‘সাধারণত রাতে ঘুমানো সম্ভব হত না। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে দু’টি অপারেশন-এর ফাঁকে দিনের বেলায় কিছু সময় ঘুমিয়ে নিতাম। সাধারণতঃ সৈনিকের পোষাকেই ঘুমিয়ে পড়তাম। সৈনিকের পোষাক বলতে খাঁকি হাফপ্যান্ট এবং একজোড়া বুটই আমার পরনে থাকত।…একটা ঘটনা বলি। আমি রামগড় থেকে সীমান্ত অতিক্রম করার পর (২রা মে, ‘৭১ থেকে জুন, ‘৭১-এর মাঝামাঝি সময়ে) জেনারেল ওসমানী সাহেব ওখানে গিয়েছিলেন আমাদের দেখতে। আমি তখন অপারেশনে ব্যস্ত। আমার পরনে শুধু একটা খাঁকি হাফপ্যান্ট এবং পায়ে একজোড়া বুট ছিল। গায়ে কোনো গেঞ্জি ছিল না। মাথা থেকে সমস্ত শরীর ছিল ধুলাময়। খবর পেয়ে ঐ অবস্থায়ই জেনারেল সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলাম। এই একটি মাত্র ঘটনা থেকেই অনুমান করতে পারেন কি অবস্থায় আমরা যুদ্ধ করেছি।’
এই কথাগুলি বলেছেন ৫নং সেক্টরের কমান্ডার লে. জেনারেল. মীর শওকত আলী। যিনি নিজের জীবন বাজী রেখে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। অসম সাহসী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জন্য ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত হন।
মীর শওকত আলী মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, বিডিআর, পুলিশ ও মুক্তিযুদ্ধে উৎসাহী কিছু ছাত্র-জনতাসহ প্রায় চারশ’ জনকে নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেন। পরে ডিসেম্বর নাগাদ সেই সংখ্যা প্রায় বিশ থেকে বাইশ হাজারে গিয়ে দাঁড়ায়। তার মধ্যে বার হাজার ছিল তালিকাভূক্ত। বাকি দশ-বার হাজার ছিল তালিকার বাইরে। মীর শওকত আলী অসংখ্য যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়েছেন।
মীর শওকত আলীর জন্ম ১৯৩৮ সালের ১১ জানুয়ারি পুরানো ঢাকায় নাজিরাবাজারে। এখানের ৯ আগা সাদেক রোডে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। প্রথমে তিনি কিছুদিন ঢাকার মাহুতটুলির ফ্রি-প্রাইমারি স্কুলে লেখাপড়া করেন। পরে ১৯৪৫ সালে ঢাকার আরমানীটোলা সরকারি উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে তিনি এই স্কুল থেকেই মেট্রিক পাশ করেন। পরে ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৫ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। কলেজ জীবন পার করেই মীর শওকত আলী পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৫৫ সালে সেনাবাহিনীতে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ভর্তি হন। ১৮৫৮ সালে তিনি গ্রাজুয়েট ডিগ্রী লাভ করেন। একই সময়ে তিনি সেনাবাহিনীতে কমিশন প্রাপ্তও হন। তিনি ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন রেজিমেন্টে অ্যাডজুটেন্ট, কোয়াটার মাস্টার, কোম্পানী কমান্ডার সহ সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীতে কাজ করেন। মীর শওকত আলী ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে বীরত্বের সাথে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে কোয়েটা স্টাফ কলেজ থেকে চট্টগ্রামের ষোল শহরে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে পোস্টিং দিয়ে পাঠানো হয় তাঁকে। ১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম ভাগে তিনি ছুটি ভোগ করছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালীর উপর যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন মীর শওকত আলী ছিলেন চট্টগ্রামে। সেসময় ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন কর্নেল ঝানঝুয়া এবং সেকেন্ড-ইন-কমান্ডার ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বর্বর হত্যাকান্ডের খবর মীর শওকত প্রথম পান চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হান্নানের কাছ থেকে টেলিফোনের মাধ্যমে।
এ সময়ই মেজর জিয়াউর রহমান ও মেজর শওকতের নেতৃত্বে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙ্গালী সৈন্যরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রথমে শওকত আলী মেজর জিয়ার সাথে এক নম্বর সেক্টরে সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসাবে কাজ শুরু করেন।
মেজর জিয়া ৩০ মার্চ রামগড় হয়ে সীমান্তের ওপারে চলে যান। তখন পুরো বাহিনীর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন মীর শওকত আলী। আর্মি, বিডিআর, ছাত্র-জনতা এবং আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক দল নিয়ে গঠিত বাহিনী নিয়ে ২রা মে পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যান তিনি। সেই সময় মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয় মেজর শওকতের। এর আগেও অবশ্য দু’একবার ওসমানী অয়ারলেস নির্দেশ তিনি মহালছড়ি পার্বত্য এলাকায় পেয়েছেন। প্রবল হামলার মুখে ২রা মে বিকেলে মীর শওকত রামগড় অতিক্রম করে সীমান্তের ওপারে চলে যান। ভারতে অবস্থানকালীন মেজর জিয়ার সাথে থেকে প্রায় দুইমাস একত্রে কাজ করেন। পরে জিয়া ‘জেড ফোর্সের’ কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
