কমলা বেগমকে তিনজন সঙ্গী ও দেড় বছরের শিশু সন্তানসহ মিলিটারিরা ধরেছিল রাস্তা থেকে, কমলা বেগমের ভাইয়েরা, বোনের ছেলেরা তখন মুক্তিবাহিনীতে। মিলিটারীর ভয়ে কমলা বেগম পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এখান থেকে ওখানে। শেষ পর্যন্ত পালাবার পথেই পাকসেনাদের হাতে ধরা পরলেন তাঁরা। আজো জানেন না কমলা বেগম কি করে ধরা পরলেন সেদিন, কেনই বা শিকার হলেন এমন নির্মমতার। শুধু কমলা বেগম কেন মুক্তিযুদ্ধের সময় কমলা বেগমের মত লাখো নারীকে পাক হানাদার বাহিনীর আক্রোশের শিকার হতে হয়েছে। শুধু কি তাই, স্বাধীনতার পরে এই মুক্ত ভূখন্ড কি মুক্তি দিয়েছিল তাঁদের? কি ছিল তাঁদের অপরাধ? স্বাধীনতার জন্য কী ভয়ানক ত্যাগ স্বীকারই না করতে হয়েছে বাংলার এই বীর জননীদের, যুদ্ধের দামামায় উন্মত্ত শত্রুর আক্রোশ যেন সহস্র বুলেটের মত ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করেছে তাদের দেহ, মন, তাদের স্বপ্ন। একটি স্বাধীন দেশের জন্য এত বড় ত্যাগ! অথচ স্বাধীনতার পরেও তাঁরা পেয়েছে কি যথাযোগ্য সম্মান?
কেমন আছেন বীরাঙ্গণা কমলা বেগম, জীবন যুদ্ধে ধুকতে ধুকতে আশিটি বছর পার করে এসেছেন তিনি। বয়সের ভারে ভেঙে গেছে শরীর, ভুগছেন শ্বাসকষ্টে, অভাবের জন্য ৩৫ টাকা খরচ করে ঔষুধ কিনবে তাও যেন অভাবের সংসারে বিলাসিতা। কমলা বেগমের ভাষায়, “আমি গরীব মানুষ, এত টাকা পাব কোতায়?” কমলা বেগম মনে করেন সরকার যে খেতাব দিয়েছে তা থেকে একদিক দিয়ে হয়ত সামান্য কিছু সাহায্য পাওয়া গেছে কিন্তু অন্যদিক দিয়ে দেখলে জানা যায় কমলা বেগমের প্রতি সমাজের নির্মম কুঠারাঘাত আরো যেন বেড়ে গেছে। তাঁর ভাষায়, “আমাদের দুইবার টেলিভিশনে দেকানোর পর সবাই জেনে গেছে যে আমরা বীরাঙ্গানা, আমরা খারাপ।” তাঁর হিসেবে টেলিভিশনে প্রচার হওয়ার পর থেকে মানুষজন তাঁকে খারাপ ভাবে। টেলিভিশনে প্রচার না হলে কেউ তাঁকে চিনতো না। তখন কেউ খারাপও বলত না। কিন্তু এখন ছোট ছেলেরাও খারাপ ভাবে। তাদের বাবা-মা বলে দেয় যে এরা খারাপ, এদের সাথে মিশতে নাই, আরো কতো কি। সমাজের এই নির্মমতা কি কোন কালে কম ছিল কমলাদের প্রতি?
