একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বীরাঙ্গনা নূরজাহান বেগমকে দুইবার মরতে হয়েছে। প্রথমবার যখন পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। আর দ্বিতীয়বার পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নির্যাতিত হওয়ার কারণে তাঁর স্বামী তাঁকে ফেলে চলে যায়, তখন। কিন্তু নূরজাহান এ দুটি কারণের কোনোটির জন্যই দায়ী নয়। তিনি এ দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বলি। নূরজাহানের কাছে এই বেঁচে থাকাটা অপরাধের মতো মনে হয়। পঁয়তাল্লিশ বছর পরও নূরজাহান এখনো মানুষের সামনে এসে দাঁড়াতে চান না। যুদ্ধ তাঁর জীবনটাকেই অভিশপ্ত করে দিয়েছে। তিনি সমাজ, রাষ্ট্র কারো কাছেই আর কোনো স্বীকৃতি চান না।
এ রকম অবস্থা জেনেই আমরা একদিন বীরাঙ্গনা নূরজাহানের সঙ্গে কথা বলতে যাই। ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার ছনকান্দা গ্রামে নূরজাহানের বাড়ি। সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা সেখানেই নিজের ছেলের সঙ্গে থাকেন। ছেলেরও সংসার আছে। এখন নূরজাহান বিছানায় থাকেন বেশিরভাগ সময়। ঘর থেকেও খুব একটা বের হন না। ছনকান্দা বাজারের পাশেই নূরজাহানের বাড়ি। স্থানীয় একজনকে ‘বীরাঙ্গনা নূরজাহানের’ বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বাড়িটি দেখিয়ে দেন।
কিন্তু কোনোভাবেই নূরজাহান কথা বলবেন না। তাঁর পরিবারের লোকজন কোনোভাবেই চান না নূরজাহান কথা বলুক। এমন কি ছবি তুলতেও রাজি নয় তাঁরা। আমরা বেশ হতাশ হই। অবশেষে তাঁর ছেলে আমাদের নিয়ে বাজারের দিকে আসেন। আমরা বাজারের একটি ঘরে বসে তাঁর সঙ্গে কথা বলি।
মুক্তিযুদ্ধ তখন শুরু হয়েছে। ফুলবাড়ীয়া সদরে থানার পাশে ডাকবাংলায় পাকিস্তানিরা ক্যাম্প করেছে। তাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য বিভিন্ন গ্রামে রাজাকার বাহিনী তৈরি হয়েছে। সারাদিন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে সেনারা। ফুলবাড়িয়ার আছিম, রাঙামাটিয়া, পলাশতলী, বাকতা এসব রাস্তায় সেনাদের আনাগোলা বেশি ছিল। প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত রাজাকাররা বিস্তৃত। ছনকান্দা গ্রামেও এমন রাজাকার আছে। পাকিস্তানি সেনারা গাড়িতে করে ছনকান্দা গ্রামে আসে। নূরজাহান বেগম তখন স্বামীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দৌড়ে পাশের ঝোপঝাঁড়ে গিয়ে আশ্রয় নেন। গ্রামের সবাই তাই করে। সেযাত্রা রক্ষা পান তিনি।
নূরজাহানদের পাশেই একটি হিন্দু পাড়া। এদের নিয়েই যত ভয়। গ্রামের অনেক বাড়ি ফাঁকা। তারা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু এই হিন্দুপাড়ার লোকজন রয়ে গিয়েছে। নূরজাহানের স্বামী হযরত আলীও বাড়িতেই থেকে যান। যুদ্ধের মধ্যেও মানুষের বাড়ি গিয়ে কাজ খুঁজতে হয় তাঁকে।
