“মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত, শোষিতরা তাদের প্রতি কী করা হয়েছিল, এটা বলতে পারার মাধ্যমে তাদের ওপর যা ঘটেছিল তা থেকে মুক্তি পেতে পারে, যা তার নিজেকে নির্যাতনের শিকার থেকে একজন বেঁচে যাওয়া ভাগ্যবান বলে মনে করতে সহায়ক হয়।”
কিন্তু আমি যখন কুড়িগ্রামের বীরাঙ্গনা বশিরন বেগমের সঙ্গে কথা বলতে যাই তখন তিনি আমার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিয়ে কথা বলবেন না বলেই দৃঢ়ভাবে জানান। তবু আমি তার সামনে বসে থাকি। আমি সময় কাটানোর জন্য সঙ্গে থাকা একটি বইয়ের পাতা উল্টে প্রফেসর টেরিসা গডউইন ফেল্পস্-এর ‘গণহত্যা, লিঙ্গীয় সম্পর্ক এবং ট্রুথ কমিশন’ আবার পড়ি। ছোট্ট লেখাটা শেষ করে পরের পাতাতে গিয়েই পেয়ে যাই ড. হামিদা হোসেনের ‘যুদ্ধাপরাধের বয়ান’। বশিরন আমার আশপাশে ঘোরে কিন্তু কাছে আসেন না। তাঁর ছেলের ঘরের নাতিকে নিয়ে ছোট্ট একফালি উঠানে খেলা করেন। সকালের রোদ গড়িয়ে গিয়ে লুকায় গাছের আড়ালে। আমি বসে থাকি। পড়ি-
“নিগ্রহের শিকার নারীদের নীরবতা ও বয়ানে অস্বীকৃতির অনেক কারণই দেখানো হয়। প্রায়ই বলা হয়, মেয়েরা লজ্জার কারণে এ ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করেছে। কিন্তু নৃশংসতার শিকার মেয়েরা ১৯৭১ সালে বা তারপরও যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই কথা বলেছে। … কাজেই লজ্জা আসলে তাদের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে সমাজেরই সৃষ্টি করা। আবার এও বলা হয় যে, মেয়েরা সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পায়। কিন্তু আসলে সমাজই তাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখে।…”
এরমধ্যেই বশিরন আমার জন্য একটি বাটিতে করে একটু মুড়ি আর গুড় নিয়ে আসেন। বলেন, নেন খান। তারপর কোথায় থেকে এসেছি, কী করি, বাড়ি কই এসব নিয়ে আলোচনা করতে করতে আমি পানি খেতে চাই। বশিরন দেখতে ছোট-খাট। আমাকে হেসে পানি দেন।
তারপর উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক ভাষায় শুরু করেন কথা বলা।
বশিরনের কোথাও জায়গা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ বশিরনের জীবনে কালিমা ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের আগে তাঁর ঘর ছিল, স্বামী-সন্তান ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর হঠাৎ একদিন তিনি জানতে পারেন স্বামী আর তাঁকে ঘরে তুলবে না। বশিরন মনে করেন, যুদ্ধই তাঁকে ঘরছাড়া করেছে। স্বামীর তাড়া খেয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন বাপের বাড়িতে। সেখানেও সেই একই লাঞ্ছনা। ভাই-ভাবীরাও তাঁকে বের করে দেয়। যুদ্ধের প্রতি এই ক্ষোভ বশিরনের সারা জীবনের।
বশিরনের জন্ম হয়েছিল শহর থেকে খানিকটা দূরে বেলগাছা এলাকায়। বাবা বকিয়ত উল্লাহ মিস্ত্রি আর মা আমেনা বেগম। এ দম্পতির এক ছেলে আর এক মেয়ে। বকিয়ত উল্লাহ কুড়িগ্রাম রেলস্টেশানেই খালাসির কাজ করতেন। পরিবার থাকত বেলেগাছায়। বকিয়ত উল্লাহ শহরে থেকেই কাজ করতেন। গ্রামে থাকার কারণে বশিরনের কোনদিন স্কুলে যাওয়া হয়ে উঠেনি।
