জীবন বহতা নদীর মতন। এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এক সংসার থেকে আরেক সংসারে, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে চলে। মূল স্রোত থেকে হারিয়ে গেলেও রেখা তাকে বাঁচিয়ে রাখে। জীবন তাকে বয়ে বেড়াতে হয়। যেমন ঘটেছে বীরাঙ্গনা কমলা বেগমের ক্ষেত্রে। ছয় দশকের জীবন তাঁর শুধু ছুটে চলার। কিন্তু তারপরও তিনি কোনো ঘাটে নিজেকে ভিড়াতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধ কমলাকে সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এই পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে কমলা তাঁর আপন গতিতে ফিরতে চেয়েছেন কিন্তু পারেননি। এতো কিছুর পরেও কমলা ভেঙে পড়েছেন? না।
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ থানার পূর্ব নাবাইদ গ্রামের আব্দুল আজিজ মোড়ল আর আনেছা খাতুনের দুই মেয়ে আর দুই ছেলের মধ্যে কমলা বেগম তৃতীয়। সবার বড় ভাই আবদুর রহমান, আর সবার ছোট ভাই রসুল মিয়া। বীরাঙ্গনা কমলা বেগম তাঁর জন্ম কতসালে বলতে পারেন না। তবে তিনি জানান, ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর বিয়ে হয়। তখন তাঁর বয়স হবে ১৩ থেকে ১৪ বছর।’
কমলার বাবা আজিজ মিয়া ছিলেন পাবিবারিকভাবেই অবস্থাসম্পন্ন কৃষক। তাঁর বাবা আনু মোড়লের বেশ জমিজিরাত ছিল। আজিজ মিয়ারা চার ভাই ছিলেন। সবাই মিলে বিরাট এক পরিবার, যৌথ পরিবার। ফলে কমলা বেগমের ছেলেবেলাটা বেশ স্বচ্ছলতার মধ্যেই কেটেছে। সে সময় মেয়েদের শিক্ষার কোনো চল ছিল না। বলা হত, মেয়েরা স্কুলে পড়লে স্বামীর হায়াত কমে। মেয়েদের নামজ শিক্ষা আর কোরান শরিফ পড়লেই হয়। তাই কমলা বেগমকে তাঁর বাবা- মা কখনো স্কুলে পাঠাননি। বাড়িতে মৌলভী রেখে কোরান শরিফ পড়িয়েছেন। বাড়ির ছেলেমেয়েরা সবাই সেখানে পড়াশোনা করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পরেই করিমগঞ্জের বালিয়াবাড়ি এলাকায় পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্প বসায়। সেই এলাকাটি পূর্ব নবাইদ গ্রাম থেকে বেশি দূরে নয়। সেসময় করিমগঞ্জ এলাকায় বেশ কিছু ডাকাত ছিল। যুদ্ধ শুরু হলে ডাকাতরা পাকিস্তানিদের সঙ্গে যোগ দেয়। তারা রাজাকারের খাতায় নাম লেখায়। এলাকায় ঘুরে খবর সংগ্রহ করত আর পাকিস্তানিদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করত। এদের একটি প্রধান কাজ ছিল মানুষের বাড়ি থেকে গরু-ছাগল-মুরগি ধরে নিয়ে ক্যাম্পে জমা দেওয়া। মাঠে গরু চড়ছে, এরা সেগুলো নিয়ে যেত।
একদিন আবদুল আজিজ মিয়া একা ঝাউতলা বাজারে যান। পাকিস্তানিদের সহযোগী ডাকাতরা তাঁকে সেই বাজারে ধরে ফেলে। সেখানে তাঁকে বেদম মার দিয়ে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখে। ডাকাতরা আজিজকে জানায়, তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের লোক। তাদেরকে গরু, ধান আর একটি মেয়ে দিতে হবে। নাহলে আজিজকে তারা পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দেবে এবং মেরে ফেলবে। কিন্তু আজিজ মিয়া তাতে রাজি হননি। বাজারের লোকজন এই খবর বাড়িতে এসে জানায়।
