মুক্তিযুদ্ধকে দেখার বাসনায় যখন ময়নার মুখের দিকে চাই তখন কেন জানি নিজের থেকেই কুঁকড়ে যাই, লজ্জিত হই। ইতিহাসের এ কোন অন্ধকার গলি, যেখানে পেছনে শুধুই দেয়াল আর সামনে শুধুই ময়না বেগম বা তাঁরই সহোদরা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল।
বীরাঙ্গনা ময়না বেগমকে পাকিস্তানী সেনারা তুলে নিয়ে গিয়েছিল কুড়িগ্রাম রেল স্টেশন থেকে। তখন তিনি অবিবাহিত। ক্যাম্পে যাওয়ার ঘটনা গোপন করেই মুক্তিযুদ্ধের পর তাঁকে বিয়ে দিয়েছিলেন বাবা-মা। কিন্তু দেড় বছর পরেই স্বামী যখন ঘটনা জানতে পারেন, সাথে সাথেই তালাক দেন ময়নাকে। তাঁর গর্ভে তখন তিন মাসের ছেলে। স্বামী চলে যাওয়ার পর ছেলেকে মানুষ করেন ময়না। তার নামে শহরতলীতে জায়গা কিনে বাড়ি করেন। ছেলের বিয়ে দেন। কিন্তু এখন সেই ছেলের বাড়িতেই জায়গা হয় না ময়না বেগমের।
ময়নার বাড়ি কুড়িগ্রাম শহরের পাশেই পলাশতলীর পশ্চিমপাড়ায়। এখানে তিনি চার বছর আগে এসে নতুন বাড়ি করেছেন। তার আগে দীর্ঘদিন থেকেছেন রেল স্টেশন ও তার পাশের এলাকায়। মূলত এ এলাকায় আসেন বাবার হাত ধরে সেই ছোটবেলাতেই। ময়নার বাবার নাম জনাব আলী। তাঁর বাড়ি ছিল তালের তল বিডিআর ক্যাম্পের পাশে। সেখানেই জন্ম ময়নার। বেশ জমিজমা ছিল জনাব আলীর। নিজে চাষাবাদ করতেন। ফলে স্ত্রী রাবেয়া বেগম আর দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তাঁর ভালই সংসার ছিল। কিন্তু এক সময় নদী ভাঙ্গনে তার বেশ কিছু পৈত্রিক জমি চলে যায়। বাকি যতটুকু ছিল সেটিও ভাইয়েরা মিলে দখল করে নেয়। ফলে পাঁচজনের পরিবার নিয়ে বিপদে পড়ে যান জনাব আলী।
একপর্যায়ে কোন উপায় না দেখে শহরে চলে আসেন কাজের আশায়। এসে উঠেন রেল স্টেশনের পাশে একটি বাড়িতে। সেখানেই অনেক দিন ছিলেন জনাব আলী। রেল স্টেশনেই ছোটখাট কাজ করে তিনি পরিবার চালাতেন।
ময়না জানান, ‘মুক্তিযুদ্ধের তিন-চার বছর আগে আমরা স্টেশন এলাকায় আসি। ছোটই ছিলাম। ফলে আমরা ভাইবোনেরা মাঝে মাঝেই স্টেশনে যেতাম। আমার বয়স যখন আট বছর তখন মুজিবের ভোট হয়। এতোকিছু তো আর বুঝতাম না। তার এক বছর পরেই তো যুদ্ধ লেগে যায়।’
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেয়ার পর পরই কুড়িগ্রামের ছাত্র-যুবকরা সেখানে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। শহরের বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ ও প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে যায়। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানী বাহিনী বেশ কয়েকবার শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে তা ব্যর্থ হয়।
মধ্য এপ্রিলের পর তারা কুড়িগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। রেলগাড়ী করে তারা এসে নামে কুড়িগ্রাম শহরে। তারপর বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়। তারা শহরের ত্রিমোহিনী, ছোট পুলের পাড়, বড় পুলের পাড়সহ বিভিন্ন এলাকায় ৬-৭টি ক্যাম্প স্থাপন করে। এসব ক্যাম্পে মাঝে মাঝেই নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হত। অনেককে সেসময় হত্যাও করা হয়। ভয়ে তখন শহর ছাড়তে শুরু করে মানুষ। এ সময় শহর থেকে বেরিয়ে অনেক মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সারাদিনই শহরে টহল দেয়। মাঝে মাঝে তারা বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে পড়ে রাজাকারদের সহায়তায়। গ্রামে পাকিস্তানী সেনারা ঢুকলেই লোকজন বাড়িঘর ফেলে দৌড়ে আশপাশের ক্ষেতে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। অনেক সময় তারা সেসব খালি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। অবশ্য অনেক সম্পন্ন গেরস্ত বাড়ির মানুষ আগেই সরে পড়েন যে যার মতো। ধরলার পাড়ে নিয়ে পাকিস্তানী সেনারা রাজাকারদের সহায়তায় মানুষকে গুলি করে পাখির মতো হত্যা করছে এসব কথাও জানতে পারেন ময়না। এ অবস্থায় পারতপক্ষে ঘর থেকে বের হতেন না।
