চতুর্থবার তিনি ভিক্ষে করতে করতে পাকিস্তানীদের টেংরা ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছেন। ঠিক জুম্মার আযানের সময়, রাস্তায় তাঁকে আটকে ফেলল কয়েকজন পাকিস্তানী সৈন্য। সৈন্যরা প্রথমে তাঁর সঙ্গে যে মুক্তিবাহিনীর যোগাযোগ আছে সেটা স্বীকার করানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাঁর এক কথা, ‘আমি আমার স্বামী আব্দুল মজিদ খানের খোঁজে ক্যাম্পে যাই।’
এরপরই শুরু হয় তাঁর উপর প্রচন্ড শারীরিক নির্যাতন। নির্যাতনের এক পর্যায়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। মাথায় পানি ঢেলে তাঁকে সুস্থ করার পর আবার শুরু হয় অত্যাচার। কিন্তু তিনি কিছুতেই সত্য বলবেন না, আর পাকিস্তানীরাও তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে ছাড়বে। গাছের সাথে বেঁধে ফেলে নিষ্ঠুরভাবে পিটাতে শুরু করলো তাঁকে। সমস্ত শরীর দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়ছে। এইভাবে দীর্ঘক্ষণ প্রচন্ড অত্যাচারের মুখে তাঁর শরীর একেবারে ভেঙে পড়ে। আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। এক পর্যায়ে পাকহানাদাররা মোটা লোহার শিক গরম করে তাঁর উরু দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। এই বীভত্স নির্যাতনের পরও তাঁর মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে পারেনি পাকিস্তানী সৈন্যরা।
পাকিস্তানীদের নিষ্ঠুর অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করা এই নারীটি হচ্ছে কাঁকন বিবি। ইতিহাস যাঁকে চেনে বীরাঙ্গণা কাঁকন বিবি নামে। শত অত্যাচার করেও পাকিস্তানী সৈন্যরা যাঁর মুখ থেকে বের করতে পারেনি, তিনি মুক্তিবাহিনীর ‘ইনফরমার’। তিনি তাদেরকে বলেননি ভিক্ষুকের বেশ ধরে জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানীদের ক্যাম্পে যেয়ে মুক্তিবাহিনীর জন্য খবর বয়ে আনেন তিনি। কারণ তিনি জানেন এই সত্য কথাটি হায়েনার দল জেনে গেলে তা দেশের জন্য, দেশের মুক্তিবাহিনীর জন্য চরম অমঙ্গল হবে। কিন্তু তিনি তো দেশের অমঙ্গল হতে দিবেন না। আর তাই তো জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে পাকবাহিনীর নির্মম অত্যাচারের মুখে তিনি চুপ করে ছিলেন।
কাঁকন বিবির জন্ম কোন সালে বা কোন তারিখে তা তিনি জানেন না। তাঁর ভাষ্যমতে তিনি এখন (২০০৯) আশি বছরের বৃদ্ধা। জন্মেছিলেন বৃটিশ ভারতের মিজোরাম প্রদেশে। এক খাসিয়া পরিবারে। বাবা গিসয়। তিনি জুমচাষের সাথেই আজীবন জড়িত ছিলেন। মা মেলি। তিনি স্বামীকে জুমচাষে সহযোগিতা করতেন এবং গৃহ সামলাতেন। গিসয়-মেলি দম্পতির ছিল ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে। বড় ছেলে উহর, মেঝ ছেলে উসাল, ছোট ছেলে উফান। আর বড় মেয়ে কাফল, সবার ছোট মেয়ে কাঁতেক নিয়তা বা কাঁকন বিবি। পরিবারটি ছিল খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী।
