তত্কালীন ব্রিটিশ-ভারতে আসামের গৌহাটির হোম সেক্রেটারি ছিলেন স্যার চার্লস রোডেন্স। বসবাস ছিল গৌহাটির জোড়হাটে। স্যার চার্লস রোডেন্স ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি। তার সাথে বাঙালীর মানসিক দূরত্ব কিংবা রেষারেষি থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। কারণ বাঙালী অনেক অনেক বছর আগেই বুঝে গিয়েছিল ব্রিটিশরা শাসনের নামে এ অঞ্চল শোষণ করছে। আর বাঙালীর এই মানসিকতা ব্রিটিশরাও বুঝত।
গৌহাটির ব্রিটিশ সরকারের বাঙালি চাকুরে ছিলেন খান বাহাদুর মফিজুর রহমান। তাঁর সাথে চার্লস রোডেন্সের দূরত্ব থাকাটাও ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু খান বাহাদুর মফিজুর রহমানের দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার ছোট ছেলেটি স্যার রোডেন্সের ছেলে মেয়েদের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছিল। দু-তিনটে বিলেতি ছেলে-মেয়ের সাথে বাঙালী কিশোরটি দুরন্তপনায় মেতে থাকতে থাকতে অনেক দুপুরের নাওয়া খাওয়া বিসর্জন দিয়েছে। বাবা-মা ছেলের অনিয়মের জন্য মৃদু শাসন করলেও খুব বেশি কড়াকড়ি আরোপ করতেন না। কারণ তাঁরা জানতেন তাঁদের ছেলে মেধাবী আর পড়াশুনায় মনোযোগী। মা-বাবা স্বপ্ন দেখতেন এই ছেলে একদিন বাঙ্গালী জাতির মুখ উজ্জ্বল করবে। মা-বাবার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে জাতিকে স্বাধীনতা উপহার দিয়েছিলেন তাঁদের সেই ছেলে। গল্পের এই চরিত্রটির নাম মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী।
১৯১৮ সালে খান বাহাদুর মফিজুর রহমান তত্কালীন আসামের সুনামগঞ্জ সদর মহকুমায় Sub-Divisional Officer হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। বসবাস ছিল সুনামগঞ্জ সদরেই। সেখানেই জন্ম এম. এ. জি. ওসমানীর এবং পরিবারের সাথে হাওড় বেষ্টিত সুনামগঞ্জেই কিছুদিন বেড়ে ওঠেন তিনি।
১৯২৩ সালে খান বাহাদুর মফিজুর রহমানের বাসায় গৃহশিক্ষক আসতেন বড় ছেলে মোহাম্মদ নুরুল গনি ওসমানী ও বড় মেয়ে সদরুন্নেছাকে পড়ানোর জন্য। তখন এক দিন ঐ শিক্ষকের কাছেই ওসমানীর পড়াশোনার হাতেখড়ি। তারপর কিছুদিন গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে বাল্যশিক্ষা লাভ করেন।
বাবার সরকারি চাকরিতে ছিল বদলি। তাই কিছুদিন পর বদলির আদেশ নিয়ে সুনামগঞ্জ থেকে চলে যেতে হয় গোহাটিতে। আর সেখানেই ওসমানীর প্রাথমিক শিক্ষার শুরু হয়। ১৯২৩ সালে কটনস্ স্কুল অব আসাম-এ ভর্তি হন তিনি। লেখাপড়ায় যে তিনি খুবই মনোযোগী ছিলেন তার প্রমাণ হলো স্কুলের প্রত্যেক পরীক্ষায় প্রথম হতেন। গৌহাটিতে সমৃদ্ধ একটা শৈশব পেয়েছিলেন তিনি। চার্লস্ রোডেন্সের বাচ্চাদের সাথে আড্ডায় মেতে থাকতে থাকতে আবারো বাবার বদলি। গৌহাটির কিছু স্মৃতি, কিছু বিস্মৃতি নিয়ে পরিবারের সাথে সিলেটে ফিরে আসতে হলো তাঁকে। ১৯৩২ সালে ওসমানী সিলেট গভর্মেন্ট পাইলট হাইস্কুলে ভর্তি হন। তত্কালীন সময়ে সিলেটের এই স্কুলটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। গৌহাটির স্মৃতি কিছুদিন তাঁকে কষ্ট দিলেও পড়াশুনায় কোনো ছেদ ঘটাতে পারেনি। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করতেন তিনি।
১৯৩৪ সাল ছিল ওসমানীর জীবনের বিশেষ এক বছর। সবাইকে চমকে দিয়ে ভবিষ্যতের এই বীর সৈনিক তাঁর আগমনী বার্তা ঘোষণা করেছিলেন সে বছর। অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে ১৯৩৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন তিনি। সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে তিনি প্রথম স্থান লাভ করেন। এই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য ব্রিটিশ সরকার এম. এ. জি. ওসমানীকে PRIOTORIA পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করে।