সেসব দিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে ময়না বলেন, ‘বাপ যেহেতু স্টেশনে কাজ করত, তাই মাঝে মাঝেই বাপের কাছে যেতাম। সেখান থেকেই একদিন দুপুরবেলা বন্দুকের নলের মুখে আমাকে তুলে নিয়ে যায় ৩-৪ জন পাকিস্তানী সেনা। আমি চিৎকার করলেও কেউ আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি সেদিন। বাবাও তখন স্টেশনে ছিল না। আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় বড় পুলের পাড়ের ক্যাম্পে। সাত দিন পরে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়। অসুস্থ শরীর নিয়ে বাপের কাছেই ফিরে আসি। যুদ্ধের মধ্যে বাইরে কোথাও তো আর চিকিৎসা করানো যায়নি, ফলে মায়ের সেবা-শুশ্রূষাতেই ভাল হই।’ দেশ স্বাধীন হওয়ার তিন মাস পরে বাবা-মা ময়নাকে বিয়ে দেন গাইবান্ধা জেলার কাবারপাড়ার কফিল উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি রিকশা চালাতেন। বিয়ের কিছুদিন পরেই কফিল ঘরজামাই হয়ে চলে আসেন। তখন শহরে থেকেই তিনি রিকশা চালাতেন। সংসার মোটামুটি ভালই চলত। বিয়ের দেড় বছর পরে আমার প্রথম ছেলে হয়। সেই ছেলে হওয়ার তিন মাস পরেই কফিল উদ্দিন এলাকার লোকজনের কাছে ময়না পাকিস্তানী ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা জানতে পারেন। তখন ময়না গর্ভে তার আরেক সন্তান। এ অবস্থাতেই ময়নাকে তালাক দেন কফিল। ময়নাকে তাঁর বাপের বাড়ি রেখে কফিল আবার গাইবান্ধায় ফিরে যান।
‘কোলে এক ছেলে আর পেটে আরেক সন্তান নিয়ে আমি তখন একেবারে দিশেহারা হয়ে যাই। বাড়িতে বাপ-মা-ভাই সোয়ামিরে অনেক বুঝায়, কিন্তু সে মন্দ কথা বলে আমারে তালাক দেন। আমার ছেলেটার দিকে একবারও ফিরে তাকাই নাই। তখন শ্বশুর-শাশুড়ি এসেও তাদের ছেলেকে অনেক বুঝায়। আমারে নিয়া ঘর করতে কয়। গাইবান্ধায় তাদের বাড়ি নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু সোয়ামী আর রাজি হয় নাই। এর কিছুদিন পরে আমার বাবা-মাও মারা যান। ভাই তখন বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমি গিয়ে উঠি কুড়িগ্রাম রেল স্টেশনের একটি কোয়ার্টারে। সেখানেই নানা কাজ করে মা-পুতে খাইতাম।’
এসব কথা যখন ময়না বলছিলেন তখন তাঁর চোখের পাতা ভিজে আসে। ময়না চোখ মুছতে মুছতেই বলেন, ‘যে ছেলে পেটে ছিল, তার জন্ম হয়। কিন্তু কিছুদিন পরে সে মারা যায় অসুখে ভুগে। অভাবের সংসার, তারে বাঁচাইতে পারি নাই চিকিৎসার অভাবে। মা হইয়া ছেলের মৃত্যু চোখের সামনে দেখছি। কিছুই করতে পারি নাই। অনেক মানুষের কাছেও তখন গেছি ছেলেটারে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু কেউ সাহায্য করে নাই।’
ময়নার কাছে জানতে চাই এখন কেমন আছেন তিনি? উত্তরে ময়না বলেন, ‘ছেলে রিকশা চালায়। তারে বিয়া করাইছি বছর তিনেক আগে। বিয়ের পরেই পলাশতলীর পশ্চিমপাড়ায় একটু জায়গা কিনে একটা ঘর তুলি। কিন্তু এখন সেই ছেলেবউও তার এখানে থাকতে দেয় না। কথায় কথায় যুদ্ধের সময়ের কথা তুলে গালিগালাজ করে। সবসময়ই সহ্য করে থাকি। যখন একেবারে অসহ্য লাগে তখন বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। রেল স্টেশনে দুলু (বীরাঙ্গনা) আপার এইখানে গিয়া থাকি। আর তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। হয়তো রাগ কমলে ৪-৫ দিন পরে আবার বাড়ি ফিইরা যাই।’
ময়না বেগমদের এই কষ্ট কি আমরা কখনো কমাতে পারব?
তথ্যসূত্র : ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে ময়না বেগমের সরাসরি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
লেখক : চন্দন সাহা রায়