রাজনীতি কী জিনিস তা অরিণা বেগম কখনোই জানতেন না। দেশের স্বাধীনতার কী হবে তাও তাঁর অজানা ছিলো। বিয়ের পর ভোট দেওয়ার সময় স্বামী বুঝালেন, কেন নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়া দরকার। স্বামীর কথামতো নৌকা মার্কায় ভোট দিলেন। কিন্তু এই ভোটই তাঁর জীবনে কাল হয়ে এলো।
এক রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার কারণে আওয়ামী লীগকর্মী অরিণার স্বামীকে রাজাকাররা তুলে নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। আর অরিণার ওপর চলে নির্মম নির্যাতন। সাড়ে চার দশক অরিণাকে তাড়িয়ে ফিরছে সেই দুর্বিসহ স্মৃতি। সামাজিকভাবে হেয়-প্রতিপন্ন হয়েছেন। কিন্তু কোনো স্বীকৃতি তিনি পাননি, বিচার তো দূরের কথা। তবু অদম্য অরিণা বেগম। যা ঘটেছে তা লুকানোর কিছু নেই। তিনি তাঁর ওপর নির্যাতনের কাহিনী শুনাতে চান কোনো স্বীকৃতির আশায় নয়, একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচার হবে সেই আশায় আজো বসে আছেন অরিণা বেগম। মোতালিব মিয়ার সঙ্গে অরিণা বেগমের বিয়ে হয় ১৯৭০ সাল। অরিণা বেগমের মনে আছে, সত্তর সালের ভোটৈর মাত্র তিন দিন আগে তিনি বাপের বাড়ি ছয়কোট গ্রাম থেকে স্বামীর বাড়ি পাশের বড়চেক গ্রামে আসেন। স্বামীর বাড়িতে সেদিন ঢোকার মুখইে দেখেছিলেন লালসালু দিয়ে বিশাল এক নৌকা বাঁধা। সেই নৌকার নীচ দিয়েই স্বামীর বাড়িতে প্রবেশ করেন অরিণা বেগম। বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়েছিলো মাস ছয়েক আগেই। কিন্তু ছেলের ছুটি না থাকায় তখন বউ তুলে আনার কাজটি সম্পন্ন হয়নি। শ্বশুর বাড়িতে আসার পরেই স্বামীর কথায় নৌকা মার্কায় ভোট দেন অরিণা বেগম। স্বামী বলেছিলো, ‘মুজিবেরে নৌকায় ভোট দাও। দেশ স্বাধীন হইব।’
তখন এ এলাকায় নৌকা মার্কার সমর্থক খুবই কম ছিলো। মোতালিব মিয়া চট্টগ্রামে জেনারেল আয়রন অ্যান্ড স্টিল মিলে কাজ করতেন। সেখানেই তিনি শ্রমিক রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম এ হান্নান প্রমুখ নেতা তখন প্রায়ই মিলে আসতেন। শ্রমিকদের মধ্যে তারা বক্তব্য দিতেন। মোতালিব মিয়া এসব সভায় নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন এবং এর মধ্য দিয়েই তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক হয়ে উঠেন।সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করার পর বড়চেক গ্রামে মুসলিম লীগের সমর্থক ছিদ্দিক মিয়া, আনোয়ার খাঁ, মিছির উল্লাহ, মন্নান মিয়া হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা করে। এলাকায় তখন মুসলমানদের মধ্যে ৭/৮টি পরিবার আওয়ামী লীগের সমর্থক। আর পাশের নাথপাড়ায় ছিলো ১২০ ঘর হিন্দু পরিবার। তারাই মূলত আওয়ামী লীগের ভোটব্যাঙ্ক। নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই মোতালিব মিয়ার সঙ্গে মুসলিম লীগ সমর্থকদের প্রচণ্ড বিরোধ দেখা দেয়। ভোটের পর এখানে কয়েকদিন ধরে উত্তজেনা চলে। তারপর আবার তা থেমেও যায়। এলাকা একটু শান্ত হয়ে আসলেই মোতালিব