বীরাঙ্গনা করিমনের গ্রামের বাড়ি ছিল সিরাজগঞ্জ জেলার তেতুলিয়া গ্রামে। বাবার নাম ছিল আজম আলী, মায়ের নাম জেলেমন। বাবা খড়ি বিক্রি করতেন, তাছাড়া বাড়িতে গরুও পালতেন। করিমনরা ছিলেন অনেকগুলো ভাই- বোন কিন্তু সকলেই ছোট ছিল বলে কিছুই করতো না। তবুও সবমিলে সংসার মোটামুটি চলত। ভাই বোনদের সাথে হাসি আনন্দেই শিশুকাল কাটিয়েছেন তিনি। ভাইবোনের অনেকেই ছোটবেলায়ই মারা গেছেন। বেঁচে ছিলেন শেষ পর্যন্ত কেবল দুই ভাই তিন বোন। বর্তমানে শুধু এক ভাই জীবিত আছেন।
যুদ্ধের বছর খানেক আগে করিমনের বিয়ে হয় কান্দাপাড়া গ্রামের বিড়ি বিক্রেতা খোকসেদের সাথে। স্বামী বিড়ি বানিয়ে বিক্রি করতেন, করিমন স্বামীকে সাহায্য করতেন তাঁর কাজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সিরাজগঞ্জে যখন মিলিটারি আসে তখন করিমন কান্দাপাড়ায় তাঁর স্বামীর সাথে ছিলেন। সেখান থেকে একমাত্র ছেলে কোলে করেই বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়িয়েছেন পাক মিলিটারীদের ভয়ে । কান্দাপাড়া থেকে প্রথমে চড়িয়া পাড়া, পরে সেখান থেকে আবার গিয়েছেন তেতুলিয়া। তারপর কিছুদিন পরে মুলিবাড়ি গিয়ে থেকেছেন, এরপর মুলিবাড়ী থেকে কান্দাপাড়া স্বামীর বাড়ী এসেছেন।
মে মাসের শেষের দিক অথবা জুন মাসের প্রথম দিকে হবে। করিমন তখন কান্দাপাড়ায়। একদিন স্বামী বাড়ীর বাইরে গেছেন। বাড়ীতে করিমন একা। তখন সকাল ১০টা, মাত্র কোলের শিশুটাকে শুইয়ে রেখে, রুটি বানাতে বসেছেন, এর মধ্যে বাড়িতে ঢুকে পরলো তিন জন মিলিটারী। একজন করিমনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকল, অন্য দুজন ঘরের ভেতর ঢুকে পরল। আঁৎকে উঠলেন করিমন, ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঢুকেনি তো ঘরে? এক ছুটে ঘরে ঢুকে করিমন দুহাতে কোলে তুলে নিল সন্তানকে। কিন্তু মিলিটারিরা ছিনিয়ে নিল শিশুটিকে তার মা’র কাছ থেকে, ছুড়ে দিল বিছানায়। তারপর দু’জনে মিলে অবুঝ শিশুর সামনেই তার মায়ের ওপর চালাল পাষবিক নির্যাতন। তারপর করিমনকে মাটিতে ফেলে রেখে বাইরে দাড়ানো মিলিটারিকে সঙ্গে করে তিনজনে ব্যারাকে ফিরে গেল। মিলিটারিরা চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ মেঝেতেই পরে থাকলেন করিমন। যন্ত্রণায় উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না তিনি। পরে অনেক কষ্টে খাটে উঠে আদরের ছেলেকে কোলে তুলে বসে থাকলেন স্বামীর অপেক্ষায়। তখনও ঘটনার আঘাতে কিংকর্তব্য বিমূঢ় তিনি। বেশ অনেকক্ষণ পর স্বামী ফিরলেন, স্বামীকে কাছে পেয়ে বাধ ভেঙ্গে গেল তাঁর, সব কথা খুলে বললেন করিমন। প্রিয় স্ত্রী সন্তানদের উপর পাক-মিলিটারির এই নিদারুণ অত্যাচারের কাহিনী মেনে নিতে পারলেন না তিনি। ক্ষোভে দুঃখে পাগল হয়ে গেলেন খোকসেদ। কিন্তু শুধু কি পাক-মিলিটারি, নির্মমতায় যেন কোন অংশে কম যায় না খোকসেদের প্রতিবেশীরা। করিমন তখনও বাস করছেন স্বামীর সাথে, এদিকে প্রতিদিন চলছে প্রতিবেশীদের বাক্যবাণ, কটুক্তি। মানুষের এসব কটু কথা তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল খোকসেদকে। অকালে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন তিনি।