তখন ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা সংক্রান্ত একটি সম্মেলনে যোগ দিতে মেজর নাজমুল হক ভারতে গেলেন। শিলিগুড়িতে সেই সম্মেলন হওয়ার কথা। যদিও সেই সম্মেলনে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যোগ দেয়ার কথা ছিল কিন্তু তিনি নিজের কর্মব্যস্ততার কারণে সেখানে যেতে পারেননি। সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য মেজর নাজমুল হককে পাঠানো হয়। ২৬ সেপ্টেম্বর শিলিগুড়ি ৩৩ কোর সদর দপ্তরে কোর কমান্ডার লে. জেনারেল মোহন লাল থাপনের সভাপতিত্বে ছিল সেই সম্মেলন। ভারতীয় অফিসারদের সাথে ভিন্ন গাড়িতে মালদহ ফিরছিলেন মেজর নাজমুল হক। তাঁর সামনের গাড়িতে ছিলেন ১০১ কমিউনিকেশন জোনের জিওসি মেজর জেনারেল গুরবক্স সিং গিল। পথের মধ্যে হঠাত্ করে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। পাহাড়ি আঁকা-বাকা পথে তখন যাত্রা দুষ্কর হয়ে পড়ে। ড্রাইভারকে পাশে বসিয়ে তিনি নিজেই ড্রাইভ করছিলেন গাড়িটি। মাঝ পথে এসে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি পাহাড়ি পথ ছেড়ে কয়েকশ’ গজ নিচে খাদে পড়ে যায় এবং তাত্ক্ষণিক মৃত্যু হয় তাঁর। জেনারেল গিল তাঁর মরদেহ ও আহত ড্রাইভারকে উদ্ধার করেন।
মেজর নাজমুল হকের মতো অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার অকৃত্রিম ত্যাগে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু সেই স্বাধীনতার স্বাদ তিনি উপভোগ করে যেতে পারলেন না। বিজয়ের মাত্র ৭৯ দিন আগে এই মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি প্রাণ হারালেন।
মেজর মোহাম্মদ নাজমুল হক ১৯৩৮ সালের ১লা আগস্ট চট্টগ্রামের লোহাগড়া থানার অন্তর্গত আমিরাবাদ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম এডভোকেট হাফেজ আহমেদ, এম.এ.বি.এল. তত্কালীন জেলা লয়ার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। মাতা জয়নাব বেগম ছিলেন গৃহিণী। তিন ভাইয়ের মধ্যে নাজমুল ছিলেন দ্বিতীয়। প্রথম শিক্ষাজীবন শুরু করেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। পিতার বদলীর চাকুরির কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় তাঁকে পড়াশুনা করতে হয়েছে। কুমিল্লা ঈশ্বর পাঠশালা থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট) ভর্তি হন। কিন্তু এখানে দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত অবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি, বাকুল হতে ১৯৬২ সালের ১৪ই অক্টোবর তত্কালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আর্টিলারি কোরে কমিশন লাভ করেন। আর্টিলারি ইউনিট, সেনা সদর ও গোয়ান্দা বাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি ৬৫’র পাক-ভারত যুদ্ধে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৭১-এর মার্চ মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধ আরম্ভের কিছুকাল পূর্বে তিনি নওগাঁয় ৭ ইপিআর তত্কালীন উইং-এর অধিনায়ক হিসাবে যোগদান করেন। একাত্তরে মার্চের প্রথম সপ্তাহে নিজের কালো রঙের মরিস মাইনর গাড়িতে স্ত্রী, দুই শিশু কন্যা সুরভি (২ বছর) এবং শিউলিকে (১১ মাস) নিয়ে ইউনিটে পৌঁছেন। তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরূপ। অবাঙালি উইং কমান্ডার মেজর আকরাম ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি হয়নি। সামনে দুঃসময় ভেবে বোধ হয় ক্ষমতা হারাতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। অবশেষে বাধ্য হন মেজর নাজমুল হকের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে।
২৫ মাচের্র কালো রাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালির উপর। চালায় বর্বর গণহত্যা। ২৬ মার্চেই সে খবর পৌঁছে যায় নওগাঁয়। মেজর নাজমুল হক নওগাঁ শহরকে শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলার অংশ ঘোষণা করেন। সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। স্থানীয় যুবকদের নিয়ে গঠন করেন ইপিআর মুজাহিদ বাহিনী। সেই বাহিনীর অধিনায়ক হিসাবে প্রথমেই তিনি নওগাঁ ও বগুড়ার পাকক্যাম্প দখল করে শত্রুমুক্ত করেন সমগ্র বগুড়া জেলা। এরপর গ্রহণ করেন রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুক্ত করার পরিকল্পনা।