বাড়িতে এই খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের লোকজন আগে নারী ও শিশুদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তারা পাশের গ্রামের একটি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আর বাড়ির কয়েকজন পুরুষ বাজারে যায়, আজিজ মিয়াকে ছাড়িয়ে আনতে। আজিজ মিয়াকে তখন কীভাবে ডাকাতদের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনা হয়েছিল তা আর মনে নেই কমলার।
এই ঘটনায় আজিজের পরিবারের সবাই খুব ভয় পায়। যুদ্ধের আগেই কমলার বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়। সে তার স্বামীর বাড়িতে থাকে। বাড়িতে একমাত্র যুবতী মেয়ে কমলা। পরিবারের সবাই সিদ্ধান্ত নেয় কমলাকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে। তখন আষাঢ় মাস। রাতারাতি বাড়ির লোকজন পাশের গ্রাম নানছির একটি গরিব পরিবারের ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে ফেলে। ছেলের নাম আবদুর নবি, লোকে কডু মিয়া বলে ডাকত। নানছি গ্রামটি পাকিস্তানিরা যেখানে ক্যাম্প করেছে তার পাশেই। একদিন কমলার বাবা-চাচারা সেই বাড়িতে যান। গিয়ে তাদের বলেন, আমরা মেয়েকে রাতেই বিয়ে দিতে চাই। আপনারা একটি শাড়ী নিয়ে আমাদের বাড়ি আসুন। যুদ্ধ শেষ হলে আমরা ছেলেকে ১০ কাঠা ধানিজমি লিখে দেব। আপনাদের চলতে কোনো অসুবিধা হবে না। কথা মতো, পরদিন রাতেই পারিবারিকভাবে আবদুর নবির সঙ্গে কমলার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর পরিবারের লোকজন কমলাকে নিয়ে স্বামীর বাড়ি চলে যায়। বাড়ি যাওয়ার পর সেই রাতে কমলার বাসর হওয়ার কথা থাকলেও তা আর হয়নি। কারণ বাড়ি ফিরে কমলার স্বামীকে বাড়ির বাইরে চলে যেতে হয়। শুধু কমলার স্বামী নয়, পরিবারের সব যুবক পুরুষ সদস্যই বাড়ির বাইরে চলে যান। বাড়িতে থাকেন শুধু বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। কমলা নতুন বউ, তাঁকেও তাদের সঙ্গেই থাকতে হয়।
এভাবে ছয়-সাতদিন চলে যায়। একদিন দুপুর বেলা কমলার এক চাচীশাশুড়ি ঘরের বারান্দায় নামাজ পড়ছিলেন। এমন সময় কোথা থেকে যেন গোলাগুলির শব্দ আসতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যেই একটা গুলি এসে তার পিছনে লাগে। নামাজ পড়া অবস্থায় সেখানে তিনি ঢলে পড়েন। এই অবস্থা দেখে কমলার আপন শাশুড়ি বললেন, এখানে গোলাগুলি হচ্ছে, তোমাকে আর এখানে রাখা যাবে না। চল, তোমাকে তোমার বাবার বাড়ি রেখে আসি। বলেই, তিনি কাপড় দিয়ে বোরখা বানিয়ে তাঁকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন। তখন বিকেল হয়ে গেছে। কমলার শ্বশুরবাড়ি নানচি থেকে পূর্ব নাবাইদ যাওয়ার পথে গুমঘর নামে একটি জায়গা পড়ে। সেই গ্রামের কাছাকাছি যাওয়ার পরই মানুষের দৌড়াদৌড়ি দেখতে পান তাঁরা। মানুষরা এদিক-সেদিক ছুটছে। গুলির আওয়াজও শুনতে পান তাঁরা। একটা বাড়ির কাছে গিয়ে দেখেন, সেখানে দু জনের লাশ পড়ে আছে। ফলে তাঁরা রাস্তা ছেড়ে পাটক্ষেতের ভিতরে ঢুকে পড়েন। পাট ক্ষেতের ভিতরে ঢুকে দেখেন, সেখানে অনেক মানুষ। মানুষগুলো ক্ষেতের ভিতর দিয়ে দৌড়াচ্ছেন। কমলা আর তাঁর শাশুড়িও রুর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে শুরু করেন।