কাঁকন বিবির বয়স যখন ছয় মাস তখন এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে তাঁর বাবা গিসয় মৃত্যুবরণ করেন। বাবার মৃত্যুর মাস ছ’য়েকের মাথায় চিরবিদায় নেন মা মেলিও। অভাবের সংসারে এই পাঁচটি এতিম সন্তান একেবারেই অসহায় হয়ে পড়ে তখন। গিসয়’র জমি-জিরাত বলতে তেমন কিছুই ছিল না। ফলে অল্প বয়েসি ভাইদের উপার্জনের জন্য কাজে লাগতে হয়। তাঁদের আর খুব বেশি পড়াশুনা করা সম্ভব হয়নি। তবে খাসিয়ারা যেহেতু একটি গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন যাপন করে সেহেতু প্রতিবেশীদের কেউ কেউ তখন পরিবারটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। গিসয়’র অন্য ভাইবোনদের অবস্থাও তেমন সচ্ছল ছিল না যে তাঁরা এতিম সন্তানদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেবে।
কাঁকন বিবিদের গ্রাম ছিল ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের খুবই কাছে। গ্রামের নাম নক্রাই। সেটি চেলা বাজার থেকে মাইল ছ’য়েকের পথ। কাঁকন বিবির ভাইদের পরিবার এখনো সেখানেই থাকে। তাঁদের কেউ কেউ মাঝেমধ্যে কাঁকন বিবিকে দেখার জন্য এদেশে আসেন। দু’ভাই ও একবোন গত হয়েছেন। এক ভাই জীবিত। তিনিই আসেন।
কাঁকন বিবির বয়স যখন ৮/৯ মাস তখনই তাঁর বড় বোন কাফলের বিয়ে হয়ে যায় এক বাঙালী মুসলমানের সাথে। তাঁর নাম খুশি কমান্ডার। মূলত তিনি বৃটিশ আমলে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীতে চাকরি করতেন। এ কারণেই লোকে তাঁকে কমান্ডার বলত। খুশি কমান্ডারের বাড়ি ছিল সিলেট জেলার কাঁঠালবাড়ি গ্রামে। খুশি কমান্ডার কাফলকে বিয়ে করার পর নিজের গ্রামেই ফিরে আসেন। তাঁদের বেশ জমি-জমা ছিল। স্থানীয়ভাবে তাঁরা ছিলেন অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ।
মা মারা যাবার পর দুগ্ধ শিশু কাঁকন বিবিকে দেখাশোনা করতেন তাঁর বড় বোন কাফল। কিন্তু তাঁর বিয়ের পর কাঁকন বিবিকে দেখাশোনা করার আর কেউ রইল না। অবশেষে কাফলই তাঁর স্বামীর সহযোগিতায় কাঁকন বিবিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে সন্তানের মতো মানুষ করতে থাকেন। খুশি কমান্ডার ছিলেন গোঁড়ামিমুক্ত একজন উদার প্রকৃতির মানুষ।
খুশি কমান্ডারের গৃহস্থ পরিবারেই কাঁকন বিবির বেড়ে উঠা। মা বলতে তিনি বোঝেন বড় বোন কাফলকে আর বাবা বলতে বোঝেন খুশি কমান্ডারকে। খুশি কমান্ডারের পরিবারের অন্য সদস্যরা এতিম এই শিশুটিকে অপাত্য স্নেহেই বড় করে তোলেন। কাঁকন বিবি তাঁর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পর এদেশকেই নিজের দেশ বলে জেনে এসেছেন। তিনি নিরক্ষর। স্কুল কী জিনিস তা তাঁর বাল্যকালে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। খুশি কমান্ডারের পরিবারেই তিনি নানা কাজকর্ম করতেন। তবে সেটা বাধ্যতামূলক ছিল না। কিন্তু কোনো কাজ ছিল না বলেই তিনি পরিবারের অন্য মহিলাদের নানা কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। এভাবেই প্রায় ত্রিশ বছর কাঁকন বিবির এ পরিবারে কাটে। পাকিস্তান আমলে মুসলিম পরিবারে বেড়ে ওঠা একটি বিবাহযোগ্য মেয়ের জন্য এই বয়স অনেক বেশি।