বগুড়া ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯১ আইএপি (ইন্ডিপেনডেন্ট এমুনেশন প্লাটুন)। রংপুরে অবস্থিত ২৩ ব্রিগেডের যাবতীয় গোলাবারুদের রিজার্ভ রাখা হতো এখানেই। ১৫/১৬ লোকের এই প্লাটুনের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে অবস্থিত ২৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি। মেজর নাজমুল হক প্রথমে এই প্লাটুনের গোলাবারুদ যেন শত্রুর নিয়ন্ত্রণে না যায় তা নিশ্চিত করেন। এরপর বিস্তৃত অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে ট্রেনিং দেয়া শুরু করেন। বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ছাত্র ও যুবকদের সংগঠিত করতেন। কাছাকাছি কোনো স্কুলের মাঠে চলত ট্রেনিং পর্ব। মুক্তিযুদ্ধকে একটি গণযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা থেকেই তিনি প্রথম থেকে উদ্যোগী ছিলেন। সেসময় তাঁর অধীনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েছিলেন অসংখ্য সাধারণ বাঙ্গালী ছাত্র ও যুবক। এমনই একজন ফণীভূষণ বোস। যিনি লিখেছেন- ‘যার অনুপ্রেরণায় আমি Head of the institution হয়েও ছাত্র ও যুবকদের নিয়ে ‘৭১ সালের মার্চ মাসে প্রকাশ্য দিবালোকে মৈনম বিদ্যালয় মাঠে Arms Training নিতে কুন্ঠাবোধ করিনি।’
মেজর নাজমুল হক ৭নং সেক্টরের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ৭নং সেক্টরের মধ্যে ছিল সমগ্র রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলা, দিনাজপুর ও রংপুরের অংশ বিশেষ (দিনাজপুরের রাণী শঙ্কাইল, পীরগঞ্জ লাইনের দক্ষিণাংশ ও রংপুরের পলাশবাড়ি-পীরগঞ্জ লাইনের দক্ষিণাংশ)। নাজমুল হকের মৃত্যুর পর সুবেদার মেজর এ. রব ও তারপর মেজর কাজী নূর-উজ্জামান এই সেক্টরের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সেক্টরের হেড কোয়ার্টার ছিল তরঙ্গপুর। প্রায় ১৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা এই সেক্টরে যুদ্ধ করেন। নিয়মিত বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই হাজার এবং সাড়ে বারো হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল গণবাহিনীর সদস্য। এই সেক্টরের আটটি সাব সেক্টর ছিল।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ নওগাঁয় তাঁর নেতৃত্বে ৭নং উইং অব ইপিআর সৈন্যরা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। তাঁর এই সঠিক ও সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত প্রাথমিক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার গতি ত্বরান্বিত করে। প্রাথমিক পর্যায়ে উইং কমান্ডার মেজর নাজমুল হক ও সহকারী উইং কমান্ডার ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী নওগাঁ, বগুড়া, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুক্ত করার লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ২৬ মার্চ থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত মূলত মেজর নাজমুল হকের নির্দেশনায় রাজশাহী, বগুড়া, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। সেক্টর কমান্ডার হিসাবে তিনি তাঁর প্রতিটি সাব-সেক্টরের অপারেশনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকতেন। অনেক সময় তিনি নিজেই অপারেশনে নেতৃত্ব দিতেন।
