জিয়াউর রহমান জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারী, বগুড়া জেলার বাগবাড়ী গ্রামে। পিতা মনসুর রহমান ও মাতা জাহানারা খাতুন। মনসুর রহমান ছিলেন রসায়নবিদ, মাতা জাহানারা খাতুন ছিলেন গৃহিণী এবং রেডিও পাকিস্তানের প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী। জিয়াউর রহমানের ডাক নাম কমল। মনসুর রহমান-জাহানারা খাতুন দম্পত্তির পাঁচ পুত্রের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন দ্বিতীয়। অন্যরা হলেন- রেজাউর রহমান (বকুল), মিজানুর রহমান, খলিলুর রহমান (বাবলু), আহমদ কামাল (বিলু)।
শৈশবের একটা বড় সময় জিয়াউর রহমানের কেটেছে কলকাতার পার্ক সার্কাসে। সেখানে তিনি প্রায় বার বছর ছিলেন। চার বছর বয়সে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় পার্ক সার্কাসের আমিন আলী এভিনিউতে অবস্থিত শিশু বিদ্যাপীঠে। এক বছর ওই স্কুলে পড়ার পর বিশ্বযুদ্ধের কারণে জিয়াউর রহমানের পরিবারকে কলকাতা ছেড়ে বগুড়ার গ্রামের বাড়িতে চলে আসতে হয়। এই সময় তিনি বাগবাড়ী বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি বছর দু’য়েকের মতো পড়াশুনা করেন। পরে বাবা-মায়ের একান্ত ইচ্ছায় তিনি ১৯৪৪ সালে পুনরায় কলকাতায় চলে যান। ওই বছরই কলকাতার কলেজ স্ট্রীটের হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। জিয়াউর রহমানের বড়ভাই রেজাউর রহমানও একই স্কুলে পড়তেন, দুই ক্লাস উপরে। সেসময় তাঁদের বাবা মনসুর রহমান কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কলকাতার মিনিস্ট্রি অব সাপ্লাইড এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-এর অধীনে টেস্ট হাউজে (টেস্টিং ল্যাবরেটরি) রসায়নবিদ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মনসুর রহমান ১৯২৮ সাল থেকেই এই সংস্থায় কাজ করতেন।
ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অঙ্গনে তখন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। দেশ বিভাগের পথে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হলে মনসুর রহমান পরিবার নিয়ে করাচি চলে যান। থাকতেন জ্যাকব লাইনে।
কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত বাঙালী মুসলমানের ‘পাকিস্তান’ প্রীতি কাটতে খুব বেশি সময় লাগল না। ‘মুসলমান-মুসলমান ভাই ভাই’ বলে যে বুলি চালু করা হয়েছিল তা আসলে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের শোষণের ভীতকে শক্তিশালী করারই একটা মোক্ষম অস্ত্র ছিল। এটা বাঙালী বুঝে ফেলে যে, এই অস্ত্র দিয়েই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী প্রথম আঘাত করে বাঙালীর মাতৃভাষা বাংলার উপর।
মনসুর রহমানের পরিবার করাচি অবস্থানকালেই জিয়াউর রহমান ১৯৪৮ সালের ১ জুলাই ভর্তি হলেন করাচি একাডেমী স্কুলে। যার বর্তমান নাম তাইয়েব আলী আলভী একাডেমী। ১৯৫২ সালে এই একাডেমী স্কুল থেকেই তিনি মেট্রিক পাশ করেন। পরে ভর্তি হন ডি.জে. কলেজে। এই কলেজে একবছর পড়ার পর ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে একজন অফিসার ক্যাডেট হিসাবে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে কমিশন পান। এ সময় তিনি অত্যন্ত কষ্টকর ও ধীরবুদ্ধি সম্পন্ন কমান্ডো ট্রেনিং গ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সালে জিয়াউর রহমান ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। ১৯৫৯ সালে তিনি সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত সততার সাথে তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৫ সালে শুরু হয় পাক-ভারত যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমান ফাস্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়নের কোম্পানী কমান্ডার হয়ে সামরিক যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি তাঁর কোম্পানী নিয়ে লাহোরের খেমকারান সেক্টরে সরাসরি শত্রুর মোকাবেলা করেন। তাঁর এই কোম্পানীর নাম ছিল ‘আলফা কোম্পানী’। পাক-ভারত যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্বের জন্য ‘আলফা কোম্পানী’ ব্যাটালিয়নের সর্বোচ্চ পুরস্কার লাভ করে। রণাঙ্গণে তাঁর এই বীরত্বের জন্য তাঁকে ১৯৬৬ সালের জানুয়ারী মাসে পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে একজন প্রশিক্ষকের দায়িত্বভার দিয়ে পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে পাঠানো হয়। দীর্ঘদিন প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসে পূর্ব পাকিস্তানের জয়দেবপুর সাব-ক্যান্টনমেন্টের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসাবে তিনি নিযুক্ত হন।