মিয়া স্ত্রী অরিণা বেগমকে মায়ের কাছে রেখে আবার কর্মস্থল চট্টগ্রামে চলে যান। মোতালিব মিয়ার তখন বড় পরিবার। বাড়িতে ছোট দুই ভাই, মা, স্ত্রী। সবাই তাঁর উপরে নির্ভরশীল। ২৫ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী সারাদেশে গণহত্যা শুরু করে দেয়। অরিণা বেগম স্বামীর চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেন। তিনি এলাকার লোকজনের কাছে শুনতে পেতেন চট্টগ্রামে অনেক মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করেছে। মৌলভীবাজার থেকে চট্টগ্রাম অনেক দূর। এই যুদ্ধের সময়ে মোতালিব মিয়ার খবর এনে দেবে তেমন কেউ ছিলো না।
এই দুশ্চিন্তার মধ্যইে একদিন গভীর রাতে মোতালিব মিয়া বাড়ি চলে আসেন। মোতালিব মিয়া চট্টগ্রাম থেকে সাতদিন হেঁটে কমলগঞ্জের বাড়িতে আসেন।কয়েকদিনের মধ্যেই মৌলভীবাজার ও কমলগঞ্জে পাকিস্তানি সেনারা চলে আসে। তারা আসার পর পরই এলাকায় এলাকায় শান্তি বাহিনী ও রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলা হয়। ছিদ্দিক মিয়া, আনোয়ার খাঁ, মিছির উল্লাহ, মন্নান মিয়া এদের নেতেৃত্ব রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনারা সড়কে সড়কে টহল দেওয়া শুরু করে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তারা মাঝে মাঝে এসেই মোতালিব মিয়ার বাড়িতে খোঁজ-খবর নিতো, হুমকি দিয়ে যেত। অরিণা তখন নতুন বউ। ঘররে ভতির থেকেই এসব হুমকি শুনতেন।মোতালিব মিয়া তখন মুক্তিযোদ্ধাদের সহকারী হিসেবে রাজনগরে কাজ করতেন। মোতালিব মিয়ার একজন ভাতিজাও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য ভারতে চলে গেছেন। প্রতিদিনই অরিণা বেগম শুনতে পেতেন, যেসব পরিবারের ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে গেছে রাজাকাররা তাদের চিহ্নিত করছে এবং পাকিস্তানি সেনাদের দিয়ে তাদের নানারকম নির্যাতন করাচ্ছে। এই নির্যাতনের মুখে অনেকেই দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। রাজাকাররা রাস্তায় রাস্তায় ক্যাম্প বসিয়েছে।
ভারতে যারা যেতে চাচ্ছে, তাদের আটকে দিচ্ছে, তাদেরে মালামাল লুটপাট করছে। নারীদের ধরে ধরে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিচ্ছে। আশপাশের চা বাগান থকে সার বেঁধে প্রতিদিন মানুষ ভারতে যাচ্ছে। এদের মধ্যে বাগানের শ্রমিক যেমন আছে, তেমনি বাবুরাও আছে। অনেক বাগানে রাজাকারদের সহায়তায় সেনাবাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করেছে। সেখানে নারীদের আটকে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে।অরিণা নতুন বউ। তাঁর বাড়ির বাইরে যাওয়া মানা। কিন্তু হাট-গঞ্জ থেকে বাড়ির মানুষজন ফিরে এসে এসব আলাপই করে। শুনে অরিণার মনে অজানা শঙ্কা ভর করে। স্বামীর চিন্তায় মন অস্থির হয়ে উঠে। কারণ, বিয়ের পর এ বাড়িতে এসেই তিনি বুঝতে পেরেছেন, স্বামী মোতালিবকে এলাকার রাজাকাররা স্বাধীনতার পক্ষের লোক হিসেবে জানে তারা সুযোগরে অপেক্ষায় আছে। যখনই সুযোগ পাবে, তারা প্রতিশোধ নেবে। এসব কথা চিন্তা করে একবার ভাবেন, স্বামী বাড়ি না এলেই ভাল। আবার ভাবেন, এই মানুষটিই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যদি বাড়ি ফিরে না আসেন তাহলে সংসারই বা কীভাবে চলবে।
