বীরাঙ্গনা আসিয়া বেগমের জন্ম হয়েছিল সিরাজগঞ্জ জেলার চিনাতি কান্দিপাড়া গ্রামে। মায়ের নাম ছিল আমিরুন নেসা, বাবা জিনাত আলী ছিল গরীব ক্ষেতমজুর। ভাইবোনেরা সবাই ছোট ছোট থাকায় তাদের মধ্যে বাবা ছাড়া উপার্জনক্ষম আর কেউই ছিল না। তাই বাবার একার উপার্জনেই কোন মতে কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালাতে হত মাকে। গরীব ক্ষেতমজুর হওয়ায় টাকা পয়সা দিয়ে বড় মেয়ের বিয়ে দেয়া জিনাত আলীর পক্ষে ছিল অসম্ভব, তাই মাত্র ১৭ বছর বয়সে একই গ্রামের বাসিন্দা ভিনদেশী হোসেন আলীর সাথে তিনি তাঁর মেয়ের বিয়ে দেন।
নিজ বাড়ি ভারতের আসাম রাজ্য থেকে হোসেন আলী কান্দিপাড়া গ্রামে চলে এসেছিলেন একেবারে খালি হাতে, এখানে এসে ক্ষেতমজুর হিসেবে তিনি কামলা খাটতে শুরু করেন। হোসেন আলীর আয় কম ছিল কিন্তু তবুও তা দিয়ে আসিয়া বেগমের সংসার মোটামুটি চলে যেত।
আসিয়া বেগমের বয়স তখন ২৭/২৮। দেশে শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। ঘরে তখন তাঁর ছোট ছোট তিনটি সন্তান। যুদ্ধ চলছে এর মধ্যে খবর এল সিরাজগঞ্জে মিলিটারি এসেছে। ভয়ে স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে ঘর ছাড়লেন তিনি। বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়ালেন কিছুদিন। প্রথমে গেলেন বালুগঞ্জে সেখানে কিছুদিন থেকে গেলেন কড্ডায়, সেখানেও থাকলেন কিছুদিন। তারপর সেখান থেকে গেলেন হালুয়াকান্দি ময়মনসিংহে। হালুয়াকান্দিতে কিছুদিন থাকতে না থাকতে সকলে বলল যে মিলিটিরি চলে গেছে আর আসবে না। তাই শুনে আসিয়া বেগম সকলকে নিয়ে গ্রামে ফিরে গেলেন। ফিরে গিয়ে দেখেন তাদের বাড়ীর কাছে ঘাটি গেড়েছে রাজাকারের দল। তারা আসিয়া বেগমদের হাঁস-মুরগী ধরে নিয়ে খেয়ে ফেলত আবার কখনো বাড়ীতে এসে ভাত নিয়ে যেত। যেদিন আসিয়া বেগমরা গ্রামে ফিরে এলেন পরদিনই রাজাকাররা তাদের বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দিল। এই ঘটনার পরে ভয়ে তারা সবাই মাটির গর্তের মধ্যে পালিয়ে থাকলেন। এরপর আবার আসল মিলিটারিরা, আবার গ্রাম ছেড়ে বারাকান্দিতে গিয়ে কিছুদিন পরিবারসহ পালিয়ে থাকলেন আসিয়া বেগম। আসিয়া বেগমের বাড়িতে দ্বিতীয়বার আগুন দিল রাজাকারেরা।
এদিকে বাদশা রাজাকার তাদের আশ্বস্ত করল যে মিলিটিরিরা একবারে চলে গেছে আর আসবে না। সরল মনে তার কথা বিশ্বাস করে পরিবারসহ বুকে আশা নিয়ে গ্রামে ফিরে এল আসিয়া বেগম। কোনমতে একটা কুড়েঘর তুললেন। তারপরও শেষ রক্ষা হল না। মিলিটারিরা তখন যে কোন মানুষ দেখলেই গুলি করে মেরে ফেলত, আসিয়া বেগমের বাবাও বাদ গেল না। এদিকে একদিন আসিয়া বেগমের স্বামী তখন কাজে, মিলিটারি তাড়া করেছে শুনে ভয়ে দৌড়ে পালানোর সময় মিলিটারির গুলি লাগল তাঁর কোলের শিশু সন্তানটির গায়ে, তৎক্ষনাৎ মারা গেল সে। নিরুপায় আসিয়া বেগম মৃত সন্তানকে ফেলে রেখে অপর দু’সন্তানকে নিয়েই প্রাণ বাঁচানোর জন্য দৌড়াতে থাকলেন। কিন্তু চারটি গুলি এসে বিদ্ধ করল তাঁকে। বড় ছেলেটার গায়েও গুলি লাগল। পরে সকলে মিলে ধরাধরি করে তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে গেল। নিজে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন বটে কিন্তু বড় ছেলেটি তখন পঙ্গু, কোলের শিশু সন্তানটিও আর নেই।