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার ও বাঙালী অফিসারদের বৈষম্য কারোরই চোখ এড়ায়নি। বাঙালী অফিসাররা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সব সময়ই অবহেলিত; শোষণ-বঞ্চনার শিকার হতেন তারা। জিয়াউর রহমান যখন জয়দেবপুর সাব-ক্যান্টনমেন্টে বদলি হয়ে এলেন সেই ব্যাট্যালিয়নের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লে. কর্নেল আব্দুর কাইয়ুম নামে একজন পশ্চিম পাকিস্তানী। তিনি ছিলেন প্রচন্ড বাঙালী বিরোধী। ‘বাঙালীরা সব সময়ই নীচে ও পদদলিত হয়ে থাকবে’-এটাই ছিল তার নীতি। ময়মনসিংহের একটি সমাবেশ লে. কর্নেল আব্দুর কাইয়ুম একদিন সে কথা প্রকাশও করে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘বাঙালীরা দিনে দিনে বড় বাড়াবাড়ি করছে। এখনো যদি তারা সংযত না হয় তাহলে সামরিক বাহিনীর সত্যিকার ও নির্মম শাসন এখানে দেখানো হবে। তাতে ঘটবে প্রচুর রক্তপাত।’ লে. কর্নেল আব্দুর কাইয়ুমের এই বক্তব্যে জিয়াউর রহমান খুব মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ হন। ১৯৬৯ সালেই জিয়াউর রহমান চারমাসের জন্য উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য জার্মানীতে যান।
এদিকে পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে গোটা ষাটের দশক উত্তাল রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে। ‘৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬৪-র শ্রমিক আন্দোলন, ‘৬৬-র ছয় দফা, ছাত্র সমাজের এগার দফা নানা দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদ পরিপুষ্ট হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ স্বায়ত্তশাসনের দাবি বাদ দিয়ে সরাসরি স্বাধীনতার দাবিই উত্থাপন করেন। পাকিস্তানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তখন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। তার ‘মৌলিক গণতন্ত্রে’ এসব ‘স্বায়ত্তশাসন’ বা ‘স্বাধীনতা’র কোনো স্থান নেই। পূর্ব পাকিস্তানের জেলখানাগুলো ভরে উঠতে থাকে স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক বন্দিদের আটকের কারণে। অন্যদিকে রাজপথেও জ্বলতে থাকে আগুন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নির্মম বুলেটে রাজপথে ঝাঁঝরা হয়ে পড়ে থাকে অগণিত ছাত্র-যুবক-শ্রমিক-পেশাজীবীসহ সাধারণ মানুষের লাশ। তবু পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা দমবার পাত্র নয়। তারা ধীর পায়ে এগিয়ে চলে স্বাধীনতার দিকে।
জার্মানী থেকে ফিরে আসার পর পরই ১৯৭০ সালের শেষের দিকে জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রামে বদলি করে দেয়া হয়। তখন সেখানে সবেমাত্র অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট খোলা হচ্ছিল। সেই রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ডের দায়িত্ব পান তিনি। চট্টগ্রামের ষোলশহর বাজারে ছিল অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঘাঁটি। রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানী লে. কর্নেল জানজোয়া।
১৯৭১ সালের ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং বাংলাদেশের পতাকা সমুন্নত রাখে। বিদ্রোহের পর জিয়াউর রহমানের অনুসারি লে. কর্নেল হারুন আহমদ চৌধুরী ২৬ মার্চ রাত সাড়ে তিনটার একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘আমি যখন চট্টগ্রাম শহর থেকে ৭/৮ মাইল দূরে ছিলাম তখন দেখলাম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কয়েকজন সৈন্য পটিয়ার দিকে দৌড়াচ্ছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম- পাক বাহিনী আক্রমণ করেছে এবং মেজর জিয়া সহ ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করেছে। তাঁরা পটিয়াতে একত্রিত হবে। আমি আরো কিছুদূর অগ্রসর হলে মেজর জিয়ার সাক্ষাত পাই।’ তিনি বললেন, ‘আমরা ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পটিয়ায় একত্রিত হবো, তারপর শহরে এসে আবার পাল্টা আক্রমণ চালাব। তিনি আমাকে তাঁর সঙ্গে থাকতে বললেন। আমি মেজর জিয়ার সঙ্গে থেকে গেলাম এবং পরবর্তীতে তাঁর কমান্ডে কাজ করি।’
