মানুষের মন বড় বিচিত্র। এর তল পাওয়া কঠিন। এটা একই সঙ্গে হতাশা ও সম্ভাবনার। যে তারুণ্য অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করে। কিন্তু সেই সাহসী রক্তও হয়তো কখনো কখনো তার চেতনাকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে পারে না। মনের এ দ্বন্দ্ব মানুষের ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। নতুন প্রাণ ইতিহাসের চাকাকে যতোটা এগিয়ে দিয়েছে, সংস্কারের প্রাচীন ভূত ঠিক ততোটাই পিছিয়ে দিয়েছে। ইতিহাসের এ বক্ররেখার মূল খুঁজতে হলে আমাদের যেতে হবে বীরাঙ্গনা আবিরনের কাছে। কেননা ইতিহাসের এ ধারাবাহিকতার বাইরে নন আবিরনের স্বামীও। লাঞ্ছিত-রক্তাক্ত-ধর্ষিত মাতৃভূমির মুক্তির জন্য আবিরনের স্বামীর ঘর ছেড়ে যুদ্ধের ময়দানে বেরিয়ে গেলেও, যুদ্ধ-ফেরত একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে ধর্ষিত-লাঞ্ছিত-রক্তাক্ত স্ত্রী গ্রহণীয় ছিল না। তাই আবিরন শুধুই একজন বীরাঙ্গনা; তিনি কোন গর্বিত মুক্তিযোদ্ধার সহধর্মিনী নন। এটাই যুদ্ধের এক নির্মম ও দৃশ্যমান বাস্তবতা।
কুড়িগ্রামের বীরাঙ্গনা আবিরনের স্বামী মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পরেও কিন্তু তাঁকে আর ঘরে তুলেননি। বরং তাঁকে ফেলে রেখে গিয়ে আবার দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আর আবিরন সারাজীবন সন্তান নিয়ে কাটিয়ে দেন তাঁর বাপের বাড়িতে। কিন্তু তারপরেও সামাজিক অবহেলা তাঁর পিছু ছাড়েনি। স্বাধীনতার চার দশক পরেও নিজের মেয়েকে বিয়ে দিতে গিয়ে ‘বীরাঙ্গনা’ পরিচয়ের কারণে সমস্যার শিকার হন আবিরন। এখনো সমাজ তো বটেই পরিবারেরও অনেকেই বাঁকা চোখে তাঁকে একাত্তরে সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হওয়ার কথা মনে করিয়ে দেন। আবিরনেরও তখন মনে হয় সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা।
আবিরনের মতো কয়েকজনের সঙ্গেই কথা বলতেই আগস্টের এক সকালে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে কুড়িগ্রাম শহরে গিয়ে নামি। আগেই একজন জানিয়েছিল, আবিরন সদর উপজেলার মুক্তারাম এলাকার একটি বাড়িতে থাকেন পরিবার নিয়ে। কিন্তু সেখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করার পরও কেউ ‘নারী মুক্তিযোদ্ধা’ আবিরনের কোন খোঁজ দিতে পারেননি। পরে তাঁকে পাওয়া যায় তাঁর ভাইয়ের পরিচয় ধরে। মুক্তারাম গ্রামেরই একটি ভাঙ্গা ঘরে বসবাস করেন পঞ্চাশোর্ধ আবিরন। তিনি জানান, এটা তাঁর নানা-নানীর ভিটে। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই তিনি এ বাড়িতে আছেন। এ তথ্য দেয়ার পরই আবিরন আবার হাসতে হাসতে জানান, ‘বাহে আসলে ছোটকাল থেকেই এইখানে আছি। আমার জন্ম এইখানেই। বিয়ের পর মাঝের একবছর খালি সোয়ামির বাড়ি আছিলাম। বাকি পঞ্চাশ-বায়ান্ন বছর এখানেই কাটছে।’
আবিরনের বাবা আজিউদ্দিন খুব সম্পন্ন গেরস্ত ছিলেন না। কিন্তু তিনি নিজের সামান্য জমি ও অন্যের জমি ভাগে চাষ করতেন। ফলে ছেলেবেলাটা আবিরনের ভালই কেটেছে। কখনো না খেয়ে থাকতে হয়নি। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আবিরন ছিলেন দ্বিতীয়। পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো আবিরনও কোনদিন স্কুলে যাননি। মাত্র আট বছর বয়সেই আবিরনের বিয়ে হয়ে যায় রাজারহাটের ফকরের হাট এলাকার হোসেন মিয়ার সঙ্গে। সেটা ‘মুজিবের ভোটের’ ঠিক এক বছর আগের কথা বলে জানালেন আবিরন। হোসেন মিয়া ছিলেন দরিদ্র কৃষক। অভাবের তাড়নায় এক সময় সেই জমি-জিরাত বিক্রি করে দেন। পরে কিছুদিন রাজাহাট এলাকায় দিনমজুরি করেন। কিন্তু তাতে সংসারের অভাব দূর না হওয়ায় আবিরন স্বামীকে নিয়ে বাপের বাড়ি মুক্তারামে চলে আসেন। এখান থেকে শহর কাছে হওয়ায় কিছু কাজকর্ম জুটতে পারে এই আশায়। ২৬ মার্চের পর কিছুদিনের মধ্যে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কুড়িগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তারা শহরের ত্রিমোহিনী, ছোট পুলের পাড়, বড় পুলের পাড়সহ বিভিন্ন এলাকায় ৬-৭টি ক্যাম্প স্থাপন করে। এসব ক্যাম্পে মাঝে মাঝেই নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হত। অনেককে সেসময় হত্যাও করা হয়। ভয়ে তখন শহর ছাড়তে শুরু করে মানুষ। কিন্তু আবিরনের কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। এ অবস্থার মধ্যেই হোসেন মিয়া একদিন স্ত্রীকে বাড়ি রেখে মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। আবিরন তাঁর বাবা-মায়ের কাছেই থাকেন। তার আগে একটা ছেলে হয়েছে আবিরনের। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর সময় ছেলে আবুলের বয়স মাত্র আট মাস।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সারাদিনই শহরে টহল দেয়। মাঝে মাঝে তারা বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে পড়ে রাজাকারদের সহায়তায়। গ্রামে পাকিস্তানী সেনারা ঢুকলেই লোকজন বাড়িঘর ফেলে দৌড়ে আশপাশের ক্ষেতে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। অনেক সময় তারা সেসব খালি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। অবশ্য অনেক সম্পন্ন গেরস্ত বাড়ির মানুষ আগেই সরে পড়েন যে যার মতো।
মে মাসের এক দুপুরে আবিরন নিজের ঘরে ছেলেকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন। এ সময় তিনি বাইরে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পান। আবিরন কিছু না বুঝেই ছেলেকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বাড়ির বাইরে দৌড় দেন। বেরিয়ে দেখেন লোকজন যে যেদিকে পারছে দৌড়াচ্ছে। আবিরনের মা ও পরিবারের অন্য সদস্যরাও বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। আবিরন পরিবারের লোকজনকে না পেয়ে গ্রামের লোকজনের সঙ্গেই চরের মধ্য দিয়ে দৌড়াতে শুরু করেন। কতক্ষণ এভাবে ছেলেকে কোলে নিয়ে দৌড়েছিলেন তা বুঝতে পারেননি। সামনে কারা, পেছনে কারা এসব যেন দেখার কোন সুযোগ নেই। আবিরন উর্ধ্বশ্বাসে শুধু দৌড়াচ্ছেন। গুলির শব্দ, মানুষের চিৎকার আর কোলের শিশুর কান্না শুনতে পাচ্ছেন তিনি। যেন এ শব্দই তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, দৌড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
আবিরন ক্লান্তি আর পিপাসায় একবার দাঁড়িয়ে যান। অবাক হয়ে দেখেন তাঁর সামনে কেউ নেই, পেছনেও কেউ না। তিনি কোথায় জায়গাটাও ঠিক ঠাওর করতে পারলেন না। শুধু বুঝতে পারলেন এ এক পোড়া মাঠ। পাশে ধরলা নদী। আবিরন পানি খাওয়ার জন্য নদীর দিকে এগিয়ে যান। নিজে পানি খেয়ে ছেলের মুখেও কিছুটা দেন। ছেলেটা কান্না করছে, তার মাথাটাও একটু ধুয়ে দেন আবিরন। নদী থেকে উঠার পথেই দেখতে পান তিনজন পাকিস্তানী সেনা আর কয়েকজন রাজাকার নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরের কড়া রোদে আবিরনের চোখ যেন তাদের ঝাপসা দেখে। আবিরনের হুঁস ফিরে আসে তাদের ডাকে, তারা বন্দুক তাক করে ডেকে কাছে আসতে বলে। আবিরন নদী থেকে তীরে আসার আগেই রাজাকাররা সেখান থেকে সরে যায়। ভয়ে আবিরন মাথা নীচু করে পাকিস্তানী সেনাদের সামনে এসে