মুক্তিযুদ্ধের দুই বছর আগে বশিরনের বিয়ে হয়ে যায় রাজারহাট উপজেলার টগরাইহাট এলাকার ক্ষেতমজুর উমর আলীর সঙ্গে। তখন তাঁর ১০ বছর বয়স। উমরের নিজের কোন জমি-জিরাতও ছিল না। কিন্তু তিনি মাঝে মাঝে অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করতেন। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় তার তখন বশিরনের একমাত্র ছেলে বজলুর রহমানের বয়স আট মাস।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেয়ার পর পরই কুড়িগ্রামের ছাত্র-যুবকরা সেখানে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। শহরের বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ ও প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে যায়। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানী বাহিনী বেশ কয়েকবার শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে তা ব্যর্থ হয়।
মধ্য এপ্রিলের পর তারা কুড়িগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তারা শহরের ত্রিমোহিনী, ছোট পুলের পাড়, বড় পুলের পাড়সহ বিভিন্ন এলাকায় ৬-৭টি ক্যাম্প স্থাপন করে। এসব ক্যাম্পে মাঝে মাঝেই নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হত। অনেককে সেসময় হত্যাও করা হয়। ভয়ে তখন শহর ছাড়তে শুরু করে মানুষ। এ সময় শহর থেকে বেরিয়ে অনেক মানুষ রাজারহাটের দিকেও আশ্রয় নেয়। যেহেতু বশিরনের বাবা শহরে কাজ করতেন ফলে বশিরন যখন বাবার বাড়ি আসতেন তখন এসব কথা জানতে পারতেন।
বশিরনের স্বামী উমরও মাঝে মাঝে বাড়ি এসে ‘গন্ডগোলের’ কথা আলোচনা করত। তবে দেশে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে এটা বশিরন বুঝতে পারত স্বামীর কাজ না থাকার কারণে। সব মানুষই তখন সন্ত্রস্ত। কেউ তখন কাজ করাতে চাইত না। ফলে উমরকে অনেক সময়ই বেকার থাকতে হত।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সারাদিনই শহরে টহল দেয়। মাঝে মাঝে তারা বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে পড়ে রাজাকারদের সহায়তায়। গ্রামে পাকিস্তানী সেনারা ঢুকলেই লোকজন বাড়িঘর ফেলে দৌড়ে আশপাশের ক্ষেতে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। অনেক সময় তারা সেসব খালি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। অবশ্য অনেক সম্পন্ন গেরস্ত বাড়ির মানুষ আগেই সরে পড়েন যে যার মতো। ধরলার পাড়ে নিয়ে পাকিস্তানী সেনারা রাজাকারদের সহায়তায় মানুষকে গুলি করে পাখির মতো হত্যা করছে এসব কথাও জানতে পারেন বশিরন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে হঠাৎ করেই বশিরনের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বশিরন ছেলেকে নিয়ে রাজারহাট থেকে বাপের বাড়ি বেলেগাছায় আসেন তাঁকে দেখার জন্য। কিন্তু আসার পরেই তিনি আটকা পড়ে যান। কারণ চারদিকে মিলিটারির দৌড়ঝাপ তখন অনেক বেড়ে গেছে। শহরের প্রতিটি মোড়ে মোড়ে রাজাকাররা বন্দুক কাঁধে করে টহল দিচ্ছে। ছেলে-বুড়ো যাকেই পাচ্ছে তাকেই ধরে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এ অবস্থার মধ্যে সাধারণত নারীরা ঘর থেকে বের হত না। এমনকি রোগী নিয়েও কেউ হাসপাতালে যেতে চাইত না।
এ অবস্থায় চিকিৎসার অভাবে বশিরনের বাবার অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। উমর মাঝে মাঝে এসে বেলেগাছায় স্ত্রী ও ছেলেকে দেখে আবার চলে যেতেন। উমর স্ত্রীকে নিয়ে যেতে চাইলেও বাবাকে এ অবস্থায় রেখে যেতে রাজি হননি বশিরন। এর কয়েকদিন পরেই বশিরনের বাবা মারা যান।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে বশিরনের মা দিশেহারা হয়ে পড়েন। প্রতিবেশী যারা ছিল তারাও কেউ সহযোগিতা করার মতো না। একমাত্র ছেলে তখনো কোন কাজকর্ম করে না। ফলে পরিবারটির কি হবে এ নিয়েই সবাই যখন চিন্তিত তখনি একদিন দুপুর বেলায় বেলেগাছা গ্রামে ঢুকে পড়ে পাকিস্তানী আর্মিরা। সেদিনের কথা মনে করতে গিয়ে বশিরন বলেন-
