জয়গন জন্মেছিলেন সিরাজগঞ্জ জেলার হরিপুর উপজেলার তেতুলিয়া গ্রামের পশ্চিম পাড়ায়। তাঁর মায়ের নাম ছিল জুলেখা। বাবা আজম শেখ খরি বিক্রি করতেন। জয়গনরা ছিলেন তিন বোন দুই ভাই। বড় বোনটার বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট বোনটা অনেক ছোট।
মুক্তিযুদ্ধের সময় জয়গনের বয়স ছিল ১৭/১৮ বছর। নাম লিখতে জানলেও পড়ালেখা তেমন একটা শেখা হয়ে ওঠেনি তার। অর্থের অভাবে বাবা বিয়েও দিতে পারছিলেন না মেয়েকে । এদিকে বড় ভাইও সংসারে কোন সহযোগিতা করতে পারতেন না, কাজকর্ম ছিল না, ঘুরে ঘুরে বেড়াত। বৃদ্ধ বাবা খরি বেচে যা আয় করত তা দিয়ে কোনমতে সংসার চলত। ১৯৭১ সালের জুন মাসের দিকে। দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। সময়টা আউশ ধান নিড়ানোর। জয়গনের ছোট ভাই বাড়ি থেকে একটু দূরে ক্ষেতে আউস ধান নিড়াতে গিয়েছে। সে দূর থেকে দেখল তার বোন জয়গন তার জন্য রোজকার মত ভাত নিয়ে আসছে, আর ওদিকে পাঁচ জন মিলিটিরি রেললাইন থেকে নেমে জয়গনকে লক্ষ্য করে ছুটে আসছে। ছোট ভাই দূর থেকে এ দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে সেখানেই ধানক্ষেতের মধ্যে বসে পড়ল। জয়গন তখনো খেয়াল করেনি এক দল মিলিটারি তার পিছু নিয়েছে। ভাত নিয়ে ভাইয়ের কাছে পৌছনোর আগেই একটা বেতের ঝোপের কাছে তারা জয়গনকে ধরে ফেলল, তারপর জয়গনের হাতের ভাতের বাটি ছুড়ে ফেলে পাঁচজন মিলে নির্মমভাবে অত্যাচার করল জয়গনকে। হিংস্র মানুষরুপী নরপিশাচদের আক্রমণে যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত জয়গন চিৎকার করতে চাইলে মিলিটারিরা তাঁর মুখ চেপে ধরল। রক্তে ভিজে গেল জয়গনের পরনের কাপড়। পাশবিক অত্যাচারের এক পর্যায়ে জ্ঞান হারালেন তিনি। এদিকে দূর থেকে এ দৃশ্য সহ্য করতে না পারে সেখানেই জ্ঞান হারাল জয়গনের ছোট ভাইটি। এদিকে পাশের ক্ষেতের কিছু শ্রমিক মিলিটারীদের এদিকে আসতে দেখেছিল, মিলিটারীরা চলে যাওয়ার পর তারা প্রথমে জয়গনের ভাইকে টেনে তুলল করে তারপর তাকে সাথে নিয়ে জয়গনকে তুলে বাড়ি নিয়ে গেল। সেখানে সেবা শুশ্রুষা করে তারা তাঁকে সুস্থ করে তুললেন। কিন্তু বোন সুস্থ হওয়ার অল্প কিছুদিন পরে পর জয়গনের আদরের ছোট ভাইটি, যার জন্য জয়গন ভাত নিয়ে গিয়েছিলেন, যার চোখের সামনে বোনের উপর এই নৃশংস নির্যাতন ঘটেছিল, সে আর বাঁচল না। হার্ট অ্যাটাকে মারা গেল।
এই ঘটনার পর থেকে জয়গন বাড়িতেই থাকতেন। যুবতী হওয়ার কারণে তাঁকে নির্যাতনের শিকার অন্যান্য মহিলারা প্রথমে পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিতে চায়নি পরে তিনি তাদের অনুরোধ করে বললেন যে এখন এমনিতে তিনি অন্যের বাড়িতে কাজ করে খাচ্ছেন, অন্যান্য নির্যাতিত মহিলার সাথে তিনি পুনর্বাসন কেন্দ্রে কাজ করতে চায়। এ কথা শুনে পুনর্বাসন কেন্দ্রের অন্যান্য নির্যাতিত মহিলারা জয়গনকে সাথে করে নিয়ে যায়। সেখানে তিনি চুড়ির কাজ করতেন, মাস্টাররা চুড়ি বানিয়ে দিতেন তারা সেই চুড়ি রঙের কৌটার মধ্যে ডুবিয়ে চুড়ি রং করতেন আর চুড়িতে পাঁচটা লাল ফোটা পাঁচটা সাদা ফোটা এভাবে ফোটা লাগাতেন। বীরাঙ্গনা জয়গনের মত পুনর্বাসন কেন্দ্রে আরো ২ থেকে ৩ শত মহিলা কাজ করতেন। উনারা সকাল ৮ টায় পুনর্বাসন কেন্দ্রে যেতেন এবং বিকেল ৫ টা পর্যন্ত সেখানে কাজ করে বাড়ি ফিরে আসতেন।