২৭ মার্চে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ থেকে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। ঘোষণাটি ইংরেজী ও বাংলা দু’ভাষাতেই পাঠ করা হয়। নিঃসন্দেহে জিয়াউর রহমানের এই ঘোষণাটি তখন বাঙালী জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে যথেষ্ট উদ্যোগী, উত্সাহিত ও আশান্বিত করেছিল।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ নামে। চট্টগ্রাম থেকে ২৬ মার্চ এর যাত্রা শুরু। জিয়াউর রহমান বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেও কেন্দ্রটি চালু রাখার জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। সেদিন সেই দুর্যোগময় মুহূর্তে যাঁরা মৃত্যুকে তুচ্ছ করে বেতার কেন্দ্র চালুর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁরা হলেন- বেলাল মোহাম্মদ, মোস্তফা আনোয়ার, আবদুল্লাহ আল-ফারুক, আবুল কাসেম সন্দীপ, আব্দুস শুকুর এবং বেতার প্রকৌশলী সৈয়দ আবদুস শাকের, রাশেদুল হোসেন, আমিনুর রহমান, এ.এম.শরফুজ্জামান, রেজাউল করিম চৌধুরী ও কাজী হাবিব উদ্দিন। বেতার কর্মী ফারুক ও মোহাম্মদ হোসেন ২৮ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমানের একটি গোপন সংবাদ নিয়ে ভারতে যাবার সময় বান্দরবানে পাক বাহিনী তাদের আটক করে এবং প্রচণ্ড নির্যাতন করে এ দু’জনকে হত্যা করে।
২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট এবং ৩০ মার্চ রামগড়ে চলে যান। সেখানেই তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প। তাঁরা বেশ কিছুদিন চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হন।
১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল মুক্তিবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চা বাগান পরিবৃত আধা-পাহাড়ি এলাকা তেলিয়াপাড়ায় অবস্থিত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের সদর দপ্তরে একত্রিত হন। এটি ছিল হবিগঞ্জ জেলায়। এম. এ. জি. ওসমানী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রব, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সালাহউদ্দিন মোহাম্মদ রেজা, মেজর কাজী নূর-উজ্জামান, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী এবং আরো অনেকে সেদিন সেখানে একত্রিত হয়েছিলেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রথম দিক নির্দেশনা আসে এই সম্মেলন থেকেই। এই সম্মেলন যখন অনুষ্ঠিত হয় তখনো গোটা দেশের সম্যক পরিস্থিতি অবগত হওয়া যায়নি।
সভায় চারজন সিনিয়র কমান্ডারকে অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মেজর শফিউল্লাহকে সিলেট-ব্রাহ্মনবাড়ীয়া অঞ্চলে অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কুমিল্লা-নোয়াখালী অঞ্চলের অধিনায়কের দায়িত্ব পান মেজর খালেদ মোশাররফ। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মেজর জিয়াউর রহমান এবং কুষ্টিয়া-যশোর অঞ্চলের অধিনায়ক হন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। এম. এ. জি. ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর সর্বময় নেতৃত্ব দেওয়া হয়।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার কাজে ভারতে চলে যান। এবং তিনি ১নং সেক্টরের কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। জুন মাস পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এই সেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন। জুলাই মাসে এই সেক্টরের দায়িত্ব পান মেজর রফিকুল ইসলাম।
জুলাই মাসের ৭ তারিখে জিয়াউর রহমানের নিজের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে গঠিত হয় ‘জেড-ফোর্স’ বা ‘জিয়া-ফোর্স’। বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে ‘জেড- ফোর্স’ এক বিশেষ অবদান রেখেছে। এই ফোর্সে তিনটি নিয়মিত পদাতিক বাহিনী ছিল। বাহিনীগুলো হল- ১ম ইস্ট বেঙ্গল, ৩য় ইস্ট বেঙ্গল এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন। জিয়াউর রহমান নিজেই ব্রিগেড কমান্ড করেন। ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ ব্রিগেড-মেজর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
‘জেড-ফোর্স’ কামালপুর, বাহাদুরাবাদঘাট, দেওয়ানগঞ্জ থানা, চিলমারী, হাজিপাড়া, ছোটখাল, গোয়াইনঘাট, টেংরাটিলা, গোবিন্দগঞ্জ, সালুটিকর বিমানবন্দর, ধলাই চা-বাগান, জকিগঞ্জ, আলিময়দান, এম. সি কলেজ, ভানুগাছা, কানাইয়ের ঘাট, বয়মপুর, ফুলতলা চা-বাগান, বড়লেখা, লাতু, সাগরনাল চা-বাগান ইত্যাদি স্থানে পাক-সেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অসীম বীরত্বের পরিচয় দেয়। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান, বীরত্ব ও কৃতিত্বের জন্য মেজর জিয়াউর রহমান ‘বীরউত্তম’ খেতাবে ভূষিত হন।
