১৯৫১ সাল থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন মেজর জেনারেল সি. আর. দত্ত। পুরো নাম চিত্ত রঞ্জন দত্ত। বছরে ছুটি ছিল এক মাস। কিন্তু এক মাসের ছুটি তাঁর কাছে খুব কম মনে হতো। একটা মাস চোখের পলকে চলে যায়। স্ত্রী সন্তান নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মাত্র একমাসের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর পিতার স্থায়ী নিবাস হবিগঞ্জে আসাটা কষ্টকর মনে হতো তাঁর। তাই তিন বছরের ছুটি জমিয়ে রেখে তৃতীয় বছর একসাথে তিন মাসের ছুটি নিয়ে স্ত্রী-সন্তানসহ হবিগঞ্জে আসতেন। ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিশ বছর তিনি তাই করছেন। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ – এই তিন মাসের ছুটি একসাথে নিয়ে তিনি হবিগঞ্জে এসেছিলেন। অনেক দিন পর দেশে এসে ভেবেছিলেন আপনজনদের সাথে দেখা করবেন। শৈশব কৈশোরের পুরনো বন্ধুদের নিয়ে প্রিয় জায়গাগুলোতে ঘুরে বেড়াবেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দেশের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে বেড়াবেন। অর্থাত্ ইচ্ছা ছিল গত তিন বছরের একঘেয়েমি কাটাতে তিন মাসের ছুটির দিনগুলোকে লাগামহীন ঘোড়ার মতোই ছেড়ে দিবেন তিনি। কিন্তু সেবছর তাঁর আশা খুব বেশি পূরণ হয়নি। বরং তিন বছর পর দেশে এসে মেজর জেনারেল সি. আর. দত্ত অবাক হয়েছিলেন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে। কারণ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তিনি বুঝতে পারতেন না পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ স্বাধীনতার জন্য এতটা ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক ঘাঁটিতে তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সম্পর্কে জানানো হতো না। তাছাড়া জানার কোনো উপায়ও ছিল না তাঁর।
দেখতে দেখতে তিন মাসের ছুটি প্রায় শেষ হয়ে আসছিল। এরকম পরিস্থিতিতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আবার পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাবেন কি না এ ব্যাপারে তিনি শঙ্কিত ছিলেন। মার্চ মাসের শুরু থেকে ব্যাপক প্রচারণা শুরু হয়েছিল ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবেন। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র থেকে শুরু করে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ অপেক্ষা করছিল ৭ মার্চের সমাবেশের জন্য। মাইকিং করে ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলোতে ব্যাপক প্রচারণা হয়েছিল ৭ মার্চের জনসভা নিয়ে। তখনও সি. আর. দত্ত হবিগঞ্জেই ছিলেন। ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের সেই তেজোদীপ্ত ভাষণ তিনি বাংলাদেশ বেতারে শুনেছিলেন। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকো’। এই কথাগুলো তাঁকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের একজন অকুতোভয় সৈনিক হিসাবে ৪নং সেক্টরের কমান্ডার হয়ে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখে দেশ স্বাধীন করেছিলেন।
সি. আর. দত্তের পৈতৃক আদিনিবাস সিলেটের চুনারু ঘাট। বাবা উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ভারতের আসামের রাজধানী শিলং-এ পুলিশ অফিসারের চাকরি করতেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন শিলং-এ। তারিখ ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারী। প্রাথমিক শিক্ষা সেখানেই শুরু। শিলং-এর লাবান গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছিলেন। তারপর বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে হবিগঞ্জে এসে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। হবিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে ১৯৪৪ সালে তিনি মাধ্যমিক পাশ করেন কৃতিত্বের সাথে। তারপর নিজের একক সিদ্ধান্তে চলে যান কলকাতায়। বাবার কিছুটা অমতে সেখানকার আশুতোষ কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়ে ছাত্রাবাসে থাকা শুরু করেন তিনি। হোস্টেলের খরচের জন্য কলকাতা থেকে টাকা চেয়ে বাবার কাছে চিঠি লিখেন। বাবা উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত সেদিন ছেলের জন্য টাকা পাঠিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু সেইসাথে ছাত্রাবাসের সুপারিন্টেন্ডেন্ট-এর কাছেও একটা চিঠি পাঠালেন। পাঠানো চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন তাঁর ছেলের ছাত্রাবাসের খরচ বাবদ তাদের পাওনা টাকা রেখে ছেলের ভর্তি বাতিল করে দিতে। বাবার ধারণা ছিল ছেলে একা একা এতদূর থাকলে বখাটে হয়ে যেতে পারে। বাবার এই ধারণা কতটা সত্যি হতো জানা নেই। তারপরও সি. আর. দত্ত বাবার কথায় আর আশুতোষ কলেজের সহপাঠীদের পরামর্শে খুলনার দৌলতপুর কলেজের বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হন। পরে এই কলেজ থেকেই বি.এস.সি. পাশ করেন।