এভাবে কিছু দিন কাজ করার পর ইসমাইল নামে একজনে সাথে জয়গনের বিয়ে হয়। গ্রামের মানুষ ২,৫০০ টাকা চাঁদা তুলে এই বিয়ের ব্যবস্থা করেন। ইসমাইল জয়গনের উপর নির্যাতনের ব্যপারে সবকিছুই জানতেন। তিনি জেনে বুঝে নিজ ইচ্ছাতেই বীরাঙ্গনা জয়গনকে বিয়ে করেন। বিয়ের সময় তিনি জয়গনকে বলেছিলেন জয়গনের জীবনের এ মর্মান্তিক ঘটনার জন্য জয়গন যেন নিজেকে কোনভাবে দোষী মনে না করে। তিনি এও বলেন ইসমাইল না করলেও কেউ না কেউতো একদিন তাঁকে বিয়ে করবেই। এটা বলে ইসমাইল তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। জয়গনের বাবার মত তাঁর স্বামী ইসমাইলও খরি বিক্রি করত তাতে সংসার ভালই চলছিল। তাছাড়া শেখ মুজিবুর রহমান পুনর্বাসন কেন্দ্র চালু করায় সেখানে কাজ করে খেয়ে পরে বীরাঙ্গনারা চলতে পারত। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানে মৃত্যুর পর কেন্দ্রের মেয়েরা সব ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ও পরবর্তীতে কেন্দ্রও বন্ধ হয়ে যায়।এর পরে একদিন তিন ছেলে ও এক মেয়ে রেখে জয়গনের স্বামীও প্যারালাইসিস হয়ে মারা যায়।
স্বামী মারা যাওয়ার পরে বীরাঙ্গনা জয়গন বিচ্ছিন্নভাবে কিছু সাহায্য পেয়েছিলেন-অর্থ, কম্বল, চাদর ও চাল। কিন্তু এভাবে কি আর সংসার চলে। তাই বীরাঙ্গনা জয়গনকে কাজে নামতে হয়েছে। কিন্তু স্বাধীন দেশেও একজন বীরাঙ্গনার জন্য কাজ পাওয়া কি কোন দিক দিয়ে কম কঠিন, পাক পশুর চেয়েও এ দেশের মানুষ কোন অংশে কম নিষ্ঠুর নয়। সেখানেও পদে পদে বিপত্তি, গ্রামের মানুষ জয়গনকে চিনে, তাঁকে নানা কথা বলে, কাজে নিতে চায় না। তাই নিজ গ্রাম থেকে দূরে অন্য গ্রাম জামতৈলে গিয়ে পরের ধানের চাতালে জয়গনকে কাজ করতে হয়। এভাবে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে সংগ্রাম করে যে তিন ছেলে মেয়েকে বড় করেছেন তারা কি তাদের এই বীর মার দিকে দেখেছে? এক মেয়ে বিয়ে করে সংসার করছে। আর তিন ছেলে বউদের নিয়ে পৃথক হয়েছ। তাদের কারো ঘরে আজ মায়ের জায়গা নেই, কারো অন্নে মায়ের ভাগ নেই। তাই এই ৫৭ কি ৫৮ বছর বয়সে জয়গনকে নিজে কাজ করে খেতে হয়, বয়স হয়েছে তাই শরীর চলতে চায় না তবুও বাঁচতে হবে তো। তাই সারাদিন কাজ করে আবার রাতেও কাজ করতে হয়। ১৫০ থেকে ২০০ মন ধান সিদ্ধ করতে হয়, শুকাতে হয়। কাজ করতে করতে জয়গনের শরীরও অনেক দূর্বল হয়ে গেছে। চোখেও আজকাল ঠিকমত দেখেন না। থাকার কোন ভাল জায়গা নেই। একটা কাগজের খুপরিতে কোন মতে থাকেন, বৃষ্টির দিনে থাকা যায়না।
তিনি দুঃখ করে বলেন, ” ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব আমাদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা কইরা দিছে। আমরা এখন কারো সাথে মিশতে পারিনা। আমরা সমাজের মানুষের কাছে সম্মান পাইনা। এখন আমাদের মা (প্রধানমন্ত্রী) যদি আমাদের সম্মান করে তাহলে এইটুকুই আমাদের পাওয়া, এটুকুই আমাদের সম্মান।”বীরাঙ্গনা জয়গনের দুঃখ করে বলেন যে বর্তমানে তরুণ সমাজের কেউ কেউ তাকে ভাল চোখে দেখে থাকলেও অনেকেই তাকে খারাপ চোখে দেখে। যারা ভাল চোখে দেখে তারা বলে, “ওরা তো ইচ্ছা করে যায় নাই।” আবার কেউ বলে, “ওতো আমাদের দাগের (সমাজের) বাইরে।”বীরাঙ্গনা জয়গন, এ দেশের বীর নারী। আমরা একটি স্বাধীন দেশ চেয়েছিলাম বলে সেই স্বাধীন দেশের জন্মযন্ত্রণার সমস্ত কষ্টটুকু নিজের শরীরে ধারণ করেছেন তিনি এবং তাঁর মত অন্যান্য বীরাঙ্গনারা। সরকারে কাছে খুব সামান্যই চাওয়া তাঁর। কেবল একটু সম্মান, একটু আশ্রয়, একটা ঘর যাতে তিনি জীবনের শেষ সময়টুকু থাকতে পারেন আর একটু থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা, এইতো। আর আমাদের সমাজের কাছে যা তার দাবী এ জাতির লজ্জা যে আজো উনাকে তা অনুরোধের সুরে বলতে হয়। উনি অনুরোধ করেন আমরা যেন জয়গনকে বীরাঙ্গনা বলে দূরে ঠেলে না দেই, তাঁর সাথে একটু ভাল ব্যবহার করি। একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে আর কবে আমাদের লজ্জা হবে? আর কবে আমরা বীরাঙ্গনাদের দিতে পারব তাঁদের প্রাপ্য সম্মান, বীরের মর্যাদা?লেখক : সুমনা মঞ্জুর