কাঁঠালবাগান গ্রামটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছে। গ্রাম থেকে একটু দূরেই ছিল পাকিস্তান সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ক্যাম্প। সেই ক্যাম্পে সৈনিক হিসাবে কাজ করত পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের আব্দুল মজিদ খান। দেখতে বেশ লম্বা-চওড়া। খুশি কমান্ডারের সাথে মজিদ খানের বেশ চেনা-জানা ছিল, বাড়িতেও আসতেন মাঝেমধ্যে। খুশি কমান্ডারই একসময় আবদুল মজিদ খানের সাথে কাঁকন বিবির বিয়ের ব্যবস্থা পাকা করেন। পারিবারিকভাবেই সে বিয়ে সম্পন্ন হয়। কাঁকন বিবির সেই বিয়ের সাল বা তারিখ কোনোটাই মনে নেই। তবে তিনি জানান, সময়টা সংগ্রামের ১২/১৩ বছর আগে। সেই অনুযায়ী ১৯৫৮/৫৯ সাল হতে পারে।
বিয়ে হওয়ার পর কাঁকন বিবি ভগ্নিপতির বাড়ি ছেড়ে স্বামীর সঙ্গে কর্মস্থল বোগলা ক্যাম্পে এসে ওঠেন। সেখানেই নতুন করে সংসার শুরু করেন। কাঁকন বিবি স্মরণ করতে পারেন এই বোগলা ক্যাম্পে তিনি প্রায় পাঁচ বছর ছিলেন। আব্দুল মজিদ খান বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে বদলিও হতেন। কাঁকন বিবিকেও তিনি সাথে নিয়ে যেতেন তখন। সে সময় কাঁকন বিবি সুনামগঞ্জে প্রায় ছয় মাস, সিলেটে প্রায় ৭ মাস এবং ছাতকেও কিছুদিন স্বামীর সাথে কাটান। বিবাহিত জীবনের দীর্ঘ আট বছরে তাঁদের ঘরে তিনটি সন্তান জন্ম নেয়। কিন্তু জন্মের পরপরই তারা মৃত্যুবরণ করে। খুব সম্ভবত এ কারণেই আব্দুল মজিদ খান সিলেট আকালিয়া ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় কাঁকন বিবিকে পরিত্যাগ করেন। হঠাত্ করেই আব্দুল মজিদ খান উধাও হয়ে যান। কাঁকন বিবি একা হয়ে পড়েন। স্বামীর খোঁজে তিনি ক্যাম্পের অন্যান্য সৈনিকদের কাছে অভিযোগ করেন, অফিসে গিয়েও নালিশ করেন। কিন্তু সকলেই তাঁকে অসহযোগিতা করে। শেষ পর্যন্ত স্বামীর কোনো খোঁজ-খবর করতে না পেরে কাঁকন বিবি আবার তাঁর ভগ্নিপতি ও বোনের সংসারে ফিরে আসেন। এরপর আর কোনোদিন আব্দুল মজিদ খানের সাথে তাঁর দেখা হয়নি। মজিদ খানও তাঁর কোনো খোঁজ-খবর নেয়নি। তবে তাঁর সাথে আর কোনোদিন দেখা না হলেও এই মজিদ খানের কারণেই কাঁকন বিবি একবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন।
স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে পুনরায় কাঁঠালবাড়িতে ফিরে আসায় পরিবারের অনেকেই মনক্ষুন্ন হন। বিচলিত হন ভগ্নিপতি খুশি কমান্ডারও। কিন্তু তিনি যেহেতু কাঁকন বিবিকে তাঁর অন্য চার সন্তানের মতোই বড় করে তুলেছেন সে কারণে খুব বেশি ক্ষুব্ধও হতে পারলেন না। চেষ্টা করতে লাগলেন আবার তাঁকে বিয়ে দেয়া যায় কি না। এই অবস্থায় কাঁকন বিবি প্রায় বছর দেড়েক ভগ্নিপতির সংসারেই থাকলেন। শেষ পর্যন্ত খুশি কমান্ডারই প্রতিবেশী শাহেদ আলীর সাথে কাঁকন বিবির পুনরায় বিয়ে দেন। শাহেদ আলী ছিলেন ছোটখাটো কৃষক। তাঁর আগেও সংসার ছিল কিন্তু সেই সংসারে কোনো সন্তান ছিল না। মূলত সন্তানের আশাতেই তিনি কাঁকন বিবিকে বিয়ে করেন। শাহেদ আলীর সাথে কাঁকন বিবির সংসার টিকেছিল দুই বছর। এরমধ্যেই কাঁকন বিবির গর্ভে জন্ম নেয় এক কন্যা সন্তান। নাম সখিনা বিবি। সন্তানের জন্মের সাল বা তারিখ মা-মেয়ের কেউই জানেন না। তবে কাঁকন বিবির দেয়া তথ্য মতে, সংগ্রামের সময় সখিনা বুকের দুধ খায়; সাত মাসের শিশু।