কেমন ছিল কমলা বেগমের শৈশব? সিরাজগঞ্জ জেলার বিন্দুপারা গ্রামে নজিরন বেগমের অভাবের সংসারে জন্ম কমলা বেগমের। বাবার বাড়ি ছিল কোলগয়লা গ্রামে। বাবা ইরাত আলী বাজারে কুলি মজুরের কাজ করতেন। নয় ভাই সাত বোনের মধ্যে কমলা বেগম ছিল ১২ নম্বর। দুই ভাই আর পাঁচ বোন ছাড়া অন্য সবাই ছোটবেলায় মারা গিয়েছে। দুই ভাইয়ের একভাই ক্ষেতের কাজ করতে গরু পালত আর অন্য ভাই রিকসা চালাত। তা দিয়ে কোনমতে সংসার চলত। তাই পড়ালেখার শেখার সুযোগ হয়নি কখনোই। মাত্র সাত বছর বয়সে কমলা বেগমের বিয়ে হয় শুকুর আলীর সঙ্গে। তিনিও কুলির কাজ করতেন। বাড়ীর অবস্থাও ভাল ছিল না। ২২ বছর বয়সে মা হয় কমলা বেগম। মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ছিল ৩৫-৪০ বছর। এর মধ্যে একে একে জন্ম দিয়েছেন নয় ছেলে মেয়ে। অভাব তাই পিছু ছাড়েনি কখনো। এর মধ্যে শুরু হল মুক্তিযুদ্ধ। ঠিকানা পরিবর্তন করে ঘোড়াছড়া, বামনগতি, সরিষাবাড়ী প্রভৃতি জায়গায় পাক বাহিনীর ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে থাকতে হল তাঁকে। তবুও পাক বাহিনীর বর্বর আক্রমণ থেকে শেষ রক্ষা করতে পারেলেন না নিজেকে।
ঘটনার দিন কমলার সাথে আরো তিনটা মেয়ে ছিল সখিনা, সরাতন আর রাবিয়া। পরে তিনজনই মারা যান। সখিনা মারা গেছে যুদ্ধের সময়ই, সরাতন মারা গেছে যুদ্ধের পরে আর রাবিয়া পশ্চিম দেশেই মারা গেছে তাঁকে আর দেশে আনতে পারে নাই। তিনজনই ছিল দত্তবাড়ীর মেয়ে আর কমলা বিন্দু পাড়া থেকে গিয়েছিল। ঘটনার দিন কমলা বেগম অন্য তিনটি মেয়েকে নিয়ে বিন্দুপাড়ায় পালিয়েছিল। খবর এল পাকবাহিনী জানপুরে আগুন দিয়েছে এই শুনে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে চারজনে বিন্দুপাড়া দিয়ে পালাবে ঠিক করল, কিন্তু পালাতে গিয়েই মিলিটারিদের সামনে পরে গেলেন তাঁরা। ১৫ জন মিলিটারি মিলে ধরে ফেলল তাঁদের, প্রথমে একজনকে ধরে ফেললে অন্যরা দৌড়ে পুকুরের পাশে ঝোপের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করে কিন্তু মিলিটারিরা পুকুরের চারপাশে ঘিরে ফেলে তারপর আর একটা মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়। কমলা বেগম আর অন্য একজন তখনো লুকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ চার-পাঁচ জন এসে তাঁদের দুজনকেও ধরে ফেলে। কমলা বেগম তখন তাঁর কোলের দেড় বছরের শিশুটিকে দেখিয়ে তাদের বাবা বলে ডেকে তাদের কাছে অনেক অনুনয় করে মনে এই আশা নিয়ে যে হয়ত তাতে করে পিশাচগুলোর মন গলবে। কিন্তু এত কিছু করেও কোন লাভ হয়না। প্রথমে কমলা বেগমকে চড় দিয়ে পুকুরের পানিতে ফেলে দেয় তারা। কোনমতে উঠে দাঁড়াতেই পিঠে লাথি বসায় বর্বরের দল। দেড় বছরের নিষ্পাপ শিশুটিকে বুট দিয়ে সজোরে লাথি মারে তিনবার । প্রায় আধমরা