একটা যুদ্ধ, যার সম্পর্কে দুলুর কোন ধারণা নেই, বা বাস্তবিক অর্থে তাঁর কোন ভূমিকাও নেই। অথচ সেই যুদ্ধই তাঁর স্বাভাবিক জীবনকে পাল্টে দিল। যুদ্ধ পরবর্তী সময়টা তাঁর কাছে একটা ঘোরের মতো। যুদ্ধের সময়কার এক অনাকাঙ্খিত ঘটনার রেশ ধরে পরিবার-সমাজ দুলুকে আর মূল স্রোতে ফিরিয়ে নিতে চাইল না। পরিচিত পৃথিবীটা এক নিমিষেই অপরিচিত হয়ে উঠল তাঁর কাছে। ঠাঁই মিলল একটি রেল স্টেশনে সমাজের আরো অনেক ছিন্নমূল মানুষের সাথে। কিন্তু এতো কিছুর পরেও জীবনের কাছে হার মানেননি দুলু বেগম। যে সমাজ তাঁকে স্বীকার করেনি সেই সামাজিক দায়িত্বই তিনি পালন করেছেন। একটি অনাথ শিশুকে নিজের বুকে ঠাঁই দিয়েছেন, মাতৃত্বের স্নেহ দিয়ে তাঁকে মানুষ হিসাবে গড়ে তুলেছেন। এটা কি এই প্রচলিত সমাজের প্রতি দুলুর কোন গর্বিত-প্রতিশোধ?
আগস্টের এক সকালে গিয়ে হাজির হই দুলুর ঘরের সামনে। যিনি জীবনের সব গ্লানিকে নিজের ভেতরের মানবিক সৌন্দর্য দিয়ে অতিক্রম করে গেছেন। এবং মুক্তিযুদ্ধের একটি দার্শনিক সত্যকে নিজের অজান্তেই ধারণ করেছেন। আমরা হয়তো আজ ভুলে যেতে বসেছি যে, এই মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটা জনযুদ্ধ; কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এটা জনযুদ্ধ ছিল কারণ, যুদ্ধকালীন সময়ে তা সব ধরনের সামাজিক-ধর্মীয় স্তর বিন্যাসের উর্ধ্বে উঠতে পেরেছিল। সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে মিলিত হয়েছিল একটি মানবিক ও সম্মানজনক জীবনের আশায়। দুলুর জীবন দেখলে সেই সত্যটাই দেখা যায়। যেন তিনি এখনো সেই যুদ্ধের মধ্যে আছেন, জীবনকে আরো মানবিক আরো সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যেতে চাইছেন।
কুড়িগ্রাম স্টেশনের একটি সরকারি ভাঙ্গা কোয়ার্টারে পরিবার নিয়ে থাকেন বীরাঙ্গনা দুলু বেগম। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প থেকে ফিরে আসার পর পরিবার যেহেতু আর তাঁকে ঘরে তুলেনি তাই এখানেই তাঁর ঠাঁই হয়। সেই থেকে স্টেশনেই আছেন দুলু। কয়েক বছর প্লাটফর্মে কাটিয়েছেন। তখন পেটের দায়ে পুরুষদের সঙ্গে কুলির কাজও করেছেন। একদিন একটা কোয়ার্টারে গিয়ে ওঠেন।
দুলুকে স্টেশন এলাকার প্রায় সবাই চেনে। তাই তাঁকে খুঁজে বের করতে কোন সমস্যা হয়নি। একদিন সকাল বেলায় স্টেশন লাগোয়া দুলুর ঘরের সামনে গিয়ে হাজির হই। দুলু তখন তাঁর মেয়ে জবার সেবা-শুশ্রুষা করছিলেন। জানালেন, মেয়েটি হঠাৎ করেই স্বামীর বাড়িতে অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় তাঁকে তিনি এখানে নিয়ে এসেছেন। কয়েকদিন থাকবে।
দুলুর এক ছেলে আছে। নাম অশরাফ আলী। ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রির কাজ করেন শহরে। সংসার মোটামুটি চলে যায়। তবু দুলু সেই ছোটবেলা থেকেই একা একা বাঁচতে শিখেছেন বলে এখনো কাজ না করে থাকতে পারেন না। তাই বিভিন্ন সরকারী কর্মকর্তাদের অফিস ও মেসে রান্না করে দেন। এতে নিজের আয়ও যেমন হয়, ছেলেকেও সহায়তা করতে পারেন। দুলু আমাকে তাঁর ঘরে নিয়ে বসিয়ে আলাপ শুরু করেন। সে সময় ছেলে ঘরে ছিল না। তবে জবা ছিল।
দুলু জবাকে দেখিয়ে বলেন, ‘জবা কিন্তু বাহে আমার পালিত মেয়ে। তারে আমি পালক রাখছি। তাঁর পরিচয় সে নিজেও জানে না। একদিন সকাল বেলা কিছু লোক ছোট একটি মেয়েকে নিয়ে আমার বাসায় আসে। বলে, তারা এই মেয়েটাকে রেললাইনের পাশে কুড়িয়ে পেয়েছে। আমি যেন মেয়েটারে আশ্রয় দেই। যদি তাঁর বাবা-মা আসে তবে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে। কেউ আর কোনদিন এ মেয়েকে নিতে আসেনি। তখন আমিই তারে লালন-পালনের দায়িত্ব নেই। নিজের ছেলেরে টাকা-পায়সার অভাবে লেখাপড়া করাইতে পারি নাই। কিন্তু জবারে আমি লেখাপড়া শিখাইছি। বছর দুয়েক আগে জবারে বিয়া দিছি শহরের পলাশতলীর পশ্চিমপাড়ায়। তাঁর স্বামীও ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি।’