নাজমুল হক সবসময়ই মনে করতেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হবে গণযুদ্ধ এবং এইজন্যই মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে নিজেকে ছাত্র, কৃষক, ইপিআর ও অন্যান্য সদস্যদের মতো একই পর্যায়ে নির্ণয় করতেন। সত্যিকার অর্থেই সেসময় তিনি মুক্তির প্রবল মন্ত্রে দীক্ষিত করতে পেরেছিলেন তাঁর সহযোদ্ধাদের। তাঁর অধীনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গাইবান্ধার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন স্কুল-পড়ুয়া মুক্তিযোদ্ধার কাছে শুনতে পাই তারই প্রতিধ্বনি। সেই ছাত্র মুক্তিযোদ্ধাটি বলেছিল, ‘আমি শরণার্থী হয়ে বাঁচতে চাই না। আমার দেশ সংকটের মুখে। আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে দেশের জন্য যুদ্ধ করা, পালিয়ে যাওয়া নয়।’
মেজর নাজমুল হকের মতে, ‘কারো দয়ায় বা দান-অনুদানে স্বল্প সময়ে দেশ স্বাধীন হলে জাতি স্বল্পমেয়াদী স্বাধীনতার মূল্য বুঝবে না। যে স্বাধীনতা অর্জনে গোটা জাতির সম্পৃক্ততা, জনগণের দীর্ঘমেয়াদী ত্যাগ-তিতীক্ষা, আত্মত্যাগ, দুঃখ-কষ্ট, অশ্রু বিসর্জন জড়িত থাকবে সেই কষ্টার্জিত ও প্রতিষ্ঠিত স্বাধীনতাই হবে অর্থবহ।’ এজন্য দীর্ঘমেয়াদী গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে ফসল উত্পাদন করে দুর্যোগ-দুর্ভিক্ষ এবং শত্রুর মোকাবেলা করে ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে দেশকে মুক্ত করার জন্য জনগণকে উদ্ধুদ্ধ করতেন মেজর নাজমুল হক।
মেজর নাজমুল হকের ভাবনার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় মুক্তাঞ্চলগুলোতে। উদাহরণ হিসাবে শাহাপার এলাকার কথাই ধরা যাক। মেজর হকের ধ্যান-ধারনা এবং রণকৌশল ও উত্পাদনে আশাব্যঞ্জক সাড়া দিয়ে হাজার হাজার কৃষক ক্ষেত-খামারে ফসল উত্পাদনে মনোনিবেশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই। এক্ষেত্রে হকের যুক্তি ছিল-‘আপনারা যদি সবাই জান বাঁচাতে ভারতে পলায়ন করেন, তবে সেক্ষেত্রে এলাকার কৃষিজমি পতিত পড়ে থাকবে। তখন দেখা দেবে খাদ্য সংকট। তাই ভবিষ্যতের স্বার্থে ফসল উত্পাদনের প্রক্রিয়াকে সচল রাখতে হবে এবং সেই সাথে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ মেজর হকের এ উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে কৃষক-জনতা তাদের ঘরে তৈরি করা বাংলাদেশের রক্তলাল সবুজ পতাকা উঁচিয়ে কৃষিকাজে লেগে পড়ে।
মূলত ২৮ মার্চের একটি অপারেশনের পর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে মেজর নাজমুলের নাম। জনতার সহায়তায় ওইদিন ইপিআর বাহিনী নবাবগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করে যখন রাজশাহী ক্যান্টমেন্টের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন নাটোর ও নবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহীতে দ্বি-মুখী আক্রমণ করেন মেজর নাজমুল হক। ফলে পাকসেনারা রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, তাদের প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতি হয়। রাজশাহী জেলার রহনপুরেও হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়েছিলেন মেজর নাজমুল হক।
মেজর নাজমুল হকের অধীনেই যুদ্ধ করেছেন মেজর রফিকুল ইসলাম। তিনি নাজমুল হকের আরেকটি অপারেশন সম্পর্কে বলেন, ‘দিনাজপুরের ধনধনিয়াপাড়ায় মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে এবং ১৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। ৪ জুলাই মেজর নাজমুল হক কাঞ্চন সেতুর উপরে পাকঘাঁটি আক্রমণ করেন। সেই যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয় তবে মুক্তিবাহিনীর দুজন সৈন্য গুরুতরভাবে আহত হয়।’
৭নং সেক্টরের পরবর্তীতে কমান্ডার কর্নেল (অব.) কাজী নূর-উজ্জামান মেজর নাজমুল হকের মৃত্যু সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘নাজমুল ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী অফিসার। তাঁর উপর ভার ছিল প্রশাসন ও ইনডাকসনের। দুটোই খুব কঠিন কাজ। ঘুমাবার পর্যন্ত সময় পেতেন না। হয়তো ড্রাইভ করতে করতে ক্লান্তিতে তিনি স্টিয়ারিং-এর উপর ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।’ পরের দিন হেডকোয়ার্টার তরঙ্গপুর এসে পৌঁছে নাজমুলের মৃত্যুর সংবাদ পাই। সেখানেই আওয়ামী লীগের কয়েকজন সাংসদ নাজমুলের লাশের সমাধির ব্যাপারে আলোচনায় বসে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় মৃত দেহটি প্রথমে ভারতে পশ্চিম দিনাজপুরের জেলা সার্কিট হাউজে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানেই দাফনের জন্য লাশের প্রাথমিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন হবে। গোসল ও অন্যান্য পরিষ্কার-পরিছন্নতার কাজ সম্পাদনের পর নাজমুলের স্ত্রীকে খবর দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন কর্তৃপক্ষ। নাজমুলের স্ত্রী তখন দুই কন্যা নিয়ে মালদহে ছোট একটি ভাড়া করা বাড়িতে থাকেন। তিনি তখনো পর্যন্ত স্বামীর মৃত্যুর খবর পাননি। সার্কিট হাউজের কাজ সমাপ্ত হলে মুক্ত এলাকা সোনা মসজিদের কাছে এনে কবর দেয়া হবে বলে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়।’
কিন্তু শহীদ মেজর নাজমুল হকের মৃতদেহ গোসল করানোর কথা বললেই ভারতীয় প্রশাসনের কর্তৃপক্ষ এতে বাধ সাধেন। তারা কিছুতেই নাজমুলের মৃতদেহ সেখানে আনতে দেবে না। অনেক বুঝানোর পরও নানা অজুহাতে ভারতীয় প্রশাসনের এক শ্রেণীর কর্মকর্তারা তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এহেন আচরণে অনেকেই মর্মাহত হন। একে তো সহযোদ্ধা হারানোর ব্যথা তার উপর এখানকার সংকীর্ণতার কারণে অনেকে আশ্চর্য হন। শেষ পর্যন্ত মনঃক্ষুন্ন হয়ে নাজমুলের মৃতদেহ সেদিন সন্ধ্যায় নিয়ে আসা হয় বিখ্যাত সোনা মসজিদের পাশে। সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় বাঙালীর এই জাতীয় বীরকে। তাঁর পাশেই শুয়ে আছেন আরেক বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। যিনি ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন মেজর নাজমুল হকের খুবই ঘনিষ্ঠ ও অনুসারী। তাঁরও আশা ছিল যুদ্ধে মৃত্যু হলে তাঁকে যেন প্রিয় নাজমুল হকের পাশে শায়িত করা হয়। সহযোদ্ধারা তাঁর কথা রাখেন।
মেজর নাজমুল হক ১৯৬৮ সালে বিয়ে করেন নওশাবা হককে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালেই সন্তানসহ তিনি ভারতে চলে যান। প্রথমে তাঁরা গিয়ে উঠেন দিনাজপুর জেলা সার্কিট হাউজে। কিছুদিন সেখানেই থাকেন। কিন্তু নাজমুল হক অবস্থান করতেন সেক্টর হেডকোয়ার্টারেই। যুদ্ধের কারণে ভারতে গেলে তখনই শুধু পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাত্ হতো। কিছুদিন পর তাঁর পরিবার বাসা ভাড়া নেন মালদহে। সেই বাসাও ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী নিবাস। মালদহের ওই বাসাই বসেই মেজর নাজমুল, ক্যাপ্টেন গিয়াস, বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর যুদ্ধক্ষেত্রের অপারেশনের প্লানিংগুলো করতেন।
নাজমুল হক যখন মারা যান তখন তাঁর বড় মেয়ের ইসরাত জাহান সুরভীর বয়স দুই বছরের কিছু বেশি আর ছোট মেয়ে নওরীন সাবা শিউলীর বয়স ১১ মাস। দুজনের কাছেই বাবার স্মৃতি ক্ষীণপ্রায়।
স্বাধীনতার প্রায় ৩৪ বছর পর প্রথম ২০০৪ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হকের নাম স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য প্রস্তাব করা হয়। তত্কালীন সেনাপ্রধান লে. জে. হাসান মসহুদ চৌধুরী এ প্রস্তাব করেন। কিন্তু জাতীয় এ বীরের ভাগ্যে সে সম্মান আজও পাওয়া হয়ে উঠেনি।
মেজর নাজমুলের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারকে একা একা দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সময় পাড়ি দিতে হয়েছে। সেই দুঃসময়ের কালে নিজের পরিবারের খুব কাছের কিছু মানুষ ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান বা সরকারের পক্ষ থেকে কোন আনুকূল্য বা সহানুভূতি পাননি এ পরিবারের সদস্যরা। মেজর হকের ছোট ভাই আতাউল হক আক্ষেপ করেই বললেন- ‘আমরা বিভিন্ন সরকারের সঙ্গে অনেক দেন-দরবার করেছি। কোনো কিছুই পাইনি। ‘৭২ সালে অনেক চেষ্টা তদবির করে ১৩০ টাকার পেনশন জোগাড় করেছিলাম। এটুকুই।’
