জ্যোৎস্না খাতুন মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে গিয়ে মাঝে মাঝেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছিলেন। সিরাজগঞ্জে তখন পাকা রাস্তা ছিল খুবই কম। মার্চের শুরুতেই পাকিস্তানী আর্মিরা একদিন ট্রেনে করে সিরাজগঞ্জ চলে আসে। তখন জ্যোৎস্না খাতুন তাঁর স্বামীর সঙ্গে সিরাজগঞ্জ শহরের মমতাজ হলের সামনে বসবাস করতেন। আলাউদ্দিন শেখ শহরে গরুর গাড়ি চালাতেন। ভালো গাড়োয়ান হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। ১৯৭১ সালে জ্যোৎস্না খাতুন ছিলেন গর্ভবতী। ফলে তাঁর শারীরিক অবস্থাও ভালো থাকত না সবসময়। এই অবস্থাতেই শহরের অবস্থা খারাপ বুঝে আলাউদ্দিন শেখ পরিবার নিয়ে পাশের বাগবাড়ি গ্রামে এক ব্যাপারির বাড়িতে আশ্রয় নেন। কিন্তু কয়েকদিন সেখানে থাকার পরই ব্যাপারি তাদেরকে নিরাপত্তার অজুহাত তুলে বাড়ি ছাড়তে বলে। সেই গ্রামে এক স্কুল ছিল। সেখানে আরো অনেকেই আশ্রয় নিয়েছিল। বিশেষত যারা সেখানে থাকতেন তাদের অধিকাংশই ছিল গরিব মেহনতি মানুষ। তবে শহর ছেড়ে যাওয়া অনেক মানুষ চলতি পথে সেখানে বিশ্রাম নিতেন। অনেক সময় রাতেও থাকতেন।
এই স্কুল ঘরে জ্যোৎস্না খাতুন বেশ কিছুদিন থাকেন। তাঁর কাছে কিছু অর্থ ও সোনাদানা ছিল সেগুলো তিনি স্কুলের পাশেই মাটিতে পুতে রেখেছিলেন। কিন্তু সেগুলো তিনি আর পরে পাননি। একদিন বিকেল বেলা একটি পরিবার সেখানে আশ্রয় নেয়। দেখেই বোঝা যায়, তারা মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। পরিবারের সঙ্গে ছিলেন এক সদ্য প্রসূতি। তিনি তখনো সুস্থ হতে পারেননি। কয়েকদিনের বাচ্চাকে নিয়েই তাদেরকে অজানার পথে নামতে হয়েছে। সেদিন রাতে ওই পরিবারটি স্কুলেই থেকে যায়। পরদিন সকাল বেলাতেই তাদের সেখান থেকে চলে যাবার কথা। কিন্তু প্রসূতির শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ায় তারা আর যেতে পারেননি। আর ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! সেদিন জৈষ্ঠ্য-আষাঢ় মাস। চারিদিকে পানি। আলাউদ্দিন ছেলেকে নিয়ে কোথাও গিয়েছিলেন। দুপুর বেলাতেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী স্থানীয় আল-বদর রাজাকারদের সহযোগিতায় চরাঞ্চলের এই গ্রামে ঢুকে পড়ে। গ্রামে সেনাবাহিনী আসছে শুনেই লোকজন গ্রাম ছেড়ে পালাতে শুরু করে। তবে চরাঞ্চল হবার কারণে সেখানে কোনো রাস্তাঘাট ছিল না। ফলে অনেকেই নদীর চরে বিভিন্ন ক্ষেতে আশ্রয় নেয়।
গ্রামে ঢুকেই হানাদাররা বসত বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় আর লুটতরাজ শুরু করে। বিকেলের দিকে স্কুল ঘরেও আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। সারা গ্রাম তখন পুড়ছে। স্কুলে যারা আশ্রয় নিয়েছিল তারাও চরের বিভিন্ন ঝোপে আশ্রয় নেয়। মালপত্র সেখানেই পড়ে থাকে। পুরুষরা দৌড়ে যে যেদিকে পারে, চলে যায়। মহিলাদের মধ্যে যারা পেরেছে দূরে সরে গেছে আর যারা দূরে সরে যেতে পারেনি তারা আশেপাশের চরে ধানক্ষেতে বা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাড়ি ও স্কুল ঘরে আগুন লাগিয়ে চরের বিভিন্ন