ফাদার মারিনো রিগন মানবসেবার নিবেদিত একজন খ্রিষ্ট সন্ন্যাসী। ১৯৫৩ সালে এ দেশে তাঁর আগমন। তাঁর জন্ম ১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী ইতালির ভেনিসের অদুরে ভিল্লাভেরলা গ্রামে। কর্মসুত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে অবশেষে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন সুন্দরবনসংলগ্ন মংলার শেলাবুনিয়া গ্রামে। আর দশজন মিশনারির মতো তিনি কেবল ধর্মীয় কর্মের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি আর মানবকল্যাণমূলক বহুমাত্রিক কর্মকান্ডে। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার কাছে হয়ে উঠেছেন প্রিয় মানুষ।
রিগনের সামগ্রিক কর্মপ্রবাহের মধ্যে চিরন্তর মানবতাবাদী চরিত্রটি ফুটে উঠেছে বারবার। রবীন্দ্রনাথ ও লালনের জীবনদর্শনে উদ্দীপ্ত ফাদার রিগন। তাই অকপটে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ আমার মস্তিষ্কে আর লালন আমার অন্তরে।’ বাংলা শিল্প-সাহিত্য প্রেমে মগ্ন এই মানুষটি কেবল এ দেশের সাহিত্য পাঠ করেননি, সেগুলোর ব্যাপক অংশ ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যকে করেছেন মহিমান্বিত। তাঁর হাত দিয়ে ইতালিয়ান ভাষায় অনুদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলিসহ প্রায় ৪০টি কাব্যগ্রন্থ, লালন সাঁইয়ের ৩৫০টি গান, জসীমউদ্দীনের নকশীকাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট ছাড়াও এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের অসংখ্য কবিতা। ফাদার রিগন প্রথম ইতালীয় অনুবাদক, যিনি গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ সরাসরি বাংলা থেকে ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ করেন। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। একাধিক সংস্করণ হয়েছে গ্রন্থটির। তাঁর ইতালির অনুদিত রবীন্দ্রকাব্যের একাধিক গ্রন্থ ফ্রেঞ্জ, স্প্যানিশ ও পুর্তগিজ ভাষায় অনুদিত হয়। যা থেকে স্পষ্ট হয় তিনি কেবল রবীন্দ্রনাথকে নিজ জাতির কাছে নয়, ইউরোপের অন্য জাতিগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিতে রয়েছে তাঁর উজ্জ্বল ভূমিকা।
১৯৯০ সালে তাঁর ভাইবোন ও স্বজনদের উদ্যোগে ইতালিতে প্রতিষ্ঠিত হয় রবীন্দ্র অধ্যয়ন কেন্দ্র। রবীন্দ্রচর্চা, অধ্যয়ন, প্রচার ও প্রকাশের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাচেতনার চিরন্তর দিকগুলো তুলে ধরার মধ্য দিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও শান্তি প্রতিষ্ঠার অমর বাণী প্রকাশ করাই সংগঠনটির মূলমন্ত্র। রবীন্দ্র কেন্দ্রের তৎপরতায় রবীন্দ্রনাথের নামে ইতালিতে একটি সড়কের নামকরণ করেছে ‘রবীন্দ্র সরণি’। প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে এই সংস্থা আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালন করে রবীন্দ্র উৎসব। রবীন্দ্র কেন্দ্রের আয়োজনে ফাদার রিগন কর্তৃক পরিচালিত শেলাবুনিয়া সেলাই কেন্দ্রের উৎপাদিত নকশিকাঁথার চারটি প্রদর্শনী হয় ইতালির বিভিন্ন শহরে। বাংলার ঐতিহ্যময় এই শিল্পকর্মটি ইতালির শিল্পবোদ্ধাদের মধ্যে প্রশংসা কুড়ায় দারুণভাবে। ফাদার রিগন হলেন রবীন্দ্র অধ্যয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মূল প্রেরণা।