এসব ঘটনার মধ্যে ২৫ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে মোতালিব মিয়াবাড়ি চলে আসেন। বাড়ির সবাই তখন ঘুমে। অরিণা পিছনের দরজায় স্বামীর ডাক শুনতে পান। তিনি শাশুড়িকে ডেকে তুলেন। শাশুড়ি দরজা খুলে দিলে মোতালিব মিয়া ঘরে ঢুকেন। তখন মা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন, ‘দেখ আমার পোলা ফিরে আসছে।’ মোতালিব মিয়া মাকে শান্ত করেন। অরিণা বেগম স্বামীকে বলেন, ‘তুমি বাড়ি আসলা কেন? রাজাকাররা তোমারে খুঁজতাছে।’ মোতালিব মিয়া স্ত্রীকে বলেন, ‘কোনো চিন্তা করো না, আমি ফজরের আজানের সময় আবার চলে যাব। তোমাদের দেখার জন্যই এসেছি।’ অরিণা ঘরে রান্না করা যে খাবার ছিলো তাই খেতে দেন স্বামীকে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে মোতালিব মিয়া স্ত্রীকে মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনান। তিনি কোথায়, কী কাজ করেন সেসব বলতে থাকেন। তখনই অরিণা জানতে পারেন পাকিস্তানি বাহিনী কীভাবে মানুষদের হত্যা করছে, গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে, লুটপাট করছে।
মোতালিব মিয়া স্ত্রীকে জানান, এরই মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা চৈত্রঘাট গ্রামের ইরেশ দত্তকে গুলি করে হত্যা করেছে। সেদিন বিকেল বেলায় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ইরেশ দত্তের বাড়ি আসে। তখন ইরেশ দত্ত নিজেদের মন্দিরে গিয়ে লুকিয়ে পড়েন। রাজাকাররা তাঁকে সেখান থেকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে। তারপর পাকিস্তানি বাহিনী যায় পাশের মনোরঞ্জন ভৌমিকের বাড়িত। তখন পালিয়ে যাওয়ার সময় মনোরঞ্জন ভৌমিক ও তাঁর ভাই সুধেন্দু ভৌমিক গুলিবিদ্ধ হন। সেদিন চৈত্রঘাট গ্রাম থেকে যতীন্দ্র দত্ত, সোনাচাঁন দত্ত ও বনামলী গোসাইকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। পরে চৈত্রঘাট ধলাই নদীর পাড়ে তাদেরকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। একইভাবে হত্যা করা হয় দুই ভাই মদনমোহন দত্ত ও মনমোহন দত্তকে।বাড়রি সব মানুষ তখন ঘুমে অচতেন। শুধু অরিণা বেগম আর তাঁর স্বামী মোতালিব মিয়া বিছানার উপর বসে এসব গল্প করছেন। মোতালিব মিয়া একটু পর পর ঘড়ি দেখছেন, কয়টা বাজে।
কারণ, ফজরের আজানের সময়ই তাঁকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হবে। রাজাকাররা যদি জেনে যায়, সে বাড়িতে এসেছে তাহলে নির্ঘাত মৃত্যু।