‘মুক্তিযুদ্ধের পর তো সোয়ামি আমারে আর ঘরে লয় না। বলে, তুই পাকিস্তানী ক্যাম্পে যা। আমি তোর লগে থাকুম না। বাহে কন, আমি তখন কই যাই? সোয়ামি ঘরে আসে না, বাইরে বাইরে থাকে। ততদিনে বড় পোলা মোস্তফার জন্ম হইছে। বাপের বাড়ির লোকজন আমারে দেখে, পোলারে দেখে। সোয়ামিরে তখন অনেক বুঝায় বাপের বাড়ির লোকজন আর গ্রামের মানুষ। শেষে ছয় মাস পরে সোয়ামি আমারে ঘরে লইছে। হেরপরেও কত ঝগড়া, কথায় কথায় খালি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা তুলত। সে এখন পঙ্গু, অচল; চলাফেরা করতে পারে না। আমিই তারে দেখি, খাওয়াই।’
কুড়িগ্রামের বীরাঙ্গনা মেহেরজান বেগম আগস্টের এক সকালে আক্ষেপ করেই এসব কথা বলছিলেন। এ সময় শহরের কালে মৌজার একটি ভাঙ্গা ঘরে শুয়ে ছিলেন তাঁর স্বামী আব্দুল কাদের। তিনি এসব কথা শুনছিলেন কিনা তা বোঝা যাচ্ছিল না। ঘরের বারান্দায় বসেই মেহেরজানের জীবনের গল্প শুনছিলাম। কিন্তু মেহেরজানের চোখ-মুখ বলে দিচ্ছিল, এখন তাঁর ভয় স্বামীকে না, ভয় তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের। কারণ, সন্তানরাও চায় না তাদের মা মুক্তিযুদ্ধের কথা কাউকে জানাক। মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনাদের ইতিহাস যেন মেহেরজানের শরীরের মতোই কঙ্কালসার, যে শরীরটি আসলে তাঁর মূল অবয়ব ছেড়ে অযত্ন, অবহেলা আর সামাজিক নিগ্রহে ক্রমশই প্রান্তিক হয়ে গেছে। মেহেরজানের সামনে বসে মনে হয় মুক্তিযুদ্ধ বোধহয় তার মূল অবয়ব ছেড়ে বেরিয়ে আসছে আমার চোখের সামনে, মেহেরজানের কঙ্কাল যেন অন্য-ভিন্ন এক ছায়াশরীর হয়ে হানা দেয় পৃথিবীর তামাম যুদ্ধবিধ্বস্ত মনস্তত্ত্বে। আমি ইতিহাসের সেই কঙ্কাল খুঁজতে এসেছিলাম কুড়িগ্রামে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের গল্প আর ইতিহাসবিস্মৃত অতীত যে এক কথা নয় মেহেরজানের চোখ, বয়সের ভারে ন্যুজ দেহ আর সামাজিক-পারিবারিক নিগ্রহে ক্লান্ত মুখ তা মনে করিয়ে দিচ্ছিল।
মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা আর বীরাঙ্গনার ইতিহাস একই পাতায় লেখা। কিন্তু ইতিহাসবেত্তারা যেন সেই বীরাঙ্গনার ইতিহাস এড়িয়ে গেছেন সযতনে।
মেহেরজানের জন্ম কুড়িগ্রাম শহরের কালে মৌজাতেই। বাবা ইউসুফ আহম্মদ আর মা গাছুয়ানি বেগম। এ দম্পতির কোন ছেলে সন্তান ছিল না। পাঁচ মেয়ে। এখন বেঁচে আছেন চারজন। মেহেরজান সবার ছোট।
‘সবার ছোট ছিলাম তো, সবাই আদর করত। বাপের জমি-জিরাত ছিল কিছু, সেসবই দেখাশোনা করতেন। আর কিছু করতেন না। গ্রামে আমাদের অবস্থা একেবারে খারাপ ছিল না। কিন্তু পরে পরিবারের অবস্থা খারাপ হতে থাকায় বাবা আমায় মাত্র সাত বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন। মুজিবের ভোটের আগের বছর। নয়-দশ বছর বয়সেই মা হয়ে যাই।’