এর কিছুদিন পরেই মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী মেজর শওকতকে ডেকে পাঠান। তিনি জানান, ‘সিলেট এলাকায় আমাদের কোনো সেক্টর খোলা হয়নি এবং সিলেটের সুনামগঞ্জ, ছাতক এবং সালুটিকর এইসব এলাকায় অনেক বিডিআর এবং সৈন্য বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছেন।’ জেনারেল ওসমানী তাঁকে শিলং চলে যেতে বলেন এবং সেখান থেকেই মীর শওকত আলী ছাতক ও সুনামগঞ্জ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
এই সময়ে পাকিস্তানী আর্মিদের জন্য সিলেট থেকে নদী পথে যেসব ছোট ছোট নৌকা এবং ছোট ছোট জাহাজ রসদপত্র নিয়ে ঢাকার দিকে যেত মীর শওকত আলী তাঁর বাহিনী নিয়ে সেগুলো আটক করে রসদপত্রাদি কেড়ে নিয়ে কিছু নিজেদের জন্য রেখে বাকীগুলো বাংলাদেশ হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিতেন। ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের আম্রকাননে ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণার পর মীর শওকতকে ৫ নং সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়।
৫ নং সেক্টর এলাকা ছিল সিলেট জেলার দুর্গাপুর থেকে ডাউকি (তামাবিল) এবং তার পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত। সেক্টর কমান্ডারের সংকেত নাম ছিল ‘টাইগার লিডার’। হেডকোয়ার্টার ছিল ছাতকের উত্তরে বাঁশতলা এলাকায়। এসময় বর্ডারের ওপারে এবং বাঁশতলা ট্রেনিং ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়। সমগ্র এলাকাতে সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সেক্টর এলাকাকে ৬টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়।
স্বাধীনতার পর মীর শওকত আলী সেনাবাহিনীর বিভিন্ন দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭২-৭৪ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে অন্যান্য ব্রিগেডেরও কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালে কায়রোতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দলের সফরে সফলতার সাথে নেতৃত্ব দেন। ১৯৭৫ সালে মীর শওকত সেনাবাহিনীর চিফ অফ জেনারেল স্টাফ নিযুক্ত হন। ১৯৭৫-৭৭ সালে তিনি পুরানো ঢাকা উন্নয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। একই সময়ে তিনি ঢাকা অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ সালে তিনি সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার পদে নিয়োগ পান। একবছর এই দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রদূত হিসাবে মিসর, সুদান, জার্মানী ও যুক্তরাষ্ট্রে দায়িত্ব পালন করেন। চাকরিকালীন তিনি বিভিন্ন সরকারী প্রকল্পের প্রধান হিসেবে এবং বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরশাদ সরকারের সময়ই ১৯৮১ সালের ৯ জুন তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
সরকারী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বিএনপি’র রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। ১৯৯৯১ সালে ঢাকার লালবাগ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন। এসময় তিনি প্রথমে খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পরে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। মীর শওকত বিএনপি’র ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ক্রীড়া ও কৃষিখাতে অবদান রাখার জন্য তিনি দু’বার রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে সোচ্চার লে. জেনারেল মীর শওকত বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি সেক্টর কমান্ডার ফোরামের ভাইস-চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। লিখেছেন তিন খন্ডে নিজের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘ইভিডেন্স’।
মীর শওকত আলীর জীবনসঙ্গিনী বেগম তাহমিনা শওকত। তাঁদের তিন কন্যা। তাঁরা সবাই উচ্চশিক্ষিত। একমাত্র ছেলে মীর জুলফিকার আলী মার্শাল ছিলেন আইটি প্রকৌশলী। তিনি ২০০৯ সালে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
মীর শওকত আলী ২০১০ সালের ২০ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র:
১. ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র’- দশম খন্ড’।
২. সুকুমার বিশ্বাস রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধে রাইফেল্স্ ও অন্যান্য বাহিনী’।
৩. ‘শত মুক্তিযোদ্ধার কথা’।
৪. ‘সেক্টর কমান্ডাররা বলছেন-মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় ঘটনা’।
৫. মীর শওকত আলী রচিত ‘এভিডেন্স’।
লেখক : চন্দন সাহা রায়