১৯৫১ সালে সি. আর. দত্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। শুরু হয় নতুন এক জীবন। সেনাবাহিনীর কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন প্রথম দিকে একটু খারাপ লাগলেও খুব কম সময়েই তিনি তাতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। কিছুদিন পর সেকেন্ড লেফটেনেন্ট পদে কমিশন পান। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তাঁর উপর অনেক অবিচার হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানী বলে। তখন থেকে পাকিস্তান সরকারের উপর ক্ষোভ জমা হচ্ছিল। কিন্তু এই ক্ষোভ তিনি কখনোই প্রকাশ করতেন না। বরং একজন কর্তব্যপরায়ণ সৈনিক হিসেবেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কাজ করে যাচ্ছিলেন।
১৯৫৭ সালের ঘটনা। ছুটি নিয়ে হবিগঞ্জে এলেন। তিনি বুঝতেও পারেননি যে তাঁর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা ঘটে যেতে পারে। পারিবারিক সদস্যরা তাঁর জন্য হবিগঞ্জেরই অভিজাত বংশের মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলেন। বিয়ের পর ছুটি শেষে স্ত্রীকে নিয়ে সি. আর. দত্ত ফিরে যান পশ্চিম পাকিস্তানে। একই ধাচে জীবন চলছিল। ১৯৬৫ সালে সৈনিক জীবনে প্রথম যুদ্ধে লড়েন তিনি। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের হয়ে আসালং-এ একটা কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন তিনি। এই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাঁকে পুরস্কৃত করে।
এরপর এলো সেই ভয়াবহ ২৫ মার্চের কালোরাত। ১৯৭১ সালের সেই রাতে তিনি হবিগঞ্জে ছিলেন। মধ্য রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বর্বোচিত হত্যাকান্ড চালিয়েছে পাক হানাদার বাহিনী। ২৬ মার্চ জেনারেল রব ও মানিক চৌধুরী কয়েকজন ছাত্রের মাধ্যমে সি. আর. দত্তের কাছে খবর পাঠালেন জেনারেল রবের বাড়িতে যাওয়ার জন্য। খবর পেয়ে সি. আর. দত্ত আর দেরি করেননি। জেনারেল রবের বাড়িতে গিয়ে দেখেন সেখানে সামরিক বাহিনী ও আনসার বাহিনীর কিছু সদস্যও আছেন। অল্প কিছু অস্ত্র নিয়ে তাঁরা প্রতিরোধ যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুত। জেনারেল রব যুদ্ধ পরিচালনার ভার দিলেন মেজর জেনারেল সি. আর. দত্তকে। তিনি হাসি মুখে এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ চোখে সেই দায়িত্ব পালন করতে সম্মতি জানালেন। তখনও মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়নি। নিজ নিজ দায়িত্বে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক সেনা অফিসার প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সি. আর. দত্ত সিলেট জেলায় যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন।
১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। স্বাধীনতার ঘোষণা হওয়ায় বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক একটা সরকার প্রয়োজন ছিল। তাই ১০ এপ্রিল নির্বাসিত অবস্থায় মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করা হয়। ১২ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসর প্রাপ্ত কর্নেল এম. এ. জি ওসমানীকে। ১২ এপ্রিল ওসমানীকে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হলে সমগ্র বাংলাদেশকে তিনি মোট ১১টি সেক্টরে ভাগ করে নেন। সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল এবং খোয়াই শায়স্তাগঞ্জ রেল লাইন বাদে পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে ৪নং সেক্টর গঠন করা হয় এবং এই সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর জেনারেল সি. আর. দত্ত। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর সিলেটের রশীদপুরে প্রথমে ক্যাম্প বানান তিনি। চারপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চা বাগান। চা বাগানের আড়ালকে কাজে লাগিয়ে তিনি যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ করে দিতেন। এছাড়া তখন সেখানকার চা বাগানের ম্যানেজার এবং বিভিন্ন গ্রামের মানুষ তাঁদেরকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি যুদ্ধের আক্রমণের সুবিধার্থে রশীদপুর ছেড়ে মৌলভীবাজারে ক্যাম্প স্থাপন করেন।
তিনি অসীম সাহসের সাথে এবং দেশ স্বাধীন করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। মূলত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকাকালীনই পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি তাঁর ক্ষোভের জন্ম হয়। সেই ক্ষোভের প্রতিফলন ঘটাতে চেয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁকে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু সব সমস্যাকে তিনি মেধা আর বিচক্ষণতা দিয়ে মোকাবেলা করে গেছেন। সিলেটের আটগ্রামে মাইলের পর মাইল পথ হেঁটে না খেয়ে এক বহর সৈন্য নিয়ে গভীর রাতে পাকবাহিনীকে আক্রমণের জন্য অবস্থান নিয়েছেন তিনি। এভাবে অনেক বীরত্বপূর্ণ অপারেশন সফল করেছেন সি. আর. দত্ত। গণবাহিনী বা গেরিলাবাহিনী, যাঁরা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদেরকে সি. আর. দত্ত কাজে লাগিয়েছিলেন শত্রুকে ধ্বংস করার জন্য। রাতের আঁধারে, কখনো দিনের আলোতে নানা কৌশলে এসব গেরিলারা তাঁর নির্দেশে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে শত্রু ঘাঁটিগুলো গুড়িয়ে দিত। এছাড়া নিয়মিত বাহিনীও তাঁর সেক্টরের বিভিন্ন এলাকায় প্রয়োজনের তুলনায় কম সংখ্যক অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে বীরত্ব দেখিয়েছেন।