তখন জুন মাস চলছে, আম কাঠালের মৌসুম। মাত্র ক’দিন হল সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন আসিয়া বেগম। মিলিটারির ভয়ে আসিয়া বেগমের বৃদ্ধা মা ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে আগেই অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন। বাড়িতে ছিলেন শুধু আসিয়া বেগম আর তাঁর স্বামী।
বেলা ১১টার দিকে নয়জন মিলিটারি আসল তাঁদের বাড়ীতে। সেদিন সকালে আসিয়া বেগমের স্বামী কাজে বেড়িয়ে গেছে। মিলিটারি এসে জিজ্ঞেস করল বাড়ির লোকজন কোথায় গেছে। আসিয়া বেগম তাদের কথা বুঝতে পারেননি তাই উত্তর দেননি। উত্তর না পেয়ে মিলিটারিরা ঘরের ভেতরে ঢুকে আসিয়া বেগমের উপর উপর্যুপরি পাষবিক নির্যাতন চালাতে লাগল। নির্যাতনের এক পর্যায়ে জ্ঞান হারালেন আসিয়া বেগম।কেন এমন ঘটনা ঘটল, পারিবারিক কোন কারণ থাকবার কথা নয়, বাবাতো মারা গেছে আগে, ভাইবোনরাও ছোট, স্বামীও কাজে গিয়েছিলেন। তবুও কেন ৯ জন পাক মিলিটারি মিলে এমন বর্বরভাবে নির্যাতন করল তাঁকে? এর কারণ এখনো খুঁজে পান না আসিয়া বেগম। তবে এটা জানেন যে এর পেছনে ছিল রাজাকারদের হাত।রাজাকারদের যোগসাজসে পাকবাহিনীর পাষবিক নির্যাতনের শিকার শুধু কি একা তিনি? না, পাক মিলিটারিরা তখন এরকম পৈশাচিক ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে বাংলাদেশের সর্বত্র। একই দিনে নির্যাতিত হয়েছে এদেশের বহু নারী তাদের মধ্যে কেউ কেউ মারা গেছেন, কেউ পঙ্গু হয়ে ঘরে পড়ে আছেন। তবে বীরাঙ্গনাদের উপর বর্বরতা কি শেষ হয়ে গেছে দেশ স্বাধীনের পর? না হয়নি। এই স্বাধীন দেশেও কিছু মানুষের নির্মম কটুক্তি সেই আহত হৃদয়ে বারে বারে আঘাত হেনেছে।ঘটনার পরপর গ্রামের মানুষ আসিয়া বেগমকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতাল থেকে পরে তিনি বাড়ি ফিরে যান।
পরে দেশ স্বাধীন হলে যান পুনর্বাসন কেন্দ্রে। এখানে ৩০০ মহিলা ছিল যাদের কেউ নির্যাতিত, কেউবা যুদ্ধে স্বামী হারিয়েছে। বিভিন্ন জন বিভিন্ন ধরনের কাজ করত। আসিয়া বেগম সেলাইয়ের কাজ করতেন। আসিয়া বেগম বলেন, “পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকাকালীন আমরা একটা সাবান পর্যন্ত কিনি নাই, সব কিছুই দিয়েছেন আমাদের শেখ মুজিবর, সে আমাদের মাথায় হাত দিয়ে বলত মা তোমরা বীর যোদ্ধা, আমরা তাঁকে বাবা বলে ডাকতাম।” তাঁর মৃত্যুর পর বন্ধ হয়ে যায় পুনর্বাসন কেন্দ্র। নির্যাতিত নারীরাও তখন যে যার মত বাড়িতে চলে যান। আসিয়া বেগমও ফিরে আসেন তাঁর বাড়িতে। আসিয়া বেগম বলেন, “দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বেশীরভাগ লোকজন তাঁদের সম্পর্কে খারাপ কথা বলত, এখনো বলে, তবে এখন কেউ কেউ তাঁকে সম্মানও করে।” আসিয়া বেগম এখন দুই ছেলের সাথে থাকে। বড় ছেলেটি পঙ্গু তাঁর অবস্থা ভাল না। মানসিক ভারসাম্যহীন ছোট ছেলে। এই ছোট ছেলের চার ছেলে-মেয়ে, বড় ছেলে দশম শ্রেণীতে পড়ে। শ্বশুরের টাকা দিয়ে ছেলে ছয় শতাংশ বাড়ী কিনেছে সেই বাড়িতেই তিনি থাকেন।