কমলার মাথায় ছিল গোছাভর্তি চুল। সেই চুল পাটের ক্ষেতের সঙ্গে পেঁচিয়ে গিয়ে কমলা একসময় ক্ষেতের মধ্যে পড়ে যান। গাছ থেকে চুল ছাড়ানোর চেষ্টা করেন কিন্তু কিছুতেই সেই চুল ছাড়ে না। একপর্যায়ে কামড়ে চুল ছিঁড়ে ফেলেন। আবার দৌড়াতে থাকেন কমলা। হঠাৎ করে কমলার খেয়াল হয়, শাশুড়ি কই? তিনি আশপাশে চেয়ে দেখেন শাশুড়ি নেই। তিনি একা দৌড়াচ্ছেন। আশপাশেও কেউ নেই। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে প্রায়। দিনের আলো নিভতে শুরু করেছে পশ্চিম আকাশে।
এই অবস্থায় সেখানেই বসে থাকেন কিছুক্ষণ। পাট ক্ষেত জোঁকে ভর্তি। একটু পর পর সাপ আশপাশ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। অসহায় কমলা সেখানে বসেই কাঁদতে শুরু করেন। দিনের আলো একেবারে নিভে যাওয়ার পর কমলা কাঁদতে কাঁদতে পাট ক্ষেত থেকে বেরিয়ে পাশের একটি রাস্তায় ওঠেন। উঠেই দেখেন সুন্দর গায়ের রঙ, হালকা-পাতলা একটি যুবক তাঁর দিকে হেঁটে আসছে। সে কমলার কাছে এসে জিজ্ঞাস করে, ‘তুমি কই যাবা? কাঁদতাছ কেন?’ কমলা সেই যুবকের কাছে তাঁর বিপদের কথা বলেন। যুবক তাঁকে অভয় দিয়ে বাড়ি কই, বাব-চাচার নাম কি এসব জিজ্ঞেস করে। কমলা সবকিছু বলেন। যুবক কমলাকে বলে, ‘চিন্তা কইর না, আমি তোমাদের সবাইকে চিনি। চল আমার সঙ্গে, আমিই তোমাকে তোমার বাড়ি পৌঁছিয়ে দিব।’ বলেই সেই যুবক কমলার হাত ধরে চলতে শুরু করে।
যুবক কমলাকে নিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা টানা হাঁটে। রাত ৮টার দিকে তারা একটি বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সামনে বিরাট একটা গেইট। কমলা দেখেন সেই বাড়িটি তাঁদের বাড়ি নয়। এটা অন্য বাড়ি। কিন্তু বাড়িটি কার- এ ধারণা তাঁর নেই। কিছু পরেই টর্চলাইট হাতে সেখান থেকে একজন লোক বেরিয়ে আসে। তার পরনে লুঙ্গি, গায়ে পাঞ্জাবি আর কাঁধে একটা বন্দুক। সে একজন রাজাকার। কমলাকে দেখেই সে লোকটি হাসে। তার হাসিটা ছিল অনেকটা পিশাচের মতো। কমলার বুঝতে বাকি রইল না তিনি কোথায় এসেছেন। তবু কমলা সেই সুন্দর লোকটিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমারে কোথায় নিয়ে আসছেন?’ লোকটি কোনো কথা বলে না। শুধু হাসে, দুজন মিলে হাসে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা রাজাকার লোকটি কমলার হাত ধরে টান দেয়। কমলা হাতটি ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তারপর লোকটি জোর করে হাত চেপে ধরে, গায়ে হাত দেয়। কমলাও গায়ের শক্তি খাটিয়ে তার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে রাজাকারের পাঞ্জাবির সঙ্গে যে ব্যাচ ছিল সেটি ছিটকে পড়ে যায়। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে যায় রাজাকারটি। সে কমলার হাত ধরে এতো জোড়ে মোচড় দেয়, যে দুটো হাতই মচকে যায়। কমলা স্পষ্ট বুঝতে পারেন, এখন আর তাঁর হাতে কোনো শক্তি নেই। তিনি চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পড়েন। তাঁর দম বেরিয়ে আসার দশা। রাজাকার দুজন কমলাকে কোলে তুলে একটি ঘরের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
