১৯৭১ সালের মার্চ মাস। উত্তাল বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ হয়ে গেছে। পরিষ্কার হয়ে গেছে, পাকিস্তান টিকবে না। বছরের পর বছর ধরে বাঙালি জনগোষ্ঠীর উপর পাকিস্তানী সরকার যে শোষণ চালিয়েছে, তাতে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছিল সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে। সে সময়ই জন্ম নেয় কয়েকটি শ্লোগান, যেগুলো আগুন জ্বালিয়ে দিত বাঙালির মনে, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’- ছিল সে রকমই একটি শ্লোগান। ইয়াহিয়া সরকার গোলটেবিল বৈঠকের নামে করছিল সময়ক্ষেপণ। ওদিকে পশ্চিম পকিস্তান থেকে নিয়ে আসছিল সেনাদের। নিয়ে আসছিল অস্ত্রশস্ত্র। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালী সৈনিকদের নিয়ে অস্বস্তি ছিল তাঁদের। তাই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি বাঙালী সেনাদের নিয়ে নানা ষড়যন্ত্রের জাল বুনে যাচ্ছিল। গোপনে চূড়ান্ত হয়েছে বাঙালীদের আক্রমণ করার পরিকল্পনা। বাঙালী সৈন্যরা যেন জনগণের পাশে না দাঁড়াতে পারে, সেজন্য বিভিন্ন কুট-কৌশল করে তারা।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তত্কালীন মেজর খালেদ মোশাররফকে নিয়েও পাকিস্তান বাহিনী বিভিন্ন কুট-কৌশলের আশ্রয় নেয়। কারণ তিনি ছিলেন বাঙালী। সেইসময় খালেদ মোশাররফ ছিলেন ঢাকা সেনানিবাসে। সেখান থেকে তাঁকে ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের হেড অফিস কুমিল্লাতে উপপ্রধান হিসেবে বদলি করা হয়। তিনি ২২ মার্চ তাঁর পরিবারকে ঢাকায় ধানমন্ডিতে রেখে চলে যান। ইউনিটে পৌঁছার সাথে সাথেই তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর সৈন্যরা বেশ উদ্বিগ্ন। পাঞ্জাবিদের কমান্ডো এবং গোলন্দাজ বাহিনী বেঙ্গল রেজিমেন্টের চারপাশে পরিখা খনন করে মেশিনগান লাগিয়ে অবস্থান নিয়েছে। নির্দেশ পেলেই সবাইকে হত্যা করবের সেনানিবাস রক্ষার অজুহাতে এসব পরিকল্পনা নিয়েছে তাঁরা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের মনে তীব্র অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠেছিল। তিনি পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা জানতে চাইলেন এখন তাঁদের কী কর্তব্য? তিনি তাঁদের সতর্ক থাকতে বললেন।
২৪ মার্চ সকালে খালেদ মোশাররফ উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার সময় লে. কর্নেল খিজির হায়াত খান তাঁকে ডেকে পাঠালেন। অফিসের ভিতর ঢুকে দেখলেন, তিনি বেশ উদ্বিগ্ন। তাঁকে জানালেন, সিলেটের শমসের নগরে নকশালপন্থিরা বেশ তত্পর হয়েছে এবং ভারত থেকে অনুপ্রবেশ ঘটছে। এসব কারণে ৪র্থ বেঙ্গলের একটি কোম্পানী নিয়ে আজই খালেদকে কুমিল্লা ছেড়ে যেতে হবে তাদের দমন করতে। জবাবে তিনি বললেন একটা কোম্পানী যখন যাবে তখন কোনো জুনিয়র মেজরকে সেখানে পাঠানো যেতে পারে। সাধারণত কোনো উপপ্রধান একটি কোম্পানী নিয়ে যায় না। তাঁর কথায় তিনি অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, আপনি এখন যান। কিছুক্ষণ পরে তিনি তাঁকে ব্রিগেড কমান্ডারের কাছে নিয়ে যান। ব্রিগেড কমান্ডার তাঁকে বললেন, এটি একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাই তোমাকে নির্বাচিত করেছি। আশা করি নিরাশ করবে না। তিনি বুঝলেন তাঁকে যেতেই হবে। শমসের নগরে যাওয়ার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছাত্র জনতা তাঁকে বাঁধা দেয়। তাঁরা তাঁকে জানায় যে, পূর্ব বাংলায় পাক সেনারা গুলি চালিয়েছে। তাঁরা ইচ্ছা করেই বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের কুমিল্লা থেকে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তিনি তাদের বুঝিয়ে শান্ত করে আবার রওনা দিলেন শমসের নগরের পথে।