স্বাধীনতার পরপরই জিয়াউর রহমান দেশ গড়ার কাজে মনোযোগ দেন। এসময় তিনি কুমিল্লা ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি কর্নেল পদে উন্নীত হন এবং জুন মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এসময় তিনি সেনাবাহিনীকে নতুন করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রাখেন। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝিতে তিনি ব্রিগেডিয়ার ও পরে একই বছরের ১০ অক্টোবর মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পান। ১৯৭৫ সালে তিনি সেনাবাহিনীর চিফ-অফ-স্টাফ হিসাবে নিযুক্ত হন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে দেশ আবার অস্থিরতার দিকে যাত্রা শুরু করে। বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যেও অস্থিরতা দেখা দেয়। এই সময় তিনি ‘তিন বাহিনীর প্রধান ও চীফ-অফ-ডিফেন্স স্টাফ’ পদে সমাসীন হন। ৩ নভেম্বর এক অতর্কিত সামরিক অভ্যুত্থানে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনা কারাগারে বন্দি হন। ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে তিনি মুক্ত হন।
ওইদিনই সেনানিবাসে এক বৈঠকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনার জন্য একটি প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করা হয়। সেখানে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সায়েম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও তিনজনকে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তিনজন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হলেন- তিন বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, এয়ার ভাইস মার্শাল এম. জি. তাওয়াব এবং রিয়ার এডমিরাল এম. এইচ. খান। ১৯৭৬ সালের ১৯ নভেম্বর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সায়েম দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ালে জিয়াউর রহমান তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করলে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন।
রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর জিয়াউর রহমান তাঁর শাসনকে অসামরিকীকরণের জন্য ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল ঐতিহাসিক ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এবং পরবর্তী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য তিনি জাতীয়তাবাদীদের নিয়ে একটি ফ্রন্ট গঠন করেন। এই ফ্রন্টের নাম দেয়া হয় জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল। সংক্ষেপে ‘জাগ দল’। বিচারপতি আব্দুস সাত্তার-এর আহ্বায়ক ছিলেন। পরে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন। প্রথমে নিজে এ দলের আহ্বায়ক হন এবং পরে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। গণতান্ত্রিক দলকে বিলুপ্ত করে বিএনপির সঙ্গে একীভূত করা হয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন।
জিয়াউর রহমান বিএনপিকে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী’ দর্শনের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেন। জিয়াউর রহমান ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী’ দর্শনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিজের লেখায় বলেন, ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল বিষয়গুলো ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, যা ছাড়া জাতীয়তাবাদী দর্শনের আন্দোলন এবং তার মূল লক্ষ্য অর্থাত্ শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজ হয়ে পড়বে অসম্পূর্ণ, ত্রুটিপূর্ণ এবং বিভ্রান্তিকর। আমরা বলতে পারি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মোটামুটি সাতটি মৌলিক বিবেচ্য বিষয় রয়েছে, যা হচ্ছে : (১) বাংলাদেশের ভূমি অর্থাত্ আন্তর্জাতিক সীমানার মধ্যবর্তী আমাদের ভৌগলিক ও রাজনৈতিক এলাকা; (২) ধর্ম ও গোত্র নির্বিশেষে দেশের জনগণ; (৩) আমাদের ভাষা বাংলা ভাষা; (৪) আমাদের সংস্কৃতি- জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, উদ্দীপনা ও আন্তরিকভাবে ধারক ও বাহক সমাজের নিজস্ব দৃষ্টি ও সংস্কৃতি; (৫) দু’শ বছর উপনিবেশ থাকার প্রেক্ষাপটে বিশেষ অর্থনৈতিক বিবেচনার বৈপ্লবিক দিক; (৬) আমাদের ধর্ম- প্রতিটি নারী ও পুরুষের অবাধে তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন ও রীতি-নীতি পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা; (৭) সর্বোপরি আমাদের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার যুদ্ধ; যার মধ্য দিয়ে আমাদের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন বাস্তব ও চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে।
