১৯৭১ সালের শুরুতে দেশ যখন স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল তখন একদিন আছিয়া বেগমের মা ও বোন এসে তাদেরকে এই জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নিতে বলে। কিন্তু নানা ঝামেলার কারণে তারা আর সেই জায়গা ছেড়ে যেতে পারলেন না। এর ঠিক পনের দিন পরেই পাকিস্তানী বিমানবাহিনী সিরাজগঞ্জে বোম্বিং শুরু করে। সেই দিনটির কথা এখনো আছিয়া বেগমের স্পষ্ট মনে আছে।
সকাল বেলা দেলোয়ার হোসেন ভাত রান্না করার কথা বলে বাজারে চলে যায় মাছ ও তরকারি কেনার জন্য। তখন যুদ্ধের বাজার, কোনো কিছুই পাওয়া যায় না। আছিয়া খাতুন ভাত চড়িয়ে রেল লাইনের পাশে যে খাল ছিল সেখানে কাপড় ধুতে যান। ঠিক সেসময় তাঁর মাথার উপর খুব নীচ দিয়ে তিন-চারটি বিমান উড়ে যায় তার একটু পরেই শুনতে পান বোম্বিং-এর শব্দ। ভয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে আসেন। এসে দেখেন তাদের ঘরের পাশের খালি জায়গায় পাঁচ-ছয়জন লোক মাটিতে শুয়ে আছেন। তিনি তাদের দিকে এগিয়ে গেলে লোকজন তাঁকে দ্রুত ঘরে যেতে বলে এবং মাটিতে শুয়ে থাকতে বলে। তিনি কিছু না বুঝেই ঘরে ফিরে আসেন। এদিকে স্বামী দেলোয়ার হোসেনও তখন বাজারে। আছিয়া খাতুন কী করবেন বুঝতে পারলেন না। ফুটন্ত চাল উনুনে। সেদিকে খেয়াল করার সুযোগ নেই তাঁর। চারিদিকে বোমার শব্দ। মনে হয় ঘর শুদ্ধ কাঁপছে। আছিয়া খাতুন ঘরের দরজা বন্ধ করে ছেলে-মেয়েদের বুকে তুলে বসে রইলেন। তাঁর একটু স্বামীর প্রতি রাগও হলো কারণ মা-বোন বলে যাওয়ার পর দেলোয়ার হোসেন এই জায়গা ছেড়ে গেলেন না।
অনেকক্ষণ পরে দেলোয়ার হোসেন বাজার থেকে খালি হাতে ফিরে আসলেন হন্তদন্ত হয়ে। বাজারের অবস্থা তখন খুবই খারাপ। চারিদিকে আগুন জ্বলছে। তিনি এসেই আছিয়া বেগমকে তাড়া দিলেন সবকিছু গোছগাছ করার জন্য। বললেন, অবস্থা খুব খারাপ, এখানে আর থাকা যাবে না। আছিয়া বেগম ভেজা কাপড়-চোপড় আর কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। ফুটন্ত চাল উনুনেই পড়ে রইল। আছিয়া বেগম উনুনে একটু পানি ঢেলে দিলেন।
সিরাজগঞ্জ শহর ছেড়ে তখন অনেক মানুষ চলে যাচ্ছেন। কেউই জানেন না তারা কোথায় যাবেন। আছিয়া বেগমের পরিবারও তাদের একটি দলের সাথে ভীড়ে গেলেন। কিন্তু সকাল থেকে পেটে কিছুই পড়েনি আছিয়া বেগমের। তাঁর উপর কোলে দুই বছরের ছেলে। মেয়েটি বড়, সে বাবার হাত ধরে হাঁটছে। তখন বেলা প্রায় দুপুর। এইভাবে একনাগাড়ে অনেকক্ষণ হাঁটার পর তিনি অনেকটা পিছনেই পড়ে গেলেন। স্বামী এসে তাগাদা দিলেন পা চালানোর জন্য। কিন্তু আছিয়া খাতুনের পা তো আর চলে না। শেষে তিনি একটি বড় আম গাছের নীচে বসে পড়লেন। মেয়েটা কয়েকটা আম গাছের নীচ থেকে কুড়িয়ে এনে দিল। মা-মেয়ে মিলে সেগুলো খেলেন। তারপর আবার হাঁটা শুরু করলেন।