মেহেরজানের স্বামী আব্দুল কাদেরের বাড়ি ছিল বিশ্বেশরের বোর্ড অফিসের পিছনে। সামান্য কিছু জমি ছিল তাঁর। কিছুদিনের মধ্যেই সেই জমি বিক্রি করে দিয়ে দিনমজুরে পরিণত হন কাদের। ইউসুফের নিজের যেহেতু কোন ছেলে সন্তান ছিল না তাই মেহেরজানের স্বামীকে ঘরজামাই করে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। এ বাড়িতে এসেই জন্ম হয় ছেলে মোস্তফার। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন তার বয়স ছিল আট মাস।
৭ মার্চ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেয়ার পর পরই কুড়িগ্রামের ছাত্র-যুবকরা সেখানে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। শহরের বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ ও প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে যায়। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানী বাহিনী বেশ কয়েকবার শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে তা ব্যর্থ হয়। মধ্য এপ্রিলের পর তারা কুড়িগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণ নেন। তারা শহরের ত্রিমোহিনী, ছোট পুলের পাড়, বড় পুলের পাড়সহ বিভিন্ন এলাকায় ৬-৭টি ক্যাম্প স্থাপন করে। এসব ক্যাম্পে মাঝে মাঝেই নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হত। অনেককে সেসময় হত্যাও করা হয়। ভয়ে তখন শহর ছাড়তে শুরু করে মানুষ। কিন্তু মেহেরজানের কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। এ অবস্থার মধ্যেই মেহেরজানের স্বামী আব্দুল কাদেরও দিনমজুরির কাজ পেতে বেগ পেতে হয়। ততদিনে মেহেরজান গর্ভবতী হয়েছেন।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সারাদিনই শহরে টহল দেয়। মাঝে মাঝে তারা বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে পড়ে রাজাকারদের সহায়তায়। গ্রামে পাকিস্তানী সেনারা ঢুকলেই লোকজন বাড়িঘর ফেলে দৌড়ে আশপাশের ক্ষেতে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। অনেক সময় তারা সেসব খালি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। অবশ্য অনেক সম্পন্ন গেরস্ত বাড়ির মানুষ আগেই সরে পড়েন যে যার মতো। ধরলার পাড়ে নিয়ে পাকিস্তানী সেনারা রাজাকারদের সহায়তায় মানুষকে গুলি করে পাখির মতো হত্যা করছে। মেহেরজান বাড়িতে বসে পরিবারের মানুষদের এসব গল্প করতে শুনেন। তার বুক কেঁপে ওঠে। সারা রাত নির্ঘুম রাত কাটান পরিবারের সব সদস্যদের নিয়ে।
একদিন ভর দুপুর বেলা কালে মৌজায় পাকিস্তানী সেনা সদস্যরা রাজাকারদের নিয়ে ঢুকে পড়ে। যখনই এরকম হতো তখন দরিদ্র পরিবারের মানুষেরা দৌড়ে আশপাশের চরে বা বিলে গিয়ে আশ্রয় নিতেন। এর আগে কখনো পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এখানে আসেনি। কিন্তু আশপাশে যখনি এসেছে আব্দুল কাদের স্ত্রী, ছেলে ও শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে নর্দা বিলের মধ্যে গিয়ে লুকিয়ে থাকতেন। আর্মিরা চলে যাবার পর তারা আবার নিজেদর বাড়িঘরে ফিরে আসতেন।