তখন রাত প্রায় ৩টা। হঠাৎ করেই অরিণা বেগম দেখতে পান বাড়ির চারপাশে মাঝে মাঝে আলো জ্বলছে। মাঝে মাঝে রাতের বেলায় রাজাকাররা রাস্তা দিয়ে টহল দেয়। তখন রাস্তার চারপাশে প্রচুর আলো ফেলে তারা পরিস্থিতি অবলোকন করে। সেই আলো এসে বাড়ির চারপাশেও পড়ে। অরিণা বেগম প্রথমে ভেবেছিলেন, সেই আলোতেই বোধহয় তিনি দেখতে পাচ্ছেন। অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারেন, আসলে বাইরে থেকে কেউ তাদের বাড়ি লক্ষ্য করে আলো ফেলছে। মোতালিব মিয়াও সেই আলো দেখে একটু চিন্তিত হন। অরিণা স্বামীকে বিছানার উপর রেখেই ঘরের টিনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখেন পুরো উঠান জুড়ে আলো। বাড়ির চারপাশে রাজকাররা অবস্থান নিয়েছে। তারাই টর্চ লাইটের আলো ফেলছে মোতালিব মিয়ার ঘর লক্ষ্য করে। ভয়ে অরিণার শরীর অবশ হয়ে যায়। তিনি যেন কোনো কথা বলতে পারছেন না। তাহলে কি রাজাকাররা মোতালিব মিয়ার বাড়ি আসার কথা জেনে গেছে! তাহলে এখন কী হবে? তিনি বিছানার কাছে গিয়ে স্বামীর হাত ধরনে।
মোতালিব মিয়া বিছানা থেকে নেমে টিনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেন। অরিণা গিয়ে নিচু স্বরে শাশুড়িকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেন। দেবরকে ডাকেন।ততক্ষণে পুরো ঘর টর্চের আলোয় আলোকিত হয়ে পড়েছে। রাজাকাররা বাইরে থেকে মোতালিব মিয়ার নাম ধরে ডাকতে শুরু করে। তাঁকে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসতে বলে। দরজা না খুললে গুলি করা হবে বলে হুমকি দেয় রাজাকাররা। অরিণা কী করবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি পাগলের মতো শুধু ঘরের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করছেন। একবার স্বামীর কাছে যাচ্ছেন, আরেকবার শাশুড়ির কাছে আসছেন। এদিকে রাজাকাররা ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য মোতালিব মিয়াকে ডাকছে। মোতালিব মিয়া ভাবেন, এখন যে পরিস্থিতি তাতে পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। ডাক-চিৎকার দিয়ে লোক জড়ো করবেন। সে আশাও মিছে। কারণ, এই যুদ্ধের মধ্যে রাতের বেলায় কেউ তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে না। এদিকে দরজা না খুললে রাজাকাররা গুলি করবে। এতে যে কেউ মরতে পারে। তাঁর একার জন্য সবগুলো মানুষ মারা যাবে এটাও তিনি ভাবতে পারছেন না। ঘরে দা-কুড়াল-ফলা-বর্শা আছে, এগুলো নিয়ে রাজাকারদের মোকাবেলা করবেন? তাতেও কোনো লাভ হবে না। উল্টো বেঘোরে সবাই প্রাণ হারাবেন।
এসব চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেন, দরজা খুলে দেবেন। তারপর যা হয়, হবে। এসব ভাবতে ভাবতে বেশ কিছুটা সময় চলে যায়। বাইরে রাজাকাররা একে অপরকে দরজা ভেঙে ফেলার কথা বলছে, গুলি করার কথা বলছে। তখন মোতালিব মিয়া ঘরের দরজা খুলে দেন। দরজা খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ৪/৫ জন বন্দুক নিয়ে এসে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ে। মোতালিব মিয়াকে দুজন জোর করে ধরে বেঁধে ফেলে ঘরের বাইরে টানতে টানতে নিয়ে যায়। অরিণা আর তাঁর শাশুড়ি বাঁধা দিয়েও কোনো কাজ হয়নি। তারাও মোতালিব মিয়াকে ধরে রাখার জন্য উঠানে চলে আসেন। কিন্তু বন্দুকের নলের মুখে তাদের আর বেশি দূর অগ্রসর হতে দেয়নি রাজাকাররা। টর্চের সামান্য আলোর মধ্যইে অরিণা বেগম দেখতে পান, রাজাকাররা তাঁর স্বামীকে মারতে মারতে বাড়ির বাইরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। অরিণার চিৎকার করে কান্না করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না।