এর মধ্যেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। সুনামগঞ্জ-সিলেট অঞ্চলটি ছিল পাঁচ নম্বর সেক্টরের অধীন। এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল মীর শওকত আলী। কাঁকন বিবি যে গ্রামে থাকতেন তার পাশেই মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। আবার এই ক্যাম্প থেকে খানিকটা দূরেই ছিল পাকিস্তানীদের ক্যাম্প। যা স্থানীয়ভাবে টেংরা ক্যাম্প নামে পরিচিত। মুক্তিবাহিনীর যে ক্যাম্প ছিল তার কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন শহীদ মিয়া। মীর শওকত আলী একদিন এই ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন। তিনিই মূলত কাঁকন বিবিকে পাকিস্তানীদের ক্যাম্প থেকে খবর সংগ্রহের কাজে লাগানোর জন্য উত্সাহিত করেন। কাঁকন বিবির সাথে সাক্ষাত্ করে তিনি তাঁকে কাজের গুরুত্বও বুঝিয়ে বলেন। কাঁকন বিবির স্বামী যেহেতু আগে পাকিস্তানী ক্যাম্পে কাজ করত সুতরাং তাঁর পক্ষেই সম্ভব সেখানকার খবরাখবর এনে মুক্তিবাহিনীর কাছে প্রেরণ করা। কাঁকন বিবিও উত্সাহ নিয়ে দেশের জন্য কিছু একটা করতে পারবেন এই ভেবে রাজি হয়ে যান।
ইতিমধ্যে তাঁর ভগ্নিপতি খুশি কমান্ডারকে পাকিস্তানীরা হত্যা করে ফেলে। পিতার মতো স্নেহ দিয়ে যে লোকটি তাঁকে বড় করে তুলেছিল, যে ছিল তাঁর সুখ-দুঃখের সাথি সেই খুশি কমান্ডারকে একদিন পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে যায়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ভারত থেকে যেসব মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশে আসে তাঁদেরকে তিনি সহযোগিতা করেন। স্থানীয় রাজাকাররাই পাকিস্তানী ক্যাম্পে গিয়ে এই তথ্য জানায়। খুশী কমান্ডারকে পরে হত্যা করে পাকহানাদার বাহিনী। এই ঘটনায় কাঁকন বিবি খুবই কষ্ট পান। প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেন। নিজের জীবনকেও তখন তাঁর কাছে একেবারে তুচ্ছ মনে হয়। তিনি ভাবতে থাকেন কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করা যায়, কীভাবে এদেশ থেকে পাকহানাদার বাহিনীকে হটানো যায়।
কাঁকন বিবি মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত হন একজন ‘ইনফরমার’ হিসাবে। যাঁর কাজ ছিল পাকিস্তানী ক্যাম্পে ঢুকে তাদের হাতিয়ারের ধরন, সংখ্যা ও সৈনিকদের অবস্থান সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করা। স্বামী শাহেদ আলী তাঁর এই কাজে বাধা দিলেও তিনি তা উপেক্ষা করেন। সেই কঠিন দায়িত্ব পালন করার জন্য তিনি কয়েক দিন সময় নেন। চিন্তা করেন। পরে নিজেই বুদ্ধি খাটিয়ে একটি ময়লা ও ছেঁড়া কাপড় পরে একদিন দিনের বেলায় ভিক্ষা করতে করতে রওনা দেন টেংরা ক্যাম্পের দিকে। এলাকার লোকজনদের অনেকেই তখন শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে গেছে। ফলে তাঁকে খুব বেশি কেউ চিনতেও পারল না। প্রথমে টেংরা ক্যাম্পের বাইরে কয়েকটি বাড়িতে ভিক্ষা করেন। পরে কৌশলে এক সময় ঢুকে পড়েন টেংরা ক্যাম্পের ভিতর। ভিক্ষা চান পাকিস্তানী মিলিটারিদের কাছেই। তারা কিছু ময়দা ও আটা ভিক্ষা দেয়। ভিক্ষা করার পাশাপাশি মিলিটারিদের কাছে তাঁর প্রথম স্বামী আব্দুল মজিদ খানের খোঁজও করেন। নানা কায়দায় কিছুক্ষণ ক্যাম্পের ভেতর অবস্থান করে সবকিছু দেখার চেষ্টা করেন এবং প্রথম দিন তিনি খুব ভালভাবেই তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। টেংরা ক্যাম্পে তিনি যা দেখেছেন তা সবই এসে জানান কোম্পানি কমান্ডার শহিদ মিয়াকে। মুক্তিবাহিনী তখন সেই মোতাবেক তাঁদের অপারেশন চালায় এবং এতে তাঁরা সফলও হয়।