অপরদিকে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান ১৯ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। যার মধ্যে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়টি প্রাধান্য পায়। এ কর্মসূচির মধ্যে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল জনগণের খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয় এবং স্বাস্থ্যখাতকে। তাঁর শাসনকালে তিনি গ্রামোন্নয়ন, সামরিক বাহিনীর উন্নয়নের উদ্যোগ নেন। এছাড়াও সংবাদপত্রের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। গ্রামোন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি স্বেচ্ছাশ্রমে খাল কাটা কর্মসূচির উদ্যোগ নেন। খাদ্য উত্পাদন ও শিল্প উত্পাদনের ফলে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো এসময় অনেকটা বেগবান হয়। ১৯৭৯-৮০ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সফরকালে আঞ্চলিক জোট সার্কের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন জিয়াউর রহমান এবং সার্ক গঠনের উদ্যোগ নেন।
রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জিয়াউর রহমান বহির্বিশ্বের সাথে গড়ে তোলেন নিবিড় যোগাযোগ। এ বিষয়ে জিয়ার দূরদর্শিতার মূল্যায়ন করতে গিয়ে অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ ঐ সময় প্রায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিল বলা যায়। এ হেন অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জিয়া দক্ষিণ, মধ্য ও বামপন্থী সব ধরনের মতাদর্শের অনুসারীদের মধ্য থেকে বন্ধু জুটিয়ে ও তাদের সঙ্গে কার্যকর সহমর্মিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রকে মজবুত ভিত্তিতে স্থাপন করেন। বাংলাদেশ পঞ্চাশটিরও অধিক মুসলিম দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রতি তেমন বন্ধুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেনি এমনি পরাশক্তি নতুন পরিস্থিতিতে ভালো বন্ধুতে পরিণত হয়। চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। ইউরোপও বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে।
কতিপয় গঠনমূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়া এবং অগ্রসরমান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ বিশ্বের সব এলাকার দেশসমূহের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। নানা দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বি-পাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য তিনি বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেন এবং অনেক দেশ ভ্রমণ করেন। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ নিরাপত্তা পরিষদের একটি অস্থায়ী আসনে সদস্য নির্বাচিত হয় এবং জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কার্যক্রমের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হয়। মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ার দেশসমূহের জন্যও বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করে।’
জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর জনসাধারণের জীবনে স্বচ্ছতা সৃষ্টি, বস্ত্র, কৃষি ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আত্মনির্ভরশীল একটি জাতি গঠনের দিকে মনোযোগ দেন। এছাড়াও কতগুলি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়নের জন্য আধুনিক সেচ প্রকল্প গ্রহণ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করা, বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা, সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকে জোরদার করা ইত্যাদি। তিনি মহিলা পুলিশ বাহিনী, গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, একুশে পদক প্রবর্তন, শিশুদের জন্য ‘নতুন কুঁড়ি’ সহ বেশ কিছু উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সংঘটিত এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন। তাঁকে ঢাকার জাতীয় সংসদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়।
জিয়াউর রহমান ১৯৬০ সালে ফেনীর ইস্কান্দার আলী মজুমদারের কন্যা খালেদা খানমকে বিয়ে করেন। পরে যিনি বেগম খালেদা জিয়া হিসাবেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তিনবার প্রধানমন্ত্রী এবং দু’বার সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রীর ভূমিকা পালন করেন। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার দুই পুত্র। বড় ছেলে তারেক রহমান। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
জন্ম : জিয়াউর রহমান জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারী, বগুড়া জেলার বাগবাড়ী গ্রামে।
পিতা ও মাতা : পিতা মনসুর রহমান ও মাতা জাহানারা খাতুন। মনসুর রহমান ছিলেন রসায়নবিদ, মাতা জাহানারা খাতুন ছিলেন গৃহিণী এবং রেডিও পাকিস্তানের প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী।