কমলাকে যে ঘরে রাখা হয়, সেই ঘরে আরো অনেক নারী ছিল। তাঁদের কেউ কমলার বয়সী, কেউ বয়সে বড়। তাঁদের অবস্থাও করুণ, কাহিল। অনেকের চোখমুখ ভাবলেশহীন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ কাঁদছে। অধিকাংশের শরীরে কোনো কাপড়-চোপড় নেই। বাইরে তখনো মানুষের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। পাকিস্তানি সেনারা উর্দুতে কি যেন বলছে। একটি ঘর থেকে পুরুষ মানুষের চিৎকার শুনতে পান কমলা। কমলাকে যে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে, সেই ঘরের বারান্দায় বুটের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। একটু পর পর দরজা খুলে একেকজন নারীকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাঁরা কাঁদছেন। কমলা বুঝতে পারছেন না, এদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। রাত বাড়ছে আর মানুষের আনাগোনাও যেন বাড়ছে। নারী-পুরুষের চিৎকারে যেন গোটা বাড়িটা একটা নরককুণ্ড। কমলা মরার মতো শুয়ে থাকে। গভীর রাতে কয়েকজন লোককে কমলাদের ঘরে চোখ বেঁধে নিয়ে আসা হয়। তাঁদেরকে উলঙ্গ নারীদের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়। পুরুষরা লজ্জায় চোখ বন্ধ করলেই তাঁদের চোখে লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়। আর অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালিজ করা হয়। এ সময় অনেকের চোখ গলে যায়।
এর কিছুক্ষণ পরেই দুজন সেনা কমলাকে নিতে আসে। কমলার শরীরে তখন উঠে দাঁড়ানোর মতো শক্তি নেই। তিনি মরার মতো পড়ে থাকেন। লোক দুটো কিছুক্ষণ টেনেটুনে ব্যর্থ হয়ে, কমলার দু পা বুট নিয়ে পিষতে থাকে। কমলা চিৎকার দিয়ে উঠেন, যেন তাঁর প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। সেনা দুটো আবার ঘর তালাবদ্ধ করে চলে যায়। কমলাও একপর্যায়ে জ্ঞান হারান। জ্ঞান যখন ফিরে আসে তখন সকাল। কমলা কোনো মতে, দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পান বাড়ি ভর্তি অসংখ্য মানুষ। কাউকে পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে এসেছে, কারো বা চোখ বাঁধা। মূলত সেদিন থেকেই শুরু হয়, কমলার উপর শারীরিক নির্যাতন। কমলার মনে পড়ে, তিনি সেখানে টানা ১৫-২০ দিন নির্যাতনের মধ্যে আটকে ছিলেন। কয়েকদিন নির্যাতনের পরই তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার ফন্দি করেন। কিন্তু কীভাবে পালাবেন? এখানে তো কিছুই তাঁর পরিচিত নয়। পালিয়ে যাওয়ার রাস্তাও তাঁর জানা নেই। তিনি ভাবেন, এই নির্যাতনের মধ্যে তো থাকা যাবে না। এরা তো তাঁকে মেরে ফেলবে। কমলা দেখেছেন, এখানে প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন নারী আসে আবার অনেকেই রাতে যায়, আর ফিরে আসে না।
