“‘কেয়া তুম মুসলমান হো! মুঝে তো পাতায়া ইধার কোই মুসলমান নেহি হ্যায়! তুম মেরে শের কি ফেকার মাত করো। তুম মুঝে সাথ লে লো, মে তোমহারা সাথ লড়েঙ্গে (কি তুমি মুসলমান! কিন্তু আমাকে তো বলা হয়েছিল এখানে কোনো মুসলমান নাই, তুমি আমার মাথার আঘাত নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না, আমাকে তোমাদের সাথে রাখো, আমি তোমাদের হয়ে যুদ্ধ করবো)’- ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় এভাবেই একজন পাকিস্তানী সৈন্য তার অনুভূতি জানিয়েছিল। পাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে বাঙালিদের যৌক্তিক লড়াইয়ের সঙ্গে এভাবেই একাত্মতা প্রকাশ করেছিল সে। তাকে বোঝানো হয়েছিল বাংলাদেশে অর্থাত্ তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে যারা পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াই করছে তারা কেউ মুসলমান নয়। তারা হিন্দু অথবা অন্য ধর্মের।
এই সেনা অফিসারটির সঙ্গে আগের দিন আমার সংঘর্ষ হয়েছিল। সে আমাকে গুলি করেছিল আর আমি তাকে রাইফেল দিয়ে বাড়ি মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, আমার আঘাতে সে মারা গেছে। পরদিন সৈন্যরা তাকে আহত অবস্থায় আমার কাছে বন্দি করে নিয়ে এলে সে আমার কাছে জানতে চায়, আগের দিন আমাকে গুলি করার শোধ আজ আমি নেব কি না- উত্তরে আমি বলি নিরস্ত্র লোকের উপর হামলা করা কোনো মুসলমানের ধর্ম না, যা ২৫ মার্চে পাকিস্তানীরা নিরস্ত্র বাঙালিদের সাথে করেছে। আমি তাকে চিকিত্সা করার জন্য হাসপাতালে পাঠাতে চাইলে সে হতবাক হয়ে যায়। বিস্মিত হয়ে জানতে চায়, আমি মুসলমান কি না এবং সব শুনে সে আমাদের পক্ষে যুদ্ধ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে।
সেদিন সেই অবাঙালি সৈন্যের মাঝেও যে মানবিকবোধ জাগ্রত হয়েছিল, তা কিন্তু এদেশীয় দালালদের মাঝে জাগ্রত হয়নি। তারা এদেশের হয়েও এ দেশের বিরোধিতা করেছে, পাকিস্তানী শাসকদের সহযোগিতা করেছে। তাদের সহযোগিতায় পাকিস্তানী সেনারা ৩০ লাখ লোককে হত্যা করেছে, ২ লাখ মা বোনকে নির্যাতন করে সম্ভ্রমহানি করেছে। সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে, এইসব যুদ্ধাপরাধী নরপশুই ‘৭৫-এর পর দেশ পরিচালনায় অংশ নিয়েছে। ৩৭ বছর আগে দেশ স্বাধীন হলেও এখনো এদেশে এসব নরপশুদের বিচার হয়নি। তবুও আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। দেরীতে হলেও হবে। তবে আমি চাই এ বিচার যেন তাড়াতাড়ি হয়, বেঁচে থেকেই যেন দেখে যেতে পারি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। অন্তত একজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে- এটুকু যেন দেখে যেতে পারি। তা না হলে ৩০ লাখ শহীদের কাছে আমরা অপরাধী হয়ে থাকব। অপরাধী হয়ে থাকব সেই বৃদ্ধার কাছে যাকে কথা দিয়েছিলাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আমরা কোনো আপোস করব না। সেক্টর কমান্ডারর্স ফোরামের উদ্যোগে আমরা চট্টগ্রামের একটি বধ্যভূমিতে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রায় ৮০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা আমাদের কাছে আসেন, কিন্তু কিছু বলেন না। আমি জিজ্ঞেস করি, মা কিছু বলবেন? তাঁর পাশে থাকা একজন আমাকে জানায়, ‘৭১ সালে এদেশের দালালরা মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেওয়ার কারণে তাঁর স্বামী ও সন্তানকে তাঁর সামনেই জবাই করে হত্যা করেছিল। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ৬ দফা দাবিতে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল বলে তাঁদের ৬ টুকরা করেছিল। স্বামী, সন্তানের রক্ত দিয়ে তাঁকে গোসল করিয়েছিল। আমরা সেখান থেকে ফিরে আসার ১০ দিন পরেই তিনি মারা যান। যেন এই কথাগুলো জানানোর জন্যই এতদিন তিনি বেঁচেছিলেন। সেদিনের সেই বৃদ্ধা আমাদের দায়বদ্ধ করে গেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য। বাংলাদেশে এরকম অসংখ্য মানুষের কাছে আমরা দায়বদ্ধ, যুদ্ধে যারা তাঁদের প্রিয় স্বজনদের হারিয়েছেন।”
উপরের কথাগুলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম সেনাপ্রধান ও মুক্তিযুদ্ধের ৩নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার, এস ফোর্সের প্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহর। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরও তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে। সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম গঠন করে সারা দেশে রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের বিচারের দাবিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন সভা সমাবেশে।
মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহর জন্ম ২রা সেপ্টেম্বর বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জে, সার্টিফিকেট অনুযায়ী জন্ম সাল ১৯৩৫ হলেও তাঁর প্রকৃত জন্ম সাল ১৯৩৪। তাঁর শৈশব আর কৈশোর কাটে রূপগঞ্জে। খেলাধুলার প্রতি ঝোঁক ছিল খুব বেশি। লেখাপড়ায়ও ভাল ছিলেন তিনি। বাবা কাজী আব্দুল হামিদ ছিলেন ম্যারেজ রেজিস্টার। আর মা রজ্জব বানু ছিলেন গৃহিণী। ৩ ভাই ৬ বোনের মধ্যে সফিউল্লাহ ছিলেন ৬ষ্ঠ। যে কারণে বাবা মায়ের আদর যত্ন কম পেয়েছেন বলে সফিউল্লাহ মনে করেন। তাঁর মতে, বাবা-মায়ের ভালবাসা সব সন্তানের প্রতি সমান হয় না। সবচেয়ে বড় আর ছোট সন্তান বাবা-মায়ের আদর ভালবাসা বেশি পায়। আর এই অভিমান থেকেই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার আগেই সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি।
বাবা কাজী আব্দুল হামিদ একসময় খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পড়াশুনা শেষ করে রিপন কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। খুতবাতে ব্রিটিশদের নাম বলতে রাজী না হওয়ায় তাঁকে শাস্তিমূলকভাবে বার্মা পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপরে ভারত ফিরলে আবারও তাঁকে ইরানে পাঠানো হয়। ইরানে থাকার সময় তিনি ফার্সি বিষয়ে পড়াশুনা করেন। পেশা হিসেবে ম্যারেজ রেজিস্টারকে বেছে নেন।