মেহেরজান সেদিনের ঘটনার কথা মনে করতে গিয়ে বলেন, ‘সেদিনও এভাবেই দুপুরে আর্মিরা আমাদের গ্রামে ঢুকে পড়ে। তখন সোয়ামী ছিল বাড়ির বাইরে। আমি ছেলেকে নিয়ে দৌড়ে পালানোর সময় নর্দা বিল-পাড়ে ধরা পড়ি। আমার সঙ্গে আরো কয়েকজন নারী-পুরুষও ধরা পড়ে। তাদেরকে আর্মিরা ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। কয়েকজনকে বিল-পাড়েই গুলি করে মেরে ফেলে রাখে। নির্যাতনে আমি অজ্ঞান হয়ে গেলে বিকালে বাপের বাড়ির লোকজন আমাকে বিল-পাড় থেকে বাড়ি নিয়ে আসে। ছেলেও আমার সঙ্গেই ছিল। বাড়ি ফিরে হুঁস ফিরলে দেখি আর্মিরা বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। আমাদের তখন আর কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। উঠানেই থাকি কয়েকদিন।’
‘আমাকে এলাকার লোকজন বাড়ি নিয়ে আসলেও সোয়ামি কিন্তু সেদিন আর বাড়ি ফিরে আসেনি। ফলে আমরা খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার বাবা তাঁকে নানা জায়গায় খুঁজতে শুরু করল। তিন দিন পরে এলাকার লোকজন তাঁকে নর্দা বিলের ভেতর থেকে বের করে। আর্মিরা আমাদের গ্রামে আসার পর তিনিও অনেকের সঙ্গেই বিলে গিয়ে লুকান। কিন্তু অনেক ভিতরে চলে যাওয়ায় তিনি আর পথ চিনে ফিরতে পারেনি। লোকজন তাঁকে খুঁজে বের করে, আমার নির্যাতনের কথা জানায়। নির্যাতনের কথা শুনেই অজ্ঞান হয়ে যায়’, বলেন মেহেরজান।
মেহেরজান আর কাদেরের দুই ছেলে আর দুই মেয়ে। বড় ছেলে মোস্তফা বিয়ে করেছে। দুই মেয়ে আমেনা আর আফরোজার বিয়ে দিয়েছেন। আরেক ছেলে মৃদুল এখনো বিয়ে করেনি। দুই ছেলেকে নিয়েই এখনো আছেন মেহেরজান। ছেলেদের সঙ্গে তাঁকেও মাঝে মাঝে কাজ করতে হয়।
একাত্তরের এ ঘটনার পর কেউ কোনদিন খোঁজ নেয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে মেহেরজান বলেন, ‘সমাজের মানুষ নানা কথা কয়। কিন্তু কন বাহে, আমরা তো একটা পরিস্থিতির শিকার। যুদ্ধই তো আমাদের সব কেড়ে নিছে। দেশ স্বাধীন হইল, মানুষ মুক্তি পাইল, কিন্তু আমরা এখনো মুক্তি পাইলাম না।’
বাড়ি থেকে যখন বেরিয়ে আসি তখন মনে হল, মেহেরজানের গ্লানি আমাকেও গ্রাস করে নিয়েছে। তবু নতজানু হই ইতিহাস-বিস্মৃত সেই অধ্যায়ের কাছে, যেন বা আরেকটি প্রজন্ম অপেক্ষা করে আছে মেহেরজানের কথাগুলো জানার জন্য। ভাবি এত বড় একটা জনযুদ্ধের ইতিহাস কেন আমাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক-ধর্মীয় বিশ্বাসের উর্ধ্বে উঠতে পারল না। সে অবশ্য আরেক গল্প, ভিন্ন কথকতা। আমরা শুধু মেহেরজানের স্কেচ এঁকে, তাঁকে অতীতের ফ্রেমে বন্দি করে না রেখে, তুলে ধরতে পারি আমাদের অজেয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অমর-অক্ষয় ‘বাতিঘর’ হিসাবে। সেখানেই বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে মেহেরজানের ‘কঙ্কালের’ আসল আলো, যা আসলে মুক্তিযুদ্ধের গোটা শরীরটাকেই আলোকিত করে রাখে অহর্নিশ।
তথ্যসূত্র : ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে মেহেরজান বেগমের সরাসরি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
লেখক : চন্দন সাহা রায়