স্কুল জীবন শেষ হয়, তারপর শুরু হয় উচ্চ শিক্ষার পালা। সুনামগঞ্জ মহকুমায় জন্ম নেয়া একটি ছেলের জন্য আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার ঘটনা ছিল তখনকার সময়ের জন্য বিরল। সেই বিরল কাজটিই করতে পেরেছিলেন এম. এ. জি. ওসমানী। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা তাঁকে আরও সমৃদ্ধ করেছিল নিঃসন্দেহে। একটা আদর্শিক মননশীলতা তৈরি হয়েছিল তাঁর ভেতর। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে ওসমানী তত্কালীন সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমিতে তাঁর সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এই সময় তাঁর মধ্যে শৃঙ্খলা, নিয়মতান্ত্রিকতা, আনুগত্য, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি গুণগুলো বেড়ে উঠেছিল। ১৯৪০ সালে তাঁর সামরিক শিক্ষা সমাপ্ত হয়। একেবারে পূর্ণাঙ্গ একজন সৈনিক হিসেবে গড়ে উঠার পর ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান আর্মিতে কমিশন পান। ১৯৪২ সালে দেখা যায় ওসমানীই হচ্ছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মেজর।
ওদিকে ১৯৩৯ সালে শুরু হয়ে গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান আর্মির একজন মেজর হিসেবে ওসমানীকেও ঐ যুদ্ধে লড়তে হয়। বার্মার রণাঙ্গনে তাঁকে এক ব্যাটেলিয়ান সৈন্য পরিচালনা করতে হয়েছিল। ইতিহাসের এরকম একটা মর্মান্তিক যুদ্ধে তরুণতম একজন মেজর হিসেবে অংশ নেয়াটা তাঁর দক্ষতা ও বিচক্ষণতাকে বাড়িয়ে দেয় অনেকাংশে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। ভারত ভাগ হতেও আর বেশি বাকি নেই। এই রকম একটা সময়ে ওসমানী ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে লং কোর্স পরীক্ষা দিয়ে উচ্চস্থান লাভ করেন। একই বছর তিনি ইন্ডিয়ান পলিটিক্যল সার্ভিসের জন্যও মনোনীত হন। কিন্তু একজন পরীক্ষিত সৈনিক হিসেবে তিনি সামরিক বাহিনীতেই থেকে যান এবং ভারত বিভাগের আগেই (১৯৪৭) তিনি লেফটেনেন্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন।
১৯৪৭ সালের আগস্টের মাঝামাঝিতে উপমহাদেশকে পাকিস্তান ও ভারত নামে বিভক্ত করে ব্রিটিশরা বিদায় নেয়। আঞ্চলিক অথবা ধর্ম ভিত্তিক বিভাজনের ফলে এম. এ. জি. ওসমানী পাকিস্তানের নাগরিক হন। ১৯৪৭-এর ৭ অক্টোবর লেফটেনেন্ট কর্নেল পদ নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। তত্কালীন সময়ে বিভাজন উত্তর কিছু বিশৃঙ্খলা ছিল। সেসময় এম. এ. জি. ওসমানী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গঠনরত প্রধান কার্যালয়ে বেশ কিছু গুরুদায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫১ সনে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ফাস্ট ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। এর পর তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাস প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তত্কালীন পূর্ববাংলার আরও কয়েকটি আঞ্চলিক স্টেশনের দায়িত্বও তিনি সফলতার সাথে পালন করেন। এভাবেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তাঁর উপর অরোপিত দায়িত্বগুলো সুষ্ঠুভাবে পালন করে নিজেকে একজন সাহসী, দায়িত্ববান ও বলিষ্ট সৈনিক রূপে গড়ে তোলেন।