কিন্তু এইভাবে আর কতোক্ষণ হাঁটা যায়। আবার বসলেন। বিশ্রাম নিলেন। তারপর আবার হাঁটা শুরু করেন। এইভাবে হাঁটতে হাঁটতে বিকেল বেলায় গিয়ে পৌঁছলেন মাথাভাঙ্গায় তার ননদের বাড়িতে। সেখানেও খাবারের তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। পরে রাত্রে একটু খাবার জোগাড় করতে পারেন আছিয়া খাতুন। সেটিই সকলে মিলে ভাগ করে খেলেন।
প্রায় খালি পেটে সারাদিন পথ হেঁটেছেন আছিয়া বেগম। যাই হোক শেষ পর্যন্ত পেটে কিছু হলেও দানাপানি পড়েছে। এখন তো শরীর বিছানা চায়। বাচ্চা দুটোকে দু’পাশে নিয়ে একটু জায়গা খোঁজে শুয়ে পড়েন আছিয়া। চোখের পাতা দু’টো বুজে এসেছে প্রায়। ওমনি হঠাৎ চিৎকার শোনা গেল চারপাশ থেকে। অন্ধকারে সেই চিৎকার আরো ফুলে-ফেঁপে উঠল। অধিকাংশই পুরুষ মানুষের চিৎকার। আছিয়া বেগম তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলেন। তার স্বামীসহ ঘরের অন্যরা উঠলো। কিন্তু সবাই চুপ। কেউ কোনো কথা বলছে না। একটু পরে দেলোয়ার হোসেন ও আছিয়ার ননদের স্বামী ঘর থেকে বেরোলেন। লোকজনের সাথে কথা বলে জানতে পারলেন, কাছেই জামতলি স্টেশনে গভীর রাতে একটা গাড়ী এসেছে। সেই গাড়িতে অসংখ্য পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। তারা এদিকেও আসবে।
বাস্তব অবস্থাটা কী তা দেখার জন্য দেলোয়ার হোসেন বেরোলেন। আজান যখন পড়ল তখন তিনি বাড়ি ফিরে আসলেন। এসেই সবাইকে তাগাদা দিলেন তৈরি হবার জন্য। বেশি সময় আর এখানে থাকা যাবে না। কিন্তু বাড়ির লোকজন যাবে না। ফলে ভোরের আলো ফোঁটার আগেই আবার অজানার-পথ ধরতে হল আছিয়া বেগমকে।
সারা সকাল ও দুপুর হাঁটার পর তারা গিয়ে পৌঁছুলেন চৌবাড়িতে। সেখানে দেলোয়ার হোসেন তাঁর এক মামাবাড়িতে আশ্রয় পেলেন। সেখানে আছিয়া বেগমকে রেখে তিনি দু’একদিন পর আবার মাথাভাঙ্গা ফিরে এলেন। কুড়ি- পঁচিশ দিন পর আছিয়া খাতুনকে আবার মাথাভাঙ্গা নিয়ে এলেন। সেখানে প্রায় মাসখানেক ছিলেন। দেলোয়ার হোসেন মনে করলেন, এখন বোধহয় পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হতে চলেছে। ফলে তিনি একদিন আছিয়া বেগমকে নিয়ে সিরাজগঞ্জের দিকে পথ দিলেন। কিন্তু দোলোয়ার হোসেন শহরে পৌঁছে দেখলেন তিনি যা ভেবেছিলেন পরিস্থিতি একবারেই তাঁর উল্টো। আছিয়া বেগমের বড় বোন গুলবাহার বেগমের স্বামী শক্কুর আলীকে পাকিস্তানী হানাদাররা হত্যা করেছে। সে গুলবাহারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে, নিজে শহরে ছিলেন। একদিন দুপুর বেলা শক্কুর আলী নিজের ঘরে শুয়ে ছিলেন। এমন সময় পাকিস্তানী সেনারা তাঁর বাড়িতে আসে। তাঁকে ‘পরিবারের’ কথা জিজ্ঞেস করে। শক্কুর আলী জানে না বলে জানায়। তখনি তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এটা শুনে আছিয়া বেগম বোনকে দেখার জন্য দত্তবাড়ির দিকে রওনা হলেন।