মুড়াপাড়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপরে মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে এইচ.এস.সি. পাস করার আগেই তত্কালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কমিশন লাভ করেন ১৯৫৫ সালে। ১৯৬৮ সালে স্টাফ কলেজ থেকে পিএসসি করেন। স্কুল অব ইনফেন্ট্রিতে ইন্সট্রাকটার ছিলেন। এরপরে ১৯৭০ সালে তিনি পদোন্নতি পেয়ে আবার ব্যাটেলিয়নে ফিরে আসেন। তিনি জানান- ‘আই ওয়াজ নান এজ ওয়ান আফ দ্যা স্মার্টেস্ট অফিসার অফ পাকিস্তান আর্মি’। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে পাক সেনা অফিসাররা বাঙালী অফিসারদের আনফিট এবং কমজোরি বলে মন্তব্য করতো। এজন্য তাঁর মনে এক ধরনের জেদ ছিল। তাই বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতায় ভাল করে ওদের এসব মন্তব্যের জবাব দিতেন তিনি। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান ক্যাডেট কলেজে ‘বেস্ট বক্সার অব দি ইয়ার’ হয়েছিলেন এবং ১৯৬১ সালে শ্যুটিং কমপিটিশনে প্রথম ১০ জনের মধ্যে তাঁর অবস্থান ছিল। ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
১৯৬০ সালে সাঈদা আক্তারের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন সাঈদা। ফারহানা রীমা, ফারজানা শোমা, তাহসিনা লোপা এই তিন মেয়ে আর এক ছেলে কাজী ওয়াকার আহমেদ (রিংকু) এই চার সন্তানের জনক কে এম সফিউল্লাহ। তাঁদের নির্ঝঞ্ঝাট সংসারের মূলে রয়েছে স্ত্রীর একনিষ্ঠ সহযোগিতা। স্বামীর পেশাগত কারণে তাঁকে সংসার পাততে হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায়। উচ্চ শিক্ষিত হয়েও সংসার আর স্বামীর পাশে থেকে সহযোগিতা করার কারণে তেমন কিছু করা হয়ে উঠেনি সাঈদার। তবে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে তিনি জড়িত। এক্ষেত্রে স্বামীর কাছ থেকে সহযোগিতা আর উত্সাহ পেয়েছেন দারুনভাবে। স্বামীর বিভিন্ন কর্মকান্ডের পাশেও থাকেন তিনি।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পুরো বাংলাদেশ প্রচন্ড উত্তাল। বাঙালী জাতি স্বাধীনতার প্রস্তুতি প্রায় নিয়েই ফেলেছে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠিও বাঙালী সেনাদের নিয়ে নানা ষড়যন্ত্রের জাল বুনে যাচ্ছে। ইয়াহিয়া সরকার গোলটেবিল বৈঠকের নামে করছিল সময়ক্ষেপণ আর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসছিল সেনাদের। নিয়ে আসছিল অস্ত্রশস্ত্র। গোপনে চূড়ান্ত হয়েছে বাঙালীদের আক্রমণ করার পরিকল্পনা। বাঙালী সৈনিকরা যেন জনগণের পাশে এসে না দাঁড়াতে পারে, সে কৌশল আঁটতে থাকে তারা। বাঙালী সেনা অফিসারদের অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়। এমনকি বাঙালী সৈন্যদের নিয়ে গঠিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের দেশের নানা অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিল। যাতে আক্রমণ করলে বাঙালী সেনারা ঐক্যবদ্ধভাবে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পারে।
এরকমই একটি পরিস্থিতিতেই ১৯ মার্চে ঢাকা ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব জয়দেবপুরে আসে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙ্গালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে। কিন্তু সেখানে বাঙালী সৈন্যদের প্রস্তুতি দেখে তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। ঐ সময় কে এম সফিউল্লাহ ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার জাহাবদেব ফিরে যাবার পর কে এম সফিউল্লাহর নেতৃত্বে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ৩টি ব্যাটেলিয়ান নিয়ে জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ হয়ে সিলেটের তেলিয়া লাগয় মাতৃমার পর সেক্টর ও এস ফোর্স গঠন করে যুদ্ধ শুরু করেন। ২৯ মার্চ ঢাকা আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। এরই মধ্যে ২নং সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ খবর পাঠান তাঁর সাথে দেখা করতে। এত স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে ঢাকা আক্রমণ না করারও অনুরোধ জানান। এত অল্প সৈন্য নিয়ে ঢাকা আক্রমণ করলে ঢাকায় অবস্থানরত পাকিস্তানের বিশাল সেনাবাহিনীর সামনে টিকতে পারবে না। দুই সেক্টরের সৈন্যরা একত্রিত হয়ে যুদ্ধের পরিকল্পনা করলে ফলাফল ভাল হবে বলে জানান তিনি। কিন্তু ঢাকা আক্রমণের পরিকল্পনার পিছনে ছিল অন্য একটি কারণ। একদিন ওয়ারলেসে খবর পাঠাতে গিয়ে হঠাত্ করে ক্রস কানেকশনে শত্রুসেনাদের পরিকল্পনার কথা শুনে ফেলেন। শত্রুরা যশোর আর চট্টগ্রামে বড় ধরনের আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। এই খবর শুনেই সফিউল্লাহ সিদ্ধান্ত নেন নরসিংদী আর পাঁচদোনায় কিছু সৈন্য রেখে ঢাকা আক্রমণ করবে। এতে ২য় বেঙ্গল এস ফোর্সের সৈন্যদের মোকাবেলায় ঢাকার শত্রুসেনারা ব্যস্ত থাকবে। যশোর ও চট্টগ্রাম আক্রমণের সময় পাবে না। খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা করে দুইদল মিলে একসঙ্গে ভবিষ্যত্ কর্মপন্থা ঠিক করেন।
সফিউল্লাহর নেতৃত্বে প্রথমে সেক্টর ও পরে এস ফোর্স গঠন করে প্রথমে সিলেটসহ বিরাট একটি অংশ মুক্তাঞ্চল হিসাবে গড়ে তোলা হয়। একদিকে সিলেট আর একদিকে আশুগঞ্জ, ভৈরব আর মাধবপুর শত্রুমুক্ত করেন তাঁরা। তাঁর নেতৃত্বে আশুগঞ্জ, ভৈরব, লালপুর, আজবপুর, সরাইল, শাহবাজপুর, মাধবপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর শত্রুমুক্ত হয়ে যায়।
যুদ্ধের সময় অনেকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। কতবার যে মরতে মরতে বেঁচে গেছেন। অনেক সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। তাঁদের কথা ভুলতে পারেননা কে এম সফিউল্লাহ। ভুলতে পারেননা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবার মুক্তিযোদ্ধা দৌলা মিয়ার কথা। তেলিয়াপাড়া থেকে মুকুদপুর পর্যন্ত শত্রুমুক্ত করতে ২১ দিন যুদ্ধ করতে হয়েছিল তাঁকে। তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে ১৯ থেকে ২১ জুন পর্যন্ত যুদ্ধ করে মনতলা থেকে কলকলিয়া পর্যন্ত শত্রুমুক্ত করেন। ২১ জুন শত্রুসেনারা তাঁকে উত্তর, পূর্ব এবং দক্ষিণ এই তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। তিনি তখন পূর্ব দক্ষিণ থেকে পাল্টা আক্রমণ করেন। এসময় তিনি টের পান পশ্চিম দিক থেকে কেউ যেন তাঁকে সাহায্য করছে। যিনি সাহায্য করছেন তাঁর কাছে একটি মেশিনগান রয়েছে। একসময় যুদ্ধ থেমে যায়। তিনি তাঁর এলাকা পুণরুদ্ধার করতে সক্ষম হন এবং খেয়াল করলেন একজন লোক রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। যুদ্ধে সে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। রক্তে তাঁর সারা শরীর ভেসে যাচ্ছে। গুলি খেয়ে নাড়িভুড়ি বেরিয়ে গেছে। ক্ষীণ গলায় তাঁকে ডাকলেন, স্যার, তিনি চমকে উঠলেন! গলাটা যেন চেনা মনে হচ্ছে তাঁর। কাছে গিয়ে চিনতে পারলেন, তিনি তাঁদের দৌলা মিয়া। তাঁদের দলের একজন মুক্তিযোদ্ধা। শৃংখলা ভঙ্গের কারণে কিছুদিন আগে তিনি তাঁকে বের করে দিয়েছিলেন। দৌলা মিয়া তাঁকে অনেক অনুরোধ করেছিলেন তিনি যেন তাঁকে আর একবার সুযোগ দেন। তিনি তাঁর অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করবেন এবং প্রমাণ করবেন তিনি একজন যথার্থ দেশপ্রেমিক যোদ্ধা। কে এম সফিউল্লাহ তাঁর কাছে গেলে অনেক কষ্টে দৌলা মিয়া বললেন, ‘স্যার, আমি আমার কথা রেখেছি।’ তাঁর রক্তমাখা শার্টটি সফিউল্লাহকে দিয়ে বললেন, ‘স্যার, আমি মরে গেলে এটি বঙ্গবন্ধুকে দেবেন।’ সফিউল্লাহ তাঁকে তাঁর গাড়িতে তুলে নিয়ে দ্রুত আগরতলা হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিত্সার পর দৌলা মিয়া সুস্থ হয়ে যান।
৬ ডিসেম্বরের কিছুদিন পূর্বে তাঁরা শত্রুসেনাদের কাছ থেকে আখাউড়া দখল করেন। ২৯ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত শত্রুসেনাদের সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ হয়। ৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সৈন্য তাঁদের সাথে যোগ দেয়। ৬ ডিসেম্বর তাঁরা তেলিয়াপাড়া থেকে আশুগঞ্জ যাচ্ছিলেন। মাধবপুর আর চান্দুরার মাঝে একটি ব্রিজের উপরে ব্লক পজিশনে ছিল সফিউল্লাহদের কিছু সৈন্য। তাঁরা সফিউল্লাহদেরকে ওখান থেকে ‘পথে কোনো বিপদ নেই’- এধরনের সংকেত দেবে এবং তাঁদের সংকেত পাওয়ার পরই তাঁরা যাবেন। তাঁরা সেই সৈন্যদের কাছ থেকে সংকেত পেয়েই রওনা হয়ে যান। পথে ইসলামপুরে একটি গাড়ি তাঁদের দিকে আসতে দেখেন তাঁরা। ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার এটিকে তাঁর ব্যাটেলিয়ান এমোনিশন গাড়ি মনে করে। গাড়িটি এমোনিশন গাড়ির মতোই ছিল দেখতে। গাড়িটি সামনে আসতেই বুঝতে পারেন এটি এমোনিশন গাড়ি না। শত্রুসেনাদের গাড়ি। গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে বসা একজন জেসিও লাফিয়ে নেমে সফিউল্লাহকে জাপটে ধরে। সফিউল্লাহর রানারের (সেনা অফিসারের সাথে যিনি সবসময় থাকেন) কাছে সফিউল্লাহর স্টেনগান ছিল। আর জেসিওর কাছে ছিল একটি রাইফেল। তাঁদের দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি চলছিল বলে রানার গুলি করতেও পারছিল না। গুলি করলে সফিউল্লাহর গায়েও লাগতে পারে। ধস্তাধস্তির কারণে স্টেনগানের নলের মুখে একবার সফিউল্লাহ পড়েন আর একবার জেসিও পড়ে। একপর্যায়ে সফিউল্লাহ ওই জেসিওর শরীরের বিশেষ স্থানে আঘাত করলে তার বাঁধন শিথিল হয়ে যায়। তিনি জেসিওর চোয়ালে ঘুষি দিলে সে পড়ে যায় এবং তার পর পরই জেসিও উঠে দাঁড়িয়ে সফিউল্লাহর রানারকে শিল্ড হিসেবে (পিছন থেকে জাপ্টে ধরে) ব্যবহার করে সফিউল্লাহকে লক্ষ্য করে রানারের হাতে থাকা তাঁর স্টেনগানের ট্রিগার চাপে। কিন্তু গুলি তাঁর শরীরে না লেগে লাগে তাঁর কোমরে থাকা পিস্তলে। রানার আগেই গুলি খেয়ে আহত হয়েছিল। সফিউল্লাহ তখন রানারের রাইফেলটি দিয়ে জেসিওর মাথায় পর পর কয়েকবার আঘাত করেন। এক পর্যায়ে জেসিওর শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়লে সফিউল্লাহ মনে করেন সে মারা গেছে। তিনি ঘুরে দাঁড়াতেই দেখেন, পাশে একটা বিরাট বাস এসে থেমেছে। আর সেটা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে শত্রুসেনা নামছে। রাইফেলটি হাতে নিয়ে তাদের লক্ষ্য করে গুলি করতে গেলেন, দেখলেন রাইফেল ভাঙা! রাইফেলটি ফেলে