বীর সৈনিক এম. এ. জি. ওসমানী পৃথিবীর ইতিহাসের অনেকগুলো যুদ্ধেই সক্রিয় অংশ নেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করেন। ডেপুটি ডাইরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশন হিসেবে যুদ্ধরত বিভিন্ন সামরিক হেড কোয়ার্টারে যোগাযোগ করতেন তিনি। পাক-ভারত যুদ্ধ যখন শেষ হয় তখন তাঁর বয়স চল্লিশের উপরে। প্রায় বাল্যকাল থেকে বেছে নেয়া নিয়মমাফিক সামরিক জীবন তখন শেষের দিকে। ১৯৬৬ সালের মে মাসে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসরকালীন ছুটি নেন এবং পরের বছর (১৯৬৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি) পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
অবসরের পর ভিন্ন-স্বাদের নতুন এক জীবন শুরু হবার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু সে নতুন জীবন তিনি পাননি। গড়-পরতা মানুষের মতো স্ত্রী সন্তান নিয়ে সৌখিন অবসর জীবন তিনি পাননি। কারণ যুদ্ধ বিগ্রহ আর পেশাগত জীবনে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠতে ওঠতে বিয়ে করার সময় হয়ে ওঠেনি তাঁর। এছাড়া ওসমানীর মতো সৈনিকের সময় অতিবাহনের জন্য সৌখিন জীবন বেছে নেয়া মানায় না। মানুষের জন্য কিছু করার যে আকাঙ্ক্ষাটা ছোট বেলা থেকে মনের মধ্যে লুকায়িত ছিল দীর্ঘ সামরিক জীবনে তা আরও পূর্ণতা পায়। তাই অবসর জীবনের শুরুতেই তিনি মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রথমে এককভাবে শুরু করলেও পরবর্তী সময়ে তাঁর চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন আসে। কিছু দিন পর তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
রাজনীতিতে নেমেই পেলেন ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনকারী ১৯৭০ সালের নির্বাচন। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সিলেটের চারটি থানা নিয়ে গঠিত উভয় পাকিস্তানের সর্ব-বৃহত্ নির্বাচনী এলাকা থেকে জয় লাভ করে জাতীয় সংসদে আসন লাভ করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং তার পরবর্তী সময়ের ইতিহাস কারোরই অজানা নয়। স্বাধীনতা পিপাসু এক পক্ষের আন্দোলন, সংগ্রাম আর অন্য পক্ষের কঠোর ভাবে দমনের ইচ্ছার মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয় কয়েকটি মাস। এম. এ. জি. ওসমানী বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে কাজ করছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকাতেই ছিলেন এম. এ. জি. ওসমানী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বছর চারেক আগে অবসর নেয়া ওসমানীর সামরিক দক্ষতা ও দূরদর্শিতা সম্পর্কে পাকিস্তান সরকার অবগত ছিল। তাই ঐ রাতেই ওসমানীকে হত্যার চেষ্টায় হন্যে হয়ে খোঁজে পাকবাহিনীর একটি কমান্ডো। কিন্তু একেবারেই ভাগ্যগুণে অলৌকিকভাবে প্রাণ বেঁচে গিয়েছিল ওসমানীর। পরের চার দিন ঢাকাতেই আত্মগোপনে থেকে পঞ্চম দিনে নদীপথে পালিয়ে গিয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যুদ্ধরত ব্যাটেলিয়নদের সাথে যোগ দেন। শুরু হয় ওসমানীর জীবনের নতুন এক অধ্যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পাক-ভারত যুদ্ধের পর এবার শুরু হয় নিজের মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার যুদ্ধ। যে যুদ্ধ ছিল নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল, বলা যায় প্রায় নির্বাসিত অবস্থায় মুজিব নগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন। ১১ এপ্রিল (১৯৭১) প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে ভাষণ দেন। ঐ ভাষণে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবকাঠামো গঠনের কথা উল্লেখ করে এম. এ. জি. ওসমানীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ঐ ঘোষণা যে কতটা সময়োপযোগী আর যুক্তিযুক্ত ছিল তা বোঝা যায় মেজর জেনারেল কে. এম. সফিউল্লার একটি বিবৃতি থেকে। তাঁর বিবৃতিটি ছিল এরকম, ‘আমরা যে বিষয়টি আগেই অনুমান করেছিলাম তাই সঠিক হলো। কর্নেল এম. এ. জি. ওসমানীকে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়েছে। এটি একটি অত্যন্ত সময়োপযোগী ঘোষণা। এর ফলে প্রত্যাশিত ও শুভ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়।’ ১২ এপ্রিল থেকে এম. এ. জি. ওসমানী মন্ত্রীর সমমর্যাদায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। রণনীতির কৌশল হিসেবে প্রথমেই তিনি সমগ্র বাংলাদেশকে ভৌগোলিক অবস্থা বিবেচনা করে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে নেন এবং বিচক্ষণতার সাথে সেক্টরগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ছিল দক্ষ এবং সংখ্যায় অনেক বেশি। এই বিবেচনায় ওসমানীর রণকৌশল ছিল প্রথমে শত্রুকে নিজেদের ছাউনিতে আটকে রাখা এবং তাদেরকে যোগাযোগের সবগুলো মাধ্যম হতে বিছিন্ন করে রাখা। এজন্য এম. এ. জি. ওসমানী মে মাস পর্যন্ত নিয়মিত পদ্বতিতে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মে মাসের পর তাঁর মনে হয় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম সংখ্যক সৈন্য নিয়ে শত্রুকে ছাউনিতে আটকে রাখা গেলেও ধ্বংস করা সম্ভব নয়। এ বিষয়টি তিনি সরকারকে জানিয়ে যুদ্ধে কৌশলগত পরিবর্তন আনেন। প্রাক্তন ইপিআর এর বাঙালী সদস্য, আনসার, মোজাহেদ, পুলিশ বাহিনী ও যুবকদের নিয়ে একটি গণবাহিনী বা গেরিলাবাহিনী গঠন করেন।
নানা ধরনের অপ্রতুলতাকে বিচক্ষণতা দিয়ে মোকাবেলা করে যুদ্ধকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন সর্বাধিনায়ক এম. এ. জি. ওসমানী। জুলাই মাসে এসে তাঁর নেতৃত্বে নিয়মিত বাহিনী ও গণবাহিনী যুদ্ধ জয়ের একটা সম্ভাবনাও সৃষ্টি করে ফেলে। তখন ওসমানীর জন্য ঘটে যায় সাময়িক এক অপ্রীতিকর ঘটনা। সামরিক বাহিনীর কতিপয় অফিসার (অধিকাংশই সেক্টর কমান্ডার) প্রশ্ন তুলেছিলেন মুজিবনগরে বসে ওসমানীর পক্ষে এককভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করা কতটুকু সম্ভব? সেক্টর কমান্ডাররা নিজ নিজ সেক্টরে নির্দেশ প্রদানের অবাধ ক্ষমতা দাবী করেন। এই ঘটনায় ওসমানী মানসিকভাবে আহত হয়ে ১০ জুলাই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের উপস্থিতিতে মুক্তিবাহিনীর প্রধানের পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন। পরে অবশ্য ধরা হয় এই ঘটনাটা ছিল একটা ভুল বোঝাবুঝি। সেক্টর কমান্ডারদের এবং প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে তিনি স্বপদে পুনর্বহাল থেকে যান।
শুরু হয় নতুন উদ্যমে মুক্তিযুদ্ধ। বিজয় পেতেই হবে মুক্তির এই যুদ্ধে; এ রকম মানসিকতা দৃঢ় হচ্ছিল সমগ্র বাঙালির ভেতর। কিন্তু সর্বাধিনায়ক এম. এ. জি. ওসমানী ভাবছিলেন গেরিলাবাহিনী গঠনের পরও আমাদের সংকটগুলো নিয়ে। মুক্তির সংগ্রামে এম. এ. জি. ওসমানীর হাতে কোনো নৌবাহিনী ছিল না। তবে নিয়মিত নৌবাহিনীর কিছু অফিসার এম. এ. জি. ওসমানীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন। তাছাড়া ফ্রান্সের জলাভূমিতে থাকা পাকিস্তানের ডুবোজাহাজের কিছু সংখ্যক কর্মীও মুক্তিবাহিনীর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। কিছুদিন পর এম. এ. জি. ওসমানী তাদের এবং কিছু সংখ্যক গেরিলা যুবক নিয়ে একটি নৌকমান্ডো গঠন করেন। আগস্টের মাঝামাঝিতে তাঁরা নদীপথে শত্রুর চলাচল প্রায় রুদ্ধ করে দেয়। নৌবাহিনী গঠনের ফলে একটা বড় ধরনের সংকটের অবসান হলেও দেশ স্বাধীন হবার আগে আগে আরও একটা সংকট এম. এ. জি. ওসমানী অনুভব করেন। সেটা হচ্ছে তাঁর হাতে কোনো বিমানবাহিনী ছিল না। শেষের দিকে দুটি হেলিকপ্টার ও একটি অটার আর তাঁর নিজের চলাচলের জন্য একটি ডাকোটা নিয়ে ছোট্ট একটি বিমানবাহিনী গঠন করেছিলেন তিনি।