দত্তবাড়িতে মাসখানেক থাকার পর হঠাৎ করেই আছিয়া বেগমের ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন গ্রামে একজন ডাক্তার বা একটু ঔষধ মেলানো খুব দায়। দেলায়ার হোসেন সিদ্ধান্ত নিলেন শহরে যাবেন ছেলের ঔষধ আনার জন্য। আর এই সুযোগে একটু পরিস্থিতিটাও দেখে নিলেন। কিন্তু বাড়ির কেউই তাঁকে শহরে যেতে দিতে রাজি না। তবু দেলোয়ার হোসেন সব নিষেধ উপেক্ষা করে একদিন ভোরবেলা শহরে গেলেন। বলে গেলেন, সন্ধ্যা বা রাতেই ফিরে আসবেন। আছিয়া বেগম সেদিকেই পথ চেয়ে রইলেন। কিন্তু একদিন, দু’দিন, তিনদিন করে অনেক দিনই চলে গেল দেলোয়ার হোসেন আর বাড়ি ফিরেন না। এদিকে চিন্তায় অস্থির আছিয়া বেগম। সবাই তাঁকে দোষারূপ করে কেন সে স্বামীকে শহরে যেতে দিল। এর কাছ থেকে ওর কাছ থেকে খবর নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু কেউই কোনো খবর দিতে পাল না। পরিবারের অনেকে বলতে শুরু করল হয়তো পাকিস্তানী আর্মিরা দেলোয়ার হোসেনকে মেরে ফেলেছে। শহরে গুলি করে পশুপাখির মতো মানষ মারা হচ্ছে এটা গ্রামে আলোচিত হয়। আছিয়া বেগমের কানের সেসব সংবাদ আসে। ফলে তিনি স্বামীর চিন্তায় মুচড়ে পড়েন। ফলে তাঁরও ধারণা হলো স্বামীকে বোধ হয় পাকিস্তানী হানাদাররা মেরে ফেলেছে।
এভাবে প্রায় চৌদ্দ দিন চলে গেল, দেলোয়ার হোসেন বাড়ি ফিরেন না। পনের দিনের মাথার গুলবাহারের ছেলে গ্রামের এক বরই গাছের নীচে দেলোয়ারকে দেখতে পায়। তখন সে ছিল খুবই ক্লান্ত। সারাদিন অভুক্ত। সবাই মিলে দেলোয়ারকে বাড়িতে নিয়ে গেল। এবং শহরে যাবার জন্য সকলেই গালমন্দ করল, আর গেলই যখন তখন কেন এতো দেরি করলেন তা জানতে চাইল।
যেদিন দেলোয়ার হোসেন বাড়ি থেকে শহরে যান, সেদিন সারাদিন তিনি জলিল মিয়ার হোটেলেই কাজ করেন। বিকেলে হোটেলের পাওনা বুঝে নিয়ে ছেলের জন্য ঔষধ কিনে দত্তবাড়ির দিকে পথ দেন। কিন্তু সন্ধ্যার সময় সে পাকিস্তানী হানাদারদের একটি দলের সামনে পড়ে যান। হানাদাররা তাঁকে ধরে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেই ক্যাম্পেই তাঁকে একটানা চৌদ্দদিন আটকে রেখে নির্যাতন করা হয় ‘মুক্তিবাহিনী’-এর লোক ভেবে। পনের দিনের দিন দেলোয়ার হোসেনসহ আরো তের জনকে চোখ কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে একটা খোলা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। দেলোয়ার হোসেন বুঝতে পারেন এটাই তাঁর শেষ সময়। তিনি লাইনে নির্বিকারে দাঁড়িয়ে রইলেন। পাকিস্তানী আর্মিরা একজন একজন করে ব্রাশ ফায়ার করছে। সমস্ত ঘটনার তদারকি করছিলেন স্থানীয় একজন বিহারী। হঠাৎ করেই সেই বিহারী