ক্ষেত ও ঝোপ তল্লাশি করা শুরু করে। জ্যোৎস্না খাতুন দূরে ক্ষেতের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে এসব দেখছেন। এক পর্যায়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কয়েকজন সৈন্য স্কুলে আশ্রয় নেয়া সেই সদ্য প্রসূতি মাকে খোঁজে বের করে ফেলে। তাঁর কোলে তখনো সন্তানটি ছিল। সেনারা সন্তানটিকে মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আর প্রসূতি মাকে গণধর্ষণ করা শুরু করে। তাঁর চিৎকার তখন চরের বাতাস ভারি করে তুলছিল। এক পর্যায়ে পাষন্ডরা প্রসূতির বুক ছুরি দিয়ে কেটে ফেলে।
জ্যোৎস্না খাতুন তখন খুব বেশি দূরে ছিলেন না। তিনি সব টের পাচ্ছিলেন। মাটিতে মাথা গুঁজে শুয়ে ছিলেন। অবস্থা খারাপ বুঝে জ্যোৎস্না তখন সাঁতরে আরো কয়েকটি ক্ষেত পাড় হয়ে দূরে সরে যান। ক্ষেতের পাশের আল দিয়ে তাঁকে এমনভাবে যেতে হচ্ছিল যেন হানাদাররা টের না পায়। তিনি তখন অনেকটাই ক্লান্ত। ক্ষেতের আলে জড়সড়ো হয়ে বসে থাকেন। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। পশ্চিম আকাশে সূর্যের লাল গোলা আর পাশেই পুড়ছে গ্রাম। একটুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ভাবছিলেন নিজের স্বামীর কথা সন্তানের কথা। তারা কোথায় আছে কেমন আছে। তারা কি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে? এসব ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ করে জ্যোৎস্না বেগম বুঝতে পারেন তাঁর চারপাশে মিলিটারি ঘিরে ফেলেছে। এখন আর কোথাও পালানোর সুযোগ নেই। চারজন সেনা তাঁকে এসে বন্দুকের নলের মুখে জিম্মি করে ফেলে। জ্যোৎস্না খাতুনের পেটে তখন এক সন্তান। তিনি নিজে দেহাতি মানুষ। কিছুক্ষণ পাষন্ডদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তা কোনো কাজেই আসেনি। তার ওপরে চলে অমানুষিক নির্যাতন। গণধর্ষণ। এক পর্যায়ে তিনি নিজেকে বাঁচাতে মৃত্যুকে হাতে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেন।
জ্যোৎস্না খাতুন প্রায় একঘন্টা স্রোতের টানে ভেসে যান। কোনদিকে যাচ্ছেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একসময় নদীর পাশে একটি চরায় আটকে যান তিনি। তাঁর পরেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। যখন সম্বিত ফিরে পান তখন জ্যোৎস্না খাতুন নিজেকে নদীর পাশে এক পাটক্ষেতে আবিষ্কার করেন। চারদিকে বেশ অন্ধকার হয়ে পড়েছে তখন। ক্ষেতের মাঝখান থেকে একবার ওঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি আর দাঁড়াতে পারছিলেন না। তাঁর সমস্ত শরীর যেন ভেঙ্গে পড়ছিল। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তাঁর। দূরে কোথাও বাড়ি-ঘর দেখা যায় বটে। কিন্তু সেখানে যাবার মতো শারীরিক সুস্থতা তখন আর তাঁর নেই। আর তাছাড়া জ্যোৎস্না খাতুন সেখানে যাবেনই বা কীভাবে? তাঁকে তো কোনো বস্ত্র ছাড়াই পানিতে ঝাঁপ দিতে হয়েছিল।