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে এম. এ. জি. ওসমানীর গঠিত নিয়মিত ও গেরিলাবাহিনীর সাথে ভারতের সৈন্যরাও যুদ্ধে অংশ নেয়। ভারত তাঁদের সাথে যোগ দিলে তিনি তাদের ট্যাংক ও কামানের সহায়তায় বিজয় ত্বরান্বিত করেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
এম. এ. জি. ওসমানী বিচক্ষণতা আর দূরদর্শিতার মাধ্যমে যুদ্ধ পরিচালনা করার কারণে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়েছিল। দেশ মাতৃকাই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। ওসমানী তাঁর অকৃত্রিম দেশপ্রেমের স্বীকৃতিও পেয়ছিলেন দুইভাবে। এক-গণমানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। স্বাধীন দেশে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে কর্নেল থেকে জেনারেলে পদে উন্নীত করে।
পরাধীন বাংলাদেশে যখন স্বাধীনতা অর্জিত হলো তখন এম. এ. জি. ওসমানী জীবনের পাঁচ দশক অতিক্রম করে ফেলেছেন। ব্রিটিশ-ভারতে জন্ম। ১৯৪৭ সালে বিভক্তির পর পাকিস্তান। তারপর ১৯৭১ সালে নিজের নেতৃত্বে সব শত্রু বিতাড়িত করে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন। জীবনের পাঁচ দশক অতিক্রম করা এই বীর কখনও ভাবেননি, স্বাধীন দেশে তাঁর দায়িত্ব শেষ। বরং ভেবেছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তাঁর দায়িত্ব আরও বেড়ে গিয়েছে। যুদ্ধ শেষ করেই তাই তিনি জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশ গঠনের কাজে নেমে পড়েন।
১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কের পদ বিলুপ্ত হয়ে গেলে জেনারেল ওসমানী সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নেন। অবসর নিলেও ঘরে বসে সময় অতিবাহিত করার মতো মানসিকতা তাঁর ছিল না। মানুষের সেবা করার তাড়না তাঁর মধ্যে সব সময় ছিল। তিনি পুনরায় ফিরে এলেন রাজনীতিতে। বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন স্বাধীন দেশে। সামরিক জীবন থেকে পুনরায় ফিরে এলেন রাজনীতিতে, অর্থাত্ কোনো অবস্থায়ই তিনি মানুষের সেবা করা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারেননি। ১৯৭২ সালের ১২ এপ্রিল তিনি কেবিনেটে শপথ নেন। এরপর বাংলাদেশ সরকারের জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ ও বিমান চলাচল মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব বুঝে নেয়ার পর তিনি নবগঠিত দেশের অবকাঠামো নির্মাণের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। কিন্তু তখনও তিনি গণতান্ত্রিক বা নির্বাচিত উপায়ে কেবিনেট সদস্য ছিলেন না। নিজের যোগ্যতা অথবা জনপ্রিয়তা যাচাই করার সুযোগ প্রথম আসে ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৩ সালের মার্চে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ নির্বাচনে ওসমানী তাঁর নিজের এলাকা থেকে অংশ নেন এবং নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেন। ১৯৭৩ এর নির্বাচনে ওসমানী ৯৪ শতাংশ ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন। ফলে কেবিনেট পদ পুনর্বহাল থেকে যায়। জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ ও বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের সাথে আরও যুক্ত হয় ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক কিছু ঘটে যায়। বলা যায় স্বাধীনতা পরবর্তী এক ধরনের অস্থিরতা। এসব ঘটনায় একেবারেই নীরব দর্শক হয়েছিলেন জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী। কারণ জীবনে অনেক বড় বড় দায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করায় কোনো প্রকার হীনমন্যতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। দেশের একটা চরম বিশৃঙ্খল অবস্থায় সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী গৃহীত হয়ে যায়। যার ফল ছিল বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) গঠন। বাকশাল গঠনের প্রতিবাদে তিনি সংসদ সদস্য পদ থেকে সরে দাঁড়ান।