বীরাঙ্গনা আসিয়া বেগমের বয়স এখন ৭০ বছর। শরীরটাও ভাল না। সারা শরীর অবশ অনুভব করেন তিনি। তাঁর ধারণা তাঁর দুই পায়ের উরুতে গুলি এখনো আছে, হাত দিলে শক্ত লাগে, ঠিক মত হাটতে পারেন না। নিজের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে দুঃখ করে বলেন, “ছেলেরা নিজেরাই খেতে পারে না মাকে কি খাওয়াবে। আজ ছয়দিন ধরে না খেয়ে আছি। এক সের খুদ (ভাঙ্গা চাল) কিনেছিলাম তাই অল্প অল্প করে লবণ দিয়ে সিদ্ধ করে খাই। মাছ-গোশত বছরে একবারও খাওয়া হয় না। জীবনতো চলতে চায়না। কোন মতে বাইচা আছি। বয়স অনেক হইছে। চল্লিশ বছর হয়ে গেল যুদ্ধের। কখনো ঠিকমত কাজ করতে পারিনি। সরকার আমাদের বীরাঙ্গনা খেতাব দিচ্ছে কিন্তু আমাদের বীরের মর্যাদা দেয় নাই। খেতাব দিয়া আমাদের সবার থেকে পৃথক করে দিয়েছে। সবাই বলে আমরা সমাজের কেউ না, আমরা বীরাঙ্গনা।”
যে মানুষগুলোর ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন দেশ আমাদের দুর্ভাগ্য যে তেমনি একজন মা, একজন বীরাঙ্গনা আসিয়া বেগমকে এই স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ‘মিলিটারির বউ’ বলে বিদ্রুপ করে এই দেশেরই অনেক অকৃতজ্ঞ তরুণ। বর্বরতা আর নির্মমতায় এরাও যেন কোন অংশে কম যায় না।এই স্বাধীন দেশে কেমন আছেন এখন আসিয়া বেগম, কি করে চলছে তার? আসিয়া বেগমে ভাষায়, “কিছু সহযোগিতা আমরা পূর্বের মত এখনো পেয়ে যাচ্ছি তবে তা শুধু মায়ের (সাফিনা লোহানী) জন্য, তিনি বিভিন্ন জনের কাছ থেকে চেয়ে এনে আমাদের দেয় বলে। কিছুদিন আগে ডিসি সাহেব আমাদের ৫০০০ টাকা ও একটা করে শাড়ী দিয়েছে। এর বাইরে সরকার আমাদের আর কিছু দেয় না।” আক্ষেপ করে বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়, কিন্তু আমাদের বেলায় যেন শুধু খেতাব দিয়েই সব শেষ হয়ে গেছে, আর কোন দায়িত্ব কি আমাদের প্রতি নেই।”আসিয়া বেগম সরকারের কাছে তাদের নির্যাতনের বিচার চান।
শেষদিনগুলো একটু ভালভাবে খেয়ে পড়ে বাঁচতে চান। তিনি বলেন, “বনের পাখিরও একটি ঠিকানা থাকে। বাসা থাকে কিস্তু আমার তাও নেই। যে ঝুপড়ি ঘরের মধ্যে থাকতাম তাও ঝড়ে উড়ে গেছে এখন আমি থাকব কোথায়, খাব কি, আমি কিছুই জানি না। শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধের ডাক দিয়েছিল। সেই যুদ্ধের পরে আমাদের সে নিজের সন্তান বলে পরিচয় দিয়েছে এখন সে নেই কিন্তু তার মেয়ে আছে আমরা তার কাছে তার বাবার রেখে যাওয়া কাজের বাস্তবায়ন দেখতে চাই। আমাদের বীর বলা হয়। আমরা বীরের মর্যাদা চাই। আর দেশের মানুষের কাছে আমরা একটু ভাল ব্যবহার চাই। আমরা কোন দোষ করি নাই কেউ ইচ্ছা করে নির্যাতিত হয় নাই। আমরা আগে যেমন মর্যাদায় ছিলাম এখনো তেমনি মর্যাদায় থাকতে চাই।”এই দেশের স্বাধীনতার জন্য অসামান্য ত্যাগ যে নারীর, এ দেশের সরকারের কাছে এদেশের মানুষের কাছে এই টুকুও কি তিনি চাইতে পারেন না? যিনি আমাদের জন্য তাঁর সবটুকু দিলেন, কথা ছিল সেই মাকে আমরা বীর বলে মাথায় করে রাখব। আজ এই স্বাধীন দেশে আমরা কি পারব না তাকে অন্তত একজন মানুষের মর্যাদাপূর্ণ জীবন ফিরিয়ে দিতে?
লেখক : সুমনা মঞ্জুর