দ্বিতীয় দিনও কাঁকন বিবি একই কায়দায় টেংরা ক্যাম্পে প্রবেশ করেন। তখন ক্যাম্পের একটি ঘরে কয়েকজন মেয়েকেও দেখতে পান। মেয়েরা ছিল ক্লান্ত এবং বিপর্যস্ত। কাঁকন বিবির বুঝতে বাকি থাকল না এদেরকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে এবং শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। দ্বিতীয় দিন তিনি যখন মিলিটারির কাছে তাঁর স্বামীর খবর জানতে চান তখনই তাঁকে আটক করে ফেলা হয়। কয়েকজন পাক হানাদার বাহিনীর সদস্য মিলে চালায় শারীরিক নির্যাতন। কিন্তু তখনো পর্যন্ত কাঁকন বিবি একজন ‘ইনফরমার’ এটা তারা ভাবতে পারেনি। নির্যাতন শেষে তারা কাঁকন বিবিকে ছেড়ে দেয়। অত্যাচারের মুখেও কাঁকন বিবি ঠিকই সেদিন সমস্ত তথ্য এনে কোম্পানি কমান্ডারকে জানান। তিনি কমান্ডারকে বুঝতে দেননি তাঁর উপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পশুরা।
এই ঘটনার পর অবশ্য কাঁকন বিবি বেশ কিছুদিন আর টেংরা ক্যাম্পে যাননি। টেংরা ক্যাম্পে ‘ইনফরমার’ হিসাবে কাজ করেছেন কাঁকন বিবি, এই খবর জানামাত্রই দ্বিতীয় স্বামী শাহেদ আলী রেগে আগুন হয়ে গেলেন। তিনি তাঁকে প্রচণ্ড মারধর করলেন। এক পর্যায়ে তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন ‘নষ্টা মেয়ে’ বলে। একমাত্র মেয়ে সখিনা বিবিকে শাহেদ আলী নিজের কাছেই রেখে দিলেন। কাঁকন বিবি এখন একেবারেই গৃহহীন, সহায়-সম্বলহীন। কোথাও যাওয়ার তাঁর কোনো জায়গা রইল না। দ্বিতীয়বারের মতো ভেঙে গেল তাঁর সংসার। শাহেদ আলী যুদ্ধের বাজারেই আবার বিয়ে করলেন।
এই দুঃসময়েও কাঁকন বিবি ‘ইনফরমার’ হিসেবে কাজ করার জন্য যান সুনামগঞ্জে অবস্থিত পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে। সেখান থেকে যান সিলেট ক্যাম্পে। পরে যান গোবিন্দগঞ্জ, জাউয়া বাজার ক্যাম্পে। সব জায়গাতেই তাঁর একই কাজ। ক্যাম্পের অবস্থান, সৈন্য সংখ্যা, হাতিয়ার ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা নিয়ে আসা। যেতেন সেই ভিক্ষা করার বেশেই। পাকিস্তানী সৈন্যদের কাছে খোঁজ করতেন নিজের প্রথম স্বামীর। কিন্তু যুদ্ধের বাজারে কে রাখে কার খবর! বরং পাকিস্তানী সৈন্যরা কাঁকন বিবিকে আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতনই চালাত। এতকিছুর পরেও কাঁকন বিবি কিন্তু নিজের কাজ সম্পর্কে ছিলেন পূর্ণ মাত্রায় সচেতন। কারণ তাঁর দেয়া তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনে জয়ের ব্যাপারে মূল ভূমিকা পালন করত। এভাবে অবশ্য তিনি আরো দুই-তিনটি ক্যাম্পে যান।
বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে কাজ শেষ করে কাঁকন বিবি আবার নিজের গ্রাম কাঁঠালবাড়িতেই ফিরে আসেন। দীর্ঘদিন পর কোম্পানি কমান্ডার শহিদ মিয়ার নির্দেশে তৃতীয়বারের মতো তিনি আবার যান টেংরা ক্যাম্পে। তৃতীয়বারও নানা নির্যাতনের মুখে পড়েন। টেংরা ক্যাম্পে তখন আরও অনেক বাঙালী মেয়েকেই বন্দি করে রেখেছে পাক হানাদার বাহিনী।