কিন্তু নূরজাহান বেগম ঠিকই যুদ্ধের খবর পান। রাতে বাড়ি ফিরে পুরুষরা বাতি নিভিয়ে যুদ্ধের গল্প করেন। তিনি শুনতে পান, নিরপরাধ মানুষকে ভালুকজান সেতুর উপর নিয়ে গুলি করে আখালিয়া নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। ডাকবাংলোয়, যেখানে পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্প করেছে, তার ভিতরে এক কূপ আছে। মানুষ হত্যা করে এই কূপে ফেলে দেয় সেনারা।
এর মধ্যেই আষাঢ় মাসের এক সকাল বেলা। নূরজাহানের স্বামী কাজে গেছেন। বাড়িতে শুধু নারীরা। এমন সময় দল বেঁধে পাকিস্তানি সেনারা হানা দেয় ছনকান্দা গ্রামে। নূরজাহানদের বাড়ির পাশে হিন্দু পাড়াতেই হানা দেয় সেনারা। সঙ্গে স্থানীয় রাজাকাররা। বাড়িতে গিয়ে পুরুষদের বেঁধে ফেলে। বন্দুকের নলের মুখে নারীদের তুলে নিয়ে যায়। রাজাকাররা বাড়িতে শুরু করে লুটতরাজ আর আগুন দেওয়া। পাকিস্তানি সেনারা স্থানীয় হাই স্কুলে এসে উঠেছে। গ্রাম থেকে নারী- পুরুষদের ধরে সেখানে আনা হচ্ছে। নূরজাহানের কোলে তখন একটি মেয়ে। তিনি তখন সন্তানসম্ভবা। মেয়েকে কোলে নিয়েই নূরজাহান বাড়ি থেকে দৌড়ে পালালেন। কিন্তু কোথায় যাবেন? গ্রাম ঘিরে ফেলেছে সেনারা। নূরজাহান প্রথমে গিয়ে একটি মসজিদে আশ্রয় নেন। কিন্তু সেখানে নিরাপদ মনে না হওয়ায় সেখান থেকেও বেরিয়ে পড়েন তিনি। দৌড়াতে দৌড়াতে নূরজাহান একসময় গিয়ে সেনাদের হাতেই ধরা পড়েন।
নূরজাহানকে হাই স্কুলের একটি কক্ষে নিয়ে বন্দি করে রাখা হয়। সেখানে শুধু নূরজাহান একা না। আরো অনেক মানুষকে ধরে এনেছে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা। কাউকে কাউকে নির্যাতনও করা হয়েছে। চোখ বাঁধা অবস্থায় অনেককে আনা হয়েছে। নূরজাহানের কোলের মেয়েটি অনবরত কেঁদে চলেছে। সেই ক্যাম্পেই নির্যাতনের শিকার হন নূরজাহান। পাকিস্তানি হানাদারদের নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে কোনোভাবে ক্যাম্প থেকে বাড়ি ফিরে আসেন নূরজাহান। সেই কলঙ্ক আজো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাঁকে।
সকালের দিকে নূরজাহানকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী আর সন্ধ্যে নাগাদ ক্যাম্প থেকে তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। সন্ধ্যার পর পরই পাকিস্তানি সেনাবহর ছনকান্দ গ্রাম ছেড়ে ফুলবাড়িয়া চলে যায়। তার আগেই বাড়ি ফিরে আসেন নূরজাহানের স্বামী। তিনি বাড়ি এসে সব কথা শোনেন। কিন্তু কিছু বলেননি। কিন্তু নূরজাহান প্রতিদিন টের পান স্বামী-সংসার থেকে তিনি কেমন যেন আলাদা হয়ে যাচ্ছেন। সংসারের কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলে না।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেসব হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে গিয়েছিল তারা ফিরে আসে। আবার কেউ কেউ বাড়ি-ঘর ফেলে ভারতে চলে যায়। একদিন স্বামী এসে নূরজাহানকে জানান, তিনি হিন্দুপাড়ার একটি পরিবারের সঙ্গে ভারতে চলে যাচ্ছেন। আর কোনোদিন ফিরবেন না। তিনি এই সংসার আর করবেন না। নূরজাহানকে স্বামীর এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয়। নূরজাহান স্বামীর ভিটেতে থাকেন বটে কিন্তু তিনি পরিবারের কেউ না।