এর মধ্যেই কমলার সঙ্গে একদিন সেই লোকটির দেখা হয়, যে কমলাকে পথ ভুলিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে আসে। তাঁকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার জন্য কমলা লোকটির হাতেপায়ে ধরে কাঁদতে থাকেন । প্রথম দিন লোকটি কমলার কথার কোনো পাত্তা দিল না। কিন্তু কমলা বুঝতে পারেন, এখান থেকে বাঁচতে হলে এই লোকটিকে যেকরেই হোক হাত করতে হবে। তার হাত ধরেই এখান থেকে পালাতে হবে। পরে যতদিন এই লোকটির সঙ্গে দেখা হয়েছে, কমলা তার সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করেন। ১৫-২০ দিন পর একপর্যায়ে সেই লোকটি কমলাকে স্নান ও কাপড়-চোপড় ধোওয়ার জন্য ক্যাম্পের বাইরে একটি খালের পাড়ে নিয়ে যেতে রাজী হয়। খালটি ক্যাম্পের বাইরে, তবে খুব বেশি দূরে নয়। খালের আশপাশেও পাকিস্তানি সেনাদের আনাগোনা আছে। বর্ষাকাল, খালে তখন বেশ পানি। পাশে একটি পাটক্ষেত। কমলা খালে নেমে একটু সময় নিয়ে স্নান আর কাপড়-চোপড় ধুচ্ছেন। পাশেই সেই লোকটি কমলাকে পাহারা দিচ্ছে। কমলার চোখ সেই লোকটির গতিবিধির দিকেই। এক সময় লোকটি বিড়ি আনার জন্য একটু সামনে থাকা অন্য একজন রাজাকারের কাছে যায়। এই ফাঁকেই কমলা খালের পানিতে ডুব মারেন। একটু দূরে গিয়ে ভেসে, মাথার মধ্যে কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে নাকটা কোনোরকমে পানিতে ভাসিয়ে রাখেন। অনেকক্ষণ পর খালটি পাড় হয়ে ঘন পাট ক্ষেতের ভিতর দিয়ে চলতে থাকেন কমলা। ক্লান্ত, শ্রান্ত শরীর নিয়েই দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত অজানার উদ্দেশে শুধু একা একা হাঁটেন কমলা। মনে ভয়, অবার যদি ধরা পড়ে যান। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যার দিকে একটি নির্জন বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন কমলা। কিন্তু জায়গাটির নাম তিনি জানেন না। সেই বাড়িতে শুধু এক বয়স্ক নারী ছিলেন। কমলা তাকে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসার কথা জানান আর আশ্রয় দিতে বলেন। রাতে সেই বাড়িতেই আশ্রয় পান কমলা। তাঁকে দু মুঠো ভাতও দেওয়া হয়। রাতে ঘুমাতে গিয়ে কমলার মনে হয়, তিনি নড়তে পারছেন না। সারা শরীরে কোনো হুঁশ নেই, কে যেন পেরেক দিয়ে তাঁকে বিছানায় আটকে রেখেছে। নির্যাতনের কারণে শরীরের নিচের অংশে ঘা হয়েছে। নিজের শরীরকে নিজেরই ঘৃণা লাগছে তাঁর। তবু কমলার মনে হয়, এর চেয়ে বড় মুক্তি আর কি আছে? পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প থেকে তিনি ফিরে এসেছেন, মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছেন। এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমের অতলে ডুবে যান কমলা।
পর দিন খুব সকালে বাড়ির বৃদ্ধ নারী কমলাকে ডেকে তুলে বলেন, এখনি বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে। গ্রামের পাশের একটি রাস্তা দেখিয়ে বলেন, এখান দিয়ে লোকজন ভারতে যাচ্ছে, তুমিও তাদের সঙ্গে ভারতে চলে যাও। কমলার কিছুই করার ছিল না, এই শরীর নিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরেন। কমলা জানতে পারেন, এলাকাটির নাম হালুয়াঘাট। এখান দিয়ে অনেক মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে যাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে লাইন ধরে হেঁটে যাচ্ছে। কমলাও তাদের সঙ্গে মিশে যান। তিনি একা, তাঁর কোনো পিছুটান নেই। তিনি পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্প থেকে বেঁচে ফিরেছেন, তাঁকে বাঁচতে হবে। বাঁচার তাগিদেই তিনি মানুষের মিছিলে মিশে গিয়ে হাঁটতে থাকেন। কিন্তু রোদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমলা টের পান তিনি আর হাঁটতে পারছেন না। তাঁর শরীরের নীচের অংশ যেন খুলে পড়ছে। সীমান্তের কাছে কড়ইতলা এলাকায় একটি নদীর পাড়ে গিয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ফলে সেদিন আর কমলা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যেতে পারেননি। এই অচেতন অবস্থাতেই মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল কমলাকে উদ্ধার করে তাঁদের সঙ্গে নিয়ে যায়। যদিও কমলা তাঁদের কাউকেই চিনেন না। কমলার মনে ভয় কাজ করছিল, এরা আবার তাঁকে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে নিয়ে যাবে না তো! মুক্তিযোদ্ধারা কমলাকে কোথাও নিয়ে গেল না বা ভারতে যেতে দিল না। দলের মধ্যে রব্বানি নামে একজন ছিলেন, যিনি কমলার কাছে সবকিছু শুনলেন এবং তাঁকে সাহস দিলেন। বিচলিত না হওয়ার পরামর্শ দিলেন। অতীত ভুলে বেঁচে থাকার কথা বললেন। কমলা তাতে একটু সাহস পেলেন। আনসার, আইয়ুব আলী, ফলু মিয়াসহ প্রায় ১০-১২ জনের একটি বাহিনী। সবাই কমলাকে নিজের বোনের মতোই দেখেন। তাঁরা কমলার জন্য ওষুধ নিয়ে এলেন। তাঁদের সবার বাড়িই ময়মনসিংহের বেগুনবাড়ি এলাকায়। এই সময়টি কমলার বেশ ভালই কাটলো। এই মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ঘরবাড়ি ছিল না। অধিকাংশ সময়ই তাঁদের জঙ্গলে কাটত। কমলা তাঁদের মাঝে মধ্যে রান্নাবান্না করে দিতেন। সব সময় তাঁদের সঙ্গেই থাকতেন। ফুটফরমরমাস খাটতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলটি মূলত সীমান্ত এলাকায় কাজ করত। শরণার্থী হিসেবে যারা ভারতে যেত, তাদের সহযোগিতা করাই ছিল এদের প্রধান কাজ। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে তথ্য আনা নেওয়ার কাজও করত তাঁরা। কমলা তাঁদের সঙ্গে প্রায় চার মাস ছিলেন। তাঁর শরীরের অবস্থারও কিছুটা উন্নতি হয়।
এর মধ্যেই যুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকে। তখন মুক্তিযোদ্ধারা কমলাকে আর নিজেদের সঙ্গে রাখতে চাইলেন না। একদিন রব্বানি কমলাকে বেগুনবাড়িতে নিজের গ্রামে নিয়ে গেলেন এবং তাঁর মার কাছে রেখে গেলেন। রব্বানি কমলাকে নিজের মায়ের কাছে রেখে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যান। যাওয়ার সময় রব্বানি বলে গেলেন, এই মেয়ের যদি কোনো ঠিকানা না মেলে তাহলে যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে তিনিই তাঁকে বিয়ে করবেন। কয়েকদিন সেখানে থাকার পর একদিন রব্বানির মা কমলাকে পাশের গাঁয়ের আরেকটি পরিবারের কাছে রেখে এলেন। কারণ, রব্বানি মুক্তিযুদ্ধে গেছে এটা সবাই জানে। এখন কেউ যদি বাড়িতে হামলা চালায়, সেই আশঙ্কা থেকেই মূলত রব্বানির মা কমলাকে বাড়ি