ফাদার রিগনের কর্মপরিধির বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে শিক্ষামূলক কার্যক্রম। তাঁর হাত দিয়েই মংলার স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেন্ট পল্স উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ সালে। ফাদার রিগনের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া হাজার হাজার সুবিধাবঞ্চিত ছেলেমেয়ের স্পন্সরশিপের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন পড়াশুনা করার সুযোগ করে দেন তিনি।
ফাদার রিগন মনে করেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মরণীয় ঘটনা। মুক্তিযোদ্ধাদের পুরোটা সময় তিনি এ দেশে কাটান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। তিনিও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখেন আর দশজন দেশপ্রেমিক বাঙালীর মতো। যুদ্ধপীড়িতদের আশ্রয় দিয়েছিলেন নিজের কাছে। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবায় এগিয়ে আসেন তিনি। উল্লেখ্য, হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দীন বীর বিক্রম (পাঁচ হাজার ৫৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি), যার মুখমন্ডল গুলিবিদ্ধ হয়ে ১১টি দাঁত এবং চোয়ালের একটা অংশ খসে যায়। ভয়ানকভাবে আহত হন তিনি। ফাদার রিগনের সঠিক তত্ত্বাবধানে সুচিকিৎসা পেয়েছিলেন তিনি। হেমায়েত উদ্দীন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ওই দুঃসময় ওপরে ছিলেন ঈশ্বর, নিচে ছিলেন ফাদার রিগন। সে সময় ওই চিকিৎসাসেবাটা না পেলে হয়তো বাঁচতাম না।’
ফাদার রিগন কেবল বাংলা সাহিত্য নয়, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক দলের নেতৃত্ব দিয়ে এ দেশের সংস্কৃতিকে ইতালির মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন বহুবার। তাঁর নেতৃত্বে যাওয়া নকশীকাঁথার মাঠ অবলম্বনে নৃত্যনাট্যের দল ইতালির সুধীজনের নজর কাড়ে। ১৯৮৬ সালে ফাদার রিগনের সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক সংগীত প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় বাংলাদেশি শিশুশিল্পী অরিন হক। রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘আমরা সবাই রাজা’ গান গেয়ে অরিন অর্জন করে প্রথম হওয়ার গৌরব, যা ছিল বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি গৌরবময় ঘটনা। ফাদার রিগন ছিলেন সে ঘটনার নেপথ্যের মানুষ।
ফাদার রিগনের এ দেশের প্রতি রয়েছে প্রবল মমতা। বাংলার মাটিতে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করার মধ্য দিয়ে তিনি প্রকাশ করেন এ দেশের প্রতি তাঁর তীব্র অনুরাগ। ২০০১ সাল। ফাদার রিগনের আকস্মিক হৃদযন্ত্রে অসুস্থতা ধরা পড়ে। তাঁর উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। ইতালির আত্মীয়স্বজন জেনে যায় তাঁর অসুস্থতার খবর। তারা উন্নত চিকিৎসার জন্য ইতালিতে যাওয়ার অনুরোধ করে তাঁকে। ফাদার রিগন ভয় পেলেন এই বুঝি মারা যাবেন! “মরলে বাংলার মাটিতেই মরব!” তিনি কিছুতেই ইতালিতে যাবেন না। স্বজনদের প্রবল অনুরোধ ও আকুতি-মিনতির পর অবশেষে রাজি হলেন এই শর্তে। ইতালিতে তাঁর যদি মৃত্যু হয়, তাহলে মরদেহটি বাংলাদেশে পাঠাতে হবে। ইতালির স্বজনেরা মেনে নেন তাঁর জুড়ে দেওয়া শর্ত। অতঃপর তিনি উন্নত চিকিৎসায় ইতালি যান। সেখানেও অস্ত্রোপচারের আগে স্বজনদের কাছে তাঁর শেষ মিনতি ছিল, ‘আমার মৃত্যু হলে লাশটি বাংলাদেশে পাঠাবে।’ এই হলো বাংলাদেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসার বাস্তবিক এক রূপকথা।
ফাদার রিগনকে এ দেশে তাঁর শিক্ষামূলক ও সৃজনশীল কর্মকান্ডে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশের সম্মানসুচক নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়েছে।
লেখক : কাব্য কামরুল