কাঁকন বিবি ক্যাম্প থেকে খবর সংগ্রহ করে মুক্তিবাহিনীর কাছে প্রেরণ করছেন তা স্থানীয় কয়েকজন রাজাকার সন্দেহ করে। তবে তারা এ ব্যাপারে খুব বেশি নিশ্চিত ছিল না। তবু ওইসব রাজাকাররা পাকিস্তানী ক্যাম্পে গিয়ে অফিসারদের কাছে তাদের সেই সন্দেহের কথা জানায়। তাঁর ভগ্নিপতি খুশি কমান্ডার যে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ছিল এবং তাঁকে যে এ কারণে হত্যা করা হয়েছে সে কথাও জানায়। এরপর পাকিস্তানী সৈন্যরা তাঁকে ধরে নিয়ে যেয়ে অকথ্য নির্যাতন চালায়। যে নির্যাতনের বর্ণনা শুরুতেই বলা হয়েছে। কাঁকন বিবিকে নির্যাতনের এক পর্যায়ে পাকবাহিনীর বড় অফিসার এল সেখানে, সে এসে দেখে কাঁকন বিবি অজ্ঞান। অফিসার ডাক্তার ডাকালেন। ডাক্তার এসে ইনজেকশান দিয়ে কাঁকন বিবির জ্ঞান ফেরাল। তারপর তাঁকে কিছু খাবারও দেয়া হলো। কিন্তু কাঁকন বিবির আর খাবার মতো সামর্থও ছিল না। উরুতে যে গরম লোহার শিক ঢোকানো হয়েছে তার যন্ত্রণায় তিনি সবকিছু অন্ধকার দেখছেন। এর মধ্যেই অফিসার তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কেন ক্যাম্পে যাও?’ কাঁকন বিবি অস্ফুট স্বরে উত্তর দিলেন, ‘স্বামীর খোঁজে।’ অফিসার আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কে তোমার স্বামী?’ কাঁকন বিবি বললেন, আব্দুল মজিদ খান।’ অফিসার বলল, ‘সে কোথায় থাকে?’ কাঁকন বিবি বললেন, ‘সিলেটে।’ ব্যস, এটুকুই। আর কিছু বলতে পারেননি কাঁকন বিবি। আবার তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
অফিসার তখন ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে সিলেটে ওয়ারলেস করল। সেখানে সত্যিকার অর্থেই আব্দুল মজিদ খান নামে কোনো সৈনিক আছে কি না তা জানার জন্য। আব্দুল মজিদ খান তখন সিলেটেই ছিলেন। কিন্তু তিনি ক্যাম্পের বাইরে ছিলেন। মজিদ খান ক্যাম্পে ফিরে আসার সাথে সাথেই অফিসার তার সাথে কথা বলে। অফিসার মজিদ খানের কাছে জানতে চায়, কাঁঠালবাড়িতে তার কোনো স্ত্রী আছে কি না? মজিদ খান স্বীকার করে যে, কাঁকন বিবি নামে তার স্ত্রী কাঁঠালবাড়িতে থাকেন এবং সে খাসিয়া উপজাতি। অফিসার মজিদ খানের কাছ থেকে এই তথ্য পাওয়ার পর কাঁকন বিবিকে পাক হানাদাররা আর কোনো অত্যাচার করেনি এবং তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু ছেড়ে দিলেও কাঁকন বিবির অবস্থা সঙ্গীন। তাঁর যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। তাঁকে নেয়ারও কেউ নেই। তিনি রাস্তাতেই এই অসুস্থ শরীর নিয়ে পড়ে রইলেন। পরে অবশ্য লোকজন তাঁকে ধরাধরি করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।
এরপর মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টিই কাঁকন বিবির কেটেছে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি আর কোনো কাজকর্ম করতে পারেননি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য কাঁকন বিবিকে ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দেয়া হলো।