এই অবস্থায় তিনি কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। যা হবার তা হয়ে গেছে। তাঁর এখন ঘরে ফেরা প্রয়োজন। কিন্তু ঘর বলতে যে স্কুলে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানে আর ফিরতে পারবেন না। তা আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে হানাদার বাহিনী। সেটা এখান থেকে কতদূর? স্বামী-সন্তান কোথায় আছে তাও জানা নেই। এই অবস্থায় শরীর আবার অবসন্ন হয়ে পড়ে। তিনি ঘুমের অতলে তলিয়ে যান।
পরদিন সকালে সূর্যের আলোতে ধানক্ষেতে ঘুম ভাঙ্গে জ্যোৎস্না খাতুনের। পেটে তখন প্রচন্ড ক্ষুধা। আশেপাশে কোনো খাবার নেই। এখান থেকে বের হবারও কোনো উপায় নেই। বেলা বাড়তে থাকে, ক্ষুধাও বাড়তে থাকে। প্রথমে জ্যোৎস্না খাতুন পানি খেয়ে ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করেন। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ থাকা যায়? ধানক্ষেতের পোকা শরীর কামড়ে দিচ্ছে। চারদিকে জোঁকের ভয়। সে বছর বেশ ভালো পানি হয়েছিল নদীতে। এক পর্যায়ে খাবার মতো আর কোনো কিছু না পেয়ে জ্যোৎস্না খাতুন ক্ষেতের মাটি খাওয়া শুরু করেন। এইভাবে পুরো দু’দিন তিনি ক্ষেতের মধ্যেই লুকিয়ে ছিলেন। দু’দিনের দিন বিকেল বেলা একজন কৃষক তাঁকে ক্ষেতের মধ্যে অর্ধমৃত অবস্থায় দেখতে পান। তিনি মহিলাদের ডেকে এনে জ্যোৎস্না খাতুনকে বাড়ি নিয়ে যান।
তৃতীয় দিন বাড়ির লোকজন জ্যোৎস্না খাতুনের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে তাঁর স্বামী আলাউদ্দিন শেখকে খবর দেয়। গরুর গাড়ির ভালো চালক হিসেবে আলাউদ্দিনের এলাকায় সুনাম ছিল। ফলে তাঁকে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়নি। তাছাড়া আলাউদ্দিন নিজেও জ্যোৎস্না খাতুনের খোঁজ করছিলেন। ফলে আবারো জ্যোৎস্না খাতুন মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে তাঁর পরিবারের সঙ্গে মিলিত হন। সেই বেঁচে আসা জ্যোৎস্না খাতুনের জীবনে কোনো গৌরব বহন করে আনেনি। স্বামী-পরিবার ও সমাজের সন্দেহ, অবিশ্বাস, অবহেলা জ্যোৎস্না খাতুন সারা জীবনই বহন করে গেছেন। জীবন সায়াহ্নে এসে জ্যোৎস্না খাতুন সমাজে ‘বীরাঙ্গনা’ পরিচয়ের চেয়ে, অনেক বেশি পরিচিত ছিলেন ‘চুরিওয়ালি’ বা ‘ভিক্ষুক’ হিসেবে। এই কষ্ট কাউকে বলতে পারেননি বীরাঙ্গনা জ্যোৎস্না খাতুন।
জ্যোৎস্না খাতুনের জন্ম সিরাজগঞ্জ জেলার গয়লা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম সোনা উল্ল্যাহ শেখ এবং মায়ের নাম সাকি বেগম। এই দম্পতির এগার সন্তান। এর মধ্যে পাঁচ ছেলে ও ছয় মেয়ে। জ্যোৎস্না খাতুন ভাইবোনদের মধ্যে পঞ্চম। শৈশবে জ্যোৎস্না খাতুনদের পারিবারিক অবস্থা ভালো ছিল। তাঁর বাবা ছিলেন অবস্থাসম্পন্ন কৃষক। ‘এক বাপের এক সন্তান’। কিন্তু তিনি কোনো কাজ করতেন না। এক সময় জমি বিক্রি করতে করতে তিনি নিঃস্ব হয়ে যান। ফলে পারিবারিক অনটনের শুরু হয়। তবে এই সময় ভাইয়েরা পরিবারের হাল ধরে কোনোমতে সংসার চালিয়ে নেন। জ্যোৎস্না খাতুন ছেলেবেলায় স্থানীয় পিটিআই স্কুলে অ আ ক খ পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন। সেসবের কিছুই আর তাঁর মনে ছিল না। অভাবের সংসারে মাত্র সাত বছর বয়সে জ্যোৎস্নার বিয়ে হয়ে যায়। তাঁর ‘দুধের দাঁত পড়েছে স্বামীর ঘরে’। পাত্রের বয়স তখন প্রায় বিশ। তাঁর নাম আলাউদ্দিন শেখ। তিনি ছিলেন কিছুটা প্রতিবন্ধী। পা দুটো ঠিকমতো কাজ করত না। কিন্তু গরুর গাড়ি চালাতে আলাউদ্দিনের কোনোদিন কোনো অসুবিধা হয়নি। বরং গরুর গাড়ির ভালো চালক হিসেবে তাঁর বেশ সুনামই ছিল। বার বছর বয়সে জ্যোৎস্না প্রথম সন্তানের মা হন। কিন্তু সেই সন্তান বাঁচেনি। কিছুদিন পর জ্যোৎস্নার যমজ সন্তান হয়। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। মেয়েটি তিন মাসের মাথায় মারা যায়। ছেলে আনোয়ার শেখ বেঁচেছিল। কিছুদিন আগে সেও মারা গেছে। তাঁর পরিবার অন্য জায়গায় থাকে। এখন একমাত্র ছোট ছেলে “সানোয়ার শেখ বাঁইচ্যা আছে। সে পাগল, মেন্টাল। ঘরে বড় ছাওয়ালের একটা বিয়ার যোগ্যি মাইয়্যা আছে। তাকে মানুষ করতাছি। কষ্ট কইরা চাইয়া-চিন্তা খাই। এই কেবল আসলাম ‘বেড়াইয়া’। যা সত্য তাই বলতাছি, বুঝছেন। আমার ঘরবাড়ি কিছুই নাই। পরের বাড়িতে কোনোরকম থাকতাছি।” জ্যোৎস্না খাতুন যখন এই কথাগুলো বলছিলেন তখন তাঁর চোখের পাতাগুলো ভিজে ওঠে। ‘বেড়াইয়া’ আসা বলতে জ্যোৎস্না খাতুন ভিক্ষা করে আসা বুঝিয়েছেন। তবে তিনি যখন সুস্থ থাকেন তখন সাধারণত গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে চুরি-মালা এসব বিক্রি করেন। তবে তার উপার্জন খুবই সামান্য। কিন্তু বীরাঙ্গনা বা দুঃস্থ অসহায় মানুষ হিসেবে কোনোদিন তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ বা অন্য কারো কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ই জ্যোৎস্না খাতুন তাঁর এক বোন ও ভগ্নিপতিকে হারান। তারা সিরাজগঞ্জ শহরে থাকতেন। একদিন সেখানে হানা দিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাদের ধরে নিয়ে যায়। পরে তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আরো একবার বিপদে পড়েন জ্যোৎস্না খাতুন ও তাঁর পরিবার।
একবার আলাউদ্দিন শেখ গরুর গাড়ি নিয়ে সিরাজগঞ্জ শহরের দিকে যাচ্ছিলেন। পথের মধ্যে তাঁকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আটক করে। তারা তাঁর গাঁয়ের বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে ও সেখানে নিয়ে যেতে বলে। কিন্তু আলাউদ্দিন সোজা বলে দেয় তাঁর কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। তখন তারা তাঁর পরিবারের খোঁজ করেন। সেনারা বারবার জিজ্ঞাসা করে তাঁর স্ত্রী কোথায়, সন্তান কোথায়। আলাউদ্দিন এবারো জবাব দেন যে, তাঁর কোনো পরিবার নেই। তিনি বলেন, ল্যাংড়া (চলন প্রতিবন্ধী) মানুষকে কে বিয়ে করবে? এভাবে অনেকক্ষণ তাঁকে আটকে রেখে তাঁর গাড়ির মালপত্র তন্নতন্ন করে খোঁজে দেখে পাক সেনারা। এক পর্যায়ে তাঁর কথায় বিশ্বাস করে তারা। তখন আলাউদ্দিন সত্যি সত্যিই গরুর গাড়ির চালক নাকি মুক্তিযোদ্ধা তার পরীক্ষা নেয় হানাদাররা। কারণ তখন দেশ জুড়ে মুক্তিযোদ্ধারা নানা ছদ্মবেশে ঘুরে ঘুরে অপারেশনের প্রস্তুতি নিতেন। হানাদাররা প্রথমে তাঁকে যেভাবে গাড়োয়ান গরু চালিয়ে যায় সেভাবে মুখে ডাক দিতে বলে। আলাউদ্দিন পেশাদার গরু গাড়ির চালক। সে যথেষ্ট সুন্দরভাবে হানাদারদের গরু গাড়ি চালানোর ডাক শুনিয়ে