম্মাননা
মুক্তিযুদ্ধে তার বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ এর রণক্ষেত্রে অসাধারণ নেতৃত্বের মূল্যায়নে ঢাকা শহরের বনানী এলাকায় ২৩ নম্বর সড়কটি তাঁর নামে নামকরণ করে তাঁকে সম্মানিত করেন।
২০১১ সালের ৩০ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র : এই লেখাটি ৩১.০১.২০০৯ তারিখে উইং কমান্ডার এম হামিদুল্লাহ্ খানের সঙ্গে সাক্ষাত্কারের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে।
কৃতজ্ঞতা :
০১. নাঈমুল করিম নাঈম, সাংবাদিক।
০২. জানে আলম, এম হামিদুল্লাহ্ খানের সহকর্মী।
লেখক : এহসানুল ইয়াসিন