কয়েক মুহুর্তের বিভৎসতা যেন লন্ডভন্ড করে দিল একটি সাজানো সংসার। কিন্তু কি দোষ ছিল তাঁর। কেন মিলিটিরিরা তাঁর সাথে এমন নৃশংস ঘটনা ঘটাল, কি যুক্তি থাকতে পারে এর পেছনে ,জানেন না করিমন। একই দিনে তাঁর চাচী শ্বাশুড়ী নির্যাতিত হন, সে দিন তিনি সন্তান প্রসব করেছেন মাত্র, তবুও রেহাই পাননি মিলিটারিদের হাত থেকে। পাষবিক নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।দেশ স্বাধীনের পর স্বামী হারা নির্যাতিত মহিলা হিসেবে বীরাঙ্গনা করিমন পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি হন। সেখানে ৩০০ মহিলা ছিল, একেক জন একেক কাজ করত। বীরাঙ্গনা করিমন করতেন সুতার কাজ। সারাদিন কাজ করে বিকেলে বাড়ীতে ফিরতেন। বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায় পুনর্বাসন কেন্দ্র। স্বামীর বাড়ীতেই থাকতেন তিনি, কিন্তু একা বাড়িতে বাচ্চাকে নিয়ে থাকা অসুবিধা তাই তিনি শিশু সন্তানকে নিয়ে সেই সময় বাবার বাড়ী তেতুলিয়া গিয়ে ওঠেন। সেখানে থেকে তিনি কাজ করে খেতেন।বর্তমানে বীরাঙ্গনা করিমনের ছেলের সাথে থাকে অন্য মানুষের বাড়িতে। তাঁর বয়স এখন ৫৭/৫৮ হবে, তাই আগের মত ঠিক করে কাজ করতে পারেন না। কিছুদিন আগে তিনি গাছের গুঁড়ির ওপর পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছেন। এছাড়া কিডনির সমস্যায় ভুগছেন কিন্তু টাকার অভাবে চিকিৎসাও করাতে পারছেন না। তাঁর সংসার ভাল চলে না। করিমন দুঃখ করে বলেন, “ছেলেরা ঠিক মত কাজ করতে পারে না। তারাই তাদের বাচ্চা-কাচ্চা নিয়া ঠিক মত চলতে পারে না আমাকে আর কি খাওয়াবে। তাছাড়া এখনকার ছেলেরা ঠিক মত বাবা-মাকে দেখে না। অন্যের কাজ করি, পাটি বুনি এটা ওটা করে খাই।”বীরাঙ্গনা খেতাব কি দিয়েছে করিমনকে বীরের মর্যাদা? বীরাঙ্গনা করিমনের থেকে জানা যায় যে সরকার বীরাঙ্গনা খেতাব দেয়ার কারণে যেটুকু উপকার হয়েছে তা হল, মাঝে মাঝে এই সুবাদে কিছু সাহায্য পান তিনি, যেমন কিছু দিন আগে ডি.সি. অফিস থেকে পেয়েছেন কম্বল, একটা চাদর আর একটা কাপড়। সিরাজগঞ্জ উত্তরণ মহিলা সংস্থা থেকে কাপড় দিয়েছে, তাছাড়া একবার পাঁচশত টাকা, একবার দুইশত টাকা, একবার পনেরশো টাকা দিচ্ছে।কিন্তু স্বাধীন দেশ কি তাঁদের দিয়েছে যথার্থ সম্মান। সরকার পরিচয়ে যদি তাঁরা বীর হয় তবে, এই কি বীরদের জীবন? করিমন দুঃখ করে বলেন, “উল্টো যেটা হয়েছে তা হল বীরাঙ্গনা খেতাব দেয়ায় এবং পত্র-পত্রিকায় প্রচার হওয়ার ফলে এখন তরুণ সমাজ তাঁদের চিনে গেছে। আগে তাঁদের কেউ চিনত না তাই কেউ খারাপ কথাও বলত না। খেতাব দেয়ার ফলে তারা সমাজ থেকে আলাদা হয়ে গেছে। সবাই এখন তাদের খারাপ চোখে দেখে, গালি দেয়, মিলিটারীরা কি করেছে তার বর্ণনা দিয়ে উত্তক্ত করে। বীরাঙ্গনা বলে উপহাস করে।”স্বাধীনতার জন্য এই বিশাল আত্মদান যাঁদের, বীরের সম্মানতো দূরের কথা একজন মানুষের মর্যাদাটুকুও কি আমরা তাঁদের দেখাতে পেরেছি। অথচ স্বাধীন দেশের জন্ম যন্ত্রণাটুকু নিজের ভাগে রেখে স্বাধীনতার সুফলটুকু আমাদের দিয়ে নিজের জন্য কি চেয়েছিল করিমন? থাকার জন্য সামান্য একটু আশ্রয়, মানুষের কাছে একটু ভাল ব্যবহার, সমাজের সকলের সাথে মিশে থাকার অধিকার। আর ন্যায় বিচার। এইটুকুও কি আমরা দিতে পারিনা এই বীর যোদ্ধাকে?লেখক : সুমনা মঞ্জুর