দেন। এতে হানাদাররা বেশ মজাও পায়। তারা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করে। পরে আলাউদ্দিনকে তাঁরা সামনের মাঠে গরুর গাড়ি চালাতে বলে। আলাউদ্দিন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে গরুর গাড়ি চালিয়ে দেখান। এক পর্যায়ে হানাদাররা আলাউদ্দিনকে ছেড়ে দেয়। সেদিন অবশ্য বিভিন্ন স্থান থেকে আরো অনেককে ধরে নিয়ে এসেছিল হানাদারা কিন্তু তাদের সবাইকে ছাড়া হয়নি। তাদের অনেককে সেদিন হানাদার বাহিনীর হাতে জীবন দিতে হয়।
মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা প্রায় দু’লাখ। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের পর এদের অনেকেই আর পরিবারে ফিরে যেতে পারেননি। সমাজও তাদের ভালভাবে গ্রহণ করেনি। ফলে সমাজে এরা প্রান্তিক পর্যায়ে চলে যায়। যদিও জ্যোৎস্না খাতুন পরিবারের দিক থেকে এ নিয়ে কোনো সমস্যায় পড়েননি। তবে সমাজ তাঁকে সবসময়ই বাঁকা চোখে দেখেছে। কিন্তু সার্বিকভাবে দরিদ্র পরিবারের নারীরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ফলে এদের দাঁড়াবার আর কোনো জায়গা রইল না। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের জন্য নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র চালু করেন। কেন্দ্রীয়ভাবে তখন এসব নারীদের সহায়তা দেবার জন্য দেশি-বিদেশী অনেক মানবতাবাদী সংগঠনও এগিয়ে আসে। সিরাজগঞ্জেও এর শাখা খোলা হয়। বীরাঙ্গনাদের স্বাবলম্বী করার কাজ শুরু হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যখন সিরাজগঞ্জে প্রথম জনসভা করতে আসেন সেইদিনের সেই জনসভার কথা স্মরণে ছিল জ্যোৎস্না খাতুনের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত।
অন্য অনেকের মতো জ্যোৎস্না খাতুন তখন নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসেন। সেখানে তাঁত, বাঁশসহ অন্যান্য কুটির শিল্পের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে স্বাবলম্বী করে তুলার চেষ্টা করেন। পুনর্বাসন কেন্দ্রে কাজ করে নিজের খাওয়া-পরা ছাড়াও তখন পরিবারকেও কিছুটা সহযোগিতা করতে পারতেন জ্যোৎস্না বেগম। সেখানে তিনি এক নাগাড়ে প্রায় তিন বছর কাজ করেন।
কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারেই পাল্টে যায়। সেই সাথে পাল্টে যায় বীরাঙ্গনাদের জীবনও। নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। বীরাঙ্গনাদের জীবনে নেমে আসে আরেক অভিশাপ। সেই দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত মুক্ত হতে পারেননি জ্যোৎস্না খাতুনরা।
জ্যোৎস্না খাতুন ২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী নিজ বাড়ীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এই লেখাটি তৈরি হয়েছে বীরাঙ্গনা জ্যোৎস্না খাতুনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে। ২০১০ সালের ১৭ জুন সিরাজগঞ্জ জেলা শহরের পাশে ধানগড়া নামক স্থানে তিনি এই সাক্ষাৎকার প্রদান করেন।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার : সাফিনা লোহানী।
লেখক : চন্দন সাহা রায়