দাঁড়ান। ছেলেটা কিছু না বুঝেই কাঁদতে শুরু করেছে। একজন পাকিস্তানী সেনা আবিরনের কোল থেকে ছেলেটাকে নিয়ে নেয়। আবিরন বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। ছেলেটি আরো জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে। আরেকজন রাইফেলের বাট দিয়ে আবিরনের পিঠে জোরে আঘাত করলে তিনি পড়ে যান। শুয়ে থেকেই আবিরন দেখতে পান তাঁর ছেলেকে পাকিস্তানী সেনাটি দূরে ঢিল দিয়ে ফেলে দিয়েছে। ছেলেটি প্রথমে একটি চিৎকার দেয় তারপর আর কোন শব্দ তিনি শুনতে পাননি। এ ঘটনার ঠিক কতক্ষণ পর আবিরনের জ্ঞান ফিরে এসেছিল তা আর তিনি ঠাওর করতে পারেননি। কিন্তু তাকিয়ে দেখেন কিছুটা দূরেই তাঁর ছেলেটি নদীর পাড়েই পড়ে আছে। তখন বিকেল। আবিরন উঠতে গিয়ে বুঝতে পারেন, তাঁর শরীরের সবটুকু শক্তিই যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। ছেলের কাছে গিয়ে বুঝতে পারেন, সে এখনো বেঁচে আছে, কোলে নেয়ার সাথে সাথে ছেলেটি চিৎকার দিয়ে ওঠে। সমস্ত ব্যাথা, যন্ত্রণা ভুলে আবিরন কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে নিয়ে আবারো গ্রামের দিকে দৌড়াতে শুরু করেন। বাড়ি ফিরে দেখেন তাদের ঘর পুড়িয়ে দিয়ে গেছে খান সেনারা। আবিরন আর তাঁর পরিবারের কয়েকদিনের জন্য ঠাঁই হয় গাছতলায়।
আবিরনের সেই আট মাসের ছেলে আবুল, যুদ্ধের মধ্যে মায়ের অক্লান্ত চেষ্টায় প্রায় দুই সপ্তাহ বেঁচে ছিল। আবিরন বলছিলেন, ‘যুদ্ধের সময় তো, কোন ডাক্তার নাই, ওষুধ নাই, খালি তেল-পানি দিয়ে ছেলেটারে বাঁচাইতে চাইছিলাম। কিন্তু পারলাম না। পরে আর আমাদের গ্রামে কোনদিন মিলিটারি আসে নাই। আমি মায়ের সাথেই যুদ্ধের বাকি দিনগুলো ছিলাম।’
যুদ্ধের পর অনেকের মতোই আবিরনের স্বামী হোসেন মিয়াও ফিরে আসেন। কয়েকদিন ভালই কাটে। এ সময় আবিরনের গর্ভে আসে তাঁর একমাত্র মেয়ে নাজমা। এরমধ্যে আবিরনের বাবাও মারা যান। কিন্তু পরে গ্রামের লোকজনের কাছে হোসেন মিয়া জানতে পারেন আবিরন পাকিস্তানী সেনাদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। শুনেই তিনি আবিরনকে তালাক দেন। আবিরনকে গর্ভাবস্থায় তাঁর মায়ের কাছে রেখে হোসেন মিয়া তাঁর বাপের বাড়ি রাজারহাটের ফকরের হাটে চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি পরে আরো দুটি বিয়ে করেন। তিনি আর কোন খোঁজ-খবর নেননি আবিরনের।
আবিরন আর তাঁর মেয়ে নাজমা মায়ের বাড়িতেই ভাইদের কাছে জীবন কাটান। মেয়ে নাজমাকে বিয়ে দিয়েছেন বাদশা নামের এক দিনমজুরের সঙ্গে। তাদের ঘরে দুই মেয়ে আছে।
‘বাহে, আমার কারণে তো মেয়ের কপালেও দাগ লাগছে। বিয়ের সময় তো মেয়ের স্বামীর বাড়ির লোকজন কিছু জানত না। পরে তারা আমার ঘটনা জানতে পারে। এ নিয়ে অনেক দেন-দরবার হয়। শেষে লোকজনকে ধরে বিষয়টার মীমাংসা হয়। কিন্তু সুযোগ পেলেই মেয়েকে তার স্বামীর বাড়ির লোকজন এখনো খোটা দেয়। বলে, তোর মা তো পাকিস্তানী ক্যাম্পে থাকত। আমার গ্রামের লোকজনও বলে। কিন্তু সব শুনে মুখ বুজে থাকা ছাড়া আমাদের আর কি করার আছে! কেউ তো আমাগো খোঁজ নেয় না’, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবিরন তার বীরাঙ্গনা কাহিনী শেষ করেন।
সরকার বা কারো কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পেয়েছেন কী না জানতে চাইলে আবিরন মুখ বাঁকান, বলেন- ‘আমাগো খোঁজ নিব কেডায়? সবাই তো আমাগোরে জঞ্জাল মনে করে। বাহে, পরিবারের লোকই তো আমাদেরকে ঘরে তুলে নাই, মনে করে আমরা ইচ্ছা কইরা পাকিস্তানী ক্যাম্পে গেছি। আবার বাইরের মানুষ!!’
লেখক : চন্দন সাহা রায়