অবস্থায় একজন শিশুটিকে নিয়ে চলে যায়। একজন কমলা বেগমের সাথে থেকে যায়, এসব কথা বলতে যেয়ে কমলা বেগমের চোখ ভিজে আসে বলে, “আমি তারে বললাম আপনে আমার বাপের মত আপনে আমারে ছাইড়া দেন। তখন সে কইল বাপ বাপ করস কেন স্বামী কইতে পারসনা তোর বাপ কেডা এখন আমি তোর স্বামীর মত আমারে স্বামী বল। তারপর তো ওই পুকুরের মধ্যেই আমার ওপর নির্যাতন করে। আমার ওপর তবু একজন মিলিটারি অত্যাচার করছে, দেশীয় কেউ ছিল না। আমার মেয়েডা তখন আমার পাশেই ছিল আমার দেড় বছরের মেয়েটাকেও মারছে অনেক অত্যাচার করছে। ঘটনার পর আমার সাথে যে সকল মেয়েরা ছিল ওরা এসে আমাকে ও আমার মেয়েকে উদ্ধার করে। এরপর আমরা খোকসা বাড়ী হাসপাতালে উঠি। খোকসা বাড়ীতে তখন হাসপাতাল নতুন হয়েছিল। ওখানে থেকে বাড়ীতে গিয়ে দেখি আমার শাশুড়ি আমার ছেলেমেয়েকে নিয়ে চিৎকার করে কান্নাকাটি করছে। আমি যাওয়ার পর আমাকে জড়িয়ে ধরেও আমার শাশুড়ি অনেক কান্নাকাটি করল। আমি একমাত্র ছেলের বউ হওয়ার কারণে আমার শাশুড়ি আমাকে অনেক ভালবাসছে। ঘটনার পরেও আমাকে কোন বকাবকি করে নাই কিছু বলে নাই বরং বলছে আমার বেটার বউ যে জীবিত ফিরে আসছে এটাই অনেক কিছু। অন্য মানুষ আমার শ্বশুড়ি কে বলছে ছিঃ ছিঃ ওই বেটার বউ-এর জন্য কান্দিস, ওই বেটার বউ-এর জন্য কান্দিস লজ্জা করিস রো লজ্জা করিস। যে বউ ছেলে মেয়ে রেখে আর্মিদের সাথে গেছে সেই বেটার বউ-এর জন্য কান্দিস। তখন আমার শ্বাশুড়ি বলছে ওকি ইচ্ছা করে গেছে।” শ্বাশুড়ির কথা গল্প করতে করতে যেন মানুষের প্রতি বিশ্বাস ফিরে আসে তাঁর, বলে “আমার শ্বাশুড়ি আমারে অনেক ভালবাসিছে।”
এরপর দেশ স্বাধীনের গল্প বলে কমলা, বলে স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসলে কমলা বেগমসহ সকলে মিলে পতাকা উড়ালেন এলাকার হাফিজ সাহেবের বাড়ীতে। বড় ভাল মানুষ ছিলেন হাফিজ সাহেব। কমলার ভাষায়, “স্বাধীনের আট দশ দিন আগে আমরা যারা দূরে ছিলাম তাদেরকে লোক পাঠায়া দিয়া নিয়ে আসছিল নিজের বাড়ীতে, রেখে খাওয়াইছে দেশ স্বাধীনের পর আমরা যার যার বাড়ীতে গেছি। যখন পুনর্বাসন কেন্দ্র চালু হয় মোতাহার মাস্টারের বউ সখিনা আম্মা, (সাফিনা লোহানী) এরা পুনর্বাসন কেন্দ্র চালু করছিল আমি পুনর্বাসন কেন্দ্রে কাজ করছি। আমি তাঁতের কাজ করছি। অনেক মহিলা আসছিল পুনর্বাসন কেন্দ্রে অনেকে ভালও ছিলো, নির্যাতিত হয় নাই কিন্তু তাদের স্বামী ছিল না তাই এখানে আসছিল পুনর্বাসন কেন্দ্রে এসে একজনের বাচ্চা হইছিল। মিলিটারির বাচ্চা, পুনর্বাসন কেন্দ্রেই বড় হইল তারপর বাবা (শেখ মজিবর) মারা যাওয়ার পর পুর্নবাসন কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে আমি বিন্দু পাড়া থাকি।”