কুড়িগ্রামের বীরাঙ্গনাদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই দুলুর সখ্যতা আছে। তারা বিপদে পড়লে দুলুর এখানে এসে আশ্রয় নেন। দুলু নিজের অভাবের মধ্যেও তাদের অভাবের কথা শুনেন।
দুলুর জন্ম হয়েছিল শহর থেকে খানিকটা দূরে বেলগাছা এলাকায়। বাবা বাটাল মিস্ত্রি আর মা ছাবিরন। এ দম্পতির কোন ছেলে ছিল না। বাবা বাটাল মিস্ত্রি রেল স্টেশনেই খালাসির কাজ করতেন। পরিবার থাকত বেলগাছায়। বাটাল মিস্ত্রি শহরে থেকেই কাজ করতেন। গ্রামে থাকার কারণে অন্য বোনদের মতো দুলুরও কোনদিন স্কুলে যাওয়া হয়ে উঠেনি।
মুক্তিযুদ্ধের দুই বছর আগে দুলুর বিয়ে হয়ে যায় ফুলবাড়ী সীমান্ত এলাকার প্রান্তিক কৃষক রহমত উল্লাহর সঙ্গে। তখন তাঁর ৯ বছর বয়স। রহমতের ছিল যৌথ পরিবার। কিছু জমি-জিরাতও ছিল সেই পরিবারের। কিন্তু একসময় তাঁর বেশিরভাগই নদীগর্ভে চলে যায়। বিয়ের পর পরই রহমত পরিবার নিয়ে আলাদা হয়ে যান। আলাদা হয়ে গেলেও শ্বশুর-শাশুড়ি দুলুকে বেশ ভালবাসতেন। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় তাঁর ঠিক সাত মাস আগে আশরাফ আলীর জন্ম হয়।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেয়ার পর পরই কুড়িগ্রামের ছাত্র-যুবকরা সেখানে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। শহরের বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ ও প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে যায়। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানী বাহিনী বেশ কয়েকবার শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে তা ব্যর্থ হয়। মধ্য এপ্রিলের পর তারা কুড়িগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণ নেন। তারা শহরের ত্রিমোহিনী, ছোট পুলের পাড়, বড় পুলের পাড়সহ বিভিন্ন এলাকায় ৬-৭টি ক্যাম্প স্থাপন করে। এসব ক্যাম্পে মাঝে মাঝেই নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হত। অনেককে সেসময় হত্যাও করা হয়। ভয়ে তখন শহর ছাড়তে শুরু করে মানুষ। এসব মানুষের ঢল দুলু তাঁর স্বামীর বাড়ি থেকেই দেখেছেন। কারণ, ওই এলাকাটি সীমান্ত হওয়ায় সেখান দিয়েই লোকজন ভারতে চলে যেত। শহরের রাজনৈতিক অবস্থার কথা দুলু তাঁর বাবার কাছে যখন আসত তখনি জানতে পারত।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সারাদিনই শহরে টহল দেয়। মাঝে মাঝে তারা বিভিন্ন গ্রামের ঢুকে পড়ে রাজাকারদের সহায়তায়। গ্রামে পাকিস্তানী সেনারা ঢুকলেই লোকজন বাড়িঘর ফেলে দৌড়ে আশপাশের ক্ষেতে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। অনেক সময় তারা সেসব খালি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। অবশ্য অনেক সম্পন্ন গেরস্ত বাড়ির মানুষ আগেই সরে পড়েন যে যার মতো। ধরলার পাড়ে নিয়ে পাকিস্তানী সেনারা রাজাকারদের সহায়তায় মানুষকে গুলি করে পাখির মতো হত্যা করছে এসব কথাও জানতে পারেন দুলু।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ফুলবাড়ী সীমান্ত এলাকা হওয়ায় সেটি খুব অনিরাপদ হয়ে পড়ে। পাকিস্তান আর্মিরা সেখানে নিয়মিত টহল দিত। রাজাকারের সহায়তায় আর্মিরা মানুষকে ধরে নিয়ে ক্যাম্পে নির্যাতন করা হত। এ অবস্থায় দুলুর বাবা একদিন মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁকে ফুলবাড়ী থেকে বেলগাছিতে নিয়ে আসেন। কারণ, এ গ্রামটি ছিল তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। তখনি এ গ্রামে পাকিস্তান আর্মিরা প্রবেশ করতে পারেনি। স্বামী রহমত উল্লাহ মাঝে মাঝে এসে স্ত্রী ও ছেলেকে দেখে যেতেন।