দেলোয়ার হোসেনের কাছে এগিয়ে এসেন এবং তাঁকে চিনে ফেলেন। তিনি হানাদার বাহিনীর একজন সদস্যের কাছে গিয়ে জানতে চান, কেন দেলোয়ারকে ধরে আনা হলো? কোথায় থেকে কবে ধরা হলো তাঁকে। পাক আর্মিটি জানায় যে, সে মুক্তিবাহিনী লোক। এজন্যই তাঁকে ধরা হয়েছে। কিন্তু সেই বিহারী প্রবলভাবে তার কথার প্রতিবাদ করে এবং তাঁকে বলে যে তার কথা সত্য না। দেলোয়ারকে ছেড়ে দেয়া হোক। মূলত এই বিহারীটি ছিল দেলোয়ার হোসেন যে জলিল মিয়ার হোটেলে কাজ করতেন তার আত্মীয়। সেখানে এই বিহারী প্রায়ই আসত। আড্ডা মারত। ফলে দেলোয়ারকে সে ভাল করেই চিনত। বিহারীর কথায় পাক আর্মি তাঁকে না মেরে ছেড়ে দেয় সেদিন। সেদিন বাকি তের জনকেই হত্যা করে হানাদাররা। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে দেলায়ার হোসেন দত্তবাড়ির দিকে রওনা দেন।
এরপর দত্তবাড়িতে আছিয়া ও দেলোয়ার কিছুদিন থাকেন। পরিস্থিতি একটু শান্ত হয়ে আসলে চলে আসেন আহ্নিক গ্রামে। সেখানে আসার পর দেলোয়ার হোসেন মুক্তিযুদ্ধে যাবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। এই কথা সে আছিয়াকে বলে। আছিয়া তখন প্রবলভাবে এর বিরোধিতা করেন এবং বলেন, তুমি চলে গেলে সংসার দেখবে কে? কিন্তু দেলোয়ার হোসেন সেসব কথা কানেই তুলর না। একদিন সে কাউকে কিছু না বলে মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়। আছিয়া অপরিচিত জায়গায় আবার অসহায় হয়ে পড়েন। আছিয়ার মা তখন তাঁর সাথেই ছিলেন।
আহ্নিক গ্রামের যে জায়গাটিতে আছিয়া থাকতেন সেটি ছিল রাস্তার পাশে। সেই রাস্তা দিয়ে প্রায়ই পাকিস্তানী হানাদাররা যাতায়াত করত। একদিন হঠাৎ করেই আছিয়ার বাড়িতে ঢুকে পরে তিন জন পাকিস্তানী সেনা। আছিয়া তখন ছেলেকে কোলে নিয়ে ঘরে বসে ছিলেন। আছিয়ার মা হানাদারদের দেখেই মেয়ের কাছে চলে আসেন। এবং মেয়েকে আগলে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু একজন সেনা আছিয়ার মাকে বন্দুক দিয়ে জোরে আঘাত করে মাটিতে ফেলে দেয়। তারপর তাঁকে জোর করে টেনে ঘরের বাইরে উঠানে নিয়ে যাওয়া হয়। দু’জন সেখানেই তাঁকে পাহারায় রাখে আর একজন ঘরে থেকে যায়। আছিয়ার কোলে থাকা ছেলেটিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় হানাদারটি। তারপর আছিয়ার আর জ্ঞান ছিল না। অসুস্থ ছেলেটিও কয়েকদিন পর চিকিৎসার অভাবে মারা যায়।
দেশ স্বাধীন হবার কয়েকদিন আগে আছিয়া তার মাকে সাথে নিয়ে সিরাজগঞ্জ শহরের নতুন ভাঙাবাড়িতে চলে আসেন। হঠাৎ করেই একদিন বিকেল বেলায় দেলোয়ার হোসেন সিরাজগঞ্জে ফিরে আসেন। ঘরে ফিরেই তিনি আছিয়াকে খাবার দিতে বলেন। বলে দেন, কাল ভোরেই তিনি আবার চলে যাবেন। অপারেশনের কাজে এখানে এসেছেন। সিরাজগঞ্জে তখন মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকতে শুরু করেছেন। তাদের সঙ্গে তিনি কাজ করবেন। তার তিনদিন পরই দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু এরপরেও আছিয়া বেগমকে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াতে হয়েছে।