স্বাধীন দেশে সবাই নিজের মতো করে আবার জায়গা করে নিল। কিন্তু বীরাঙ্গনা কাঁকন বিবির কোথাও জায়গা হলো না। অবশেষে কাঁকন বিবি একদিন নিজেই ঢাকায় চলে এলেন। এর-ওর কাছে জিজ্ঞেস করে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি খুঁজে বের করেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর কথাও হয়। একজন বীরাঙ্গনাকে বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের পরিবারেই আশ্রয় দেন। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সাথে বেশ কিছুদিন ছিলেন কাঁকন বিবি। পরে ‘৭৫-এর শুরুর দিকে আবার চলে যান নিজের গ্রামেই। বঙ্গবন্ধুর আপত্তি সত্ত্বেও তিনি নিজ গ্রামেই ফিরে যান। নিজ গ্রামে বসেই মুজিব হত্যার খবর পান। কাঁকন বিবির বুকটা ভেঙে যায়।
‘৭৫-এর পর থেকে প্রায় ২২ বছর কাঁকন বিবির কেটেছে স্থানীয় বাংলাবাজারের পাশে একটি ছোট্ট কুঁড়েঘরে। এই সময়ে তিনি কিছুটা অপ্রকৃতিস্থও ছিলেন কিছুদিন। মানুষের দেয়া খাবারই ছিল তাঁর সম্বল। নিজে কিছুই করতে পারতেন না। পরে অবশ্য স্থানীয় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা উদ্যোগ নিয়ে তাঁকে চিকিত্সা করান, ভরণ-পোষণেরও দায়িত্ব নেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর কাঁকন বিবিকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায় কিছু লেখালেখি হয়। তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁকে সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করেন। শেখ হাসিনাও কাঁকন বিবির সঙ্গে দেখা করে তাঁকে বাসস্থানের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন। তখন বিভিন্ন সংগঠন এগিয়ে আসে কাঁকন বিবিকে জাতীয়ভাবে তুলে ধরার জন্য। জনকন্ঠসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা তাঁকে সংবর্ধনা দেয়। কেউ কেউ কিছু মাসিক ভাতারও ব্যবস্থা করেন। এসব নিয়ে কাঁকন বিবি ও তাঁর মেয়ের পরিবার বেশ ভালোই চলে যাচ্ছিল। কিন্তু ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর জনকন্ঠসহ সকলেই নিয়মিত মাসোহারা বন্ধ করে দেন। একমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ মাসিক নয়শো টাকাই এখন পান কাঁকন বিবি। তাও ছয় মাস অন্তর অন্তর।
কাঁঠালবাড়ি, সীমান্তবর্তী একটা গ্রাম্য বাজার। তার থেকে হাঁটা পথে মিনিট দশেক। জিরার গাঁও। সেখানেই সরকারি খাস জমির ৭০ শতাংশের উপর বর্তমানে ঘর করে আছেন কাঁকন বিবি। স্থানীয় বাঙালীদের কাছে তিনি ‘খাসিয়া বিটি’। দ্বিতীয় স্বামী মারা যাওয়ার পর একমাত্র মেয়ে তাঁর কাছে ফিরে আসে। মা-মেয়ের এই সংসারে অভাব চতুর্দিক থেকে গ্রাস করে ফেলেছে। এখন কাঁকন বিবি বয়সের ভারে নু্জ্ব। স্থানীয় বাংলাবাজারে তাঁকে ডাক্তার দেখিয়েছেন তাঁর মেয়ে। কিন্তু অবস্থা দিন দিনই বেগতিক। এভাবে আর কতদিন অবহেলা নিয়ে বেঁচে থাকবেন কাঁকন বিবি? যাঁদের জন্য এই স্বাধীন দেশ, স্বাধীন পতাকা তাঁদের প্রকৃত মুল্যায়ন কি কোনোদিনই হবে না? কাঁকন বিবির এখন শেষ ইচ্ছা তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একবার দেখা করতে চান। তাঁর এই ইচ্ছা কি পূরণ হবে?
২০১৮ সালের ২১ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র: লেখাটি তৈরি করার জন্য কাঁকন বিবি ও তাঁর মেয়ের সাক্ষাত্কার নেয়া হয়েছে।
লেখক: চন্দন সাহা রায়