মেজর নাজমুল হকের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য জনগণ তাদের মনের সেনানায়ককে অম্লান করে রাখতে ১৯৭২ সালেই মৈনম বিদ্যালয়ের মাঠে এক জনসভায় শহীদ মেজর নাজমুল হক মহাবিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দেয়। নানা আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়েই সেটি চালু হয়। ১৯৮৭ সালে তাঁর গ্রামেই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘শহীদ মেজর নাজমুল হক স্মৃতি সংসদ’; ‘শহীদ মেজর নাজমুল হক প্রাথমিক বিদ্যালয়’। এরপর চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন রোডস্থ ওভারব্রীজের পাশে স্থাপন করা হয় ‘মেজর নাজমুল হক স্মৃতিফলক’। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকা বিস্মৃতপ্রায় অমিতত্যাগী এই মহান সেক্টর কমান্ডারের নামে গুলশান-২-এর ৭১নং সড়কের নামকরণ করেন আর মেজর নাজমুল হকের পরিবার, আত্মীয় স্বজন, সহযোদ্ধা ও বন্ধুদের সহযোগিতায় গড়ে তোলা হয়েছে ‘শহীদ মেজর নাজমুল হক স্মৃতি ফাউন্ডেশন’। যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার আশা পোষণ করেন ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা।
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
জন্ম : মেজর মোহাম্মদ নাজমুল হক ১৯৩৮ সালের ১লা আগষ্ট চট্টগ্রামের লোহাগড়া থানার অন্তর্গত আমিরাবাদ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম এডভোকেট হাফেজ আহমেদ, এম.এ.বি.এল. তত্কালীন জেলা লয়ার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। মাতা জয়নাব বেগম ছিলেন গৃহিণী। তিন ভাইয়ের মধ্যে নাজমুল ছিলেন দ্বিতীয়।
শিক্ষা-দীক্ষা: প্রথম শিক্ষা জীবন শুরু করেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। পিতার বদলীর চাকরির কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় তাঁকে পড়াশুনা করতে হয়েছে। কুমিল্লা ঈশ্বর পাঠশালা থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট) ভর্তি হন। কিন্তু এখানে দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত অবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন।
চাকরি তথা সেনাজীবন : পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি, বাকুল হতে ১৯৬২ সালের ১৪ই অক্টোবর তত্কালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আর্টিলারি কোরে কমিশন লাভ করেন। আর্টিলারি ইউনিট, সেনা সদর ও গোয়েন্দা বাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি ১৯৬৫’র পাক-ভারত যুদ্ধে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৭১-এর মার্চ মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধ আরম্ভের কিছুকাল পূর্বে তিনি নওগাঁয় ৭ ইপিআর তত্কালীন উইং-এর অধিনায়ক হিসাবে যোগদান করেন।
পরিবার: ১৯৬৮ সালে বিয়ে করেন নওশাবা হককে। তাদের দুই কন্যা; বড় মেয়ে ইশরাত জাহান সুরভী ও ছোট মেয়ে নওরীন সাবা শিউলি।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান: ৭নং সেক্টরের প্রথম সেক্টর কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
মৃত্যু: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতে একটি সম্মেলনে যোগদান শেষে ফিরে আসার পথে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় শহীদ হন।
তথ্যসূত্র :
১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল – ১০ম খন্ড
২. লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে – মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম
৩. সাপ্তাহিক জয়যাত্রা – ২৫ বছর পূর্তি সংখ্যা
৪. বাংলাপিডিয়া
কৃতজ্ঞতা:
১. লুত্ফর রহমান (চেয়ারম্যান, শহীদ মেজর নাজমুল হক স্মৃতি ফাউন্ডেশন)
২. মেজর (অব.) কামরুল হাসান ভূঁইয়া (‘গণযুদ্ধের জনযোদ্ধা’ বইয়ের লেখক)
৩. লে. কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ এ. জহির বীর প্রতীক
৪. মেজর (অব.) কাজী নূর-উজ্জামান; সেক্টর কমান্ডার ৭নং সেক্টর
৫. নওরীন সাবা শিউলি (শহীদ মেজর নাজমুল হকের ছোট মেয়ে)
লেখক : চন্দন সাহা রায়