একদিন দুপুর দুলু ছেলেকে নিয়ে ঘরে শুয়ে ছিলেন দুলু। বাবা যথারীতি কাজে ছিল কুড়িগ্রাম শহরের রেলস্টেশানে। মা বাড়ির উঠানে রান্না বসিয়েছেন। এমন সময় পাড়ার মানুষ চিৎকার-চেঁচামিচি শুরু করেন। দুলু প্রথমে বিষয়টি বুঝতে পারেননি। তাঁর মা বাড়ির বাইরে গিয়ে ‘মিলিটারি আইছে, মিলিটারি আইছে’ শুনতে পান। তিনি বাড়ির ভিতরে ঢুকে দুলুকে তাড়া দেন ছেলেকে নিয়ে পালানোর জন্য। দুলু ছেলেকে বিছানা থেকে তুলে বাড়ির বাইরে দৌড় দেন। ছেলেটি চিৎকার দিয়ে কাঁদতে শুরু করে। সেই কান্নার শব্দ যাতে খুব বেশি দূর না যায়, তাঁরজন্য দুলু ছেলের মুখ চেপে ধরে রাখেন। ততক্ষণে সারা গ্রামেই পাকিস্তানী সেনারা ঢুকে পড়েছে। দুলু তাঁর মায়ের সঙ্গে গ্রামের মাঝ বরাবর আসতেই পাকিস্তানী সেনাদের সামনে পড়ে যান।
‘ওরা মাকে ছেড়ে দেয়। আমাকে আর ছেলেকে বন্দুকের মুখে ছোট পুলের পাকিস্তানী সেনাদের ক্যাম্পের নিয়ে যায়। আমার সঙ্গে আরো কয়েকজন হিন্দু-নারীকেও তারা নিয়ে আসে। আমি সেখানে চার দিন ছিলাম নির্যাতনের মুখে। চার দিন পরে সেখান থেকে ছাড়া পাই। আমার বাবা রাজাকারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাকে সেখান থেকে বের করে আনে।’ সেই ক্যাম্পে রাতে অনেক নারীর কান্না শুনতে পেতেন দুলু। অনেক সময় দল বেঁধে ক্যাম্পে ধরে আনা পুরুষ সদস্যদের ক্যাম্পের বাইরে নিয়ে যাওয়া হত। ক্যাম্প থেকে বন্দিদের বাইরে নিয়ে যাওয়ার মানে হচ্ছে, তাদের ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলা।
এরপরে দুলু মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে বাবা-মায়ের সাথেই থাকেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে অনেক হিন্দু পরিবার গ্রাম ছেড়ে ভারতে চলে যায় লোকলজ্জার ভয়ে। কিন্তু দুলুর সেই লজ্জার ভয় থাকলেও তাঁর যাওয়ার কোন জায়গা ছিল না। কারণ, দুলুকে পাকিস্তানী সেনারা ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা তখন তাঁর স্বামীর বাড়ির লোকজন জেনে গেছে। স্বামী রহমত উল্লাহ এ ঘটনার পর থেকে আর কোনদিন ছেলে বা স্ত্রীকে দেখতে আসেনি।
মুক্তিযুদ্ধের কিছুদিন পরেই দুলুর বাবা-মা মারা যান। তাঁর কোন ভাই ছিল না। ছিল তিন বোন। তাদেরও বিয়ে হয়ে যায়। বেলগাছার যে বাড়িটিতে থাকতেন সেই বাড়িটিও হাতছাড়া হয়। ফলে দুলু আর কোথায় যাওয়ার জায়গা না পেয়ে ছেলেকে নিয়ে স্টেশনে এসে আশ্রয় নেন। স্টেশনে তাঁর বাবার পরিচিতরা তখন তাঁকে কিছুটা সাহায্য করে।
দুলু জানান, ‘আমার শ্বশুর-শাশুড়ি ঘটনা শুনে অনেকদিন আমাদের বাড়ি আসছে। আমাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। গ্রামের লোকজনও তাদেরকে বুঝাইছে। তারা বুঝতে পারছে। কিন্তু স্বামী তো আমাকে আর ঘরে তুলবে না বলে দিয়েছে। ফলে আমার আর স্বামীর বাড়ি যাওয়া হয় নাই।’
দুলুর স্বামী তাঁকে তালাক দেয়ার পর পরই আরেকটি বিয়ে করে তাঁর গ্রামে। তাঁর দু’মাস পরেই কলেরায় মারা যায় রহমত উল্লাহ।
এখনো স্টেশন এলাকায় লোকজন দুলুকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ঘটনা ধরেই তীব্রভাবে অপমান করে।
‘আগে আমি এসব কথায় কষ্ট পাইতাম। এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। আমি তো আর সাধে পাকিস্তানী ক্যাম্পে যাই নাই। আমার দোষ কী?’ অনেকটা ক্ষোভের সুরেই বলেন দুলু।
তথ্যসূত্র : ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে দুলু বেগমের সরাসরি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
লেখক : চন্দন সাহা রায়