রাখলেন না। এভাবে আরো কয়েকটি জায়গায় কমলা জায়গা পরিবর্তন করলেন। নভেম্বরের শেষ দিকে কমলা খবর পেলেন, যুদ্ধ করতে গিয়ে রব্বানি মারা গেছেন। তাঁর লাশ বেগুনবাড়িতে নিয়ে আসা হবে। কমলা আবার ভেঙে পড়লেন। এখন তিনি কোথায় যাবেন। এতদিন তবু তো একটা আশ্রয়ের আশা ছিল, এখন কী হবে। রব্বানি মারা যাওয়ার কয়েকদিন পর তাঁর মা আর কমলাকে নিজের কাছে রাখতে রাজি হলেন না। এই যুদ্ধের মধ্যেই তিনি কমলাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন।
তারপর আরেকজন বৃদ্ধ কমলাকে নিয়ে এলেন ময়মনসিংহে। রেল স্টেশনের পাশে রেল লাইনের ধারে একটি ঝুঁপড়িতে ঠাঁই হয় কমলার। সেখানে কমলা আরো কয়েকজন বীরাঙ্গনার দেখা পেলেন। পরে স্থানীয়রা রেল লাইনের পাশে আলমগীর মনসুর মিন্টু কলেজের ভিতরে একটি কক্ষে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। তখন কেউ এসব নারীদের সঙ্গে কথা বলত না। তাঁদের খাবারের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পরনে ভাল কোনো কাপড় ছিল না। চেয়ে-চিন্তে কোনোভাবে দিন গেছে এসব নারীদের। সেই সময়ের কথা মনে করতে গিয়ে কমলা বলেন, তখন কুকুরের দাম ছিল, কিন্তু এসব নারীদের কোনো দাম ছিল না।’ এখানে থাকা অবস্থায়ই দেশ স্বাধীন হয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কমলাদের সবাইকে তাঁদের আশ্রয়স্থল মিন্টু কলেজ ছেড়ে দিতে হল। ঠাঁই হল আবার রেল লাইনের ঝুঁপড়ি ঘরে। এই ঝুঁপড়ি ঘরে কমলা একা প্রায় ছয় বছর কাটিয়েছেন। এখানে সেখানে কাজ করে নিজের পেট চালিয়েছেন।
একদিন ময়মনসিংহের একটি এতিমখানার দারোয়ান আবুল কাসেমের সঙ্গে কমলার পরিচয় হয়। তিনি তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তার গ্রামের বাড়ি ফুলবাড়িয়া উপজেলার দাপুনিয়া গ্রামে। তিনি আগেও একটি বিয়ে করেছেন, বাড়িতে তাঁর মা, বউ, ছেলেমেয়ে আছে। কমলা ভাবেন, তাঁর একটি আশ্রয়ের দরকার। নিজের ভবিষ্যতের চিন্তায় তিনি দারোয়ান কাসেমকে বিয়ে করতে রাজি হন।
বিয়ের পর কাসেম বীরাঙ্গনা কমলাকে নিয়ে দাপুনিয়া নিজের বাড়ি নিয়ে যায়। প্রথম কয়েকদিন স্বামীর সংসারে ভালই ছিলেন কমলা। কিন্তু স্বামী বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফেরার পরই কমলার উপর পরিবারের লোকজন অত্যাচার শুরু করে। এক বেলা খাবার দেয় তো আরেক বেলা খাবার দেয় না। এই অত্যাচারের মধ্যেও কমলা সেখানে কষ্ট করে থাকেন। কাসেম বাড়ি গেলে কমলা কষ্টের কথা বলেন। স্বামী তাঁকে সান্ত্বনা দেন, কষ্ট করে থাকতে বলেন। তিনি বলেন, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ের তিন বছর পর কমলার একটি ছেলে হয়। কাসেমের সংসারে কমলা আট বছরের বেশি সময় ছিলেন। বড় ছেলে আবু হানিফের বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন ছোট ছেলে আবু কায়সার মনিরের জন্ম হয়। ছোট ছেলের জন্মের পর পরই স্বামী কাসেম মারা যান। তখন কমলার জীবনে আবার অমানিশা দেখা দেয়। কমলাকে স্বামীর বাড়ির লোকজন বাড়ি থেকে বের করে দেয়। দুই ছেলেসহ কমলা আবার পথে বসলেন। তখন কেউ তাঁকে কাজ করতেও ডাকে না। কারণ, সঙ্গে দুটি ছেলে আছে।