আছিয়া খাতুনের জন্ম সিরাজগঞ্জের চরাঞ্চল কুড়িবাড়িতে। তাঁর বাবার নাম দেলোয়ার হোসেন, মা বাতাসি বেগম। এই দম্পতির চার ছেলে ও চার মেয়ে ছিল। কিন্তু ছোটবেলাতেই ছয়জন মৃত্যুবরণ করে। এখন বেঁচে আছেন আছিয়া বেগম ও তাঁর বড় বোন গুলবাহার বেগম। আছিয়া খাতুন ছেলেবেলায় কোনোরকম পড়াশুনার সুযোগ পাননি। আছিয়া খাতুনের বয়স যখন তিন বছর তখন তাঁর বাবা দেলোয়ার হোসেন মারা যান।
দশ-বারো বছরের সময় আছিয়াদের গ্রাম যমুনা নদীর গর্ভে চলে যায়। তখন তারা তাদের মামাবাড়ি তেতুঁলিয়াতে চলে যান। এই সময় তাঁর বিয়ে হয়ে হয়ে যায় পাশের মাথাভাঙা গ্রামের আব্দুল মান্নান খানের সাথে। তাদের চার ছেলে-মেয়ে। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। এর মধ্যে এক ছেলে ও এক মেয়ে মারা গেছে। তেতুঁলিয়ায় গ্রামের বাড়িটিও এক সময় নদীগর্ভে চলে যায়। তখন তাদের পরিবার নিয়ে সিরাজগঞ্জ ফকিরপাড়া রেল লাইনের পাশে আশ্রয় নিতে হয়। স্বামী দেলোয়ার হোসেন স্থানীয় জলিল মিয়ার হোটেলে বাবুর্চির কাজ করতেন। জলিল মিয়া ছিল বিহারি। সেখানেই তিনি জীবনের একটি বড় অংশ অতিবাহিত করেছেন।
দেশ স্বাধীন হবার পনের দিন পর্যন্ত দেলোয়ার হোসেন আর বাসায় ফিরলেন না। একদিন বাড়ি ফিরে জানালেন তিনি আর একটি বিয়ে করবেন। করলেনও তাই। আছিয়া বেগমের আবার কপাল ভাঙল। ফলে স্বাধীনতার পর অনেকের বুদ্ধি-পরামর্শে তিনি নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে কাজ শুরু করেন। একাই সামলে চলেন সংসারের ঘানি। পঁচাত্তর পর্যন্ত তিনি ভালই চলতে পারতেন। নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে কাজ করে যা উপার্জন করতেন তা দিয়ে তাঁর মোটামুটি চলে যেত। একমাত্র মেয়ে মরিয়মকে এতিমখানায় দিয়ে দেন। এতিমখানা থেকে মেয়েটি মেট্রিক পাশ করে। তাঁকে সেখান থেকে বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়। মরিয়মের স্বামীর নাম আতিয়ার রহমান। সে সিরাজগঞ্জেই একটি রড-সিমেন্টের দোকানে কাজ করে। আছিয়া বেগম এখন মেয়ের সংসারেই আশ্রিতা।
এই লেখাটি তৈরি হয়েছে আছিয়া বেগমের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে। ২০১০ সালের ১৬ জুন সিরাজগঞ্জ জেলা শহরের পাশে নতুন ভাঙ্গাবাড়ি নামক স্থানে নিজ বাড়িতে তিনি এই সাক্ষাৎকার প্রদান করেন তিনি। বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার : সাফিনা লোহানী।
লেখক : চন্দন সাহা রায়