২৫ মার্চে শমসের নগরে পৌঁছার পর তিনি দেখলেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করে আরও জানতে পারলেন সেখানে কোনো অঘটন ঘটেনি। কোথাও নকশালপন্থিদের কোনো চিহ্ন খুঁজে পেলেন না তিনি। বুঝতে পারলেন তাঁকে কৌশল করে এখানে পাঠানো হয়েছে এবং যা কিছু তারা বলেছিল তার সবটাই মিথ্যা। কারণ বাঙালি সৈন্যদের নিয়ে গঠিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের দেশের নানা অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। যাতে আক্রমণ করলে বাঙালি সেনারা ঐক্যবদ্ধভাবে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পারে।
খালেদ মোশাররফ ওয়ারলেসের মাধ্যমে হেডকোয়ার্টারে শাফায়াত জামিল এবং ক্যাপ্টেন হায়দারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন। অনেক কষ্টে পরের দিন যোগাযোগ হয় তাঁদের। তাঁরা জানান, ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় সান্ধ্য আইন জারি হয়েছে এবং ৪র্থ বেঙ্গলকে তা কার্যকর করতে বলা হয়েছে। লোকজন সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে মিছিল করছে। এ অবস্থায় কী করণীয়?
প্রায় ১শ মাইল দূরে অবস্থান করে তাঁর পক্ষে এ প্রশ্নের জবাব দেয়া কঠিন ছিল। একদিকে সামরিক শৃঙ্খলা আর কর্তব্য বোধ আর অন্যদিকে বিবেকের দংশন তাঁকে পীড়িত করছিল। এই উভয় সংকটে পড়ে তিনি চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেললেন। মেজর শাফায়াত জামিলকে তিনি বললেন, আমাকে কিছুটা সময় দাও।
অবশেষে তাঁর বিবেক তাঁকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করল। যদিও কোনো রাজনৈতিক নির্দেশ সেই মুহূর্তে ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণার কথা তাঁর মনে পড়ে গেল। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবার ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তিনি লে. মাহবুবকে বললেন, ‘এই মুহূর্তে আমি স্বাধীন বাংলার আনুগত্য স্বীকার করলাম। স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দাও। আর সব সৈনিকদের বলে দাও আজ থেকে আমরা আর কেউ পাকিস্তানের অনুগত নই’। লে. মাহবুব যেন এই নির্দেশের অপেক্ষাতেই ছিলেন। তিনি দৌড়ে গিয়ে বাকি সৈনিকদের জানিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পরেই খালেদ মোশাররফ শুনতে পেলেন বাঙালী সৈনিকদের শ্লোগান ‘জয় বাংলা’।
খালেদ মোশাররফের নির্দেশেই মেজর শাফায়াত জামিল, লে. কবির আর লে. হারুন বিদ্রোহ ঘোষণা করে পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। পাক সেনারা আত্মসমর্পণ না করে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে ৭২ পাক সেনাকে হত্যা এবং তিন সামরিক অফিসারকে গ্রেফতার করে ২৬ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে শত্রু মুক্ত করেন তাঁরা। আর ২৭ মার্চ সিলেট থেকে ব্রাহ্মনবাড়িয়া এসে পৌঁছেন মেজর খালেদ মোশাররফ। এখান থেকেই ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের নেতৃত্ব দেন তিনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে হেড কোয়ার্টার করে তার আশেপাশে প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তোলেন এবং এখান থেকেই ভৈরব, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী এবং ঢাকার আশেপাশের এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাঁর নেতৃত্বে সিলেট থেকে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, নোয়াখালী এবং ফেনীর বিরাট এলাকা শত্রু মুক্ত হয়।