এরপর থেকে শুরু হয় জেনারেল ওসমানীর জীবনের নতুন এক অধ্যায়। বীরদর্পে যে সৈনিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পাক-ভারত যুদ্ধ এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন সে সৈনিক চলে যান একেবারেই পর্দার আড়ালে। অনেক কলুষতার মধ্যে একেবারে স্বতন্ত্র চরিত্রের অধিকারী মানুষটি টিকতে না পেরে নিজেকে গুটিয়ে নেন।
বাকশাল গঠনের কিছুদিন পর শেখ মুজিবের পরিবারকে নৃসংশভাবে হত্যা করা হয়। এই সময় তিনি নিজেকে একেবারেই আড়ালে রাখেন। কিন্তু শেষ জীবনে দেশের জন্য কিছু করার মানসিকতা অটুট ছিল তাঁর। কিন্তু ততদিনে পরিস্থিতির অনেক পালা-বদল ঘটে গিয়েছিল। তবুও ১৯৭৬ সালে তিনি জাতীয় জনতা পার্টি গঠন করে জনগণকে ঐক্যের ডাক দেন। কিন্তু সে ডাকে তিনি খুব একটা সাড়া পাননি। কারণ রাষ্ট্রযন্ত্র ততদিনে একটা সংগঠিত সামরিক শক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল।
১৯৭৮ সালে জেনারেল ওসমানী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন গণঐক্য জোট-এর প্রার্থী হিসেবে। কিন্তু ঐ ধরনের পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেয়াটা ছিলো ওসমানীর মতো বিচক্ষণ ব্যক্তির পক্ষে ভুল সিদ্ধান্ত। বয়সের ভারে ভারী হতে থাকলে হয়ত মানুষের স্বাভাবিক বিবেক বুদ্ধি লোপ পায়। তিনি ১৯৮১ সালে নাগরিক কমিটির জাতীয় প্রার্থী হিসেবে পুনরায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯৮১ সালের নির্বাচনেও তিনি ব্যর্থ হন।
বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা এই বীর সৈনিক যুদ্ধের সময় বহুবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেও শেষতক চিরন্তন মৃত্যুকে জয় করতে পারেননি। শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি হলে ১৯৮৪ সালে তাঁকে লন্ডনের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। কিছুদিন পর ১৬ ফেব্রুয়ারি সেখানেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে বর্ণাঢ্য এক সৈনিকের জীবনের যবনিকা ঘটে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
নাম: মোহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী
বাব: খান বাহাদুর মফিজুর রহমান
মা: জুবেদা খাতুন।
শিক্ষাজীবন : কটনস্ স্কুল অব আসাম, সিলেট গভঃ পাইলট হাইস্কুল এবং আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়।
কর্মজীবন: সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন ব্রিটিশ-ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের হয়ে।
উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পাক-ভারত যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ।
রাজনৈতিক জীবন: বাংলাদেশের গণপরিষদে নির্বাচিত কেবিনেট সদস্য।
মৃত্যু: ১৯৮৪ সালে ১৬ ফেব্রুয়ারি লন্ডনের একটি হাসপাতালে।
তথ্যসূত্র :
১. শত মুক্তিযোদ্ধার কথা
২. আমাদের মুক্তিযুদ্ধ – মেজর কে. এম. সফিউল্লাহ।
৩. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ও দলিলপত্র (তৃতীয় খন্ড)
৪. মোহাম্মদ ফয়জুর রহমান (অনির্বাণ ওসমানী-এর রচিয়তা)।
লেখক : কামরান পারভেজ