কিন্তু সেই চিৎকারও অরিণা বেগম বেশিক্ষণ দিতে পারেননি। হঠাৎ করেই একজন রাজাকার তাঁর মুখ চেপে ধরে। কিছু বুঝে উঠার আগেই একজন রাজাকার মাথায় কাছে বন্ধুক ধরে, গলা পেঁচিয়ে ধরে। অরিণা চুপ করে যান। মুর্হূতইে যেন ভুলে যান স্বামীকে কিছুক্ষণ আগেই তুলে নিয়ে গেছে। তিনি নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন। দুজন রাজাকার টানতে টানতে তাঁকে ঘরের ভিতরে নিয়ে যায়।
বাড়ির সব লোককে রাজাকাররা বন্দুকের মুখে বন্দি করে ফেলে। সবাইকে একটি ঘরে বন্দি করে অরিণাকে নির্যাতন করে রাজাকাররা।একসময় জ্ঞান হারান অরিণা বেগম। তখন সুবহে সাদেক। গ্রামের মসজিদ থেকে আযান ভেসে আসছে। রাজাকাররা চলে যায়। ঘরের লোকজনই অরিণাকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করেন। ভোরের আলো একটু ফুটলে আশপাশের প্রতিবেশিরাও আসেন। অরিণা তখন নির্বাক, কথা বলার মতো শক্তিও আর অবশিষ্ট ছিলো না।এদিকে মোতালিব মিয়াকে রাজাকাররা প্রথমে স্থানীয় শান্তি কমিটির কার্যালয়ে নিয়ে আটকে রাখে। তারাই মৌলভীবাজারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে খবর পাঠায়। পরদিন দুপুরের দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি জিপ এসে মোতালিব মিয়াকে তুলে নিয়ে যায়। মৌলভীবাজারের সার্কিট হাউজে সেনাবাহিনীর সেই ক্যাম্পে আরো অনেককে ধরে আনা হয়েছে। সেখানেই তাদের আটক করে রাখা হয়। টানা ১০ দিন মোতালিব মিয়া সেখানে আটক ছিলেন। এখানে আটক থাকাবস্থায় অনেক লোককে হারিয়ে যেতে দেখেছেন মোতালিব মিয়া।
প্রতিদিন রাতেই এখান থেকে লোকদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। তাদের কান্নার শব্দ শোনা যেত। কিন্তু কারো কিছু করার নেই। ১০ দিন পর এক সকালে মোতালিব মিয়াকে নিয়ে যাওয়া হয় সার্কিট হাউজের উল্টো দিকে এসডিওর বাংলোতে। সেখানেই নিজের অফিস বানিয়েছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এক মেজর। মেজর সেখানে বসে প্রত্যকের বিচার কাজ করছে। তাকে সাহায্য করছে মৌলভীবাজার মহকুমা শান্তি কমিটির আহ্বায়ক মিছির আলী। সবাইকে চোখ বেঁধে মেজরের সামনে হাজির করা হয়। মোতালিব মিয়াকেও সেভাবেই হাজির করা হয়। কিছুক্ষণ পর তাঁর চোখ খুলে দিলে মেজর নানা প্রশ্ন করা শুরু করে। একপর্যায়ে মোতালিব মিয়া তাঁর পকেটে থাকা চট্টগ্রামের জেনারেল আয়রন স্টিল মিলের পরিচয়পত্র দেখান। সেই পরিচয়পত্রে উর্দুতে ঠিকানা লেখা ছিলো। বিচারের একপর্যায়ে মেজর মোতালিব মিয়াকে জেলে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।অরিণা বেগম সুস্থ হওয়ার পর জানতে পারেন তাঁর স্বামী মোতালিব মিয়া জেলে আটক আছেন। কিন্তু তাঁকে ছাড়ানোর মতো কোনো ব্যবস্থা তিনি করতে পারেননি।