খালেদ মোশাররফই প্রথম বাঙালী সেনা অফিসার যিনি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার এবং কে ফোর্সের প্রধান ছিলেন। যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর উত্তম খেতাব দেন। যুদ্ধের সময় সমগ্র বাংলাদেশের রণাঙ্গনকে মোট ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ২ নম্বর সেক্টর নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ এখানেই সংগঠিত হয়। এখানে ট্রেনিং সেন্টার ছিল। ভারতীয়দের সহায়তা ছাড়াই গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং দেওয়া হতো। ট্রেনিং-এর দায়িত্বে ছিলেন মেজর হায়দার। ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকায় বড় বড় অপারেশন চালিয়েছেন। খালেদ মোশাররফের ইচ্ছা ছিল যুক্তিবাদী প্রতিটি বাঙালী যেন যুদ্ধে অংশ নিতে পারে। এই ২ নম্বর সেক্টরের নেতৃত্ব্বে ছিলেন খালেদ মোশাররফ। বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত মরণপণ লড়াই চালিয়ে গেছেন তিনি।
উল্লেখযোগ্য অনেকগুলো অপারেশনে খালেদ মোশাররফ নেতৃত্ব দেন। মে মাসের শেষদিকে একটি অপারেশন চালিয়ে কসবার মন্দভাগ ও শালদানদী এলাকাকে শত্রুমুক্ত করে তাঁর কে ফোর্স। ২৬ মে রাত ৯টায় সুবেদার ভুঁইয়ার নেতৃত্বে বাঙালী সৈন্যরা রকেট লাঞ্চার নিয়ে শালদানদীর নদী এলাকায় শত্রু ঘাঁটিতে ঢুকে পড়ে বাঙ্গালী সেনারা। রকেট লাঞ্চার দিয়ে শত্রুদের ২টি বাংকার তাঁরা ধ্বংস করে দেয়। এই আকস্মিক হামলায় ১০ পাক সৈন্য নিহত হয়। ২৭ মে শত্রু সেনারা আরও সৈন্য এনে হামলা চালানোর চেষ্টা করলে মুক্তিবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে তারা পিছিয়ে যায়। এই আক্রমণে প্রচুর শত্রুসেনা আহত ও নিহত হয়। পাক সেনাদের প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গাড়ি মুক্তিবাহিনীর হাতে চলে আসে।
শত্রুদের ঘায়েল করতে হলে প্রথমেই দরকার তাদের অবাধ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা অর্থাত্ তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। আর এই চিস্তা থেকেই খালেদ মোশাররফ পরিকল্পনা করেন সিঙ্গারবিল রেলওয়ে ব্রিজ ধ্বংস করার। মে মাসের শেষ দিকেই ক্যাপ্টেন আইনউদ্দীনের নেতৃত্বে একটি দল কসবার উত্তরে ইমামবাড়ির কাছে ১৫০ পাউন্ড এঙ্প্লোসিভ লাগিয়ে রেলওয়ে ব্রিজ ধ্বংস করে দেয়। এর কিছুদিন পরেই লে. হারুন ১৪০ এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে সিঙ্গারবিল রেলওয়ে ব্রীজ উড়িয়ে দেয়। পাকবাহিনী এ সেতুটি মেরামত করার জন্য সরঞ্জাম নিয়ে আসে স্টেশনে। পাক বাহিনী সেতু মেরামত শুরু করলে সুবেদার শামসুল হক আর লে. হারুনের দুটি দল যৌথভাবে আক্রমণ চালায়। আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পাক সেনারা সেখান থেকে জিনিসপত্র ফেলে পালিয়ে যায়। আর সেই সঙ্গে সিলেট-চট্টগ্রাম রেলওয়ে লাইন পাক সেনাদের জন্যে চিরতরে হাতছাড়া হয়ে যায়।
খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সীমান্ত থেকে কুমিল্লা শহর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা বাঙালী মুক্তিসেনাদের দখলে চলে আসার পর তাঁদের মনোবল অনেক বেড়ে যায়। এরকম একটি পরিস্থিতিতেই খবর আসে জুন মাসে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিম ঢাকা আসছে সরেজমিনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখতে। তারা গিয়ে রিপোর্ট দিলে পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য দিবে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক। আর ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যদি পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য দেয় তাহলে পাকিস্তানের সমরাস্ত্র কেনার ও যুদ্ধ পরিচালনার পক্ষে যথেষ্ট সুবিধা হবে। পাকিস্তানী প্রচার মাধ্যমগুলো এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মহলকে বুঝিয়েছিল, বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। সিদ্ধান্ত হয়, ওয়াল্ড ব্যাংক টিম যখন ঢাকায় আসবে যেভাবেই হোক আক্রমণ করে বুঝিয়ে দিতে হবে যে পরিস্থিতি মোটেই স্বাভাবিক নয়, বাংলাদেশের অধিকাংশ স্থানই পাকবাহিনীর আয়ত্ত্বে নেই। এই পরিকল্পনা অনুসারেই ৪ঠা জুন একটি গেরিলা দল গোপনে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়। তাঁরা দুটি দলে ভাগ হয়ে তত্কালীন জিন্নাহ এভিন্যুর সামনে গ্রেনেড ছোঁড়ে। ওই একই দিনে আরেকটি ছোট গেরিলা দল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে পাকিস্তানী অফিসারের বাড়ির ভিতরে দুপুরে গ্রেনেড ছোড়ে। ৯ জুন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের টিমের সদস্যরা যখন ভেতরে মিটিং করছিল তখন বাইরে তাদের পার্কিং করা গাড়ি লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে গাড়িটি ধ্বংস করে দেয়। এ ঘটনায় বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিরা খুব সহজেই বাংলাদেশের পরিস্থিতি বুঝতে পারে।
জুন মাসের মাঝামাঝি সময়েই পাকবাহিনী আকস্মিকভাবে আক্রমণ চালিয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের কাছ থেকে কৈখোলা এলাকার দখল নিয়ে নেয়। কিন্তু ঘন্টাখানেকের মধ্যেই মেজর সালেক চৌধুরী পাল্টা হামলা চালায়। ঘন্টা দুয়েকের যুদ্ধে বাঙালী সৈনিকদের প্রচন্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পাক সেনারা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে পাক সেনাদের একজন জেসিওসহ ৩১ জন সিপাহী আহত হয়।
অন্যদিকে ২১ জুন সকালে বাঙালী সৈন্যরা একটি আর আর রাইফেল নিয়ে কুমিল্লা শহরের কাছে বিমানবন্দরে এবং শহরের উপকন্ঠে এলোপাথাড়ি গোলাগুলি শুরু করলে পাক সেনারা প্রচন্ড ভয় পেয়ে পাগলের মতো ছুটে পালিয়ে যায়। এতে জনসাধারণের মনে সাহস ফিরে আসে। খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে এসব আক্রমণের ফলে পাকিস্তানীদের মনোবল ভেঙে যায় এবং তাদের শাসনব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। খালেদ মোশাররফের মতো অনেক বীর সেনাদের বীরত্বের কারণেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হয়েছিল।
খালেদ মোশাররফের গ্রামের বাড়ি জামালপুর জেলার ইসলামপুরের মোশাররফগঞ্জে। জন্ম ১৯৩৭ সালের ১ নভেম্বর। বাবা মোশাররফ হোসেন ছিলেন একজন পাট ব্যবসায়ী। মায়ের নাম জমিলা আখতার। মোশাররফ হোসেন ইসলামপুরের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর নাম অনুসারেই গ্রামটির নাম মোশাররফগঞ্জ। খালেদ মোশাররফরা পাঁচ ভাই, পাঁচ বোন। ছোটবেলায় তিন ভাই মারা যায়। খালেদ মোশাররফ ছোটবেলা থেকেই খুব মেধাবী ছিলেন। তাঁর শৈশব কাটে মোশাররফগঞ্জে আর চট্টগ্রামে। পড়াশুনা শুরু করেন ইসলামপুর হাই স্কুলে। ময়মনসিংহ জেলা স্কুলেও দুবছর পড়েছেন। তারপর চলে যান মামার বাসায়। মামা থাকতেন কক্সবাজার। সেখান থেকেই ১৯৫৩ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ছাত্র অবস্থাতেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ঢাকা কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তিনি ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে নির্বাচন করে সমাজকল্যাণ এবং সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। এছাড়াও ১৯৫৪ সালের রাজনৈতিক আন্দোলনেও জড়িত ছিলেন। ১৯৫৫ সালে খালেদ মোশাররফ সেনাবহিনীতে ভর্তি হন এবং ১৯৫৭ সালে তিনি কমিশন পান।