এর মধ্যেই একদিন পরিচিত এক লোক তাঁকে নিয়ে গেলেন ময়মনসিংহ শহরের মধ্যে অবস্থিত বেশ্যা পল্লীতে। সেখানে আলী আকবর নামে এক ব্যক্তির দোকান ছিল। কমলার অসহায়ত্বের কথা শুনে তাঁকে একটি কাজের প্রস্তাব দেন তিনি। আলী আকবর এই দোকনটি ছেড়ে বাইরে আরেকটি দোকান নিয়েছেন। তিনি এখন সেই দোকানটিই চালাবেন। তিনি কমলাকে প্রস্তাব দেন, তার দোকানটি চালাতে এবং সঙ্গে তিনশ টাকাও দেন মালামাল তোলার জন্য। কমলা কোনোকিছু না ভেবেই এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। সারাদিন কমলা দুই ছেলেকে নিয়ে দোকানদারি করেন আর রাতে বাসায় গিয়ে ঘুমান। শহরের মধ্যে ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটা ছোট ঘর ভাড়া নেন তিনশ টাকায়। বলতে গেলে এই দোকানটিই কমলার জীবন বাঁচিয়েছে। কমলা টানা ১৬ বছর এই দোকানটি চালিয়েছেন। এই দোকানের আয় দিয়েই ছেলেদের মানুষ করেছেন। কমলার ছেলেরা এখন বড়। তারা নিজেরা উপার্জন করে। তারা মায়ের সব ঘটনা জানে। মায়ের সঙ্গেই তারা থাকে শম্ভুগঞ্জ জুট মিল গেইটে।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর সরকারের লোকজন কমলাকে খুঁজে বের করে। স্থানীয়রা জানতে পারেন, কমলা একজন বীরাঙ্গনা। কিন্তু কমলা প্রথমে নিজের এই পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি ছিলেন না। তিনি অতীতের সবকিছুই ভুলে থাকতে চেয়েছেন। কিন্তু একদিন পুলিশের এক কর্মকর্তা কমলার বাসায় গিয়ে হাজির হন। তিনি কমলার কাছ থেকে সব ঘটনা শোনেন। পরে একদিন ওই পুলিশ কর্মকর্তা কমলাকে জানান, যুদ্ধের একজন নির্যাতিত নারী হিসেবে তাঁকে সাক্ষী দিতে হবে। সেই সাক্ষ্য তাঁকে দিতে হবে কম্বোডিয়ার আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এই প্রস্তাব শুনে কমলা একটু বিচলিত হন। যে ঘটনা তিনি কোনোদিন কাউকে বলতেই চাননি, এখন সেই ঘটনার জন্য তাঁকে সাক্ষী দিতে হবে, তাও দেশের বাইরে গিয়ে। কমলার ছেলেরা এ কথা শুনে প্রথমে রাজি হয়নি। পরে তারা রাজী হয়। এরপর কমলা আরো কয়েকজন নারীর সঙ্গে কম্বোডিয়ায় যান যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য। সেখানে তিনি প্রায় এক মাস ছিলেন।
সেখান থেকে ফিরে আসার পর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের একজন কমলাকে একটি বীমা কম্পোনিতে অফিস সহকারীর কাজ দেন। এখনো তিনি সেই কাজটি করছেন নিজের পরিবারের জন্য। এ সময় থেকেই কমলা নিজের জন্য একটি মুক্তিযোদ্ধা সনদ জোগাড় করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এখনো তাঁর সেই আশা পূরণ হয়নি। সেই সূত্র ধরেই দীর্ঘ ৪০ বছর পর কমলার সঙ্গে আবার তাঁর পরিবারের যোগাযোগ হয়। কমলার মা জানতে পারেন, কমলা বেঁচে আছেন। তখন তিনি তাঁর ছোট ছেলেকে কমলার খোঁজে পাঠান। এখন অবশ্য কমলা নিজেও মাঝে মাঝে মাকে দেখার জন্য বাড়ি যান।
তথ্যসূত্র : ২০১৬ সালের জুন মাসে একদিন ময়মনসিংহ শহরের ব্রহ্মপুত্র সেতুর পাশে মুক্তিযোদ্ধা আবাসন প্রকল্পে কমলা বেগমের সাক্ষাতকার নেওয়া হয়। তার ভিত্তিতেই এটি লেখা হয়েছে।
লেখক: চন্দন সাহা রায়