‘আমার বাপের বাড়িটি বেশ বড়ই ছিল। উঠান পার হলেই পিছনে বাঁশের বাগান, তারপর চরের মতো। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে বাঁশ বাগানের দিকে দৌড় দেই। মা তখন ঘরেই রইল। আমি তো আর প্রথমে বুঝতে পারিনি যে আমাদের বাড়িতেই আর্মিরা ঢুকে গেছে। আমি যে দৌড় দিয়েছি সেটি একজন আর্মি দেখে ফেলে। সেও তখন বন্দুক নিয়ে আমার পিছনে দৌড় দেয়। কিন্তু আমি তো বাগানের ভিতরের রাস্তা চিনতাম, ফলে প্রথমে আমাকে দৌড়ে ধরতে পারেনি আর্মি।’
‘কিন্তু একসময় আমার শাড়ীর আঁচল বাঁশ ঝাঁড়ে আটকে যায়, আমিও পড়ে যাই। ছেলেটা ছিটকে দূরে পড়ে যায়। আর তখনি সেই আর্মিটা এসে আমার পিঠে বুটের পাড়া দিয়া ধরে। অনেকক্ষণ সে এইভাবে আমারে পিসছে।’
তারপর পাকিস্তানী সেনাটি বশিরনকে চুলের মুঠি ধরে আর ছেলেটিকে হাতে নিয়ে বাড়ির ভিতরে আসে। বশিরনের মা ঘরের বাইরে আসতে চাইলেও তাঁকে আসতে দেয়নি রাজাকাররা। তারা ছেলেটিকে বশিরনের মায়ের কাছে দিয়ে বশিরনকে নিয়ে ক্যাম্পে চলে যায়।
‘আমাকে ওরা বন্দুকের মুখে ছোট পুলের পাকিস্তানী সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেই ক্যাম্পে গিয়ে আমি আরো অনেক নারীকেই দেখতে পাই। তাদের অনেকেই ছিল অসুস্থ। বেশ কয়েকদিন আটকে রেখে নির্যাতনের পর তারা আমাকে ছেড়ে দেয়।’
সেই ক্যাম্পে রাতে অনেক নারীর কান্না শুনতে পেতেন বশিরন। অনেক সময় দল বেঁধে ক্যাম্পে ধরে আনা পুরুষ সদস্যদের ক্যাম্পের বাইরে নিয়ে যাওয়া হত। ক্যাম্প থেকে বন্দিদের বাইরে নিয়ে যাওয়ার মানে হচ্ছে, তাদের ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলা। এরপরে বশিরন মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে মায়ের সাথেই থাকেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে স্বামী উমর আলী একদিন বেলেগাছায় আসে।
‘তখন গ্রামের লোকজন তাকে জানায়, আমাকে পাকিস্তানীরা ধরে ক্যাম্পে নিয়ে গেছিল। বাড়ি ফিরে সে আমাকে অনেক গালিগালাজ করে। আমাকে আর নেবে না বলে জানায়। আমার মা তাকে তখন অনেক বুঝাইছে। কিন্তু সে আমারে তালাক দেয়ার কথা বলে বাড়ি চলে যায়। কয়েকদিন পরেই সোয়ামী আমারে তালাক দেয়। সে তার এলাকায় আরেকটি বিয়ে করে ফেলে।’
এর কিছুদিন পরেই বশিরনের মাও মারা যান। তখন বশিরন আর তাঁর ভাই বাড়িতে থাকতেন। দুজনে কাজ করেই সংসার চালাতেন। নিজের ছেলেটাকে বড় করেন। পরে ভাইকে বিয়ে করান। ভাই বিয়ে করার পর তাঁকে আর তাঁর সংসারে থাকতে দিতে চায়নি। সবসময়ই খালি ভাই আর ভাবী মিলে বশিরনকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা তুলে অপমান করত। একদিন রাগে সেই বাড়ি ছেড়ে ছেলেকে নিয়ে গ্রামেরই আরেক বাড়িতে গিয়ে উঠেন বশিরন। নিজেই মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে সংসার চালান।
ছেলে বজলুর বড় হলে তাকে বিয়ে করান। ছেলের সঙ্গেই থাকেন বশিরন। এখনো গ্রামের মানুষ তাকে নানাভাবে অপমান করে বলে জানান বশিরন। ‘তবে আগে আমি এসব কথায় কষ্ট পাইতাম। এখন গা- সওয়া হয়ে গেছে। তাই কারো সাথে আর এ নিয়ে কথা বলি না। শুনে মুখ বুজে চলে আসি।’ অনেকটা ক্ষোভ আর হতাশার সুরেই বলেন বশিরন।
তথ্যসূত্র : ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে বশিরন বেগমের সরাসরি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
লেখক : চন্দন সাহা রায়