দিয়ে তাঁর পাউচে থাকা একটা পিস্তল দিয়ে গুলি করতে গিয়ে দেখলেন সেটিও ভাঙা! জেসিও যখন স্টেনগান দিয়ে গুলি করেছিল সেই ২টি গুলি তাঁর শরীরে না লেগে পিস্তলে লেগেছিল। উপায়ান্তর না দেখে লাফ দিয়ে পড়েন পাশের নালায়। নালার কাঁদাপানিতে কিছুক্ষণ শরীর লুকিয়ে রাখেন তিনি। কিন্তু কতক্ষণ আর পানিতে ডুবে থাকা যায়। উঠে সোজাসুজি হাঁটতে শুরু করলেন। এমন ভঙ্গিতে হাঁটতে থাকলেন যেন তিনি কোনো দলের দলনেতা, দল পরিদর্শন করছেন। হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের ভেতরে চলে গেলেন। ওরা কোনো ধরনের সন্দেহ করলো না। সফিউল্লাহর গলায় একটা ছোট কোরান শরীফ ছিল। তিনি তাতে হাত রেখে মনে মনে দোয়া করছিলেন- ‘আল্লাহ অস্ত্র ছাড়া আমার মৃত্যু কবুল করো না।’ আল্লাহ মনে হয় তাঁর দোয়া কবুল করেছিলেন। ওরা তাঁকে সন্দেহ করলো না। সফিউল্লাহর পোশাক ছিল জলপাই রঙের। কাঁদাপানিতে ডুবে থাকার কারণে তাঁর পোশাকের রং ওদের পোশাকের রঙের সাথে মিলে গিয়েছিল। সেজন্যই হয়তো ওরা সফিউল্লাহকে সন্দেহ করেনি। ওই রাত সফিউল্লাহরা ওই এলাকাতেই কাটান।
পরদিন তাঁর হেডকোয়ার্টারে বন্দি অবস্থায় আহত এক পাকিস্তানী সেনা অফিসারকে নিয়ে আসে তাঁর সৈন্যরা। তিনি চিনতে পারেন তাকে। আগের দিন তার সাথেই সফিউল্লাহর সংঘর্ষ হয়েছিল। অফিসারটিও সফিউল্লাহকে চিনতে পারে। আর এই অফিসারটি হচ্ছে সেই অফিসার যার কথা শুরুতেই বলা হয়েছে।
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কে এম সফিউল্লাহ। প্রায় ৯৯ হাজার সৈন্য নিয়ে সেনাবাহিনীতে ফিরে যান সফিউল্লাহ। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীসহ দেশের সব নিয়মিত বাহিনী পুনর্গঠনে মনোযোগ দেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু কে এম সফিউল্লাহকে ডেকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিতে বলেন। কে এম সফিউল্লাহ সেনাপ্রধান হতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাঁকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিতে হয়। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন। এরমধ্যে রয়েছে মালয়েশিয়া, কানাডা, সুইডেন আর ইংল্যান্ড। ১৯৯১ সালে দেশে ফিরে এলে এক বছর তাঁকে চাকুরীতে ওএসডি করে রাখা হলে ‘৯২ সালের জুন মাসে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। তারপর ‘৯৫ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং ‘৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হন।
কে এম সফিউল্লাহ সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় কিছু সেনা অফিসারের হাতে বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে শহীদ হন। এ ব্যাপারে সফিউল্লাহ বলেন, ‘আমি সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় ১৫ আগস্ট কিছু বিপথগামী এবং উশৃঙ্খল সেনা অফিসরের হাতে স্বপরিবারে শহীদ হয়েছেন বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটা আমাকে সারাজীবন পীড়া দিয়েছে এবং যতদিন বেঁচে থাকব ততদিনই এই ঘটনা আমাকে কষ্ট দেবে।’