প্রায় এক মাস জেলে বন্দি থাকার পর ৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা মৌলভীবাজার দখল করে নেয়। তখন তারা জেল ভেঙে সেখানে বন্দি সবাইকে মুক্ত করেন। তখন মোতালিব মিয়াও জেল থেকে বের হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন।বাড়িতে ফেরার পরই স্ত্রী অরিণা বেগম স্বামীকে তাঁর ওপর রাজাকারদের নির্মম অত্যাচারের কথা বলেন। মোতালিব মিয়াসব কিছু মেনে নেন। কোনোদিন এ নিয়ে স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব বাঁধেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার আট বছর পর মোতালিব মিয়া চট্টগ্রামের চাকরি ছেড়ে কুয়েতে চলে যান। একটি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পা ভেঙে যায়। তারপর নিঃস্ব, রিক্ত মোতালিব মিয়া খালি হাতে আবার বাড়ি ফিরে আসেন। এর মধ্যে মোতালিব মিয়া আর অরিণা বেগমের ঘরে চার মেয়ে সন্তান এসেছে। তাদের বিয়ে দিয়েছেন। বড় মেয়ে রনি বেগমকে বিয়ে দিয়েছেন চামড়কোনা গ্রামে। তৃতীয় মেয়ে পান্না বেগমকে বিয়ে দিয়েছেন শমসেরেনগরে। দ্বিতীয় মেয়ে ইমরানার বিয়ে দিয়েছেন ভানুগাছ থানার গোবিন্দপুর গ্রামে। সবার ছোট মেয়ের বিয়ে হয়েছে বড়চেক গ্রামেই। মেয়েদের খুব একটা পড়াশোনা করাতে পারেননি এই দম্পতি। বড় মেয়েটা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। আর বাকিদের প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পরই বিয়ে দিয়ে দেন।
মূলত অভাবের কারণেই মেয়েদের পড়াশোনা করাতে পারেননি।মোতালিব মিয়াও অরিণা বেগমের নিজেদের কোনো জমি-জিরাত নেই। শারীরিক কারণে মোতালিব মিয়াও এখন আর কোনো কাজ করতে পারেন না। মেয়েদের অবস্থাও তত ভাল নয় যে, বাবা-মাকে দেখবে। তবু তারা সুযোগ পেলে সাহায্য করেন। মোতালিব মিয়া আর অরিণা বেগম এখন ছোটভাই ও ভাইপোর ওপরই নির্ভরশীল। কষ্টে-সৃষ্টে দিন কেটে যাচ্ছে তাদের।মোতালিব মিয়াকে আজো চার বছর আগের সেই স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজাকাররা পালিয়ে যায়, আত্মগোপন করে। স্বাধীনতার বেশ কিছু পর তারা আবার গ্রামে ফিরে আসে। কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূল থাকায় তখন তাদের নামে মামলা করতে পারেননি মোতালিব মিয়া। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় রাজাকারও সমাজে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেছে।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর স্ত্রীর ওপর নির্যাতনের বিচার চেয়ে মোতালিব মিয়া গ্রামের রাজাকারদের নামে মামলা করেছেন। এই শেষ বয়সে তিনি এই মামলার বিচার দেখে যেতে চান। আর চান, স্ত্রীর স্বীকৃতি। এর জন্য তিনি অনেকেরে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি তবু মোতালিব মিয়ার আশা, এই দেশ তাঁর স্ত্রীকে নিশ্চয়ই প্রাপ্য মর্যাদা দেবে।২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার বড়চেক গ্রামে অরিণা বেগম ও তাঁর স্বামী মোতালিব মিয়ার বাড়িতে তাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
লেখক : চন্দন সাহা রায়