এরপর কমলা বেগমের মুখে শোনা যায় সমাজের বর্বর নিপীরক চরিত্রের বর্ণনা। তিনি বলেন, “বর্তমান সমাজ আমাদের ভাল চোখে দেখে না। গ্রামে থাকাই কঠিন আমাদের। একটু ঝগড়া বিবাদ লাগলেই আমাদের ওই কথা বলে। অনেকে বলে তোরা তো ফাতরা (খারাপ) মেয়ে তোদের তো সমাজে থাকতেই দেয়া যায় না। এখন আমি আমার এক দেবরের ছেলের সাথে বিন্দু পাড়া থাকি। আমার তো ছেলে নাই মেয়েদের বিয়ে দিছি। পরিবারের অবস্থা খুবই খারাপ আমার দেবরের ছেলেরই পাঁচটা ছেলে মেয়ে তার নিজের সংসারই ঠিক মত চলে না। আমি যা সাহায্য একটু পাই তাই দিয়ে কোনমত চলি। আগে তেমন সাহায্য পাই নাই। সবাই মনে করছিল আমি মারা গেছি। আর আমি যুদ্ধের পরে বাবার (শেখ মজিবর) সাথে দেখা করিছিলাম ঢাকা গিয়ে বঙ্গভবনে আমরা দেখা করতে গেছিলাম দশ জন, আমি বাবার কাছে একটা ঘরের জন্য আবেদন করিছিলাম। বাবা আমারে একখান টিন আর কিছু টাকা পয়সা দিছিল। টাকাগুলো আমি পাইছিলাম। কিন্তু টিন পাই নাই। আমরা দেখা করে চলে যাবার সপ্তাহ খানের পর সে মারা যায়।”
কমলা বেগমের কাছে জানা গেল শেষ পর্যন্ত টিন এসেছিল কিন্তু তার গ্রামের চেয়ারম্যান হালিম মাষ্টার টিনটা রেজিয়া নামের একজনকে দিয়ে দেন। পিওন এসে কমলাকে খবর দিয়েছিল যে বৃহস্পতিবার সে যেন কোর্টে গিয়ে তাঁর টিন নিয়ে আসে কিন্তু তখন জ্বরের কারণে তিনি টিন আনতে যেতে পারেননি তাই রেজিয়া সেটা পেয়ে যায়। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের শহিদুল সাহেব কমলার কাছে ভোট চেয়ে বলেছিল যে চেয়ারম্যান হলে তিনি কমলা বেগমকে টিন ও টিউবওয়েল পাইয়ে দিবে। কিন্তু সে চেয়ারম্যার হলেও লোকজনের কারণে তাঁকে টিন দিতে পারে নাই। কমলা বেগমের ধারণা সেই রাগে শহিদুল চেয়ারম্যান আর চেয়ারম্যান নির্বাচনে দাঁড়াননি। কমলা বেগমের ভাষায়, “আমি যে সর্বহারা সেই সর্বহারাই থাকলাম। এখন আম্মার (সাফিনা লোহানী) কাছ থেকে কিছু সাহায্য পাই তাই দিয়া চলি।”
কমলা বেগমের কথা শুনতে গিয়ে মনে হয় যে শেষ পর্যন্ত কতটুকু মুক্ত হয়েছি আমরা। হয়ত একটি স্বাধীন ভূখন্ড আমরা পেয়েছি কিন্তু সমাজ কি মুক্তি পেয়েছে তার কূপুমন্ডুকতার থেকে। কমলা বেগমরা কি মুক্তি পেয়েছে তার দারিদ্রের নাগপাশ থেকে। পাক হানাদার বাহিনীর চেয়ে নির্মমতায় কতটা কম কমলা বেগমের নিজের দেশ, নিজের মানুষেরা। একজন মানুষ ছিলেন, মানুষের মত মানুষ, যিনি নিজে রিক্ত হয়েও পরম মমতায় সিক্ত করেছিলেন কমলা বেগমকে, আগলে রেখেছিলেন সমাজের কুশ্রী মানুষগুলোর নির্মম বাক্যবাণের থেকে। কমলা বেগম বলেছিলেন তার কথা – “আমার শ্বাশুড়ি আমারে অনেক ভালবাসিছে।” আমরা কি পারব কমলা বেগমকে এমন দিন দেখাতে যে দিন সে বলতে পারবে, “এ দেশ আমাকে অনেক ভালবাসিছে।” কেবলমাত্র সেদিনই শেষ হবে, সার্থক হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। সে দিন কতদূর।
লেখক : সুমনা মঞ্জুর