তিনি বলেন, ‘যে অবিসংবাদিত নেতার জন্ম না হলে এ জাতি মুক্ত হতো না, যাঁর ডাকে জীবন বাজী রেখে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাঁকেই মেরে ফেলা হলো নির্মমভাবে। হত্যার বিচারও হলো না। আত্মস্বীকৃত খুনীরা দম্ভ করে বলে, আমরাই হত্যা করেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না হওয়ায় পরবর্তীতে আরও হত্যাকান্ড ঘটেছে এবং যুদ্ধাপরাধীরা আজ এত শক্তিশালী হয়েছে। সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মানুষকে সোচ্চার করছে। সারাদেশ ঘুরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য তাদের অত্যাচারের তথ্য প্রমাণ যোগাড় করছে। তাঁরা জাতিসংঘে তাদের বিচারের দাবি জানিয়েছেন।
সফিউল্লাহ বিশ্বাস করেন এই বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হলে ৩০ লাখ শহীদের আত্মা শান্তি পাবে না।
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
জন্ম: মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহর জন্ম ২রা সেপ্টেম্বর বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জে, সার্টিফিকেট অনুযায়ী জন্ম সাল ১৯৩৫ হলেও তাঁর প্রকৃত জন্ম সাল ১৯৩৪।
মা-বাবা-ভাইবোন: বাবা কাজী আব্দুল হামিদ ছিলেন ম্যারেজ রেজিস্টার। আর মা রজ্জব বানু ছিলেন গৃহিণী। ৩ ভাই ৬ বোনের মধ্যে সফিউল্লাহ ছিলেন ৬ষ্ঠ।
পড়াশুনা ও কর্মজীবন: মুড়াপাড়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপরে মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে এইচ.এস.সি. পাস করার আগেই তত্কালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কমিশন লাভ করেন ১৯৫৫ সালে। ১৯৬৮ সালে স্টাফ কলেজ থেকে পিএসসি করেন। স্কুল অব ইনফেন্ট্রিতে ইন্সট্রাকটার ছিলেন। এরপরে ১৯৭০ সালে তিনি পদোন্নতি পেয়ে আবার ব্যাটেলিয়নে ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু কে এম সফিউল্লাহকে ডেকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিতে বলেন। কে এম সফিউল্লাহ সেনাপ্রধান হতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাঁকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিতে হয়। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন। এরমধ্যে রয়েছে মালয়েশিয়া, কানাডা, সুইডেন আর ইংল্যান্ড। ১৯৯১ সালে দেশে ফিরে এলে এক বছর তাঁকে চাকুরীতে ওএসডি করে রাখা হলে ‘৯২ সালের জুন মাসে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। তারপর ‘৯৫ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং ‘৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হন।
সংসার জীবন: ১৯৬০ সালে সাঈদা আক্তারের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ফারহানা রীমা, ফারজানা শোমা, তাহসিনা লোপা এই তিন মেয়ে আর এক ছেলে কাজী ওয়াকার আহমেদ (রিংকু) এই চার সন্তানের জনক কে এম সফিউল্লাহ।
স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান : কে এম সফিউল্লাহ স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযুদ্ধের ৩নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ও এস ফোর্সের প্রধান ছিলেন। তিনি অনেক সম্মুখ যুদ্ধে বীরোচিতভাবে অংশ নিয়ে সুনাম অর্জন করেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর উত্তম উপাধি দেয়।
তথ্যসূত্র: কে এম সফিউল্লাহর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে জীবনীটি তৈরি করা হয়েছে।
লেখক : শামীমা দোলা