স্বামী চলে যাওয়ার কয়েকদিন পরেই নূরজাহানের ঘরে একটি ছেলে জন্ম নেয়। এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে তিনি অথৈ সাগরে পড়েন। নিজে কীভাবে বাঁচবেন আর দুটি সন্তানকেই বা কী খাওয়াবেন! পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্যাতিত নারীকে কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে নি। এই অবস্থার মধ্যেই নূরজাহান কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। এর বাড়ি ওর বাড়ি কাজ করেন, সারাদিনে যা মিলে রাতে এসে ছেলে-মেয়ে নিয়ে তাই খান। এভাবেই দুটি ছেলে- মেয়েকে বড় করেছেন নূরজাহান। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তারও সংসার আছে। ছেলে এখন দিনমজুর।
জীবনের লড়াই বীরাঙ্গনা নূরজাহানের কাছে এতোটাই কঠিন ছিল যে, স্বামী বেঁচে আছেন কি নেই, সেই খবরও রাখার সুযোগ হয়ে উঠেনি। নূরজাহানের জগত-সংসার তখন ছেলে- মেয়েকে ঘিরেই। ভারতে চলে যাওয়ার প্রায় ৩৭ বছর পর নূরজাহানের স্বামী হয়রত আলী একদিন বাড়ি এসে হাজির হন। বাড়ির সবাই তাকে চিনতে পারে। কিন্তু নূরজাহান এতে পুলকিত হননি। নূরজাহানের ছেলে-মেয়েরা বাবার বাড়ি ফিরে আসায় খুশি হননি। বরং তাদের ক্ষোভ, এই মানুষটি তাঁদের মাকে একা বিপদে ফেলে চলে গিয়েছে।
হযরত আলী বাড়িতে কিছুদিন থেকে আবার ভারতে ফিরে যান। ভারতে তার নিজের আরেকটি সংসার আছে। স্ত্রী আর পাঁচ-ছয়জন ছেলে-মেয়ে নিয়ে তার সংসার। তার পর থেকে হয়রত আলীর সঙ্গে পরিবারের আর কোনো যোগাযোগ নেই। তাদের ধারণা, তিনি হয়তো বেঁচে আছেন।
ছনকান্দা গ্রামেই নূরজাহানের বাবার বাড়ি। দরিদ্র পরিবার। বাবা মানিক বেপারি দিনমজুর ছিলেন। নূরজাহানের বাবার বাড়ির পাশের বাড়িটিই শের মণ্ডলের। তার ছেলেই হয়রত আলী। তিনিও দিনমজুরি করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের ১২ বছর আগে নূরজাহান বেগমের সঙ্গে হয়রত আলীর বিয়ে হয়। বিয়ের পর প্রায় ১০ বছর তাঁদের কোনো সন্তান হয়নি। ১১ বছরের মাথায় তাঁদের ঘরে একটি মেয়ে সন্তান আসে। পরে ছেলেটির জন্ম হয়।
বীরাঙ্গনা নূরজাহানকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় স্থানীয় সাংবাদিকরা বেশ কিছু লেখালেখিও করেছেন। কিন্তু এসব নিয়ে তাঁর পরিবার মোটেই খুশী নয়। বরং তাঁরা এসব বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনা না হোক এটাই চান।
তথ্যসূত্র : ১. ২০১৫ সালের জুন মাসে একদিন বিকেলে নূরজাহানের ছেলের সঙ্গে ছনকান্দা বাজারে আলাপ হয়। ২. ফুলবাড়ীয়া উপজেলার স্থানীয় সাংবাদিক আবুল কালাম নানা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন। তিনি নূরজাহানের একটি ছবিও দেন।
লেখক: চন্দন সাহা রায়