১৯৬৫ সালে খালেদ মোশাররফ বিয়ে করেন সালমা খালেদকে। সালমা খালেদ তখন ইডেন কলেজের ছাত্রী। আর খালেদ মোশাররফের পোস্টিং ছিল পাকিস্তানের মিলিটারি একাডেমিতে। মাহাজেবীন খালেদ, আমমেরীন খালেদ আর আয়রীন খালেদ-এ তিন সন্তানের জনক ছিলেন খালেদ মোশাররফ। দাম্পত্য জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সালমা খালেদ বলেন, ‘খালেদ ছিলেন আমার স্বামী, বন্ধু এবং অভিবাবক। মানুষ হিসেবে খালেদ মোশাররফ একটু একরোখা ধরনের হলেও স্বামী হিসেবে খালেদ ছিলেন চমত্কার বন্ধুত্বপূর্ণ। আর পছন্দ করতেন ঘুরে বেড়াতে। সেনাজীবনের ব্যস্ত সময়েও পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরে বেড়াতে ভুল হতো না তাঁর। প্রচন্ড বন্ধুপ্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি। খেতে এবং খাওয়াতে পছন্দ করতেন। কারণে-অকারণে বন্ধুদের দাওয়াত করে খাওয়ানো ছিল খালেদের নিত্য অভ্যাস। একজন সেনা অফিসারের স্ত্রী হিসেবে তাঁর জীবনে কোনো একঘেয়েমী ছিল না।
সালমা খালেদের দাম্পত্য জীবন ছিল মাত্র ১০ বছরের। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থানের মুখে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই বীরসেনানী সামরিক বাহিনীর সৈনিকদের হাতে নিহত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিছু সেনা অফিসারের হাতে সপরিবারে নিহত হবার পর সেনাবাহিনীতে বিরাজ করছিল চরম বিশৃংখলা। কোনো চেইন অব কমান্ড ছিল না। সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ নেতৃত্ব দিয়ে দ্বিতীয় অভ্যুত্থান ঘটান। ৭ নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থানে সামরিক বাহিনীর সৈনিকদের হাতে খালেদ মোশাররফ নিহত হন।
খালেদ মোশাররফ সালমার কাছে এখন শুধুই স্মৃতি। সুখকর জীবনের প্রতিটি ঘটনা এখন তাঁকে ভাবায়। ভাবায় খালেদ মোশাররফের মৃত্যুর আগের মুহূর্তে বলে যাওয়া শেষ কথাগুলো। সারাক্ষণ যেন কথাগুলো কানে বাজে। শেষবার যখন খালেদ মোশাররফের সঙ্গে তাঁর কথা হয়, তিনি বলেছিলেন, ‘চিন্তা করো না। ভাল আছি। কাল সকালে আসবো। কিন্তু সকালে তিনি ফিরে আসেননির ফিরে এসেছিলেন চার দিন পর লাশ হয়ে।
তিন মেয়ের মাঝেই খালেদ মোশাররফকে খুঁজে পান সালমা খালেদ। দেশের কাছে দেশের মানুষের কাছে তাঁর একটিমাত্র অভিযোগ- একজন মুক্তিযোদ্ধাকে বিনা বিচারে মেরে ফেলা হলো আর কেউ কিছু বললো না! বিচার হলো না! কোনো অন্যায় করলে তাঁর বিচার হতে পারতো। কিন্তু তাঁকে মেরে ফেলা হলো কেন? বেগম খালেদ আক্ষেপ করে বলেন, খালেদ যুদ্ধ করার সময় মারা গেলেন না। অথচ বিনা বিচারে তাঁর মৃত্যু হলো স্বাধীন দেশে। যে দেশের জন্য তিনি জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধে শত্রু সেনাদের শেলে স্প্লিন্টার এসে লাগে খালেদের মাথায়। আহত হয়ে তিনি লক্ষ্ণৌ হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর ব্রেন অপারেশন করতে হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন, তাঁর বাঁচার আশা অত্যন্ত ক্ষীণ। আশ্চর্যজনকভাবেই সেদিন বেঁচে উঠেছিলেন তিনি। অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! তাঁকে জীবন দিতে হলো স্বদেশের মাটিতে।