অনেক ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠনিকভাবে সমগ্র বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি তাঁর বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত হন। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ পূনর্গঠনে তাঁর দায়িত্ব আরও বেড়ে গিয়েছিল। তিনি মূলত নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের অবকাঠামোগত দিক নিয়ে কাজ করেন। ১৯৭২ সালে রংপুরে ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সীমান্ত রক্ষা প্রহরী (বর্তমান যার নাম বিজিবি) গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সরকার। এই বিষয়ে সি. আর. দত্তকে দায়িত্ব দিল বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশ রাইফেলস (বিজিবি-র পূর্বের নাম) নামটি মেজর সি. আর. দত্তের দেয়া। তিনিই বাংলাদেশ রাইফেলস-এর প্রথম ডাইরেক্টর জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হন।
১৯৭১-এর পর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তাঁকে নানা ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি হেড কোয়ার্টার চিফ অব লজিস্টিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। ১৯৭৯ সালে বিআরটিসি এর চেয়ারম্যান হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮২ সালে তিনি পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। পুরাতন ডিওএইচএস এর একটি চমত্কার নিরিবিলি বাড়িতে অবসর জীবন যাপন করছেন মেজর জেনারেল (অবঃ) সি. আর. দত্ত এবং তাঁর স্ত্রী। তিনি চার সন্তানের জনক এবং তাঁর চার সন্তানই দেশের বাইরে বসবাস করছেন।
কিন্তু অবসর জীবনে এসে তিনি কখনও মনে করেননি তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়েছে। আর তাই তিনি অবসর জীবনের শুরু থেকে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন। ১৯৮৮ সালে সামরিক সরকার হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করলে তিনি সরাসরি এর প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন রাষ্ট্রকে ধর্ম-ভিত্তিক করার জন্য যুদ্ধ করিনি। ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হলে আমরা বাংলাদেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে যাব। কিন্তু ১৯৭১-এ আমরা কেউ দ্বিতীয় শ্রেণীর ছিলাম না। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের জন্য সবাই এক সাথে যুদ্ধ করেছি। তত্কালীন সময়ে প্রেসিডেন্ট এরশাদকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করলেও এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, এ সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। এর প্রতিবাদে ১৯৮৮ সালে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ গঠন করেন এবং এই ঐক্য পরিষদের সভাপতি হিসেবে তিনি অসাম্প্রদায়িক ঐক্যের ডাক দেন। এখনও পর্যন্ত তিনি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মানুষকে অসাম্প্রদায়িকতার মন্ত্রে দীক্ষিত করতে চান তিনি। বাংলাদেশ জাতীয় পূজা উদযাপন কমিটিরও তিনি সভাপতি। কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি সরকার ও বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সংগঠনের কাছ থেকে পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন।
মেজর জেনারেল সি. আর. দত্ত ছিলেন একজন সৈনিক। সৈনিকের যুদ্ধ কোনোদিনও শেষ হয়না। তাই এখনও তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে। সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম গঠন করে সারা দেশে রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের বিচারের দাবিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন সভা সমাবেশে। তাঁর এই দাবিকে সর্বস্তরের মানুষের দাবিতে পরিণত করতে চান তিনি। একাশি বছর পেরিয়ে তিনি দৃঢ়কন্ঠে এখনও বলে বেড়ান এই দেশে ‘৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখবই একদিন’।
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
নাম : চিত্ত রঞ্জন দত্ত
বাবা : উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত
মা : লাবন্য প্রভা দত্ত
জন্ম : ১ জানুয়ারি ১৯২৭ শিলং, আসাম।
সন্তান : তিনি চার সন্তানের জনক। তাঁর চার সন্তানই দেশের বাইরে বসবাস করেছেন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা : লাবান গভঃ স্কুল, শিলং, হবিগঞ্জ গভঃ হাই স্কুল, দৌলতপুর কলেজ, খুলনা।
পেশা : সামরিক সরকার
সর্বশেষ পদবী : মেজর জেনারেল
উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ : ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ
মুক্তিযুদ্ধের খেতাব : বীর উত্তম
অবসর : ১৯৮৪ সাল
বর্তমান সময় : বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত এবং ৭১ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন করছেন।
তথ্যসূত্র : ‘শত মুক্তিযোদ্ধার কথা’ নামক গ্রন্থ ও মেজর জেনারেল (অব.) সি. আর. দত্তের সাক্ষাত্কার।
লেখক : কামরান পারভেজ