পড়াশুনা : চার বছর বয়সে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় পার্ক সার্কাসের আমিন আলী এভিনিউতে অবস্থিত শিশু বিদ্যাপীঠে। এক বছর ওই স্কুলে পড়ার পর বিশ্বযুদ্ধের কারণে জিয়াউর রহমানের পরিবারকে কলকাতা ছেড়ে বগুড়ার গ্রামের বাড়িতে চলে আসতে হয়। এই সময় তিনি বাগবাড়ী বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি বছর দু’য়েকের মত পড়াশুনা করেন। পরে বাবা-মায়ের একান্ত ইচ্ছায় তিনি ১৯৪৪ সালে পুনরায় কলকাতায় চলে যান। ওই বছরই কলকাতার কলেজ স্ট্রীটের হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে দেশ বিভাগ হলে মনসুর রহমান পরিবার নিয়ে করাচি চলে যান। থাকতেন জ্যাকব লাইনে। মনসুর রহমানের পরিবার করাচি অবস্থানকালেই জিয়াউর রহমান ১৯৪৮ সালের ১ জুলাই ভর্তি হলেন করাচি একাডেমী স্কুলে। যার বর্তমান নাম তাইয়েব আলী আলভী একাডেমী। ১৯৫২ সালে এই একাডেমী স্কুল থেকেই তিনি মেট্রিক পাশ করেন। পরে ভর্তি হন ডিজে কলেজে। এই কলেজে একবছর পড়ার পর ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে একজন অফিসার ক্যাডেট হিসাবে যোগ দেন।
চাকরি জীবন : ১৯৫৫ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে কমিশন পান। এ সময় তিনি অত্যন্ত কষ্টকর ও ধীরবুদ্ধি সম্পন্ন কমান্ডো ট্রেনিং গ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সালে জিয়াউর রহমান ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। ১৯৫৯ সালে তিনি সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত সততার সাথে তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৫ সালে শুরু হয় পাক-ভারত যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমান ফাস্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়নের কোম্পানী কমান্ডার হয়ে সামরিক যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি তাঁর কোম্পানী নিয়ে লাহোরের খেমকারান সেক্টরে সরাসরি শত্রুর মোকাবেলা করেন। তাঁর এই কোম্পানির নাম ছিল ‘আলফা কোম্পানি’। পাক-ভারত যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্বের জন্য ‘আলফা কোম্পানি’ ব্যাটালিয়নের সর্বোচ্চ পুরস্কার লাভ করে। রনাঙ্গণে তাঁর এই বীরত্বের জন্য তাঁকে ১৯৬৬ সালের জানুয়ারী মাসে পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে একজন প্রশিক্ষকের দায়িত্বভার দিয়ে পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে পাঠানো হয়। দীর্ঘদিন প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসে পূর্ব পাকিস্তানের জয়দেবপুর সাব-ক্যান্টনমেন্টের ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসাবে তিনি নিযুক্ত হন। ১৯৬৯ সালেই জিয়াউর রহমান চারমাসের জন্য উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য জার্মানীতে যান। জার্মানী থেকে ফিরে আসার পর পরই ১৯৭০ সালের শেষের দিকে জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রামে বদলি করে দেয়া হয়। তখন সেখানে সবেমাত্র অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট খোলা হচ্ছিল। সেই রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ডের দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৭১ সালের ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং বাংলাদেশের পতাকা সমুন্নত রাখে।
পরিবার : জিয়াউর রহমান ১৯৬০ সালে ফেনীর ইস্কান্দার আলী মজুমদারের কন্যা খালেদা খানমকে বিয়ে করেন। পরে যিনি বেগম খালেদা জিয়া হিসাবেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তিনবার প্রধানমন্ত্রী এবং দু’বার সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রীর ভূমিকা পালন করেন। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার দুই পুত্র।
মৃত্যু : রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সংঘটিত এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন। তাঁকে ঢাকার জাতীয় সংসদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়।
তথ্যসূত্র :
১. ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’- সম্পাদনা : আহমেদ মুসা।
২. ‘মুক্তিযুদ্ধে রাইফেল্স্ ও অন্যান্য বাহিনী’- সুকুমার বিশ্বাস।
৩. ‘অবিস্মরণীয় নেতা জিয়াউর রহমান’ – সম্পাদনা : আমিনুর রহমান সরকার।
৪. ‘শহীদ জিয়া বিএনপি ও বাংলাদেশের রাজনীতি’ – ড. হাসান মোহাম্মদ।
৫. ‘মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার নেতৃত্ব’ – এ্যাড. তৈমুর আলম খন্দকার।
৬. ‘জিয়াউর রহমান, আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার’- সম্পাদনা : মহিউদ্দিন খান মোহন ।
৭. বাংলাপিডিয়া।
লেখক : চন্দন সাহা রায়