খালেদ মোশাররফকে অনেকে ৩ নভেম্বরের ব্যর্থ অভ্যুত্থানকারী মনে করেন। তাদের মত, খালেদ মোশাররফ নিজে অভ্যুত্থান ঘটালেও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তত্কালীন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে কে ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে একটি ব্রিগেড পরিচালনা করেছিলেন। সম্মুখ যুদ্ধে বীরোচিতভাবে অংশ নিয়ে সুনাম অর্জন করেন। সেনাবাহিনীর একজন প্রথিতযশা অফিসার হিসেবেও তাঁর সুনাম ও জনপ্রিয়তার অন্ত ছিল না। কিন্তু তিনি তাঁর এই সুনাম এবং জনপ্রিয়তা কাজে লাগাতে পারেননি। একজন দক্ষ ও সাহসী সেনা অফিসার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেও রাজনীতির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নিতান্তই অনভিজ্ঞ।
আবার অন্যদের মত হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা বা সেনাপ্রধান হওয়া খালেদ মোশাররফের উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন সেনাবাহিনীর শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে, চেইন অব কমান্ড ঠিক করতে।
১৯৭৫ সালে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন কি না বা নিতে পারলে কী হতে পারতো তা ঠিক করে বলা যাবে না। তবে ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চে কিন্তু তিনি সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছিলেন। একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক সৈনিক হিসেবে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল তিনি সেই সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন সেদিন। জীবন বাজি রেখে তিনি যুদ্ধ করে গেছেন। তাঁর মতো অসংখ্য দেশপ্রেমিক সাহসী যোদ্ধাদের কারণেই আমরা পেয়েছি মুক্ত স্বদেশ ভূমি। স্বাধীন বাংলাদেশ। এ মাটি ঋণী খালেদ মোশাররফদের মতো বীর সেনাদের কাছে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
জন্ম : ১৯৩৭ সালে নভেম্বর মাসে জামালপুর জেলার ইসলামপুরের মোশাররফগঞ্জে খালেদ মোশাররফের জন্ম হয়।
শিক্ষা : খালেদ মোশাররফ পড়াশুনা শুরু করেন ইসলামপুর হাইস্কুলে। ময়মনসিংহ জেলা স্কুলেও দুবছর পড়েন। কক্সবাজার থেকে ১৯৫৩ সালে এস.এস.সি. পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা কলেজে এবং এখান থেকেই এইচ.এস.সি. পাস করেন।
কর্মজীবন : ১৯৫৫ সালে খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীতে ভর্তি হন এবং ১৯৫৭ সালে তিনি কমিশন পান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান : খালেদ মোশাররফ স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে কে ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে একটি ব্রিগেড পরিচালনা করেছিলেন। যুদ্ধকালে সমগ্র বাংলাদেশের রণাঙ্গনকে যে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল তার মধ্যে ২নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন খালেদ মোশাররফ। এছাড়াও অনেক সম্মুখ যুদ্ধে বীরোচিতভাবে অংশ নিয়ে সুনাম অর্জন করেন। মুক্তিযুদ্ধে তার বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরোত্তম উপাধি দেয়।
মৃত্যু: ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থানের মুখে সৈনিকদের হাতে খালেদ মোশাররফ নিহত হন।
তথ্যসূত্র:
১. খালেদ মোশাররফের লেখা বই ’আমিই খালেদ বলছি’। এবং খালেদ মোশাররফের স্ত্রী সালমা খালেদের সাহায্য নেয়া হয়েছে।
লেখক : শামীমা দোলা